বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০

১৯৭৪ সালে ভারতের প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা


ভারত ১৯৭৪ সালের ১৮ মে  প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায়। এ পরীক্ষা ছিল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য দেশের বাইরে অন্য কোনো দেশের প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণ। ভারতীয় পদার্থ বিজ্ঞানী হোমি জাহাঙ্গীর বাবা হলেন ভারতের পারমাণবিক কর্মসূচির জনক। ভারত তার পারমাণবিক বিস্ফোরণকে ‘শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক বিস্ফোরণ’ হিসেবে দাবি করছিল। এ বিস্ফোরণ আংশিকভাবে  ব্যর্থ হওয়ার আশংকা ছিল। ভারতের প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষার বিস্ফোরণ ক্ষমতা ছিল ১২ কিলোটন। ডিভাইসটি একটি লম্বা চোঙ্গার মধ্যে স্থাপন করা হয় এবং ভূগর্ভের ১২০ মিটার নিচে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বিস্ফোরণের ক্ষমতা ছিল প্রকৃতপক্ষে ৪ থেকে ৬ কিলোটন। বিস্ফোরণে ৪৭ থেকে ৭৫ মিটার ব্যাসার্ধের ১০ মিটার গভীর একটি গর্ত সৃষ্টি হয়।
    ১৯৪৪ সালে ভারত তার নিজস্ব পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করে। এ সময় হোমি জাহাঙ্গীর বাবা টাটা ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। পদার্থ বিজ্ঞানী রাজা র‌্যামন পারমাণবিক অস্ত্র  প্রযুক্তি গবেষণায় অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি  পারমাণবিক অস্ত্রের বৈজ্ঞাানিক গবেষণার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করেন এবং তিনি পারমাণবিক পরীক্ষা পর্যবেক্ষণকারী একটি ক্ষুদ্র বিজ্ঞানী টিমের নেতৃত্ব দেন।  ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর প্রধানমন্ত্রী  জওহরলাল নেহরু  বিজ্ঞানী হোমি বাবার নেতৃত্বে পারমাণবিক কর্মসূচির উন্নয়ন অনুমোদন করেন। ভারত পারমাণিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) আন্দোলনে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিল। কিন্তু দেশটি এ চুক্তিতে স্বাক্ষর দান না করার সিদ্ধান্ত নেয়।     
 ১৯৭২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পারমাণবিক ডিভাইস তৈরি এবং তা পরীক্ষা করার জন্য বাবা এটমিক রিসার্চ সেন্টারের (বেএআরসি) বিজ্ঞানীদের মৌখিকভাবে অনুমোদন দেন। তার অনুমোদন দানের পর ডিভাইসের প্রকৌশল কাজ শুরু হয়। একইসঙ্গে একটি উপযুক্ত পরীক্ষাস্থল খুঁজে বের করার এবং তার জরিপ কাজও শুরু হয়। নির্মাণকালে ‘পিসফুল নিউক্লিয়ার এক্সপ্লে¬াসিভ’ হিসেবে আখ্যায়িত এ ডিভাইস সাধারণভাবে ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’ হিসেবে পরিচিত। বাবা এটমিক রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক ড. রাজা র‌্যামন ছিলেন পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রধান রূপকার। অন্যদের মধ্যে ছিলেন পিকে আয়াঙ্গার, রাজাগোপাল চিদাম্বরাম ও নাগাপট্টিনাম সম্বাসিব ভেঙ্কটেশ্বর। বিস্ফোরণ ঘটানোর সমন্বয় সাধনে রাজা র‌্যামন প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার (ডিআরডিও) পরিচালক ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ড. বাসন্তী দুলাল নাগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভবে কাজ করছিলেন। র‌্যামনের সহকারী হিসেবে পিকে আয়াঙ্গার পারমাণবিক ডিভাইস উদ্ভাবনের দিকনির্দেশনায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। অন্যদিকে ড. আর. চিদাম্বরাম নিউক্লিয়ার সিস্টেম ডিজাইন তৈরিতে নেতৃত্ব দেন।
১৯৬৭-১৯৭৬ সাল পর্যন্ত এ প্রকল্পে ৭৫ জন বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীর বেশি লোক নিয়োগ করা হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত আমেরিকান ডিজাইনের ভিত্তিতে চন্ডিগড়ে টার্মিনাল ব্যালিস্টিক রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে (টিবিআরএল) উদ্ভাবিত এ ডিভাইসে উচ্চ বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়। তবে ভারতীয় ডিজাইন ছিল আমেরিকান ডিজাইনের চেয়ে মামুলি ও অনগ্রসর। স্বাভাবিক ঘনত্ব দ্বিগুণ করার প্রয়োজনে ডিভাইসের মূল অংশকে সংকুচিত করা হয়। এ লক্ষ্যে উচ্চতাপ সৃষ্টিকারী সিস্টেম ব্যবহার করা হয়। ভারতীয়রা ১৯৪৫ সালে আমেরিকার প্রথম আণবিক বিস্ফোরণ ‘ট্রিনিটি’র অনুরূপ আরডিএক্স ও টিএনটির একটি মিশ্রণকে ত্বরিত বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহার করে। ধীর বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহার করা হয় ব্যারাটল (ব্যারিয়াম নাইট্রেট ও টিএনটি)। অভ্যন্তরীণ ধীর বিস্ফোরক যন্ত্রটি ছিল শিব লিঙ্গের মতো। ডিভাইসে ১২টি লেন্স ব্যবহার করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে আমেরিকা ৩২ লেন্সের ‘সসার বল’ সিস্টেম উদ্ভাবন করেছিল। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত নাগাপট্টিনাম ডেঙ্কটেশ্বর টিবিআরএল-এ ডিভাইস নির্মাণকালে ৫ শতাধিক লেন্স পরীক্ষা করেন। ডিভাইসের জন্য যেসব ডেটোনেটর উদ্ভাবন করা হয় সেগুলো ছিল সীসা দিয়ে তৈরি স্পার্ক গ্যাপ ডেটোনেটর। এসব ডেটোনেটর ছিল উচ্চ তাপ সৃষ্টিকারী সিস্টেমের জন্য প্রয়োজনীয় তীব্র গতিসম্পন্ন। তবে এগুলো ছিল আমেরিকার ম্যানহাটন প্রকল্পে বৈজ্ঞানিক আলভারেজ উদ্ভাবিত  অত্যাধুনিক ডেটোনেটরের চেয়ে নিম্মমানের। স্পার্ক গ্যাপ ডেটোনেটর সবচেয়ে অনিরাপদ ডেটোনেটর। বিস্ফোরণকালে স্থায়ীভাবে আণবিক কণা বিদারণ অথবা শক্তি উৎপন্ন হলে এগুলো ভস্মীভূত হয়ে যেতে পারে। ভারতে এ জাতীয় ডেটোনেটর কেবলমাত্র ১৯৭৪ সালের বিস্ফোরণে ব্যবহার করা হয়। পরে এগুলোর স্থলাভিষিক্ত হয় আরো আধুনিক ডেটোনেটর। ডিভাইসে বিস্ফোরণ ঘটাতে উচ্চ গতিসম্পন্ন গ্যাস টিউব সুইচ তৈরি করা হয়। ডিভাইসের জন্য প্লুটোনিয়াম সরবরাহ একটি সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। 
    ১৯৭০ সালে ফোনিক্স প্লুটোনিয়াম প্লান্টে গুরুতর ফাটল ধরা পড়ে এবং ফাটল দেখা দেয়ায় এ প্ল¬ান্ট বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল যে, এক বছরের মধ্যে এ প্ল্যান্টে উৎপাদন শুরু করা যাবে। কিন্তু ১৯৭২ সালের গোড়ার দিকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সেখানে প্লুটোনিয়ামকে বিযুক্ত করতে আরো এক বা দুবছর সময়ের প্রয়োজন হবে। পূর্ণিমা প্ল¬ান্ট নির্মাণের পর সেখান থেকেও পর্যাপ্ত প্লুটোনিয়াম পাওয়া যায়নি। ৮ মাস পর উৎপাদন শুরু হলে ড. র‌্যামন ১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে এ প্লান্ট বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেন যাতে প্ল¬ান্টের জ্বালানি নিউক্লিয়ার ডিভাইস তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। তখনকার ভারতীয় ডিজাইনের জন্য প্রয়োজন ছিল ৬ কেজি প্লুটোনিয়াম। ‘ট্রিনিটি’ ও ‘ফ্যাট ম্যান’ আণবিক বোমায় যুক্তরাষ্ট্র ৬ দশমিক ২ কেজি কওে প্লুটোনিয়াম ব্যবহার করেছিল। ভারতীয় ডিভাইস ছিল অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র। পূর্ণিমায়  প্লুটোনিয়াম ছিল মাত্র ১৮ কেজি। অতএব ১৯৭৪ সালে ভারতের কাছে তিনটির বেশি বোমা বানানোর প্লুটোনিয়াম ছিল না। বাবা এটমিক রিসার্চ সেন্টারের রেডিও মেটালারজি বিভাগের পিআর. রায়ের নেতৃত্বে একটি টিম সত্যিকার প্লুটোনিয়াম কোর বা মূল যন্ত্র উদ্ভাবন করে। এ টিম পূর্ণিমা প্লান্টের জন্য প্লুটোনিয়াম  জ্বালানি রডও তৈরি করে। 
১৯৭২ সালের মাঝামাঝি নিউট্রন বিদারণ কাজ শুরু হয় এবং এ কাজ প্রকল্পের একটি জটিল অধ্যায়ে পরিণত হয়। ১৯৭৪ সালের মে নাগাদ প্রস্তুতি সম্পন্ন করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ভিকে আয়া কাজের জটিলতা অনুধাবনে সক্ষম হন। শুরুতে টিএস. মূর্তি হিসাব করেছিলেন যে, প্রয়োজনীয় সবকিছু পেলে ১৮ মাসের মধ্যে প্লুটোনিয়াম তৈরি করা যাবে। তবে বিপুল পরিমাণ প্লুটোনিয়াম উৎপাদন এবং এগুলো ব্যবহারের কৌশল না জানা ছিল আরেকটি বিরাট সমস্যা। নিউট্রন বিদারণের সাংকেতিক নাম দেয়া হয় ‘ফ্লাওয়ার’। এ ধরনের নামকরণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ভারতীয় বিজ্ঞানী চেনগাপ্পা বলেন, ধারণা করা হচ্ছিল যে, ভারতীয় টিম পদ্মফুল আকৃতির একটি যন্ত্রের ওপর প্লুটোনিয়াম স্থাপন করেছে এবং প্লুটোনিয়াম ভর্তি যন্ত্রটি একটি ধাতব আবরণে আবৃত করে রাখা হয়েছে।
বাবা এটমিক রিসার্চ সেন্টারের সাইরাস রিঅ্যাক্টরে উৎপাদিত ৬ কেজি প্লুটোনিয়ামের সাহায্যে ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’ ডিভাইস তৈরি করা হয়। ১৯৭২ সালের মধ্যে মৌলিক ডিজাইন তৈরি হয়ে যায়। প্লুটোনিয়াম  বিযুক্তকরণ, শোধন ও উৎপাদন এবং উচ্চ তাপ সৃষ্টিকারী লেন্স সিস্টেম ও আনুষঙ্গিক ইলেকক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনে লেগে যায় দুবছর। অধিকাংশ কাজ সম্পন্ন করা হয় বিএসআরসিতে। তবে ডিফেন্স রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ডিআরডিও) বিস্ফোরণোক্ষম লেন্স তৈরি করে। নিউট্রন বিদারক ছিল একটি পুলোনিয়াম-২১০ বেরিলিয়াম টাইপের। 
বিস্ফোরণস্থলে পরিবহন করে নিয়ে যাবার আগে পুরো ডিভাইটি ট্রম্বেতে সংযোজন করা হয়। পুরোপুরিভাবে সংযোজিত ডিভাইসে এক দশমিক ২৫ মিটার ব্যাসের ষড়ভুজাকৃতির একটি ক্রস সেকসন ছিল এবং তার ওজন ছিল এক হাজার ৪  শো কেজি। ভারতের রাজস্থানের থর মরভূমিতে পোখরান পরীক্ষা ক্ষেত্রে সকাল ৮টা ৫ মিনিটে এ বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সরকারিভাবে বিস্ফোরণ ক্ষমতা ১২ কিলোটন দাবি করা হলেও বাইরের হিসাবে ২ থেকে ২০ কিলোটন দাবি করা হয়।
১৯৭৪ সালের ১৮ মে গৌতম বুদ্ধের জন্মদিন বুদ্ধ জয়ন্তী হওয়ায় বিস্ফোরণ প্রকল্পের সাংকেতিক নাম দেয়া হয় ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’। তবে আমেরিকার সামরিক সূত্র অনুযায়ী এ প্রকল্পের সাংকেতিক নাম ছিল ‘অপারেশন হ্যাপি কৃষ্ণ’। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে বিস্ফোরণস্থলে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন অনুপস্থিত। বিস্ফোরণ ঘটানোর সংবাদ ইন্দিরা মন্ত্রিসভায় জানতেন একমাত্র তিনি এবং তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও সাবেক মুখ্য সচিব পিএন হাক্সার এবং মুখ্য সচিব ডিপি ধর। প্রতিরক্ষামন্ত্রীসহ কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে অবহিত করা হয়নি। ১৯৭৪ সালের ১৮ মে সফল বিস্ফোরণের পর ড. র‌্যামন এ সুসংবাদ প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন বহু দূরে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হটলাইন অকেজো হয়ে গেলে তিনি নিকটবর্তী গ্রামে যান এবং একটি সাধারণ টেলিফোনে প্রধানমন্ত্রীকে জানান, ‘ম্যাডাম অবশেষে বুদ্ধ হেসেছে।’
পোখরান হচ্ছে রাজস্থান রাজ্যের জয়সিলমার জেলার একটি ছোট্ট গ্রামের নাম। এখানে ভারতের চারটি অনুশীলন ক্ষেত্রে রয়েছে। একটির নাম রেঞ্জ-এ। এখানে সর্বোচ্চ ৪০ কিলোমিটার পাল¬ার কামানের গোলাবর্ষণ অনুশীলন করা হয়। রেঞ্জ বি-তে চালানো হয় ট্যাঙ্কের মহড়া। রেঞ্জ-সি ভারতীয় বিমানবাহিনীর ব্যবহৃত একটি ক্ষেত্র। রেঞ্জ-ডি হচ্ছে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটানোর স্থল। রেঞ্জ-ডি পরিবেষ্টন করে রাখা হয় এবং এ রেঞ্জ হচ্ছে একটি সংরক্ষিত এলাকা।
রাজস্থানের রাজধানী যোধপুরে মোতায়েন ৬১তম ভারতীয় প্রকৌশল রেজিমেন্টকে পোখরান পরীক্ষা ক্ষেত্রে গভীর খাদ খনন করার দায়িত্ব দেয়া হয়। ড. র‌্যামন গভীর কূপ খনন করার জন্য ১৯৭৩ সালের মে মাসে এ রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুব্রাওয়ালের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জেনারেল বেবুরকে নির্দেশ দেয়ার আগে জুন নাগাদ সেনাবাহিনী কোনো সহযোগিতা করেনি। গভীর কূপ খননে এ ইউনিটের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় ঝামেলা হলেও  কাজ এগিয়ে চলে। কূপ খননের সাংকেতিক নাম ছিল ‘অপারেশন ড্রাই এন্টারপ্রাইজ’। প্রকৌশলী ও সৈন্যদের জানানো হয় যে, পোখরান অঞ্চলে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহে এ কূপ খনন করা হচ্ছে। ১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পে বিপর্যয় দেখা দেয়। খননকালে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর উন্মোচিত হয়ে পড়ে। ফলে পানি উঠতে থাকে। প্রবাহ বন্ধের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। পানি ওঠা বন্ধ করতে না পারায় কূপটি পরিত্যক্ত হয়। জনবসতিশূন্য গ্রাম মালকির কাছে একটি নয়া কূপ খনন শুরু হয়। ১৯৭৪ সালের ফেব্র“য়ারিতে কূপ খনন শুরু হয় এবং ১৮ মে’র কয়েক দিন আগে শেষ হয়।
তার মানে হলো ভারত ১৯৭৪ সালে দুটি পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায়। তবে প্রথম বিস্ফোরণটি ব্যর্থ হয়। বিস্ফোরণের আগে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বেশ কটি বৈঠক হয়। এসব বৈঠকে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন ড. র‌্যামন, এটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান হোমি শেঠ, ডিআরডিও’র প্রধান নাগ চৌধুরী, পিএন হাক্সার ও ডিপি ধর। প্রথম বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় ফেব্র“য়ারিতে। বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ায় এই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল যে, পারমাণবিক ডিভাইস তৈরি সম্পন্ন হওয়ার পথে। ১৮ মে বিস্ফোরণের কয়েক সপ্তাহ আগে চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ডিপি ধর ও হাক্সার বিস্ফোরণের বিরোধিতা করেন। অন্যদিকে পিএনই কর্মসূচির নেতৃবৃন্দ দৃঢ়ভাবে বিস্ফোরণের প্রতি সমর্থন জানান। উভয়পক্ষের বাদানুবাদের মুখে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিস্ফোরণ ঘটানোর নির্দেশ দেন।
চিদাম্বরাম ও রায়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সেনাবাহিনীর একটি সাঁজোয়া যানে ট্রম্বে থেকে পোখরানে মূল কাঠামো বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়। প্লুটোনিয়াম ছিল একটি বিশেষ বাক্সে প্যাকেটকরা। সাঁজোয়া যানে র‌্যামনও ছিলেন। ৯ শো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে তিনদিন সময় লাগে। টিবিআরএল থেকে ট্রাকে করে বিস্ফোরক লেন্স ও বিপুল তাপ উৎপাদনকারী অন্যান্য যন্ত্রপাতি পাঠানো হয়। বিস্ফোরণের ক্ষমতা রেকর্ড করার জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরাও পাঠানো হয়। কূপ থেকে ৪০ মাইল দূরে একটি কুঁড়েঘরে ডিভাইস সংযোজন করা হয়। সোনি, কাকোদগার, আয়াঙ্গার, ভেঙ্কটেশ্বর ও বালাকৃষ্ণকে নিয়ে গঠিত একটি টিম ১৩ মে থেকে ডিভাইসের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সংযোজন শুরু করে। সংযোজন প্রক্রিয়াকালে প্লুটোনিয়ামে তৈরি মূল অংশ তামার একটি ডিস্কে উঠানো হয়। মরুভূমির উত্তপ্ত তাপমাত্রায় মূল অংশ যথাযথভাবে সংযোজন করা যায়নি। তাতে সংযোজন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরদিন সকালে পুনরায় সংযোজন প্রচেষ্টা শুরু করা হলে সফলতা আসে। প্রতিটি লেন্সের ওজন ছিল আনুমানিক এক শো কেজি। প্রতিটি লেন্স বহনের জন্য প্রয়োজন ছিল ৪ জন লোক। ডিভাইসের উভয় অংশ সংযোজন সম্পূর্ণ হয়। প্রতিটি অংশে ছিল ৬টি করে লেন্স। নির্দিষ্ট জায়গায় স্থাপন করার জন্য ক্রেন দিয়ে প্রথম অংশটি উঠানো হয়। উঠানোর সময় একটি লেন্স পতিত হয়। মাটিতে পড়ে গিয়ে লেন্সটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়। প্রতিস্থাপনের জন্য তখন একটি মাত্র লেন্স হাতে ছিল। রাত নেমে আসার পর সংযোজন প্রক্রিয়া শেষ হয়। হেক্সাগোনাল নামে ডিভাইসটি একটি ধাতব তেপায়ার ওপর উঠানো হয় এবং রেলগাড়িতে করে কূপে নিয়ে যাওয়া হয়। সেনাবাহিনী বালি দিয়ে কূপটি ঢেকে রেখেছিল।
 ১৫ মে ভোরে ডিভাইস কূপে নামানো হয়। এল আকৃতির কূপের কোণে একটি গর্তের শেষ মাথায়  ডিভাইসটি স্থাপন করা হয়। কূপের পাশে পিচ্ছিল কাদা থাকায় ফায়ারিং সার্কিটের নির্ভুলতা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দেয়। ফায়ারিং সার্কিট পরীক্ষা করার জন্য বালাকৃষ্ণ নিচে নামেন। অবশেষে বালি ও সিমেন্ট দিয়ে কূপটি সীল করে দেয়া হয়। বিস্ফোরণে নিয়োজিত টিম ১৮ মে পরীক্ষাস্থল থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে বিশ্রাম গ্রহণ করে। পিএনই  প্রজেক্টের সিনিয়র নেতৃবৃন্দসহ সবাই উপস্থিত ছিলেন। সংযোজনের দায়িত্বে নিয়োজিত টিম ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন র‌্যামন, ভিএস শেঠি, নাগ, চৌধুরী, চিদাম্বরাম, সিক্কা, শ্রীনিবাস, দস্তগীর, মূর্তি, রায়, জেনারেল বেবুর ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুব্রাওয়াল। সকাল ৮ টায় বিস্ফোরণ ঘটানোর কথা ছিল। কিন্তু টিবিআরএল’র প্রকৌশলী ভিএস শেঠি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরা পরীক্ষা করতে গিয়ে পরীক্ষাস্থলে আটকা পড়েন। তার জীপ স্টার্ট নিচ্ছিল না। নির্ধারিত সময়ে বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য তিনি হাজির হন। কিন্তু তার জীপটি উদ্ধারে সেনাবাহিনীর প্রচেষ্টায় বিস্ফোরণে ৫ মিনিট বিলম্ব করা হয়। অবশেষে সকাল ৮টা ৫ মিনিটে দস্তগীর বোতামে টিপ দেন।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম কখন বিস্ফোরণের কথা জানতে পেরেছিলেন এ ব্যাপারে দ্বিমত রয়েছে। পার্কোভিচের ভাষ্য অনুযায়ী তিনি ৮ মে জানতে পেরেছিলেন। তবে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মতামত নেয়া হয়নি। অন্যদিকে চেনগাপ্পা দাবি করেছেন, বিস্ফোরণ ঘটানোর পর তাকে অবহিত করা হয়। পার্কোভিচ আরো দাবি করেন, ৪৮ ঘণ্টা আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংকে জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীকে বিস্ফোরণের খবর পাঠাতে কয়েকটি সমস্যা দেখা দেয়। ভিএস শেঠি বাংকারে স্থাপিত একটি ফিল্ড টেলিফোনের মাধ্যমে ডিপি ধরের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি সংবাদটি দেয়ার আগে লাইন অকেজো হয়ে যায়।  কর্নেল সুব্রাওয়াল অন্য একটি টেলিফোনে চেষ্টা করার জন্য শেঠিকে পোখরান গ্রামে নিয়ে যান। কিন্তু শেঠি ধরের টেলিফোন নাম্বার ভুলে যান। সুব্রাওয়াল টেলিফোন অপারেটরের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন। তবে জেনারেল বেবুর তার ১০ মিনিট আগে পোখরান গ্রামের একটি টেলিফোনের মাধ্যমে ধরকে সফল বিস্ফোরণের সংবাদ দেন।
আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়ার পর থেকে ভারতের প্রথম আণবিক বিস্ফোরণ ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’ নামে পরিচিত। সম্ভবত ডিপি ধর এ নামকরণ করেছিলেন। নামকরণের জট খোলা কঠিন। প্রকৃতপক্ষে পরীক্ষার কোনো আনুষ্ঠানিক সাংকেতিক নাম ছিল না। চেনগাপ্পা এ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, এটি একটি কল্পকাহিনী। মৃত্যুর আগে পিএন হাক্সার এক সাক্ষাৎকারে স্মাইলিং বুদ্ধ নামকরণের সত্যতা নিশ্চিত করতে অস্বীকার করেন। শেঠিও এ ধরনের সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করার সত্যতা অস্বীকার করেন। ডিপি ধর তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, এ ধরনের কোনো শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয়নি এবং তিনি এ সাংকেতিক নাম দেননি। র‌্যামন দাবি করেন, শেঠি তাকে জানিয়েছেন, এ সাংকেতিক শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে এবং এ কটি শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন ডিপি ধর। শেঠি বিশ্বাস করেন যে, বিস্ফোরণের পর ধর এ সাংকেতিক নাম দিয়ে থাকবেন।
স্মাইলিং বুদ্ধ-এর বিস্ফোরণ ক্ষমতা কত ছিল তা নিয়ে বির্তক রয়েছে। পত্রপত্রিকার খবরে প্রায়ই বিস্ফোরণের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ২০ এবং সর্বনিম্ন ২ কিলোটন হিসেবে উল্লে¬খ করা হয়। সরকারিভাবে বিস্ফোরণ ক্ষমতা ১২ কিলোটন নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে ভূকম্পন জরিপ এবং সৃষ্ট গর্তের নমুনা আভাস দিচ্ছে যে, বিস্ফোরণ ক্ষমতা ছিল স্বল্পমাত্রার। বিশে¬ষণকগণ বিস্ফোরণ ক্ষমতাকে ৪ থেকে ৬ কিলোটন হিসেবে উল্লে¬খ করেন। পরবর্তী সময়ে হোমি শেঠি ও পিকে আয়াঙ্গার স্বীকার করেন যে, বিস্ফোরণের ক্ষমতা সম্পর্কে সরকারি দাবি ছিল অতিরঞ্জিত। আয়াঙ্গার প্রায়ই বলতেন, বিস্ফোরণ ক্ষমতা চিল ৮ থেকে ১০ কিলোটন।
পারমাণবিক ডিভাইস পরীক্ষার পর সংশি¬ষ্ট বিজ্ঞানীগণ জাতীয় বীরে পরিণত হন। ১৯৭৫ সালে বিজ্ঞানী শেঠি, র‌্যামন ও নাগ চৌধুরীকে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব পদ্মভূষণ-এ ভূষিত করা হয়। অন্যদিকে বিজ্ঞানী আয়াঙ্গার, চিদাম্বরাম, ভেঙ্কটেশ্বর, দস্তগীর ও শেষাদ্রিকে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পদ্মশ্রী খেতাব দেয়া হয়। পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটানোর পর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্দীর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হয়।

লেখাটি ‘আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিরোধ’ থেকে নেয়া। বইটি প্রকাশ করেছে আফসার ব্রাদার্স।)

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বৃহস্পতিবার ইতিহাসে একটি কালো দিন। সেদিন ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পলাশীর আম্রকাননে প্রহসনের যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলা পরাজিত হলে প্রথমে বঙ্গদেশ এবং পরে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ ইংরেজ কোম্পানির করতলগত হয়। ঐতিহাসিকরা বলছেন, নবারের সৈন্যরা প্রত্যেকে একটি করে ঢিল ছুঁড়লে ইংরেজরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো। কিন্তু যুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা বিজয়ী হয়। পলাশীর যুদ্ধকে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠায় একটি চূড়ান্ত যুদ্ধ হিসাবে গণ্য করা হয়। এ যুদ্ধে লুণ্ঠিত সম্পদকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের শক্তি বৃদ্ধিতে ব্যবহার করে। পলাশীর যুদ্ধ ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা এবং বৃহত্তর উপনিবেশ গঠনের একটি প্রচেষ্টা। এ বিজয়ের খলনায়ক ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামরিক অফিসার কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ। তার বিজয়ের মূলে ছিল চক্রান্ত, ঘুষ প্রদান, চুক্তি ভঙ্গ এবং নবাবের প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা।   
শক্তিশালী রাষ্ট্রের কাছে একটি দুর্বল রাষ্ট্র পরাজিত হতে পারে। তদ্রƒপ একটি দেশের সেনাবাহিনীর কাছে আরেকটি দেশের সেনাবাহিনীর বিপর্যয় ঘটতে পারে। কিন্তু পলাশীতে ঘটেছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার প্রবল পরাক্রান্ত নবাব মির্জা মোহাম্মদ সিরাজুদ্দৌলা পরাজিত হয়েছিলেন একটি বিদেশী জয়েন্ট স্টক কোম্পানির সামান্য একজন কর্নেলের কাছে। পলাশীর যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল কয়েক ঘণ্টা। তবে যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারিত হয়েছিল নবাবের সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছার অনেক আগে। যুদ্ধ না করার জন্য তার সৈন্যদের ঘুষ দেয়া হয়েছিল। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু তার ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’য় ক্লাইভের বিজয়কে প্রতারণা ও ছলচাতুরির বিজয় হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।
 পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজুদ্দৌলার পতন এবং পরে তিনি নিহত হলে মীর জাফর বাংলার নবাব হন। মীর জাফরের নবাবীকালে ইংরেজরা কার্যকরভাবে বাংলার নিয়ন্ত্রণ কব্জা করে। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে ঔধের নবাব মীর কাসিম ও মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম সম্মিলিতভাবে পরাজিত হলে উত্তর ভারতে ব্রিটিশদের আধিপত্য বিস্তারের পথে আর কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেননি। বাংলা বিজয়ের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত রচিত হয়। ব্রিটিশদের এ সাফল্যের পেছনে ঐতিহাসিক নগরী কলকাতার বিরাট অবদান ছিল। কর্ণাটক যুদ্ধে কলকাতা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফরাসী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান ডুপ্লের কাছে মাদ্রাজের পতন ঘটলেও ব্রিটিশরা কলকাতায় তাদের শক্তিশালী ঘাঁটি থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তারা ফরাসীদের পরাজিত করতে বাংলার সম্পদকে কাজে লাগিয়েছিল। ড. আর. সি. মজুমদার তার ‘এন এডভান্সড হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’য় মন্তব্য করেছেন, সত্যিকারভাবে পলাশীর যুদ্ধকে ভারতে ফরাসীদের চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারণকারী হিসাবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে।      
যুদ্ধ 
১৭৫৭ সালের ১৩ জুন মাদ্রাজের ফোর্ট সেন্ট ডেভিডের গভর্নর এডমিরাল চার্লস ওয়াটসন নৌপথে ও ডেপুটি গভর্নর কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ চন্দরনগর (বর্তমান চন্দননগর) থেকে স্থলপথে যাত্রা করেন। চন্দরনগর ছিল একসময় ফরাসীদের ঘাঁটি। ক্লাইভের সঙ্গে যুদ্ধে ফরাসীরা এ ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ হারালে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেখানে তাদের আধিপত্য কায়েম করে। ১৯ জুন ক্লাইভের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সৈন্যরা কাটওয়ায় পৌঁছে। আগেরদিন মেজর আয়ারকুট কাটওয়া দখল করে নিয়েছিলেন। ২১ জুন ক্লাইভ কলকাতার প্রায় ১৫০ কিলোমিটার উত্তরে মুর্শিদাবাদ থেকে ১৬ মাইল ভাটিতে আম্রবাগান শোভিত পলাশী নামে একটি গ্রামের বিপরীতে গঙ্গা নদীর শাখা ভাগিরথী নদীর তীরে পৌঁছান। 
ইংরেজরা এসেছিল নৌকায়। অন্যদিকে দেশীয় সিপাহীরা এসেছিল হুগলী নদীর তীর ধরে হেঁটে। ক্লাইভ শিকারের জন্য ব্যবহৃত একটি ঘরে নিজের সদরদপ্তর স্থাপন করেন। তার মনে ছিল শংকা। জীবনে প্রথম ভয় তাকে স্পর্শ করে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যান তিনি। নিজের ক্ষুদ্র সামর্থ্যরে কথা ভেবে তিনি যুদ্ধ বিলম্বিত করার কথা ভাবতে থাকেন। সহযোদ্ধাদের তিনি বলেন যে, অন্য কোনো পক্ষ অথবা মিত্র কোনো দেশের সহযোগিতা ছাড়া যুদ্ধে বিজয় অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই তিনি অভিযান বিলম্বিত করার প্রস্তাব দেন। অন্যরা তার প্রস্তাবের বিরোধিতা করায় তিনি ১৬ জন ইংরেজ অফিসারকে নিয়ে একটি কাউন্সিল গঠন করেন। যুদ্ধ বিলম্বিত করা হবে নাকি এ মুহূর্তে যুদ্ধ শুরু করা হবে, এ প্রশ্নে ২১ জুন ওয়ার কাউন্সিলে ভোটাভুটি হয়। ৯ জন সদস্য যুদ্ধ বিলম্বিত করার পক্ষে ভোট দেন। ক্লাইভ ছিলেন তাদের একজন। মেজর আয়ারকুটের নেতৃত্বে অন্য ৭ জন সদস্য অবিলম্বে যুদ্ধ শুরু করার পক্ষে রায় দেন। তারা যুক্তি দিয়ে বলেন যে, বিলম্বিত করা হলে অথবা পিছু হটলে পরাজয় নিশ্চিত। নিজের কাপুরুষতার প্রতি ধিক্কার আসায় এবং মীর জাফরের পত্রে প্রদত্ত প্রতিশ্র“তির কথা মনে হওয়ায় ক্লাইভ মনোভাব পরিবর্তন করেন। তিনি এক ঘণ্টা চিন্তা করেন। মীর জাফর ক্লাইভের কাছে পাঠানো এক পত্রে প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন যে, যুদ্ধ শুরু হলে তিনি নবাবের পক্ষে অস্ত্রধারণ করবেন না। ২২ জুন বিকেলে মীর জাফরের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেয়ে ক্লাইভ পলাশীর উদ্দেশে যাত্রা করেন। মধ্যরাতে তিনি সেখানে পৌঁছান। প্রবল বৃষ্টিপাতের পর সূর্য উঁকি দেয়। ক্লাইভ ৩ হাজার ৩শ’ সৈন্য ও ৯টি কামান নিয়ে ভাগিরথী নদী অতিক্রম করেন এবং পলাশী গ্রামের পাশে একটি আমবাগান ও কয়েকটি পুকুরের পাড়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। অন্যদিকে নবাব সিরাজুদ্দৌলা যাত্রা করেন রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে। ইংরেজদের ১২ ঘণ্টা আগে পলাশীতে তিনি তাবু খাটান।
২৩ জুন ভোর ৭ টায় প্রচণ্ড গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় য্দ্ধু শুরু হয়। নবাবের সৈন্যরা তাদের সুরক্ষিত শিবির থেকে বের হয়ে ব্রিটিশ শিবিরে ব্যাপক গোলাবর্ষণ করে। তুমুল যুদ্ধের এক পর্যায়ে নবাবের পক্ষের বিজয় সুনিশ্চিত হয়ে উঠে। সকাল ১১ টায় মীর মদন, মোহনলাল, খাজা আবদুল হাদি খান ও নবাব সিংহাজারী প্রচণ্ড গতিতে হামলা চালালে ব্রিটিশ সৈন্যরা পিছু হটে আমবাগানে আশ্রয় নেয়। ঠিক তখন গোলন্দাজ বাহিনীর কমান্ডে নিয়োজিত বকশি মীর মদন ব্রিটিশ কামানের গোলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় যুদ্ধের দৃশ্যপট পাল্টে যায়। মীর মদনের অধীনস্থ সৈন্যসহ গোলন্দাজরা আতংকিত হয়ে নিজেদের তাবুতে ফিরে আসে। তখন ছিল দিনের মধ্যভাগ। গোলন্দাজ সৈন্যরা মীর মদনের লাশ নিয়ে তাবুতে ফিরে। নবাবের অধীনে তখন ছিল মাত্র ২ হাজার সৈন্য। তিনি এ মুষ্টিমেয় সৈন্য নিয়ে শত্র“র উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। ঐতিহাসিকরা বলছেন যে, মীর মদনের মতো নবাবের অধীনস্থ সকল সেনাপতি একযোগে হামলা চালালে ব্রিটিশরা অবশ্যই পরাজিত হতো। কিন্তু সেনাপতি ইয়ার লতিফ খান ও রায় দুর্লভ সেনাপতি মীর জাফরের মতো রণাঙ্গন থেকে দূরে অবস্থান করছিলেন। সেনাপতি মীর জাফর তার অধীনস্থ ১৬ হাজার সৈন্য নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের বামদিকে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকেন। নবাব তাকে বার বার তার পাশে এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। কিন্তু মীর জাফর নবাবের আহ্বানে সাড়া দেননি।
ব্রিটিশদের কামানের পাল্লা ছিল নবাবের কামানের পাল্লার চেয়ে দীর্ঘ। দুপুর ১২টায় মুষলধারে বৃষ্টি নবাবের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষায় ব্রিটিশরা তাদের কামান ও গোলাবারুদ আচ্ছাদন দিয়ে ঢেকে রাখলেও ৪০ জন ফরাসী কামান চালক নবাবের কামান রক্ষায় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বৃষ্টিতে গোলাগুলি ভিজে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। দুপুর ২টা থেকে নবাবের কামান থেকে গোলাবর্ষণ বন্ধ হয়ে যায়। ক্লাইভের অন্যতম সহযোগী মেজর কিলপ্যাট্রিক দু’টি বাহিনীর মাঝামাঝি একটি পুকুরের বিপরীত দিক থেকে হামলা চালান। কামান ও গোলাগুলিতে কাজ না হওয়ায় এবং মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা ধরা পড়ায় নবাবের সৈন্যরা ভীত হয়ে পড়ে। সেনাপতি মীর মদন নিহত হলে নবাব সিরাজুদ্দৌলা মীর জাফরকে তার শিবিরে ডেকে পাঠান। মীর জাফর পবিত্র কোরআন ছুঁয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করার শপথ করেন এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে নবাবকে পরামর্শ দেন। তিনি প্রতিশ্র“তি দেন যে, পরদিন ভোরে নতুন উদ্যমে লড়াই শুরু করা হবে। নবাব সরল বিশ্বাসে মীর জাফরের পরামর্শে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করেন এবং পরদিন নাগাদ যুদ্ধ স্থগিত রাখার নির্র্দেশ দেন। মীর জাফর নবাবের শিবির থেকে বের হয়েই গুপ্তচর মারফত ইংরেজদের কাছে একটি গোপন চিঠি পাঠান। চিঠিতে তিনি অবিলম্বে নবাবের সৈন্যদের উপর আক্রমণ চালানোর জন্য ক্লাইভকে ইঙ্গিত দেন। ক্লাইভ আক্রমণ চালান। নবাবের পিছু হটা সৈন্যরা অতর্কিত আক্রমণে হতচকিত হয়ে পড়ে। 
দাউদপুর শিবিরের সৈন্যরা পালিয়ে নদীর ওপারে চলে যায়। নবাব পলায়নরত সৈন্যদের যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে আসার আহ্বান জানান। সূর্যাস্তের দু’ঘণ্টা আগে সিরাজুদ্দৌলার বাহিনীতে ব্যাপক পলায়ন শুরু হয়। ৫ টার মধ্যে তার সকল সৈন্য মাঠ ত্যাগ করে। তখন রণাঙ্গনে ব্রিটিশ সৈন্যদের একক নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয়। তারা নবাবের কামানগুলো দখল করে। এ পরিস্থিতিতে নবাব যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগে বাধ্য হন। রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে নৌকায় পাটনার রাজমহলের উদ্দেশে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেন। ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত নবাব দানা শাহ নামে এক ফকিরের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ লোভী ফকির নবাবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করায় তিনি ভগবান গোলায় ধরা পড়েন। ২৭ জুন বন্দি করে তাকে মুর্শিদাবাদ নিয়ে আসা হয়। পরে মীর জাফরের পুত্র মীরনের নির্দেশে ইরানী প্রহরী মোহাম্মদ আলী বেগ তাকে ২ জুলাই দিবাগত রাতে হাজার দেউরির নিমক হারাম গেইটে হত্যা করে। নবাবের লাশ হাতীর পিঠে চড়িয়ে সারা মুর্শিদাবাদ ঘুরিয়ে অমর্যাদাকর অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। তার লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। পরে রাতের অন্ধকারে নবাবের বিশ্বাসী খাদেম হোসেন খাঁ খোশবাগে তাকে সমাহিত করেন। মৃত্যুকালে তিনি মা আমেনা বেগম, স্ত্রী লুৎফুন্নেসা, কন্যা উম্মে জোহরা ও ভাই মীর্জা মেহেদীকে রেখে যান। ২৯ জুন ইংরেজরা হীরাঝিলে নবাবের প্রাসাদে ঢুকে ধনাগার লুট করে। তারা ৩২ লাখ স্বর্ণমুদ্রা, এক কোটি ৭৬ লাখ রৌপ্য মুদ্রা, দুই সিন্দুক ভর্তি স্বর্ণপিন্ড, চার বাক্স হীরা-জহরত ও দুই বাক্স মণিমুক্তা লুট করে। আর নবাবের গোপন ধনাগার থেকে দেশীয় বিশ্বাসঘাতকরা লুট করে আট কোটি টাকা। 

যুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষে কতজন হতাহত হয় তা নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে। ১৮৫০ সালে প্রকাশিত আর্থার ব্র“মের ‘হিস্ট্রি অব বেঙ্গল আর্মি’ নামে ঐতিহাসিক পুস্তকের ৪৮-৪৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়, পলাশীতে ব্রিটিশদের পক্ষে ৭২ জন হতাহত হয়। নিহতদের মধ্যে ৭ জন ছিল ইংরেজ এবং আহতদের মধ্যে ছিল ১৩ জন। দেশীয় সিপাহী নিহত হয় ১৬ জন এবং আহত হয় ৩৬ জন। অন্যদিকে ‘দ্য ইন্ডিয়ান রেকর্ড সিরিজ’- এ বলা হয়, ইংরেজ নিহত হয় ৪ জন ও আহত হয় ১৫ জন। দেশীয় সিপাহী নিহত হয় ১৫ জন এবং আহত হয় ৩৮ জন। নবাবের যেসব কামান ব্রিটিশদের হস্তগত হয় সেগুলো কলকাতায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে সংরক্ষিত রয়েছে।
 
নবাবের পরাজয়ের কারণ
পলাশীর যুদ্ধে বিবদমান দু’টি পক্ষের শক্তি বিবেচনায় নেয়া হলে কোনোভাবেই ফলাফলকে স্বাভাবিক হিসাবে মেনে নেয়া যায় না। নবাবের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রতিপক্ষের তুলনায় ৬৫ হাজার বেশি। কামানও ছিল তাদের তুলনায় কয়েকগুণ। নৈতিক অবস্থান ছিল তার সঠিক। নিজের দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে তিনি যুদ্ধ করেছেন। তারপরও তিনি বিজয়ী হতে পারেননি। তার পরাজয়ের প্রথম কারণ হলো সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা। যুদ্ধ শুরু হলে মীর জাফর তার অধীনস্থ সৈন্য নিয়ে রণাঙ্গনে নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে থাকেন। তার সৈন্যরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে ফলাফল হতো অন্যরকম। নবাবের পরাজয়ের দ্বিতীয় কারণ হলো যুদ্ধের ঠিক মাঝ সময়ে তার অনুগত সেনাপতি মীর মদনের মৃত্যু। সেনাপতি মীর মদন একবার আহত হন যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে এবং আবার আহত হন তার কয়েক ঘণ্টা পর দুপুরে। গুরুতর আহত হয়ে তিনি মারা গেলে সৈন্যরা দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাতে থাকে। নবাবের পরাজয়ের তৃতীয় কারণ হলো বৃষ্টি। দুপুরে ভারি বৃষ্টিপাত শুরু হলে গোলাবারুদ ভিজে যায়। ফরাসী কামান চালকরা কামানগুলো বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষার কোনো চেষ্টা করেনি। ফলে বৃষ্টি থেমে যাবার পর যুদ্ধ শুরু হলে নবাবের কামান থেকে গোলাবর্ষণ করা সম্ভব হয়নি। আরেকটি কারণ হলো আফগান শাসক আহমদ শাহ আবদালির মোকাবিলায় পশ্চিমাঞ্চলে সৈন্য প্রেরণ। ইংরেজরা যে মুহূর্তে পূর্বাঞ্চলে হুমকি সৃষ্টি করছিল, ঠিক তখন দিল্লী লুণ্ঠনকারী আহমদ শাহ আবদালি দেশের পশ্চিমাঞ্চলে এসে উপস্থিত হন। শেষ কারণ হিসাবে উল্লেখ করতে হয় যে, তখনকার দিনে প্রাচ্যের অধিকাংশ শাসকের মতো নবাব সিরাজুদ্দৌলার বাহিনী ছিল সেকেলে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জ্বিত। ইংরেজরা যে পরিমাণ সৈন্য নিয়ে পলাশীতে বিজয়ী হয় তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সৈন্য নিয়ে সে সময় তারা ইউরোপের কোনো দেশকে পদানত করতে পারতো কিনা সন্দেহ। প্রাচ্যের শাসকদের এ সামরিক দুর্বলতার সুযোগেই ইউরোপীয়রা এ অঞ্চলে পদার্পণ করার সাহস পায়।  
পলাশীর যুদ্ধের জন্য একতরফাভাবে ইংরেজরা দায়ী। তারা নবাবের বিনা অনুমতিতে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে অস্ত্রশস্ত্র মজুদ করতে থাকে। ইংরেজদের দূরভিসন্ধি টের পেয়ে নবাব তাদেরকে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ উঠিয়ে নিতে এবং অস্ত্রসজ্জা বন্ধ করার নির্দেশ দেন। একজন সার্বভৌম শাসক হিসাবে নিজ দেশের ভূখণ্ডে বিদেশীদের অস্ত্রসজ্জা বন্ধের হুকুম দেয়ার পরিপূর্ণ এক্তিয়ার তার ছিল। কিন্তু তারা তার সার্বভৌম অধিকারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে এবং ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে মাদ্রাজ থেকে অস্ত্র আমদানি করতে থাকে। ১৭৫৬ থেকে ১৭৬৩ সাল পর্যন্ত ইউরোপে ব্রিটিশ ও ফরাসীদের মধ্যে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধকালে পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এসময় দু’টি দেশ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দেশের মধ্যে মোট ৩৯ টি যুদ্ধ হয়। পলাশীর যুদ্ধ ছিল তার একটি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার উইন্সটন চার্চিল ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধকে প্রথম মহাযুদ্ধ হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন। ইউরোপে বিদ্যমান যুদ্ধের আলোকে লা কোম্পাগনি দ্যস ইন্ডিস অরিয়েন্টালস নামে একটি ফরাসী কোম্পানি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে মোকাবিলার জন্য একটি ক্ষুদ্র সেনাদল পাঠায়। 

কলকাতা অবরোধ
কলকাতা অবরোধ ছিল পলাশীর যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ। দু’টি কারণে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ অবরোধ করা হয়। প্রথম কারণ ছিল রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণবল্লভের ফোর্ট উইলিয়ামে আশ্রয় গ্রহণ। কৃষ্ণবল্লভের অবাধ্যতার জন্য নবাব তাকে একবার বন্দি করেছিলেন। পরে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তিলাভের পর পিতা রাজবল্লভ তাকে তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও ধনসম্পদসহ ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে আশ্রয় দেয়ার জন্য ইংরেজদের রাজি করান। নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকানোর জন্য ইংরেজরা কৃষ্ণবল্লভকে আশ্রয় দেয়। ইংরেজরা ধনসম্পদসহ তাকে ফেরত দেয়ার দাবি মেনে নিতে অস্বীকার করলে নবাব ক্রোধান্বিত হন। কলকাতা অবরোধের দ্বিতীয় কারণ ছিল ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ মেরামত। ফরাসীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক দ্বন্দ্বের পটভূমিতে ইউরোপে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধ শুরু হলে ভারতে ডুপ্লের অধীনস্থ ফরাসী বাহিনীর সঙ্গে ইংরেজদের সংঘর্ষ বাধে। ফরাসীদের সঙ্গে সংঘর্ষে মাদ্রাজের পতন ঘটলে ১৭৫৬ সালের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ পুরনো ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ মেরামত করতে থাকে। ফোর্ট উইলিয়াম মেরামতের কথা জানতে পেরে বাংলার নয়া নবাব সিরাজুদ্দৌলা অগ্নিশর্মা হয়ে যান। তিনি তাদের প্রচেষ্টাকে তার সার্বভৌমত্বের প্রতি একটি হুমকি হিসাবে বিবেচনা করছিলেন। দুর্গের ৩৪ বছর বয়স্ক অস্থায়ী গভর্নর রজার ড্রেক ছলনার আশ্রয় নিয়ে নবাবকে জানান যে, তারা কেবল নিজেদের আত্মরক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কোনো দুর্গ মেরামত করছেন না। এসময় ইংরেজরা মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় বিপুলসংখ্যক সৈন্য আমদানি করে এবং নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনা করতে থাকে। ইংরেজদের অভিসন্ধির কথা জানতে পেরে নবাব ১৭৫৬ সালে মে মাসের শেষ দিকে রায় দুর্লভের নেতৃত্বে ৫০ হাজার সৈন্যের একটি বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন এবং গভর্নর ড্রেকের কাছে একটি চিঠি পাঠান। ৩ জুন নবাবের সৈন্যরা ষড়যন্ত্রের মূল ঘাঁটি কাশিমবাজার কুঠি অবরোধ করে। এ কুঠিতে ৫০ জন ইংরেজ অবস্থান করছিল। দু’দিনের মাথায় কাশিমবাজার কুঠি আত্মসমর্পণ করে। কুঠির কমান্ডার ছাড়া আর কেউ গুলিবর্ষণ করেনি। পতন নিশ্চিত হয়ে উঠলে এ কমান্ডার আত্মসমর্পণ না করে আত্মহত্যা করেন। নবাবের সৈন্যরা কুঠির সকল ব্রিটিশ কামান ও গোলাবারুদ বাজেয়াপ্ত করে এবং কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম অভিমুখে অগ্রযাত্রা করে। নবাবের সৈন্যদের অগ্রযাত্রার খবর পৌঁছলে ফোর্ট উইলিয়ামে আতংক ও ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। গভর্নর ড্রেক ছিলেন উদ্ধত স্বভাবের। এ স্বভাবের জন্য তিনি স্বদেশীয়দের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। কিছু যোগ্য কর্র্মকর্তার পরামর্শ তিনি উপেক্ষা করেন। কাশিমবাজারের পতন ঘটলে ড্রেক ও কলকাতার ব্রিটিশ কাউন্সিল ফরাসী ও ওলন্দাজদের কাছে সহায়তা পাঠানোর জন্য বিনীত আবেদন জানায়। তবে কোনো পক্ষই ব্রিটিশদের সংকটে তাদের সহায়তা দানে রাজি হয়নি। এ পরিস্থিতিতে ফোর্ট উইলিয়াম শক্তিবৃদ্ধির জন্য মাদ্রাজে ইংরেজ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানায়। মাদ্রাজ কর্তৃপক্ষ সৈন্য প্রেরণে অক্ষমতা প্রকাশ করলে গভর্নর ড্রেক নবাবের সকল দাবি মেনে নিতে সম্মত হন। তবে তিনি অনেক দেরি করে ফেলেন। ফোর্ট উইলিয়ামের উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বদিকের তিনটি মূল সড়কে কামান বসানো হয়। ছোট ছোট রাস্তাগুলোয় বসানো হয় বাঁশের চিকন কঞ্চি। দুর্গ প্রতিরক্ষায় কমান্ডার ক্যাপ্টেন মিনচিন মাত্র ১৮০ জন যোদ্ধা খুঁজে পেয়ে বিস্মিত হন। তাদের মধ্যে ৪৫ জন ছিল ব্রিটিশ, বাদবাকিরা ছিল পর্তুগীজ ও আর্মেনীয়। ‘লেখক’ হিসাবে পরিচিত কোম্পানির শিক্ষানবিশদের নিয়ে দ্রুত একটি মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করা হয়। কর্নেল ম্যানিংহাম ও লে. কর্নেল ফ্রাঙ্কল্যান্ড মিলিশিয়া বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। মিলিশিয়া বাহিনীর সঙ্গে আরো তিন শ’ যোদ্ধাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সব মিলিয়ে কলকাতা রক্ষায় ইংরেজদের সৈন্যসংখ্যা ছিল মাত্র ৫১৫ জন। নবাব সিরাজুদ্দৌলার অগ্রযাত্রার খবর পাওয়া মাত্র কলকাতার ‘ব্লাক টাউন’ বা কৃষ্ণ পল্লী থেকে লস্করসহ সকল স্থানীয় লোকজন পালিয়ে যায়। এসব লোক পালিয়ে যাওয়ায় তাদের মধ্য থেকে ইংরেজরা সৈন্য সংগ্রহে ব্যর্থ হয়। ৩ জুন নবাব সিরাজুুদ্দৌলার বাহিনীর একটি অগ্রবর্তী দল ফোর্ট উইলিয়ামের ১৫ মাইলের মধ্যে পৌঁছে যায়। এসময় কলকাতার সকল ইংরেজ মহিলা ও শিশুদের দুর্গে আশ্রয় নেয়ার আদেশ দেয়া হয়। ইংরেজ কামান চালকদের গোলাবর্ষণের সুযোগ না দিয়ে নবাব দুর্গ অবরোধ করেন এবং দক্ষিণের দেয়ালে আঘাত হানেন। ১৭৫৬ সালের ২০ জুন সংক্ষিপ্ত অবরোধের পর কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের পতন ঘটে। নবাব কলকাতার নামকরণ করেন ‘আলীনগর।’ নবাব মানিকচাঁদকে কলকাতার গভর্নর হিসাবে নিয়োগ দিয়ে রাজধানী মুর্শিদাবাদ ফিরে আসেন। রাজধানীতে তাকে বিপুল সংবর্ধনা জানানো হয়। ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ অবরোধকালে দুর্গের গভর্নর ও অন্যান্য কর্মকর্তা আটকেপড়া ইউরোপীয়দের তাদের ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে হুগলি নদী দিয়ে পালিয়ে যান। এসময় নবাবের সৈন্যদের হাতে ধৃত কিছুসংখ্যক ইউরোপীয় একটি কক্ষে আটক থাকা অবস্থায় মারা যায়। এ ঘটনাকে ফুঁলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করা হয় এবং দু’জন জীবিত ইংরেজ দাবি করে যে, নবাবের নির্দেশে ১৪৬ জন বন্দিকে একটি সংকীর্ণ কক্ষে আটক করে রাখা হয়। তাদের মধ্যে শ্বাস বন্ধ হয়ে ১২৩ জনের মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনার নামকরণ করা হয় ‘ব্ল্যাক হোল ট্রাজেডি।’
     ফোর্ট উইলিয়ামের পতন ঘটলে এ দুর্গের ব্রিটিশ কাউন্সিল মাদ্রাজে ফোর্ট সেন্ট জর্জের প্রেসিডেন্সীর কাছে সহায়তা কামনা করে। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে মাদ্রাজস্থ ফোর্ট সেন্ট জর্জ থেকে কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ ও এডমিরাল চার্লস ওয়াটসনকে কলকাতা অভিমুখে পাঠানো হয়। তারা ১৭৫৭ সালের ২ জানুয়ারি পুনরায় কলকাতা দখল করেন এবং হুগলির উত্তর দিকে এগিয়ে যান। ইংরেজদের কাছে ফোর্ট উইলিয়ামের পতনের সংবাদ পেয়ে নবাব সিরাজুদ্দৌলা ৪০ হাজার সৈন্য নিয়ে আবার কলকাতার উদ্দেশে রওনা হন। ক্লাইভ আলোচনার প্রস্তাব দিলে নবাব তা প্রত্যাখ্যান করেন। আলোচনা করার সুযোগ না পেয়ে ২ ফেব্র“য়ারি ক্লাইভ শহরের বাইরে নবাবের শিবিরে আক্রমণ চালিয়ে পরাজিত হন। ৬ শ’ ব্রিটিশ নৌ সেনা, সাড়ে ৬ শ’ ইউরোপীয় সৈন্য ও ৮ শ’ দেশীয় সিপাহী লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে। তাদের মধ্যে ১০০ ইউরোপীয় ও ৫০ জন সিপাহী নিহত হন। নবাবের পক্ষে নিহত হয় ৬ শ’ সিপাহী। লড়াই থেমে যাবার ৫ দিন পর উভয়পক্ষ একটি চুক্তিতে পৌঁছে। আহমদ শাহ আবদালীর আক্রমণের আশংকায় নবাব ৭ ফেব্র“য়ারি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে এ চুক্তি করেন। চুক্তিটি আলীনগরের সন্ধি নামে পরিচিত। নবাব ফোর্ট উইলিয়াম দখলের জন্য ইংরেজদের ক্ষতিরপূরণ প্রদানে প্রতিশ্র“তি দেন। আলীনগর চুক্তিতে নবাব সিরাজুদ্দৌলা সাময়িকভাবে পরাজয় স্বীকার করে নিলেও তিনি আবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসীদের সঙ্গে আঁতাত গড়ে তুলছিলেন।
 (লেখাটি 'দুনিয়া কাঁপানো যুদ্ধ’ থেকে নেয়া।)

কিভাবে ঘটলো অটোমান সাম্রাজ্যের পতন


উত্থানের পর পতন। প্রকৃতির এ শাশ্বত নিয়মকে কেউ অতিক্রম করতে পারে না। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী অটোমান সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রেও একথা সত্যি। আধুনিক তুরস্ক ছাড়া অটোমান সাম্রাজ্যের আর কোনো স্মৃতি অবশিষ্ট নেই। ১২৯৯ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত ৬ শো বছরের অধিক এ সাম্রাজ্য এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশের বিস্তীর্ণ ভূখন্ড শাসন করেছে। অমুসলিম ইউরোপে একমাত্র মুসলিম শক্তি হিসেবে টিকে থাকা ছিল অটোমানদের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। আয়তনে এ সাম্রাজ্য ছিল আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের সমকক্ষ এবং মুসলিম বিশ্বের বহু বৈরি অংশ এ সাম্রাজ্যের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয়। এতবড় বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনা করা কঠিন হয়ে ওঠে। প্রশাসনিক চাপে এ সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ে।  ষোড়শ শতাব্দীতে অটোমান সাম্রাজ্য অস্তাচলে যাত্রা করে। অটোমান সৈন্যবাহিনীর পরিপূর্ণ পরাজয়ের মধ্য দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। যুদ্ধে পরাজয়ের পরিণামে এ সাম্রাজ্যের ব্যবচ্ছেদ ঘটানো হয়। চার বছরের চরম বিশৃঙ্খলা এবং লড়াইয়ের পর আনাতোলিয়া, থ্রেসের পূর্বাঞ্চলের একটি ক্ষুদ্র ভূখন্ড, উত্তর ইস্তাম্বুল এবং ব্রিটিশ ও ফরাসিদের নিয়ন্ত্রিত পাঁচটি নয়া নির্ধারিত ভূখন্ড নিয়ে আধুনিক তুরস্কের উত্থান ঘটে। ১৯২২ সাল নাগাদ অটোমান সুলতানরা শাসন ক্ষমতায় থাকলেও সীমান্ত রক্ষায় পশ্চিমে হ্যাবসবার্গ এবং পূর্ব দিকে সাফাভি পারস্যের সঙ্গে তাদের লড়াই করতে হয়েছে। এসব লড়াইয়ে অটোমানদের ইউরোপীয় ও আরব প্রদেশগুলো খোয়াতে হয়। ঊনিশ শতকে ফরাসি সৈন্যরা মাগরিব (উত্তর আফ্রিকা) দখল করে নেয় এবং ১৮৩০ সালে গ্রীস স্বাধীনতা অর্জন করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো অটোমান সাম্রাজ্যের অস্তিত্বে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়। রাতারাতি পৃথিবীর দীর্ঘস্থায়ী এ সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যায়নি। শত শত বছরের অবক্ষয় তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। ২০০০ সালের ২৯ জানুয়ারি লন্ডনের দ্য টেলিগ্রাফের একটি রিপোর্টে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের কারণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, কেউ কখনো ভাবতে পারেননি যে, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মাত্র ২০ বছরের মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম চারটি সাম্রাজ্য জার্মান, রুশ, হ্যাবসবার্গ ও অটোমান সাম্রাজ্য বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে। রিপোর্টে এ সাম্রাজ্যের পতনের জন্য অনেকগুলো কারণ উল্লেখ করা হয়। যেসব কারণ অটোমান সাম্রাজ্যের অবনতি ও অবক্ষয় ডেকে এনেছে নিচে সেগুলো একে একে আলোচনা করা হলো:
 
জার্মানির সঙ্গে জোট গঠন
জার্মানিকে মিত্র হিসেবে বেছে নেয়ায় অটোমান সাম্রাজ্য অর্ধ-শতাব্দী ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অটোমান সরকার শুধুমাত্র জার্মানির সহায়তার ওপর নির্ভর করতে পারতো। জার্মানির বন্ধুত্ব ছিল সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের জন্য ব্রিটিশ ও ফরাসি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে একটি সুবিধাজনক বিকল্প। ১৯০২ সালে জার্মানিকে ৯৯ বছরের জন্য বার্লিন-বাগদাদ রেললাইন নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়। জার্মানি অটোমান অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করে এবং জার্মান অফিসাররা অটোমান সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিতো এবং সৈন্যবাহিনীতে কমান্ড পোস্টে অধিষ্ঠিত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার অব্যবহিত পরে ১৯১৪ সালের ২ আগস্ট অটোমান-জার্মান গোপন চুক্তি অনুমোদন করা হয়। পতনোন্মুখ অটোমান সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী ও আধুনিকীকরণ এবং পার্শ্ববর্তী ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে জার্মানিকে নিরাপদে প্রবেশের সুযোগদানে এ চুক্তি করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে অটোমান সাম্রাজ্যের অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। উপর্যুপরি যুদ্ধে দেশটি ভূখ-ের পর ভূখ- হারায়। অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ে এবং জনগণের মনোবল ভেঙ্গে যায় এবং ক্লান্ত হয়ে পড়ে। অটোমান সাম্রাজ্য এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি এবং সংস্কার চালিয়ে যেতে চাইছিল। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় দেশটি সেই সুযোগ পায়নি। যুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পক্ষে নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব ছিল না। কোনো না কোনো পক্ষের সঙ্গে যোগদান করা ছাড়া তাদের গত্যন্তর ছিল না। কেননা ইতালি-তুর্কি যুদ্ধ এবং বলকান যুদ্ধে দেশটি পুরোপুরি দেউলিয়া হয়ে যায়। তাদের মানসম্পন্ন পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র ও যন্ত্রপাতি ছিল না। নতুন নতুন অস্ত্র ক্রয়ের সামর্থ্য ছিল না। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে জার্মানির সঙ্গে জোট গঠন করা ছিল একমাত্র বিকল্প।

আরব জাতীয়তাবাদ 
আরব জাতীয়তাবাদ অটোমান সাম্রাজ্যের ভাঙ্গনের জন্য অনেকাংশে দায়ী। সাম্রাজ্যবাদী গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সম্মিলিত দিকনির্দেশনায় আরব বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। তাদের লক্ষ্য ছিল অটোমান সাম্রাজ্যকে ভেঙ্গে দিয়ে মুসলিম মধ্যপ্রাচ্যকে গ্রাস এবং আরবদের সহায়তায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ। আরব বিদ্রোহ শুরু না হলে অটোমান সৈন্যরা মিসরে সুয়েজ খালে ব্রিটিশদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। সুয়েজ খালে অটোমান হামলার আশঙ্কা দূর করতে চতুর ব্রিটিশ সরকার  মরুচারী আরবদের একটি সাম্রাজ্য দানের প্রতিশ্রুতি দেয়। ব্রিটিশ ও ফরাসিরা তাদের লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়। অস্ত্র ও অর্থের যোগান দিয়েছিল ব্রিটেন ও ফ্রান্স। মিসর থেকে ব্রিটিশ সৈন্যরা আরব বিদ্রোহে যোগ দেয়। বানু হাশেম গোত্রের মক্কার শেরিফ হোসেন বিন আলী সাম্রাজ্যবাদীদের বহন হিসেবে কাজ করেন। তার ও তার চার পুত্রের কাঁধে পা রেখে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের নীলনকশা বাস্তবায়ন করে। মুসলিম অটোমানরা হয়ে যায় আরবদের কাছে বিদেশি এবং শত্রু। অন্যদিকে সুদূর ইউরোপের বিধর্মী ব্রিটিশ ও ফরাসিরা হয়ে যায় মুসলিম আরবদের মিত্র। মুসলিম ঐক্যকে বিনষ্ট করার জন্য আরবদের মধ্যে পাশ্চাত্যের ধ্যান ধারণায় লালিত জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করা হয়। বিদেশি আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই জাতীয়তাবাদের মূল বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আরব জাতীয়তাবাদে এ ধরনের উপাদানের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। একটি বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে আরবরা অন্য কয়েকটি বিদেশি শক্তির সহায়তা গ্রহণ করেছে। তারা চিরাচরিত মুসলিম ঐক্যের অবিনাশী আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেয়। কোনো জাতির স্বাধীনতা অর্জনের অধিকারকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু অশুভ বিদেশি শক্তির সহায়তা ও দিকনির্দেশনায় স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যে কোনো গৌরব নেই। বিদেশি শক্তির সহায়তায় স্বাধীনতা অর্জন করলে কখনো মাথা তুলে কথা বলা যায় না। জাতির মানসিকতায় হীনমন্যতার ছাপ পড়ে। সৌদি আরবের আচরণে একথা স্পষ্ট হয়ে যায়। ব্রিটিশরা যে সময় আরবদের স্বাধীনতা অর্জনে আদাজল খেয়ে লেগেছিল, সে সময় ভারতবর্ষসহ পৃথিবীর এক বিরাট অংশ ছিল তাদের ঔপনিবেশ।    

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ 
অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধ প্রথমে দায়ী। এ বিধ্বংসী যুদ্ধ না হলে টিম টিম করে হলেও অটোমান সাম্রাজ্য টিকে থাকতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী মিত্রপক্ষ অটোমান সাম্রাজ্য ভাগাভাগি করে। অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা এ সাম্রাজ্যের ভাঙ্গনকে ত্বরান্বিত করে। একইসঙ্গে অটোমান সালতানাতের বিলুপ্তি ঘটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এ অবিস্মরণীয় রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে এবং ১৯১৮ সালের নভেম্বরে ব্রিটিশ, ফরাসি ও ইতালীয় সৈন্যরা কন্সটান্টিনোপল দখল করে নেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে মিত্রশক্তি কয়েকটি চুক্তির মাধ্যমে অটোমান সাম্রাজ্য ভাগাভাগির পরিকল্পনা করে। এসব চুক্তি ও সমঝোতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সাইকস-পিকোট চুক্তি, বেলফোর ঘোষণা, সেভার্স চুক্তি, লাউসেন চুক্তি এবং হোসেন-ম্যাকমোহন পত্রবিনিময়। সাইকস-পিকোট চুক্তির বাইরে ব্রিটেন ও রাশিয়ার মধ্যে আরেকটি চুক্তি হয়। ১৯১৫ সালের মার্চে ব্রিটেন ও রাশিয়া এ গোপন চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী রাশিয়া অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সটান্টিনোপল, ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে কৃষ্ণসাগর সংযোগকারী দার্দানেলিস প্রণালী এবং গ্যালিপলি উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। বিনিময়ে রাশিয়া তেল সমৃদ্ধ মেসোপটেমিয়া অঞ্চলসহ মধ্য পারস্য এবং অটোমান সাম্রাজ্যের বাদবাকি অংশের ওপর ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণ মেনে নিতে সম্মত হয়। রাশিয়ার সঙ্গে ব্রিটেনের  গোপন চুক্তি হওয়ার এক বছরের অধিক অতিক্রান্ত হলে সাইকস-পিকোট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। একটি ক্ষুদ্র প্রতিনিধি দলের নেতা পিকোট সিরিয়ায় ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণ কায়েমে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তার অনমনীয়তার জবাবে সাইকস এ অঞ্চলে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় ব্রিটেনের দাবি উত্থাপন করেন। চুক্তিতে ভবিষ্যতে আরব জাতীয়তাবাদের উত্থানকে মূলত উপেক্ষা করা হয়। অথচ সে সময় যুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিজয় লাভে ব্রিটিশ সরকার ও সামরিক বাহিনী আরব জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিচ্ছিল। ১৯২০ সালের ১০ আগস্ট ত্রিপক্ষীয় আঁতাত, সেন্ট্রাল পাওয়ার্স ও অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে স্বাক্ষরিত সেভার্স চুক্তিতে অটোমান সাম্রাজ্যের ভাগাভাগি ও ব্যবচ্ছেদ ঘটানো হয় এবং কার্যত তুরস্কের সার্বভৌমত্ব বিলুপ্ত করা হয়। চুক্তিতে অটোমান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে। ইউরোপের ‘রুগ্ন ব্যক্তি’কে খ- বিখ- করা হয়।

অযোগ্য সুলতান
সোলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্টের রাজত্বকাল অটোমান সাম্রাজ্যের গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। বিংশ শতাব্দীর বহু গবেষক বলছেন যে, ১৫৬৬ সালে সুলতান সোলেমানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অটোমান সাম্রাজ্যের ক্ষয় এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নতুন সম্পদ হস্তগত না হওয়ায় সাম্রাজ্যে অধঃপতন শুরু হয়। সুলতান সোলেমানের আমলেই এ সাম্রাজ্যের অবনতির লক্ষণ ফুটে উঠতে শুরু করে। তিনি বিনা প্রমাণে বিদ্রোহের অভিযোগে জ্যেষ্ঠ পুত্র শাহজাদা মোস্তফা ও চতুর্থ পুত্র শাহজাদা বায়েজীদকে মৃত্যুদ- দেন। তার তৃতীয় পুত্র শাহজাদা মেহমেদও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে মৃত্যুবরণ করেন। তিনজন শাহজাদার অকাল মৃত্যুতে অটোমান সাম্রাজ্য বড় ধরনের একটি ধাক্কা খায়। উচ্ছৃঙ্খল সৈন্যরা নিজেদের খেয়াল খুশি মতো উজিরে আজম নিয়োগ করতো। এমনকি তারা সুলতান প্রথম উসমানকে হত্যা করে। প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, দুর্নীতি ও প্রাদেশিক বিদ্রোহে সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। সুলতানরা ছিলেন দুর্বল ও অধঃপতিত। তারা রাষ্ট্রীয় বিষয়ে উদাসীনতা প্রদর্শন করতেন এবং হেরেমে তাদের সময় কাটাতেন। কোনো সুলতানের মৃত্যু হলে নরকের দ্বার খুলে যেতো এবং সকল রীতি নীতি বিসর্জন দিয়ে একজন শাহজাদা সিংহাসন দখল করতেন। দ্বিতীয় সেলিম সুলতান সোলেমানের উত্তরাধিকার লাভ করেন। তিনি ছিলেন সোলেমানের সর্বশেষ জীবিত একমাত্র পুত্র। দ্বিতীয় সেলিম স্বর্ণ নির্মিত পানপাত্রে মদপান করতেন। ১৫৬৬ সালে সিংহাসনে আরোহণের সময় তার প্রথম কাজ ছিল সাইপ্রাস দখল। তাই সাইপ্রাসের তৈরি মদ তার প্রিয় হয়ে ওঠে। সাইপ্রাস দখলে লিপান্টো যুদ্ধ হয়। দ্বিতীয় সেলিম কুৎসিত ও রুক্ষ মেজাজের ছিলেন। তাকে এক শো বামুনের একটি দেহরক্ষী ঘেরাও করে রাখতো। ক্ষুদে তরবারি সজ্জ্বিত এসব বামুনের পরনে থাকতো সোনালী পোশাক। 
    দ্বিতীয় সেলিমের পুত্র তৃতীয় মুরাদ রাজনীতিতে তত বেশি আগ্রহী ছিলেন না। তিনি তোপকাপি প্রাসাদের অভ্যন্তরে হেরেমের আয়তন বৃদ্ধিতে তার শক্তি ক্ষয় করেন এবং ইউরোপে তিনি কামুক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন। ১৬৯৫ সালে মৃত্যুর আগে তৃতীয় মুরাদের ২০ পুত্রের মধ্যে ১৯ জনকে হত্যা করা হয়। অবশিষ্ট পুত্র তৃতীয় মেহমেদ ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত ছাড়া সিংহাসনে বসেন। তৃতীয় মেহমেদকে খাৎনা করানো হলে ৫২ দিন পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলে। ১৬৩৩ সালে সুলতান চতুর্থ মুরাদ ধূমপানের জন্য মৃত্যুদ-ের পরিবর্তে ধূমপান বিরোধী প্রচারণা জোরদার করেন। তার পিতা সুলতান প্রথম আহমদ ধূমপানের পাইপ দিয়ে নাক ছিদ্র করে ধূমপায়ীদের শাস্তি দিতেন। চতুর্থ মুরাদ যুদ্ধক্ষেত্রে গোপনে অটোমান সৈন্যদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করতেন এবং ধূমপানের জন্য শিরñেদ, ফাঁসি কিংবা আটক রাখতেন। মনোভাব ভালো থাকলে তিনি হাত-পা ভেঙ্গে অপরাধীদের মুক্তি দিতেন। তার সম্পর্কে প্রজাদের ভাবনা জানার জন্য তিনি ছদ্মবেশে ঘুরতেন। এক হিসাবে বলা হয়, তার আমলে ধূমপান বিরোধী প্রচারণাকালে ২৫ হাজারের বেশি ধূমপায়ীকে হত্যা করা হয়। মৃত্যুদ-ের বিধান থাকায় ধূমপায়ীরা গোপনে ধূমপান করতো। ১৪ বছর পর এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। তৃতীয় সেলিম ফরাসি মডেলে সামরিক স্কুল চালু করেন। তিনি ধারণা করছিলেন যে, এ ধরনের সামরিক স্কুল অটোমানদের ইউরোপীয়দের সমকক্ষ করে তুলবে। কিন্তু তিনি এবং অন্য অটোমান সুলতানরা বুঝতে ব্যর্থ হন যে, ইউরোপীয় সমাজ, বাণিজ্য ও সরকার ব্যবস্থায় আরো গভীরতর পরিবর্তন সংঘটিত হচ্ছে। পাশ্চাত্যে উন্নতমানের ভ্রাম্যমাণ গোলন্দাজ বাহিনী গড়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে অটোমান সাম্রাজ্য বহু পেছনে পড়ে গিয়েছিল। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডস রেকর্ডসে বলা হয়, ১৭৯৮ সালে সুলতান তৃতীয় সেলিম একটি ধনুক থেকে তীর নিক্ষেপ করলে ৯৭২ গজ (প্রায় এক কিলোমিটার) দূরে গিয়ে পতিত হয়। এই রেকর্ড এখনো কেউ ভাঙ্গতে পারেননি। 

অটোমান ও ইউরোপ 
অটোমানরা একটি শক্তিশালী অবস্থান থেকে বরাবরই ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোকে মোকাবিলা করতো। তাদের সঙ্গে চুক্তিগুলো সুলতানরা অনুমোদন করতেন। চুক্তিতে অটোমান সুলতানরা বার্ষিক রাজস্ব প্রদানের শর্ত জুড়ে দিতেন। কিন্তু অটোমানদের বুঝতে বিলম্ব হয় যে, ইউরোপের অনুকূলে সামরিক ভারসাম্য ঘুরে যাচ্ছে। তারা ইউরোপীয়দের ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুমতি দেন। ইউরোপীয় পণ্যের অনুপ্রবেশে স্থানীয় শিল্প ধ্বংস হয়ে যায় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ভারসাম্য সাম্রাজ্যের স্বার্থের বিপরীতে চলে যায়। অর্থনৈতিক অনুপ্রবেশের পর ইউরোপীয়রা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করে। ১৫৩৬ সালে শক্তির শীর্ষে অবস্থান করার সময় অটোমান সাম্রাজ্য স্বেচ্ছায়  ফ্রান্সকে ছাড় মঞ্জুর করে। তবে সে সময় কার্যকর অধীনতামূলক চুক্তিগুলোকে (ক্যাপিচ্যুলেশন সিস্টেম) পরবর্তীকালে অটোমান সাম্রাজ্যের সার্বভৌমত্বের ওপর গুরুত্বপূর্ণ বিধিনিষেধ আরোপে ব্যবহার করা হয়। ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক সুবিধা বৃদ্ধি করা হয় এবং চুক্তির আওতায় বসবাসকারীদের অটোমান আইনের পরিবর্তে সেই দেশের আইনের অধীন করা হয়। এতে মারাত্মকভাবে ন্যায়বিচার লংঘিত হয়। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ৩০ বছর দ্রুত অটোমান সাম্রাজ্যের শক্তির অবক্ষয় দেখা দেয়। ১৫৭১ সালে লিপান্টোর যুদ্ধে স্পেনীয় ও পর্তুগীজ নৌবহরের কাছে অটোমান নৌবহরের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এ অবক্ষয় ধরা পড়ে। কোপরুলু যুগে ভেনিসের কাছ থেকে ক্রীট ও লেমনোস এবং পোল্যান্ড ও রাশিয়ার কাছ থেকে ইউক্রেনের বিরাট অংশ দখল করা হয়। কোপরুলু পরিবার অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে পুনরায় অভিযান শুরু করে এবং ভিয়েনার ১২০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে অটোমান সীমান্ত নিয়ে যান। ১৬৬৪ সালে হ্যাবসবার্গ রাজধানী দখলে ব্যর্থ চেষ্টা চালানো হয়। অটোমান উজিরে আজম আহমদ কোপরুলু ১৯ বছর স্থায়ী চুক্তির বিনিময়ে বিরাট অঙ্কের রাজস্ব আদায় করেন। চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে অটোমান সৈন্যবাহিনী ১৬৮৩ সালের জুলাইয়ে দ্বিতীয়বার ভিয়েনা অবরোধ করে। দুমাস পর পোল্যান্ডের রাজা জান সোবায়েস্কির নেতৃত্বে একটি উদ্ধারকারী বাহিনী ভিয়েনাকে অবরোধমুক্ত করে। ভিয়েনা অবরোধ ছিল ইউরোপে অটোমান সম্প্রসারণের চূড়ান্ত সীমা।

 ভিয়েনায় অটোমানদের দ্বিতীয় অভিযানের ফলাফল
১৬৮১ সাল নাগাদ অটোমান সৈন্যবাহিনীকে শক্তিশালী বলে প্রতীয়মান হচ্ছিল। উজিরে আজম মারজিফনলু কারা মোস্তফা পাশা মধ্য ইউরোপের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করার সাহস দেখান এবং ১৬৮৩ সালের জুলাইয়ে দ্বিতীয়বার ভিয়েনা অবরোধ করেন। স্যাভয়ের ইউজিন কাহলেনবার্গে তুর্কিদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত হামলায় নেতৃত্ব দেন। হ্যাবসবার্গকে সহায়তাদানে তিনি মহিলার ছদ্মবেশে পারিসে পালিয়ে যান। তিনি অটোমান সৈন্যবাহিনীকে ধাওয়া করেন এবং বেলগ্রেডের কাছে জিন্টায় তিসা নদী অতিক্রম করার সময় তাদের ওপর হামলা চালান। বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শেষ হয়। ২০ হাজার অটোমান সৈন্য নিহত এবং সরবরাহ ও রসদ বোঝাই ৯ হাজার ঘোড়ার গাড়ি, ৬ হাজার উট এবং নগদ ৩০ লাখ রৌপ্যমুদ্রা ফেলে অবশিষ্টরা পালিয়ে যায়। তুর্কি ঐতিহাসিক এ বিপর্যয়কে একটি দুর্যোগ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। অটোমান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এতবড় বিপর্যয় আর কখনো ঘটেনি। ভিয়েনায় দ্বিতীয় পরাজয় ছিল অটোমান সৈন্যবাহিনীর জন্য একটি নয়া অভিজ্ঞতা। এ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে তাদের দুর্বলতা ও শোচনীয় অবস্থা প্রকাশ হয়ে পড়ে। তারপর একে একে বিপর্যয় ঘটতে থাকে। ইউরোপীয়রা খ্রিস্টান ভূখ- মুক্ত করতে সক্ষম হয় এবং অটোমান ও মুসলিম ভূখ-ে অগ্রযাত্রা করে। রাশিয়া মধ্য এশিয়া দখল করে নেয়। পর্তুগীজরা  দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে এবং বহু মুসলিম বাণিজ্যিক রুট দখল করে। ভিয়েনায় দ্বিতীয় পরাজয় যুদ্ধের একটি নয়া যুগের সূচনা করে। এ যুদ্ধ ১৬৮৩ থেকে ১৬৯৯ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এ সময়কে বলা হয় ‘গ্রেট রিট্রিট।’ হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্য একটি নিয়মিত সৈন্যবাহিনী গঠন করায় ১৬৯৯ সালের মধ্যে হাঙ্গেরী ও সার্বিয়া থেকে অটোমানদের বিদায় নিতে হয়। হ্যাবসবার্গের নিয়মিত সৈন্যবাহিনী সমান শক্তিতে অটোমানদের মোকাবিলা করে এবং এ সৈন্যবাহিনী হাঙ্গেরী ও পূর্ব ইউরোপে তুর্কিদের কাছে হারানো ভূখ- পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়। 
   ১৬৯৯ সালে স্বাক্ষরিত কার্লোভিজ চুক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় যে, অটোমান সাম্রাজ্য আর কোনো আক্রমণকারী শক্তি নয়। অথচ এ চুক্তির আগ পর্যন্ত এ সাম্রাজ্য তিন শো বছরের অধিক ইউরোপের খ্রিস্টান শক্তিকে ভীতিসন্ত্রস্ত করে রেখেছিল। তখন থেকে অটোমান সাম্রাজ্যকে শক্তিশালী খ্রিস্টান ইউরোপের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়। হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্য ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রধান ইউরোপীয় শত্রু। রুশ জার সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি তুরস্কের বিরুদ্ধে হ্যাবসবার্গের লড়াইয়ে নেতৃত্ব গ্রহণ করে। রুশ জাররা অটোমান রাজধানী কন্সটান্টিনোপলের প্রাচীর কৃষ্ণসাগরে প্রবেশ করতে চাইছিলেন। দুশো বছর লড়াই শেষে রুশ নৌবহর ১৭৭০ সালের জুলাইয়ে চেসমা যুদ্ধে অটোমান নৌবহর ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয় এবং রুশ সৈন্যবাহিনী অটোমান সৈন্যবাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। পরবর্তী দুই শতাব্দী ক্রমান্বয়ে অটোমান সাম্রাজ্যের সীমান্ত সংকুচিত হয়। রাশিয়া নিস্তার নদীর পশ্চিমে তার সীমান্ত সম্প্রসারণ করে।        
   ১৭১৮ সালের মধ্যে অস্ট্রীয়রা হাঙ্গেরী থেকে তুর্কিদের তাড়িয়ে দেয়। কফির বস্তা ফেলে রেখে তুর্কিরা পিছু হটে। অস্ট্রীয়রা আনন্দের সঙ্গে কফি পান করে। তারই সূত্র ধরে বিখ্যাত ভিয়েনা কফি হাউজ গড়ে ওঠে। ভিয়েনা অবরোধ ব্যর্থ হওয়ার পর অটোমান সাম্রাজ্যকে তুলনামূলকভাবে লঘু হুমকি এবং শক্তিশালী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গণ্য করা হয়। তুর্কি প্রভাব ইউরোপীয় ফ্যাশনে রূপান্তরিত হয় এবং হাইডিন, মোর্জাট ও বিটোফেনের মতো অমর সঙ্গীতজ্ঞরা তাদের সঙ্গীতে তুর্কি সুর গ্রহণ করেন।
    ভিয়েনায় দ্বিতীয় পরাজয়ের মধ্য দিয়ে তুর্কিদের মধ্যে আত্মজিজ্ঞাসার একটি নয়া যুগের সূচনা হয়। তারা তাদের নিজস্ব বিধি বিধানের যৌক্তিতকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং পাশ্চাত্যের ধ্যান ধারণা ও রীতি নীতির প্রতি আরো আগ্রহ দেখাতে শুরু করে এবং সেসব রীতি নীতি অনুকরণ করতে থাকে। রক্ষণশীলরা  এ আন্দোলন প্রতিহত করার চেষ্টা করে। তখন উভয়পক্ষ একমত হয় যে, মূলত প্রযুক্তিতে ইউরোপীয় সংস্কৃতি ধার করা হবে। অটোমানরা রেনেসাঁ ও শিল্প বিপ্লব হাতছাড়া করে এবং প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে পাশ্চাত্যের পেছনে পড়ে যায় এবং গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ লাইনে সমাজ গঠনে ব্যর্থ হয়। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে অটোমান অস্ত্র ও শিল্প কলকারখানা ছিল সেকেলে। অটোমান শহরগুলোতে প্লেগ ও দুর্ভিক্ষ দেখা দিতো। অন্যদিকে ইউরোপীয় শহরগুলোতে পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা ছিল এবং এসব রোগ নির্মূল করা হচ্ছিল। ইউরোপীয়রা তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি করছিল। তারা ব্যবসা ও শিল্প থেকে অর্জিত অর্থ শক্তিশালী সামরিক বাহিনী ও অর্থনীতি গঠনে ব্যবহার করছিল। পক্ষান্তরে অটোমানরা পুরনো ধাঁচের কৃষিভিত্তিক সমাজে বসবাস করছিল। অটোমান সাম্রাজ্য প্রাথমিকভাবে বাষ্পীয় ইঞ্জিন, রেলরোড, টেলিগ্রাফ, কলকারখানা ও মেশিনগান ব্যবহার করতে জানতো না। তবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় অটোমানরা দেখতে পায় যে, তারা অনেক পেছনে পড়ে গেছে। অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণ ও বিজ্ঞান বিষয়ক পরামর্শ দানে ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ দেয়া হয়। জেনিসারি ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা শুরু হয়। সামরিক স্কুলগুলোতে ইউরোপীয় ধাঁচে গণিত, বিজ্ঞান ও ভূগোল শিক্ষাদান করা হয়। ১৭২৮ সালে তুরস্কে প্রথম মুদ্রণ যন্ত্র স্থাপন করা হয়।

ইউরোপে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন
ভিয়েনা অবরোধ ছিল ইউরোপে অটোমান সাম্রাজ্যের ক্ষমতার সর্বোচ্চ চূড়া এবং এ অভিযান ব্যর্থ হলে অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তি পুনরায় হাঙ্গেরী দখলের সুযোগ পায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে অটোমান সাম্রাজ্যকে পারস্য, পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার সঙ্গে অনবরত যুদ্ধ করতে হয়। অবমাননাকর কুচুক-কায়নারজা চুক্তির মধ্য দিয়ে ১৭৬৮-৭৪ সালের রুশো-অটোমান যুদ্ধের অবসান ঘটে। এ চুক্তিতে অটোমান কেন্দ্রীয় সরকারকে ক্রিমিয়ায় তাতার খানাত পরিত্যাগ করতে হয়, দানিয়ুব অঞ্চলের প্রদেশগুলোকে স্বায়ত্তশাসন মঞ্জুর, অটোমান জলসীমায় অবাধে রুশ জাহাজ চলাচলের সুযোগ এবং রাশিয়াকে বিপুল পরিমাণ যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। ১৮৫৩ সালে রাশিয়ার প্রথম জার অটোমান সাম্রাজ্যকে ‘ইউরোপের রুগ্ন ব্যক্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ১৮২১-৩২ সালে গ্রীসের স্বাধীনতা যুদ্ধে ইউরোপ হস্তক্ষেপ করে। ১৮২৭ সালে একটি অ্যাংলো-ফরাসি নৌবহর নাভারিনো যুদ্ধে অটোমান ও মিসরীয় নৌবহরকে ধ্বংস করে দেয়। অন্যদিকে ১৮২৯ সালে যুদ্ধবিরতির আগে রুশ সৈন্যবাহিনী এডিরনি পর্যন্ত এগিয়ে আসে। ইউরোপীয় শক্তিবর্গ গ্রীসের স্বাধীনতা মেনে নিতে অটোমান কেন্দ্রীয় সরকারকে বাধ্য করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে রুশ জার পিটার দ্য গ্রেট রাশিয়ার একটি দীর্ঘস্থায়ী পররাষ্ট্রনীতি ঘোষণা করেন। অটোমান সাম্রাজ্যের ভূখ- গ্রাস করে উষ্ণ পানির বন্দরে পৌঁছানো ছিল তার পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য। পিটার দ্য গ্রেট প্রথমেই কৃষ্ণসাগরের উত্তর উপকূলে অটোমান উপস্থিতি নির্মূলে অগ্রসর হন। প্রথমে কৃষ্ণসাগরের উষ্ণ পানির বন্দরে পৌঁছানো এবং পরে অটোমান নিয়ন্ত্রিত দার্দানেলিস ও বফফোরাস প্রণালীর মধ্য দিয়ে ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ রাশিয়ার মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। অটোমান সাম্রাজ্যের কাছ থেকে ভৌগোলিক সুবিধা আদায় করতে সক্ষম হলেও রাশিয়া এ লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়নি। কৃষ্ণসাগর ‘অটোমান হ্রদ’ হিসেবে বজায় থাকে। এ সাগরে রুশ জাহাজ চলাচল নিষিদ্ধ ছিল। পরবর্তী দুই শতাব্দী রাশিয়া অটোমান শক্তি ধ্বংসে যুদ্ধের পর যুদ্ধ করে। রাশিয়া ও খ্রিস্টান হলি লীগ দীর্ঘ ১৬ বছর যুদ্ধ করে অটোমানদের দানিয়ুবের দক্ষিণে এবং কার্পেথিয়ানের পূর্বদিকে হটিয়ে দেয়। ১৬৯৯ সালে স্বাক্ষরিত কার্লোভিজ চুক্তিতে অটোমানরা প্রথম পরাজয় স্বীকার করে এবং অস্ট্রিয়ার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হাঙ্গেরী, ট্রান্সিলভানিয়া ও ক্রোয়েশিয়া ছেড়ে দেয়। পোল্যান্ড পোডলিয়া ও ডালমাটিয়া পুনরুদ্ধার করে এবং ভেনিসের কাছে মোরিয়া ছেড়ে দেয়া হয়। পরবর্তী বছর অন্য একটি শান্তিচুক্তিতে রাশিয়া আজোভ অঞ্চল লাভ করে। ১৭৭৪ সালে কুচুক-কায়নারজা চুক্তির মাধ্যমে রুশ জাহাজ অটোমান জলসীমার মধ্য দিয়ে চলাচলের অধিকার পায়।
   
লিপান্টো যুদ্ধ 
ষোড়শ শতাব্দীতে পৃথিবীতে পরাশক্তি ছিল দুটি। পশ্চিমে স্পেন এবং প্রাচ্যে অটোমান তুরস্ক। ১৫৭১ সালে লিপান্টো যুদ্ধে এ দুটি পরাশক্তি একে অন্যকে মোকাবিলা করে। যুদ্ধে স্পেনীয় নৌবহর অটোমান নৌবহরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ভেনিস, পোপের রাজ্য ও অস্ট্রিয়ার নৌবহর স্পেনীয় নৌবহরকে সহায়তা করে। ১৫৭০ সালে তুর্কিরা সাইপ্রাস আক্রমণ করলে লিপান্টোর যুদ্ধ হয়। সাইপ্রাস রক্ষায় ভেনিসীয়রা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে অন্যান্য খ্রিস্টান রাষ্ট্রগুলোর সহায়তা কামনা করে। এসব রাষ্ট্র ভেনিসের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও পোপ পঞ্চম পায়াসের উৎসাহে মুসলিম তুর্কিদের বিরুদ্ধে হলি লীগের আওতায় ক্রুসেডে ঐক্যবদ্ধ হয়। লিপান্টো যুদ্ধ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ইতিহাসে বৃহত্তম নৌযুদ্ধ। ১৫৭১ সালের ৭ অক্টোবর আড্রিয়াটিক সাগরে গ্রীসের অদূরে লিপান্টোতে এ যুদ্ধ হয়। সম্মিলিত খ্রিস্টান বাহিনীতে অস্ট্রিয়ার ডন জনের নেতৃত্বে সৈন্য ছিল ৮৪ হাজার, ২ শো গ্যালে, ৬টি গ্যালিউস                    এবং অসংখ্য ক্ষুদ্র নৌযান। আলী পাশার কমান্ডে তুর্কিদের জাহাজ ছিল ২৯০টি এবং সৈন্য ৮৮ হাজার। অধিকাংশ নৌযান ছিল গ্যালিয়ট। ডন জন ছিলেন স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের জারজ বৈমাত্রেয় ভাই। মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। তিনি অস্ত্রভা-ার থেকে লোহার ভারি চঞ্চু অপসারণ করেন এবং জাহাজের অগ্রভাগে পাঁচটি কামান বসান। অন্যদিকে তুর্কিরা তাদের জাহাজে চঞ্চুগুলো বজায় রাখে এবং তাদের জাহাজের অগ্রভাগে কামান ছিল মাত্র তিনটি। চূড়ান্ত যুদ্ধ মাত্র চার ঘণ্টা স্থায়ী হয়। দুটি নৌবহর অর্ধচন্দ্রাকারে একে অন্যকে মোকাবিলা করে। ইউরোপীয়রা তিনটি গ্যালিউস নিয়ে অগ্রসর হয়। প্রতিটি গ্যালিউস একটি করে স্কোয়াড্রনের নেতৃত্ব দিচ্ছিল। তুর্কি জাহাজগুলো এগিয়ে আসার চেষ্টা করলে উন্নততর ইউরোপীয় কামানের গোলার মুখে পড়ে। তবে তুর্কি জাহাজগুলো ইউরোপীয় জাহাজের কাছাকাছি পৌঁছতে সক্ষম হয়। দুঘণ্টা লড়াইয়ে তুর্কিদের বামপাশ ও মধ্যভাগ ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু লড়াই আরো দুঘণ্টা অব্যাহত থাকে। মাল্টার নাইটরা এডমিরাল সুফি আলী পাশার একটি পতাকা দখল করে। সুলতান দ্বিতীয় সেলিম আলী পাশার হাতে এই বিশাল সবুজ পতাকা তুলে দিয়েছিলেন। কালেমা শাহাদাৎ খচিত এ পতাকায় সোনালী ক্যালিগ্রাফিতে আল্লাহর নাম লেখা ছিল ২৮ হাজার ৯ শো বার। ইসলামের এ সবুজ পতাকা উপহার দেয়া হয় স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপকে। এখনো এ পতাকা ইতালির পিসার একটি গির্জায় প্রদর্শন করা হয়।

লিপান্টো যুুদ্ধের ফলাফল
মোট ১১৭টি তুর্কি জাহাজ আটক এবং আরো ৮০টি জাহাজ ধ্বংস হয়। অন্যদিকে ইউরোপীয়রা হারায় ১২টি জাহাজ এবং সাড়ে ৭ হাজার সৈন্য। অটোমান সৈন্য নিহত হয় ৩০ হাজারের অধিক। তাদের অধিকাংশ নিহত হয় স্পেনীয় মাস্কেটিয়ার ও আর্কুবাশিয়ারদের গুলিতে। অটোমানদের পিছু হটার সময় স্পেনীয় আর্কুবাশিয়াররা তাদের ওপর হামলা চালায়। ১২ হাজারের বেশি খ্রিস্টান দাসকে মুক্ত করা হয়। খ্রিস্টানদের এ বিজয়ে তুর্কি নৌবাহিনী ধ্বংস এবং ইউরোপে অটোমান অগ্রযাত্রা বন্ধ হয়ে যায়। তুর্কিদের অজেয় ভাবমূর্তি ধূলিসাৎ হয়ে যায়। অটোমান দিগি¦জয়ের অবসান ঘটে এবং এ সাম্রাজ্যের  সাড়ে তিন শো বছরের দীর্ঘ অবনতির সূচনা হয়। এ যুদ্ধে প্রমাণিত হয় যে, ইউরোপীয় শক্তিগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে সক্ষম। তার আগে বিগত চার শো বছর তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। ক্রীট বিজয় ছিল অটোমানদের শেষ বিজয়। ১৬৩৬ সালে অটোমানদের ইয়েমেন থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। পঞ্চদশ শতাব্দীতে অটোমানরা আর কখনো কোনো নৌযুদ্ধে পরাজিত হয়নি। বিপর্যয়ের জন্য তারা নিজেদের কৃতকর্মকে দায়ী করে। সমসাময়িক ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেন যে, অটোমান শাহী নৌবহর অভিশপ্ত কাফেরদের নৌবহরকে মোকাবিলা করে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্যরকম। হলি লীগ তাদের বিজয়কে কাজে লাগাতে পারেনি। অটোমানদের বিপর্যয়কে একটি ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এতে অটোমানদের ভৌগোলিক সম্প্রসারণে স্থবিরতা নেমে আসে। লিপান্টোতে খ্রিস্টানদের বিজয় কার্যত ভূমধ্যসাগরের বিভক্তিকে নিশ্চিত করে। পূর্বাংশ ছিল অটোমানদের শক্ত নিয়ন্ত্রণে এবং পশ্চিমাংশ হ্যাবসবার্গ ও তাদের ইতালীয় মিত্রদের নিয়ন্ত্রণে। ইতালীয় ভূখ-ে অটোমান অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়। লিপান্টো যুদ্ধের আগে অটোমানরা যেসব ভূখ- দখল করে নিয়েছিল, হলি লীগ সেসব ভূখ- পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। লিপান্টোর যুদ্ধে এ বিজয় ছিল স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এ বিজয় তুর্কিদের স্পেনীয় ভূখ-ে অনুপ্রবেশ করা থেকে বিরত রাখে এবং স্পেন নয়া বিশ্বে (আমেরিকা মহাদেশ) অবাধ লুণ্ঠনের সুযোগ পায়।

অটোমান সাম্রাজ্যকে দুর্বল করার চেষ্টা
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্রিটিশ, ফরাসি ও ইতালীয় সাম্রাজ্যবাদ, গ্রীস ও বলকান জাতীয়তাবাদ, অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার আগ্রাসন, অটোমান সহিষ্ণুতা এবং আধুনিকায়নে তাদের ব্যর্থতায় অটোমান সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে যায়। ১৮৭৮ সালে বার্লিন সম্মেলনে সাবেক অটোমান ভূখ- বুলগেরিয়া, রুমানিয়া ও সার্বিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। একই সময় সাইপ্রাস ও মিসর দখল করে ব্রিটেন এবং আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়া দখল করে ফ্রান্স। ১৮৮২ সালে অটোমান ভূখ- মিসরে ব্রিটিশের দখলদারিত্ব শুরু হয়। ইউরাবি বিদ্রোহ দমনে অটোমন সরকারকে সহায়তাদানের অজুহাতে ব্রিটেন মিসরে সৈন্য পাঠায়। এসব ভূখ- খোয়া যাওয়ায় অটোমান সাম্রাজ্যের আয়তন আরো সংকুচিত হয়। সময়ের পরিক্রমায় স্থানীয় পাশাদের নিয়ন্ত্রিত শরিয়াহ আদালত দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে যায়। ইউরোপীয়রা অটোমান শাসনকে অতিমাত্রায় ইসলামি এবং মুসলমানরা অতি ইউরোপীয় হিসেবে আখ্যায়িত করে।  মাদ্রাসা বিদ্রোহ করতে শুরু করে। সামরিক বাহিনী ক্রমশ বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। ইউরোপীয়দের প্রতিযোগিতায় ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামে। বল্গাহীন দুর্নীতি শুরু হয় এবং ধনীরা আরো ধনী এবং দরিদ্ররা আরো দরিদ্র হয়। সুলতানরা আর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না। তার ক্রমশ প্রজাদের সান্নিধ্য থেকে দূরে সরে যান। তাদের সার্মথ্য ও ক্ষমতার ক্রমবর্ধমান ঘাটতি ছিল সাম্রাজ্যের অবনতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সরকার পরিচালনা করতেন মূলত উজিররা। সামরিক বাহিনী ও প্রশাসনে মেধা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে এবং অযোগ্যরা পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন। 
সূএঃ ইন্টারনেট 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্য

 

১৯১৪ সালের ২৯ অক্টোবর কৃষ্ণসাগরের রুশ উপকূলে আকস্মিক অটোমান নৌহামলার মধ্য দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্য যোগদান করে।  কৃষ্ণসাগরের উপকূলে ওডেসায় গোলাবর্ষণের জবাবে রাশিয়া ১৯১৪ সালের পহেলা নভেম্বর অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ৫ নভেম্বর রাশিয়ার মিত্র ব্রিটেন ও ফ্রান্স যুদ্ধ ঘোষণা করে। কোনো বৃহৎ শক্তির সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে জোটবদ্ধ না থাকায় অটোমান হামলার তাৎক্ষণিক কারণ স্পষ্ট হয়নি। কৃষ্ণসাগরীয় উপকূলে গোলাবর্ষণের সিদ্ধান্ত লাখ লাখ অটোমানকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় এবং পর্যায়ক্রমে এ সাম্রাজ্যের পতন ডেকে আনে এবং অটোমান সালতানাতের বিলুপ্তি ঘটে। দুটি কারণে অটোমান সাম্রাজ্য সেন্ট্রাল পাওয়ার্সের পক্ষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করে। এক: জার্মানির চাপ এবং দুই: অটোমান যুদ্ধমন্ত্রী আনোয়ার পাশার চক্রান্ত। অন্য কারণগুলোর মধ্যে ছিল যুদ্ধের প্রাথমিক দিনগুলোতে জার্মানির বিজয় এবং ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের সঙ্গে তুরস্কের বিবাদ। তুরস্ককে শত্রুর সঙ্গে যোগদান করা থেকে বিরত রাখা এবং রুমানিয়া ও বুলগেরিয়াকে সেন্ট্রাল পাওয়ার্সের সঙ্গে যোগদানে উৎসাহিত করা ছিল জার্মানির লক্ষ্য। তুরস্কে নিযুক্ত জার্মান সামরিক মিশন প্রধান জেনারেল অটো লিমান ভন স্যান্ডার্স তুরস্ক-জার্মান জোট গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।    

পটভূমি
ইয়াং টার্ক মুভমেন্ট সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদকে অটোমান পার্লামেন্ট পুনরুজ্জীবিত এবং ১৮৭৬ সালের সংবিধান পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বাধ্য করে। ১৮৭৮ সালে সুলতান আবদুল হামিদ পার্লামেন্ট ও প্রথম সাংবিধানিক শাসন স্থগিত রাখেন। ইয়াং টার্ক মুভমেন্ট কার্যকরভাবে দ্বিতীয় সাংবিধানিক শাসন চালু করে এবং গোপনে তৎপরতা চালানোর সময় তারা তাদের নিজস্ব দল গঠন করে। এসব দলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কমিটি অব ইউনিয়ন অব প্রোগ্রেস (সিইউপি) এবং লিবারেল ইউনিয়ন (এলইউ) নামে পরিচিত ফ্রিডম এন্ড একর্ড পার্টি। ১৯০৮ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সিইউপি বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ঐতিহ্যবাহী অটোমান সৈন্যবাহিনীকে সংস্কার করে তাকে একটি আধুনিক বাহিনীতে রূপান্তরিত করা হয়। এ বাহিনী প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এসময় অটোমান সৈন্যবাহিনী ১৯১১ সালে ইতালি-তুর্কি যুদ্ধ, ১৯১২-১৩ সালে বলকান যুদ্ধ এবং কয়েকটি বিদ্রোহ ও সাম্রাজ্যের অব্যাহত রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে। ১৯০৯ সালে একবার এবং ১৯১২ সালে দ্বিতীয়বার অভ্যুত্থান ঘটে। দ্বিতীয় অভ্যুত্থানের পর ১৯১৩ সালে অটোমান সাবলাইম পোর্টিতে (সদরদপ্তর) হামলা হয়। অতএব দেখা যাচ্ছে যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে অটোমান সৈন্যবাহিনী পূর্ববর্তী তিন বছর অব্যাহত লড়াইয়ে সম্পৃক্ত ছিল। 
  বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল বহুমাত্রিক। কোথাও কোনো একটি একক রাষ্ট্র অথবা দুই তিনটি রাষ্ট্র আধিপত্য বিস্তার করেনি। বিশ্ব রাজনীতি বহুমাত্রিক হওয়ায় অটোমানরা এক রাষ্ট্রকে অন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঠেলে দিতে পারতো। ঐতিহাসিক মাইকেল র‌্যানল্ডস বলেছেন, অটোমানরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এ কৌশল ব্যবহার করেছে। জার্মানি সুলতান আবদুল হামিদের সরকারকে সমর্থন করতো এবং এ সমর্থনের বিনিময়ে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে। প্রাথমিকভাবে সিইউপি ও এলইউ ব্রিটেনের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। অটোমান সাম্রাজ্য জার্মানি ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ব্রিটেনকে সন্তুষ্ট করে পোর্টির জন্য বৃহত্তর সুবিধা অর্জনের আশা করছিল। 
    অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরী বসনিয়া ও হারজেগোভিনা দখল করে নিলে দেশটির মিত্র জার্মানির প্রতি বৈরিতা বৃদ্ধি পায়। সিইউপিপন্থী তানিন এতদূর পর্যন্ত উল্লেখ করে যে, সাংবিধানিক সরকার উৎখাত করাই ভিয়েনার এসব কার্যকলাপের অভিপ্রায়। দুটি দেশের মধ্যে সম্ভাব্য সহযোগিতার বিষয় নিয়ে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার এডওয়ার্ড গ্রে ও স্যার চার্লস হার্ডিঞ্জের সঙ্গে আলোচনার জন্য সিইউপির দুজন শীর্ষ নেতা আহমদ রিজা ও ড. নাজিমকে লন্ডনে পাঠানো হয়। আলোচনায় জোট গঠনের ব্যাপারে স্যার এডওয়ার্ড গ্রে বলেন, অন্য দেশের সঙ্গে আঁতাত ও বন্ধুত্ব করলেও হাত স্বচ্ছ রাখাই আমাদের নীতি। এটা সত্যি যে, জাপানের সঙ্গে আমরা জোট গঠন করেছি। তবে এ জোট দূরপ্রাচ্যে কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অটোমান প্রতিনিধিদল জবাবে বলেন, এ সাম্রাজ্য হলো দূরপ্রাচ্যের জাপান। আপনাদের সঙ্গে আমাদের সাইপ্রাস চুক্তি হয়েছে। এ চুক্তি এখনো বহাল। 
    বলকান যুদ্ধ শেষ হলে সিইউপি বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, কেবলমাত্র ব্রিটেনের সঙ্গে একটি জোট বা আঁতাত অটোমান সাম্রাজ্যের অবশিষ্টাংশের অস্তিÍত্ব রক্ষার নিশ্চয়তা দিতে পারে। এ ধরনের জল্পনা কল্পনার জবাবে ১৯১৪ সালে পোর্টিতে নিয়োজিত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার লুই ম্যালেট বলেন, আমাদের সঙ্গে একটি জোট গঠন অথবা ত্রিপক্ষীয় আঁতাতে যোগ দেয়া হচ্ছে তুরস্কের স্বাধীনতা রক্ষার একমাত্র উপায়। তবে আমি মনে করি, তুরস্কের স্বাধীনতা ও ভৌগোলিক অখ-তার প্রতি সকল বৃহৎ শক্তির সম্মান প্রদর্শনে একটি চুক্তি স্বাক্ষর কিংবা ঘোষণা হচ্ছে কম ঝুঁকিপূর্ণ পন্থা। দেশটি নিরপেক্ষতা রক্ষা করবে এবং অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ ও সংস্কার সাধনে বৃহৎ শক্তিগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে। 
   সিইউপি এ প্রস্তাবে সম্মত হতে পারেনি। অটোমানদের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় শক্তিগুলো বলকান যুদ্ধে পক্ষপাতমূলত আচরণ করায় তারা তাদের প্রতি আস্থা রাখতে পারেনি। অটোমানরা বিশ্বাস করতে পারেনি যে, ইউরোপীয়রা  অটোমান সাম্রাজ্যের স্বাধীনতা ও ভৌগোলিক অখ-তা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে। সম্ভবত স্যার লুই ম্যালেট এ সত্য পুরোপুরি বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিলেন। তার পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করার পেছনে যুক্তি ছিল। বিগত শতাব্দীগুলোতে ইউরোপের বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে বড় ধরনের যুদ্ধ হয় খুব কম। তবে তাদের মধ্যে ‘গ্রেট গেইম’ নামে একটি গোপন প্রতিযোগিতা চলছিল। উত্তেজনা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যে, তা মীমাংসা করার প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৯০৭ সালে স্বাক্ষরিত অ্যাংলো-রুশ চুক্তিতে তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয় এবং সীমান্ত চিহ্নিত হলে পারস্য ও আফগানিস্তানে তাদের নিজ নিজ নিয়ন্ত্রণ জোরদার হয়। এ চুক্তি ত্রিপক্ষীয় আঁতাত গঠনে একটি অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। এ চুক্তির মধ্য দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়ে যায়। 

রাশিয়ার অবস্থান 
রাশিয়ার অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ দ্রুত অস্বস্তিদায়কভাবে অটোমান প্রণালীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। রাশিয়ার রপ্তানি বাণিজ্যের এক-চতুর্থাংশ পণ্য পরিবহন করা হতো দুটি অটোমান প্রণালীর মধ্য দিয়ে। ইয়াং টার্ক মুভমেন্ট এবং ১৯০৯ সালে পাল্টা অভ্যুত্থানের মতো বিশৃঙ্খলার সময় রাশিয়া ইস্তা¤ু^লে সৈন্য পাঠানোর বিষয় বিবেচনা করছিল। ১৯১৩ সালের মে’তে জার্মান সামরিক মিশন জেনারেল অটো লিমান ভন স্যান্ডার্সকে অটোমান সৈন্যবাহিনীকে প্রশিক্ষণদানের দায়িত্ব দেয়। জার্মানির এ উদ্যোগ ছিল সেন্ট পিটার্সবার্গের কাছে অসহ্য। প্রতিশোধ গ্রহণে রাশিয়া কৃষ্ণসাগরীয় বন্দর ট্রাবজোন অথবা পূর্বাঞ্চলীয় আনাতোলিয়ার বায়েজীদ শহরে হামলা এবং দখল করার পরিকল্পনা উদ্ভাবন করে। তবে দেশটি তখন সম্ভাব্য পূর্ণাঙ্গ সামরিক অভিযানকে কোনো সমাধান হিসেবে দেখতে পায়নি। ইস্তা¤ু^লে নৌ আধিপত্য কায়েমের বিকল্প ছিল রুশ ককেশাস আর্মিকে পুনর্গঠন করা। নিজেদের সৈন্যবাহিনীকে সহায়তাদানে রাশিয়া অটোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে বিভিন্ন আঞ্চলিক গ্রুপের সঙ্গে স্থানীয় যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে। রুশরা দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয় যে, অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় পরিবহন সমস্যা মোকাবিলায় একযোগে কাজ করবে এবং সেনা ও নৌবাহিনীকে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হবে। উভচর অভিযানের সাফল্যের জন্য সৈন্য ও কামানের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। সৈন্য সমাবেশকালে এসব লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। রুশরা অটোমান সাম্রাজ্য পর্যন্ত ককেশাস রেলওয়ে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯১৩ সালে রাশিয়ার যুদ্ধ প্রস্তুতি শেষ হয়ে যায়। একই সময় রাশিয়া আর্মেনীয় সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের দাবি জানায়। 
 
বাগদাদ-বার্লিন রেলওয়ে 
ঐক্যবদ্ধ জার্মান সাম্রাজ্য অটোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান তৎপরতা দেখাতে থাকে। এসব তৎপরতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাগদাদ রেলওয়ে।  এ রেলওয়ে বাগদাদ-বার্লিন রেলওয়ে নামে পরিচিত। বাগদাদ থেকে জার্মানরা পারস্য উপসাগরে একটি বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা করে। এক হাজার ৬ শো কিলোমিটার দীর্ঘ এ রেলপথ আধুনিক তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরাকের সঙ্গে ইউরোপকে যুক্ত করে। এজন্য বসফোরাস প্রণালীতে একটি ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। রেলপথ নির্মাণে কয়েক দশক লাগে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনালগ্নে রেলপথ ছিল লক্ষ্যস্থল থেকে ৯৬০ কিলোমিটার দূরে। জার্মান ডয়েস ব্যাংক এবং ফিলিপ হোলসম্যান কোম্পানি এ রেলপথ নির্মাণের তহবিল, প্রকৌশল ও নির্মাণ ব্যয় বহন করে। এ রেলপথের মাধ্যমে অটোমান সাম্রাজ্য আরব উপদ্বীপে নিয়ন্ত্রণ বজায় এবং লোহিত সাগরের ওপারে খেদিভ শাসিত মিসরে প্রভাব সম্প্রসারণ করতে চেয়েছিল। এ রেললাইন নির্মাণ করে জার্মানি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে এবং অটোমান সাম্রাজ্য তাদের প্রতিদ্বন্দ্বি রাশিয়াকে মোকাবিলা করতে চেয়েছিল। বাগদাদ রেলওয়ে রাশিয়ার প্রতি হুমকি হয়ে দেখা দেয়। কেননা এতে ককেশাস ফ্রন্ট এবং উত্তর পারস্য পর্যন্ত জার্মানির অর্থনৈতিক প্রভাব সম্প্রসারিত হয়। ১৮৭২ সালে অটোমান সরকার তুরস্কে রেলওয়ে নির্মাণে জার্মান রেলওয়ে প্রকৌশলী উইলহেম ভন প্রেসেলকে নিয়োগ করে। ১৮৮৮ সালে ওয়াটেম্বারগিসি ভারেন্সব্যাঙ্কের ম্যানেজার আলফ্রেড ভন কুলা এবং ডয়েস ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক জর্জ ভন সিমেন্স একটি সিন্ডিকেট গঠন এবং তুরস্কের কাছ থেকে ছাড় পেলে কন্সটান্টিনোপল থেকে বাগদাদ পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। 
    ১৮৯২ সালের ডিসেম্বরে আঙ্কারা পর্যন্ত লাইন সম্পন্ন হলে এস্কিসেহিরে রেলওয়ে ওয়ার্কশপ নির্মাণ করা হয় এবং এস্কিসেহির থেকে কোনিয়া পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণে অনুমোদন নেয়া হয়। ১৮৯৬ সালের জুলাই নাগাদ এ লাইন নির্মাণ সম্পন্ন হয়। এ দুটি লাইন ছিল বাগদাদ রেলওয়ের প্রথম দুটি সেকশন। একই সময় জার্মানরা প্রকৌশলীরা হেজাজ রেলওয়ে নির্মাণ করে। অটোমান সাম্রাজ্য রেললাইনকে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর কামানের পাল্লার বাইরে রাখে। এজন্য আলেক্সান্ড্রেটা থেকে আলেপ্পো পর্যন্ত উপকূল এড়িয়ে যাওয়া হয়। ১৯০৩ সালের পর রাশিয়া, ফ্রান্স ও ব্রিটেনে গ্রেট বাগদাদ-বার্লিন রেলওয়ে নির্মাণে জার্মানির পরিকল্পনার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। কূটনৈতিক আপত্তি সত্ত্বেও ধীরে ধীরে রেললাইন নির্মাণ শুরু হয়। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বাধায় এ রেললাইন নির্মাণ সম্পন্ন হয়নি। ১৯১৩ সালে ব্রিটেন ও অটোমান সরকারের মধ্যে বাগদাদ রেলওয়ে নির্মাণ নিয়ে একটি চুক্তি হয়। চুক্তিতে বলা হয়, তুরস্কের এশীয় অংশে কোনো রেললাইন নির্মাণে বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না। ব্রিটিশ সরকার অনুমোদিত দুজন ব্রিটিশ প্রতিনিধিকে বাগদাদ রেলওয়ে কোম্পানির বোর্ডে রাখতে হবে। বসরায় রেললাইন নির্মাণ শেষ করতে হবে। ব্রিটিশ সরকারের সম্মতি ছাড়া বসরা থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত কোনো রেললাইন নির্মাণ করা যাবে না। ১৯১৪ সালের ১৫ জুন লন্ডনে অনুরূপ শর্তে অ্যাংলো-জার্মান চুক্তি হয়। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে এসব চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও কার্যকর হয়নি।      

জোট গঠন
১৯১৩ সালের ২২ জুলাই অটোমান যুদ্ধমন্ত্রী আনোয়ার পাশা কন্সটান্টিনোপলে নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত ব্যারন হ্যান্স ফ্রিহার ভন ওয়ানগেনহেইমের কাছে জার্মান-অটোমান জোট গঠনের প্রস্তাব দেন। তুরস্কের মূল্যবান কিছু দেয়ার নেই বিবেচনা করে জার্মানি এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। উজিরে আজম সৈয়দ হালিম পাশা অস্ট্রো-হাঙ্গেরী রাষ্ট্রদূতের কাছে অনুরূপ প্রস্তাব দেন। ১৯০৯ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত আনোয়ার পাশা সামরিক অ্যাটাশে হিসেবে বার্লিনে দায়িত্ব পালন করেন। তবে জার্মান সামরিক মিশন বিশেষ করে জেনারেল অটো লিমান ভন স্যান্ডার্সের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো ছিল না। তিনি তার সৈন্য ও সৈন্যবাহিনীর প্রতি আস্থা রাখেন এবং জার্মান সামরিক হস্তক্ষেপে গভীর অনুতপ্ত হন। জার্মানির সঙ্গে জোট গঠনে আনোয়ার পাশা ও সৈয়দ হালিম পাশার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে ১৯১৪ সালের জুলাইয়ে নৌমন্ত্রী কামাল পাশাকে প্যারিসে পাঠানো হয়। তিনি সামরিক পদক নিয়ে ইস্তাম্বুলে ফিরে আসেন। কিন্তু তিনি ফ্রান্সের সঙ্গে জোট গঠনে সক্ষম হননি। প্রাথমিকভাবে অটোমান সরকার বিশেষ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তালাত পাশা ব্রিটিশের সঙ্গে জোট গঠনের প্রতি সমর্থন দেয়। কিন্তু ব্রিটেন ইউরোপে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখে এবং জোট গঠনে সিইউপি’র প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
   ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই ব্রিটিশ ফার্স্ট লর্ড অব দ্য এডমিরাল্টি উইন্সটন চার্চিল তাদের শিপইয়ার্ডে নির্মাণাধীন দুটি অটোমান যুদ্ধহাজাজ অধিগ্রহণের নির্দেশ দেন। একটি যুদ্ধজাহাজ সুলতান উসমান-ই-ঈভেলের নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং জাহাজটি তুরস্কের উদ্দেশে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এ ধরনের অধিগ্রহণের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও ৩১ জুলাই ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার একটি বৈঠকে তুরস্ককে মূল্য পরিশোধের প্রস্তাব পাস হয়। ৩ আগস্ট অটোমান সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে দুটি জাহাজ জব্দ করার সিদ্ধান্ত অবহিত করা হয়। ইতিমধ্যে ২৯ জানুয়ারি থেকে তিন পাশা তাদের দুটি জাহাজ আটক হওয়ার কথা জানতে পেরেছিলেন। কেননা আনোয়ার পাশা জানতেন যে, ব্রিটেনের সঙ্গে তাদের জোট গঠন সম্ভব হবে না। তাই তিনি জার্মানির সঙ্গে নতুন করে জোট গঠনের চেষ্টায় তাদের কাছে ব্রিটেনে আটক দুটি জাহাজ বিক্রি করে দেয়ার প্রস্তাব দেন। জার্মানির কাছে আনোয়ার পাশার ২২ জুলাইয়ের প্রস্তাব নাকচ হয়ে যাবার পরও জার্মান কাইজার দ্বিতীয় উইলহেম জোট গঠনের সম্ভাবনা পুনর্বিবেচনার নির্দেশ দেন। ২৮ জুলাই নতুন করে আনোয়ার পাশা, তালাত পাশা ও সৈয়দ হালিম পাশার সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়। পহেলা আগস্ট দুটি দেশের মধ্যে গোপন প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে জার্মানি প্রতিশ্রুতি দেয় যে, অটোমান সাম্রাজ্য আক্রান্ত হলে জার্মানি তাকে রক্ষা করবে। আরো বলা হয়, অস্ট্রিয়ার সঙ্গে চুক্তির শর্ত পালনে জার্মানি যুদ্ধে যোগদান করলে তুরস্ক তার পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেবে। তবে বুলগেরিয়া যুদ্ধে যোগদান না করলে অটোমান সাম্রাজ্য যুদ্ধে যোগ দেবে না। ১৯১৪ সালের ২ আগস্ট অটোমান সাম্রাজ্য সাবির্ক সৈন্য সমাবেশের নির্দেশ দেয় এবং ঘোষণা করে যে, তারা যুদ্ধে নিরপেক্ষতা রক্ষা করবে। অটোমান কর্র্তৃপক্ষ আশা করছিল যে, চার সপ্তাহের মধ্যে সৈন্য সমাবেশ সম্পন্ন হবে। সৈয়দ হালিম পাশা জার্মানির সঙ্গে পরবর্তী আলোচনায় মিলিত হওয়ার আগে পরিস্থিতির ওপর নজর রাখার পক্ষপাতি ছিলেন। তিনি গ্রীস, রুমানিয়া ও বুলগেরিয়ার সঙ্গে আলোচনার ফলাফল দেখতে চাইছিলেন। সৈয়দ হালিম দুটি সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমত: তিনি জার্মান রাষ্ট্রদূতকে সামরিক বিষয়ে এবং জার্মান কমান্ডার জেনারেল লিমান ভন স্যান্ডার্সকে রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নির্দেশ দেন। দ্বিতীয়ত: তিনি ফরাসি ও রুশ রাষ্ট্রদূতদ্বয়ের সঙ্গে পুনরায় আলোচনার নির্দেশ দেন। ৯ আগস্ট আনোয়ার পাশা জেনারেল লিমান ভন স্যান্ডার্সকে ফার্স্ট আর্মির কমান্ডার পদে নিয়োগ করেন। রাশিয়া এ নিয়োগদানকে দার্দানেলিস ও বসফোরাস প্রণালীর প্রতিরক্ষা জোরদারের একটি উদ্যোগ হিসেবে ব্যাখ্যা করে। প্রকৃতপক্ষে জেনারেল স্যান্ডার্সকে ফার্স্ট আর্মিতে নিয়োগ দিয়ে তাকে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী অবস্থান থেকে দূরে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। আগস্টের মাঝামাঝি জেনারেল স্যান্ডার্স আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে অব্যাহতিদান এবং জার্মানিতে ফিরে যাবার অনুমতি প্রার্থনা করেন। তার স্টাফ ওডেসা যুদ্ধের তথ্য ফাঁস করে দিলে তিনি পুুরোপুরি বিস্মিত হন। ১৯১৪ সালের ৩ আগস্ট অটোমান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকার ঘোষণা দেয়। ৫ আগস্ট আনোয়ার পাশা রাশিয়াকে জানান, তিনি রুশ সীমান্ত বরাবর সৈন্য সংখ্যা হ্রাস এবং পূর্বাঞ্চলীয় থ্রেসে সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করতে চান।  
   ৯ আগস্ট সৈয়দ হালিম পাশা জার্মানদের অবহিত করেন যে, রুমানিয়া একটি ত্রিপক্ষীয় নিরপেক্ষ জোট গঠনে কন্সটান্টিনোপল ও এথেন্সের দারস্থ হয়েছে। ৬ আগস্ট রাত একটায় সৈয়দ হালিম পাশা জার্মান রাষ্ট্রদূত হ্যান্স ফ্রিহার ভন ওয়ানগেনহেইমকে তার অফিসে ডেকে পাঠান এবং তাকে অবহিত করেন যে, অটোমান মন্ত্রিসভা সর্বসম্মতিক্রমে জার্মান ব্যাটলক্রুজার গোয়েবেন এবং হাল্কা ক্রুজার ব্রেসলাউয়ের জন্য দুটি প্রণালী খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি এ দুটি জার্মান যুদ্ধজাহাজকে ধাওয়া করছিল। তারপর সৈয়দ হালিম পাশা জার্মান রাষ্ট্রদূত ওয়ানগেনহেইমের কাছে ৬টি প্রস্তাব পেশ করেন। জার্মান রাষ্ট্রদূত তৎক্ষণাৎ এসব প্রস্তাব গ্রহণ করেন।
(১) বিদেশি শক্তি বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে অটোমান সাম্রাজ্যের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বাতিলে সমর্থনদান।
(২) রুমানিয়া ও বুলগেরিয়ার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের আলোচনায় সমর্থনদান। 
(৩) যুদ্ধে জার্মানির কোনো শত্রু অটোমান ভূখ- দখল করে নিলে এসব ভূখ- ফিরিয়ে দেয়া নাগাদ জার্মানি শান্তি চুক্তি মেনে নেবে না।
(৪) গ্রীস যুদ্ধে যোগদান করলে এবং অটোমান সাম্রাজ্যের কাছে পরাজিত হলে তাকে এজিয়ান সাগরের দ্বীপগুলো অটোমানদের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।
(৫) মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রুশ আজারবাইজানের সঙ্গে সংযোগ সাধনে ককেশাসে অটোমান সীমান্ত পুনর্বিন্যাস করতে হবে।
(৬) যুুদ্ধের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।   
   পরবর্তীতে জার্মান সরকার এসব প্রস্তাব অনুমোদন করে। ১৯১৪ সালের ৯ আগস্ট আনোয়ার পাশা রুশ রাষ্ট্রদূত গায়ার্সের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদের আলোচনা এতদূর পর্যন্ত পৌঁছে যে, আনোয়ার পাশা সেদিনই অটোমান-রুশ জোট গঠনের প্রস্তাব দেন। আনোয়ার পাশার অবস্থান সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা  দুধরনের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। একদল বিশ্বাস করছেন, এ প্রস্তাব ছিল জার্মানির সঙ্গে জোট গোপন করার একটি অজুহাত। আরেকদল বিশ্বাস করছেন, আনোয়ার পাশা সৈয়দ হালিম পাশার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করছিলেন এবং এ সন্ধিক্ষণে তারা সাম্রাজ্যকে যুদ্ধের বাইরে রাখার একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে চাইছিলেন। একথা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, অটোমান সরকারের কেউ যুদ্ধে  যোগদানের পক্ষে ছিলেন না। যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে তারা বহু বিকল্প নিয়ে ভাবছিলেন।

অটোমান-বুলগেরিয়া জোট গঠন 
১৯১৪ সালের ১৯ আগস্ট প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রারম্ভিক মাসে সোফিয়ায় অটোমান-বুলগেরিয়া জোট গঠন করা হয়। সে সময় দুটি দেশ ছিল নিরপেক্ষ। অটোমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তালাত পাশা এবং অটোমান পার্লামেন্টের স্পীকার হালিল বে অটোমান সাম্রাজ্যের পক্ষে এবং প্রধানমন্ত্রী ভাসিল রাদোস্লাভ বুলগেরিয়ার পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। অটোমান সাম্রাজ্য ও বুলগেরিয়া একে অন্যের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করছিল। কেননা বলকান যুদ্ধে তারা উভয়ে ভূখ- হারিয়েছিল। গ্রীসের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল তিক্ত। এ অঞ্চলে সুবিধাজনক অবস্থান অর্জনে সহায়ক নীতি ছিল তাদের জন্য হিতকর এবং স্বাভাবিক। তুরস্ক যুদ্ধে যোগদান করলে এ চুক্তি বুলগেরিয়ার সেন্ট্রাল পাওয়ার্সের সঙ্গে যোগদানে একটি পূর্বশর্ত হতে পারতো। চুক্তিতে অনুচ্ছেদ ছিল ৭টি। চুক্তিটি ছিল পুরোপরি আত্মরক্ষামূলক। চুক্তিতে বলা হয়েছিল, কোনো বলকান দেশ স্বাক্ষরদানকারী কোনো দেশ আক্রমণ করলে অন্য দেশ যুদ্ধে যোগদান করবে। দুটি দেশ পারস্পরিক আলোচনা ছাড়া কোনো বলকান দেশ আক্রমণ না করতে সম্মত হয়। চুক্তির চতুর্থ অনুচ্ছেদে বুলগেরিয়ার ভূখ-ের মধ্য দিয়ে অন্য দেশ আক্রমণে অটোমান সৈন্যদের সুযোগ দেয়া হয়। পূর্বে আলোচনা ছাড়া যুদ্ধ বেধে গেলে তারা নিরপেক্ষতা রক্ষার অঙ্গীকার করে। বুলগেরিয়া তার ভূখ-ে যেকোনো ধরনের বিদেশি সৈন্য সমাবেশ সম্পর্কে তুরস্ককে অবহিত করার প্রতিশ্রুতি দেয়। চুক্তির পঞ্চম অনুচ্ছেদে তুরস্ক রুমানিয়াকে নিরপেক্ষ রাখার জন্য আলোচনা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। যুদ্ধ শেষ হওয়া নাগাদ চুক্তি গোপন রাখার অঙ্গীকার করা হয়। বুলগেরিয়ার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের পর অটোমানরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক জোট গঠনের চেষ্টা অব্যাহত রাখে। তবে তাদের চেষ্টা সফল হয়নি। ২২ আগস্ট উজিরে আজম সৈয়দ হালিম পাশা স্পষ্টাক্ষরে বলেন, অটোমান-জার্মান চুক্তি অনুযায়ী জার্মানির পাশাপাশি তার দেশ যুদ্ধে যোগদানে বাধ্য নয়। তিনি মন্ত্রীদের রুমানিয়া, রাশিয়া, গ্রীস ও ফ্রান্সের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। রুমানিয়ার সঙ্গে রুশ বিরোধী জোট গঠনের  আলোচনা ব্যর্থ হলে ৩০ আগস্ট অটোমানরা তাদের জার্মান মিত্রদের অবহিত করে যে, সার্বিয়া ও গ্রীসের বিরুদ্ধে বুলগেরিয়ার সঙ্গে জোট গঠন করা সম্ভব। জার্মানরা আপত্তি জানায়। কিন্তু অটোমানরা বুলগেরীয় জেনারেল স্টাফের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে একজন কর্নেলকে সোফিয়ায় পাঠায়। যুদ্ধে যোগদান করার পরও অটোমানরা ১৯১৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর নাগাদ জার্মানদের কাছে বুলগেরিয়ার সঙ্গে জোট গঠনের সত্যতা স্বীকার করেনি। ১৯১৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সোফিয়া চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়া নাগাদ বুলগেরীয়রা সেন্টাল পাওয়ার্সের পক্ষে যুদ্ধে যোগদানে সম্মত হয়নি। ১৯১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর অটোমান কেন্দ্রীয় সরকার একতরফাভাবে বিদেশি শক্তিগুলোকে প্রদত্ত সুবিধা বাতিল করে। ব্রিটিশ, ফরাসি, রুশ, ইতালীয়, অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় ও জার্মান রাষ্ট্রদূতরা একটি যৌথ প্রতিবাদলিপিতে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু একান্তভাবে অস্ট্রো-হাঙ্গেরী ও জার্মান রাষ্ট্রদূতদ্বয় অটোমান উজিরে আজম সৈয়দ হালিম পাশাকে অবহিত করেন যে, তারা এ ইস্যুতে চাপ প্রয়োগ করবেন না। পহেলা অক্টোবর অটোমান সরকার আবগারি শুল্ক উত্তোলন করে এবং সকল বিদেশি পোস্ট অফিস বন্ধ করে দেয়। ২৮ সেপ্টেম্বর তুরস্কের দুটি প্রণালীতে নৌচলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এ দুটি প্রণালী ছিল পশ্চিমা মিত্র ও মস্কোর মধ্যে বাণিজ্যিক যোগাযোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

যুদ্ধে যোগদান 
অটোমান নৌমন্ত্রী ও নৌবহরের কমান্ডার-ইন-চিফ আহমদ কামাল পাশা ব্রিটিশ সামরিক মিশনের মাধ্যমে ব্রিটিশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি অটোমান নৌবাহিনীর উন্নয়নে এ সম্পর্ক কাজে লাগান। ১৯১২ সাল থেকে এডমিরাল আর্থার লিম্পাস ব্রিটিশ সামরিক মিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ব্রিটিশ সামরিক উপদেষ্টারা ছিলেন মূলত নৌবাহিনীর। অটোমান নৌবাহিনীর ওপর তাদের প্রভাব ছিল সামান্য। ব্রিটেনের যুদ্ধে যোগদানের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের প্রেক্ষিতে ১৯১৪ সালের সেপ্টেম্বরে এডমিরাল আর্থার লিম্পাসকে প্রত্যাহার করা হয়। তাকে প্রত্যাহার করা হলেও অটোমান জাহাজগুলোতে ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীর রং ব্যবহার করা হতো এবং অফিসারদের পোশাক ছিল ব্রিটিশের মতো। এডমিরাল উইলহেম এন্টন সৌচন ভূমধ্যসাগরে কাইজারলিচি মেরিনের (জার্মান রাজকীয় নৌবাহিনী) নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। ব্যাটল ক্রুজার এসএমএস গোয়েবেন এবং হাল্কা ক্রুজার এসএমএস ব্রেসলাউয়ের সমন্বয়ে ভূমধ্যসাগরে জার্মান নৌবাহিনী গড়ে উঠেছিল। যুদ্ধের শুরুতে ভূমধ্যসাগরীয় ব্রিটিশ নৌবাহিনী জার্মান যুদ্ধজাহাজকে ধাওয়া করে। জার্মান যুদ্ধজাহাজ ব্রিটিশ নৌবহরকে এড়িয়ে যায় এবং ১৯১৪ সালের ৪ আগস্ট নিরপেক্ষ দেশ ইতালির মেসিনা বন্দরে গিয়ে ভিড়ে। ইতালীয় কর্তৃপক্ষ জোর দিয়ে জানায়, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জার্মান যুদ্ধজাহাজ বন্দর ছেড়ে গেছে। এডমিরাল সৌচন জানতে পারেন যে,  অস্ট্রো-হাঙ্গেরী ভূমধ্যসাগরে কোনো নৌসহায়তা প্রদান করবে না এবং অটোমান সাম্রাজ্য তখনো নিরপেক্ষ। এ পরিস্থিতিতে তার কন্সটান্টিনোপলের উদ্দেশে যাত্রা করা উচিত ছিল না। কিন্তু তিনি যেকোনোভাবে কন্সটান্টিনোপলের উদ্দেশে এগিয়ে যান।
    ১৯১৪ সালের ৬ আগস্ট রাত ১টায় অটোমান উজিরে আজম সৈয়দ হালিম পাশা জার্মান রাষ্ট্রদূত হ্যান্স ফ্রিহার ভন ওয়ানগেনহেইমকে তার অফিসে ডেকে পাঠান এবং তাকে অবহিত করেন যে, অটোমান মন্ত্রিসভা সর্বসম্মতিক্রমে জার্মান ব্যাটলক্রুজার গোয়েবেন এবং হাল্কা ক্রুজার ব্রেসলাউ এবং তাদের সঙ্গী অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় জাহাজের জন্য দুটি প্রণালী খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ৯ আগস্ট তিনি কল্পিত বিক্রির অজুহাতে গোয়েবেনকে তুরস্কের নিয়ন্ত্রণে হস্তান্তরের অনুরোধ করেন। জার্মান সরকার তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। কোনো ধরনের চুক্তি হওয়ার আগে ১০ আগস্ট জার্মান যুদ্ধজাহাজ দার্দানেলিসের প্রবেশমুখে পৌঁছে এবং আনোয়ার পাশা তাদের প্রণালীতে প্রবেশের অনুমতি দেন। উজিরে আজম আপত্তি করে বলেন, জার্মান যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি অকালীন এবং বুলগেরিয়ার সঙ্গে প্রয়োজনীয় চুক্তি হওয়ার আগে ত্রিপক্ষীয় জোট অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে। তিনি পুনরায় কল্পিত বিক্রির প্রস্তাব দেন।
   ব্রিটিশের চোখে ধূলো দিয়ে ১৯১৪ সালের ১১ আগস্ট এডমিরাল সৌচনের যুদ্ধজাহাজ কন্সটান্টিনোপলে এসে পৌঁছে। উইন্সটন চার্চিল জার্মান যুদ্ধজাহাজ পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে এক বিবৃতিতে বলেন, এডমিরাল সৌচন অনমনীয়তার সঙ্গে গ্রীক দ্বীপপুঞ্জের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। তিনি চেষ্টা করছিলেন যাতে দার্দানেলিসে তাকে ভিড়তে দেয়া হয়। তিনি দিনিউসায় ৩৬ ঘন্টা বিলম্ব করেন এবং কয়েকবার তার একমুখী ওয়ারলেস ব্যবহারে বাধ্য হন।
   ১৯১৪ সালের ১৬ আগস্ট কামাল পাশা গোয়েবেন এবং ব্রেসলাউয়ের আনুষ্ঠানিক কমিশনিংয়ে সভাপতিত্ব করেন। পুনরায় এ দুটি জার্মান যুদ্ধজাহাজের নামকরণ করা হয় যথাক্রমে ইয়াভুজ সুলতান সেলিম ও মিদিল্লি। জার্মান অফিসার ও নাবিকদের অটোমান নৌবাহিনীতে আত্মীকরণ করা হয়। নাবিকরা তুর্কি ফেজ টুপি পরিধান করে। ব্রিটেন অটোমান ড্রীডনট যুদ্ধজাহাজ আটক করায় অটোমানরা দেশে ব্যাপক প্রচার চালায় যে, তারা জার্মান যুদ্ধজাহাজ ‘ক্রয়’ করেছে। সে সময় অটোমান নৌবাহিনীতে এডমিরাল সৌচনের পদমর্যাদা কি ছিল তা স্পষ্ট নয়। বিদেশি একটি দেশের নৌবাহিনীতে জার্মান কমান্ডার হিসেবে তিনি ছিলেন জার্মান রাষ্ট্রদূত ওয়ানগেনহেইমের কমান্ডে। ১৯১৩ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে তুরস্কে জেনারেল অটো লিমান ভন স্যান্ডার্সের অধীনে একটি জার্মান সামরিক মিশন কাজ করছিল। এডমিরাল সৌচন জার্মান সামরিক মিশনের অংশ না হওয়ায় জেনারেল স্যান্ডার্সের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। এ পর্যায়ে সৈয়দ হালিম পাশা দেখতে পান যে, এডমিরাল সৌচন অথবা তার যুদ্ধাজাহাজ অটোমান নিয়ন্ত্রণে নেই। 
    ১৪ সেপ্টেম্বর আনোয়ার পাশা এডমিরাল সৌচনকে যুদ্ধজাহাজসহ কৃষ্ণসাগরে প্রবেশ এবং যেকোনো রুশ জাহাজে গোলাবর্ষণের নির্দেশ দেন। নৌমন্ত্রী আহমদ কামাল পাশাকে ডিঙ্গিয়ে ভারপ্রাপ্ত সি-ইন-সি আনোয়ার পাশা এ নির্দেশ দিয়েছিলেন। চেইন অব কমান্ডে এডমিরাল সৌচনের অবস্থান ছিল অস্পষ্ট। উজিরে আজম সৈয়দ হালিম পাশা যুদ্ধমন্ত্রী আনোয়ার পাশার নির্দেশ যাচাইয়ে মন্ত্রিসভায় একটি ভোটাভুটির আয়োজন করতে বাধ্য হন। ভোটাভুটিতে আনোয়ার পাশার নির্দেশ বাতিল হয়ে যায়। একই সময় এডমিরাল সৌচন প্রশিক্ষণ মহড়া পরিচালনা করতে চাইছিলেন। তিনি জার্মান রাষ্ট্রদূত ওয়ানগেনহেইমের কাছে অভিযোগ করেন। তিনি তাকে সরাসরি অটোমান সরকারের কাছে প্রস্তাব দেয়ার অনুমতি দেন। ১৮ সেপ্টেম্বর এ জার্মান এডমিরাল ও সৈয়দ হালিম পাশার মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।  সৈয়দ হালিম পাশা তার অনুরোধে অসন্তুষ্ট হন। 
   ১৫ সেপ্টেম্বর এডমিরাল লিম্পাস ব্রিটিশ নৌমিশন পরিত্যাগ করেন। প্রস্থানকারী ব্রিটিশ এডমিরালের ভূমিকা পালনে এডমিরাল সৌচনকে অনুরোধ করা হয়। সেপ্টেম্বরে দুটি তুর্কি প্রণালীর শক্তিবৃদ্ধি করতে এডমিরাল গাইডো ভন ইউজডোমের নেতৃত্বে ৭ শো নাবিক ও উপকূলীয় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি জার্মান নৌমিশন এসে পৌঁছে। এডমিরাল গাইডো ভন ইউজডোমের নেতৃত্বাধীন নৌমিশনের অনুকরণে এডমিরাল সৌচনকে অটোমান নৌবাহিনীতে এক বছর কমিশন লাভ করতে হয়। এ সময় তিনি কামাল পাশার সরাসরি নির্দেশের আওতায় কাজ করতেন। কৃষ্ণসাগরে জার্মানদের মহড়া না চালাতে নিষেধ করা হয়।
   ১৯১৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ভাইস এডমিরাল পদমর্যাদায় এডমিরাল সৌচনকে অটোমান নৌবাহিনীতে কমিশন দেয়া হয়। ভাইস এডমিরাল হিসেবে তিনি সরাসরি যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে পারতেন। অন্যদিকে জেনারেল লিমান ভন স্যান্ডার্স কখনো তার মর্যাদায় পৌঁছতে পারেননি। অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতি এডমিরাল সৌচনের আনুগত্য ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তবে তার মাধ্যমে জার্মানি অটোমান সশস্ত্র বাহিনীকে স্বাধীনভাবে ব্যবহারে সক্ষম হয়। এডমিরাল সৌচন ও তার যুদ্ধজাহাজগুলোকে সৈয়দ হালিম পাশা অটোমান নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আনতে সক্ষম হন। অটোমান সাম্রাজ্য ও এডমিরাল সৌচনের মধ্যে একটি অকার্যকর কমান্ডিং সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। নৌমন্ত্রী আহমদ কামাল পাশা যথার্থভাবে তার আত্মজীবনীতে এসব ঘটনা এড়িয়ে গেছেন। তিনি তার আত্মজীবনীতে ১২ থেকে ৩০ অক্টোবরের ঘটনাবলী উল্লেখ করেননি। 

কৃষ্ণসাগরে হামলা  
১৯১৪ সালের অক্টোবরে অটোমান নৌমন্ত্রী কামাল পাশা উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে প্রেরিত এক নির্দেশে বলেন, এডমিরাল সৌচন নির্দেশ জারির ক্ষমতা রাখেন। কামাল পাশা কেন এ নির্দেশ দিয়েছিলেন তা তিনি তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেননি। অটোমান নৌবাহিনীতে নি?

অটোমান সাম্রাজ্য


অটোমান সাম্রাজ্য (دولت عليه عثمانیه‎) হলো ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ ও দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্য। পাশ্চাত্যের বাইরের একমাত্র সাম্রাজ্য হিসেবে অটোমান সাম্রাজ্য মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত টিকে থাকে এবং এ সাম্রাজ্য ইউরোপ ও বিশ্বরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সাম্রাজ্যের ইতিহাস মধ্যপ্রাচ্য, বলকান উপদ্বীপ, মধ্য ও পশ্চিম ইউরোপের জাতিগুলোর ভাগ্য নির্ধারণ করেছে। একটি বৃহৎ শক্তি হিসেবে অটোমান সাম্রাজ্য পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে খ্রিস্টান বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের স্থলাভিষিক্ত হয় এবং নিজেকে ইসলামি খিলাফতের উত্তরাধিকারী হিসেবে দাবি করে। এমন এক সময় অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে যে সময় চেঙ্গিস খান এশিয়া ও ইউরোপ জয় করছিলেন এবং চীন থেকে পোল্যান্ড পর্যন্ত একটি বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলছিলেন। প্রায় একই সময় ইউরোপে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধ শুরু করার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। তখনো আজকের আমেরিকা আবিষ্কার হয়নি। তবে স্পেন ও পর্তুগাল এই নয়া পৃথিবী আবিষ্কারে তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। তুরস্ক ছাড়া অন্য কোনো দেশ নিজেকে অটোমান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী রাষ্ট্র হিসেবে দাবি করছে না। এ দেশটি হলো দুটি মহাদেশ জুড়ে। মূল অংশ এশিয়ায় এবং সাবেক রাজধানী ইস্তাম্বুল ইউরোপে। দুটি অংশের মাঝে দার্দানেলিস ও বসফোরাস প্রণালী এবং মারমারা সাগর। এ তিনটি জলপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ইউরোপের সাথে এশিয়ার এবং খ্রিস্টানদের সাথে মুসলমানদের শত শত বার লড়াই হয়েছে।      
    অস্তাচলে হলেও এখনো প্রতিটি মুসলমান এ সাম্রাজ্যকে নিয়ে গর্ব করে। উত্থানের পর পতন অনিবার্য। এক বিশেষ পরিস্থিতিতে আধুনিক তুরস্কের মূল ভূখণ্ডে আকস্মিকভাবে অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে এবং প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে একসময় এ সাম্রাজ্য বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। তবে তার রেশ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। ইতিহাস অটোমান সুলতান ও অটোমান সাম্রাজ্যকে চিরদিন মনে রাখবে। সুলতান সোলেমানকে নিয়ে মুহতাসিম ইউজিল (দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট সেঞ্চুরি), সুলতান দ্বিতীয় মোহাম্মদকে নিয়ে ফাতিহ ১৪৫৩ এবং অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উসমান গাজীর পিতা আরতুগ্র“লকে নিয়ে দিরিলিজ আরতুগ্র“ল চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রমাণ করছে যে, তাদের আবেদন এখনো ফুরিয়ে যায়নি। এ সাম্রাজ্যের ইতিহাসের সাথে শুধু অটোমান নয়; তুর্কি, আরব, পার্সি, গ্রীক, সার্ব, রুশ, পোলিশ, চেক, আর্মেনীয়, বুলগেরীয়, হাঙ্গেরীয়, আলবেনীয়, ভেনিসীয়, জেনোয়িজ, ইতালীয়, স্পেনীয়, ফরাসি, জার্মান, পর্তুগীজ ও মামলুকসহ আরো বহু জাতি জড়িত।     
   একটি নির্দিষ্ট তারিখে অটোমান সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হয়। কিন্তু কবে এ সাম্রাজ্যের যাত্রা শুরু হয়েছিল তা বলা কঠিন। ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয় যে, ১২৯৯ সালে এ সাম্রাজ্যের সূচনা হয়েছিল। কোনো স্মরণীয় যুদ্ধ, কোনো স্বাধীনতা ঘোষণা কিংবা কোনো বিখ্যাত দুর্গের পতন ঘটা ছাড়া ইতিহাসের একটি বৃহত্তম সাম্রাজ্যের যাত্রা শুরু হয়েছিল। বছরটি ছিল হিজরি ৬৯৯-৭০০ সাল। খ্রিস্টান ও ইসলামি বর্ষপঞ্জিতে একই সময় শতাব্দীর শুরু হয়। সম্ভবত এ বিবেচনায় ১২৯৯ সালকে অটোমান সাম্রাজ্যের শুরু হিসেবে ধরা হয়। ১৩০০ সালে অটোমানরা ছিল পূর্ব বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অংশ আনাতোলিয়ায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নিয়োজিত মধ্য এশিয়া থেকে বিতাড়িত অগণিত তুর্কমেন গোষ্ঠীর অন্যতম। আনাতোলিয়া হলো কৃষ্ণসাগর, ভূমধ্যসাগর ও এজিয়ান সাগর পরিবেষ্টিত তুরস্কের বৃহত্তম ভূখণ্ড। আনাতোলিয়াকে এশিয়া মাইনরও বলা হয়। এশিয়া মাইনর মানে হলো ছোট এশিয়া। 
     ষোড়শ শতাব্দীতে অটোমানদের পাশাপাশি আরো দুটি বৃহত্তম মুসলিম শক্তির উত্থান ঘটে। একটি ছিল ইরানের সাফাভি এবং আরেকটি ভারতে মোগল। তৈমুরের উত্তরসূরি মোগলরা ভারতের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাফাভিরা ছিল সুফি। এসব সুফি আজারবাইজানের আরদাবিলে একটি মাজারের কাছে বসবাস করতো। তাদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সাইফউদ্দিন। সাইফউদ্দিন নিজেকে বিশ্বনবীর (সা.) বংশধর বলে দাবি করতেন।     
    অটোমানরা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার অনেক আগে তুর্কমেনরা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে লুণ্ঠন চালাতো। সেলজুক তুর্কিরা হলো তুর্কমেনদের মধ্যে সবচেয়ে সফল। সেলজুক তুর্কিরা যাযাবর হিসেবে মধ্য এশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও আনাতোলিয়ায় অভিবাসন করে। সে  সময় অভ্যন্তরীণ গোলযোগে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক। সেলজুক তুর্কিরা খুব সামান্য প্রতিরোধের মুখোমুখি হয় এবং ১০৭১ সালে আনাতোলিয়ার উত্তরে সুলতান আল্প আরসালানের নেতৃত্বে মানজিকারাত যুদ্ধে একটি বাইজান্টাইন বাহিনীকে পরাজিত করে।  এ বিজয় তুর্কমেনদের পশ্চিমে অভিবাসনের দরজা খুলে দেয়। ৮ শো বছরের দিগি¦জয়ে মুসলমানরা স্পেন এবং ভূমধ্যসাগরের কয়েকটি দ্বীপ ছাড়া আর কোনো ভূখণ্ড হারায়নি। মরক্কো থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত ভূখণ্ডে একটির পর একটি মুসলিম রাষ্ট্র। এখানে কোনো অমুসলিম রাষ্ট্র নেই। যেন মুসলিম রাষ্ট্রগুলো একে অন্যের পিঠে হেলান দিয়ে প্রাচীরের মতো দাঁড়ানো। সামরিক দিক থেকে কেউ অটোমান তুর্কিদের সমকক্ষ ছিল না। ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিকে অটোমান অগ্রযাত্রা মন্থর হয়ে যায়। কেননা সংখ্যায় তুর্কিরা ছিল তাদের খ্রিস্টান প্রতিপক্ষদের তুলনায় স্বল্প।  
     এমন এক সময় ছিল যখন চীন সীমান্ত থেকে আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূল পর্যন্ত মুসলমান ছাড়া অন্য কোনো জাতির নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এশিয়ার দক্ষিণ ভাগে ছিল মোগল সাম্রাজ্য, তার লাগোয়া ছিল পারস্যের সাফাভি সাম্রাজ্য, মধ্যভাগে সেলজুক সাম্রাজ্য ও মামলুক সালতানাত এবং পশ্চিমে শেষ মাথায় অটোমান সাম্রাজ্য। সেলজুক সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের ওপর অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, অটোমান সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। সুলতান দ্বিতীয় বায়েজীদ স্পেনের মুসলমানদের রক্ষায় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি শুধু মুসলমান নন, ইহুদিদেরও রক্ষা করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি এডমিরাল কামাল রইসকে স্পেনে পাঠান। তবে তিনি পূর্বাঞ্চলে মামলুক হুমকিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সুলতান সোলেমানের আমলে সুদূর ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে কুরতোগলু খিজির রইসের নেতৃত্বে অটোমানরা অভিযান চালিয়েছিল। ভারত মহাসাগরে প্রথম অভিযান চালিয়েছিলেন সোলায়মান পাশা। সোলায়মান পাশার পর অভিযান চালান যথাক্রমে পিরি রইস, মুরাদ রইস ও সৈয়দ আলী রইস। কাপুরুষের মতো পালিয়ে আসায় পিরি রইসকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। প্রলয়ঙ্করী ঝড়ে নৌবহর ল-ভ- হয়ে গেলে সৈয়দ আলী রইস দিল্লিতে মোগল সম্রাট হুমায়ুনের দরবারে আশ্রয় নেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান চালানোর সামর্থ্য অটোমানদের ছিল। কিন্তু তাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিল পশ্চিম ভূমধ্যসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগর। এ অঞ্চলে অটোমানরা আজকের শক্তিশালী ইউরোপীয় জাতিগুলোকে কোণঠাসা করে রেখেছিল।  
     ১৬৮৩ সালের পর অটোমানরা আর কখনো ইউরোপের প্রতি হুমকি হয়ে উঠতে পারেনি। তারা দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে ২ শো বছরের বেশি নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখে এবং আধুনিক বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, গ্রীস, রুমানিয়া, হাঙ্গেরী ও অন্য দেশগুলোতে প্রাধান্য বিস্তার করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত আধুনিক তুরস্ক, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, ইসরাইল, ফিলিস্তিন, জর্দান ও সৌদি আরবের অধিকাংশ ছিল এ সাম্রাজ্যের অংশ। ১৯২২ সালে বিলুপ্তির কয়েক দশক আগে অটোমান সাম্রাজ্যের কোনো ইউরোপীয় প্রদেশ ছিল না। ১৮৭৮ সালে বার্লিন চুক্তির আগে অটোমান সাম্রাজ্যকে একটি ইউরোপীয় শক্তি হিসেবে গণ্য করা হতো। শেষ দিনগুলোতে তাকে একটি এশীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের শক্তি বলে মনে হতো। 
    দুটি ভিন্ন রুটে ইউরোপে ইসলাম প্রবেশ করে। একটি রুট ছিল জিব্রাল্টার প্রণালী এবং আরেকটি বসফোরাস প্রণালী। অটোমানরা দ্বিতীয় রুটে ইসলামকে ইউরোপীয় ভূখণ্ডে নিয়ে যায়। ১৩৫৪ সালে অটোমানরা ইউরোপে প্রবেশ করে এবং বলকান অঞ্চল বিজয়ের মধ্য দিয়ে অটোমান বেলিক একটি আন্তঃমহাদেশীয় সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হয়। ১৪৫৩ সালে সুলতান দ্বিতীয় মোহাম্মদ কন্সটান্টিনোপল বিজয় সম্পন্ন করলে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে মহান সুলতান সোলেমানের রাজত্বকালে শক্তির চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছার সময় অটোমান সাম্রাজ্য ছিল বহুজাতিক ও বহুভাষী। কন্সটান্টিনোপল রাজধানী হওয়ায় এবং ভূমধ্যসাগরের আশপাশের ভূখণ্ডগুলো নিয়ন্ত্রণ করায় অটোমান সাম্রাজ্য ৬ শো বছর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে।
    তিনটি মহাদেশ জুড়ে অটোমান সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করেছিল। প্রাথমিকভাবে বাইজান্টাইন ভূখণ্ডে অটোমান সাম্রাজ্যের বীজ উপ্ত হয়েছিল। পরে মধ্য এশিয়া ও ইউরোপে এ সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ঘটে। একসময়ের অখ্যাত উসমান গাজীর বংশধররা পরবর্তী ২ শো বছরের মধ্যে আড্রিয়াটিক উপকূলের দুরাজ্জো থেকে পূর্ব আনাতোলিয়ার ইরজুরুম পর্যন্ত ভূখণ্ডের ওপর প্রভুত্ব কায়েম করে। ইউরোপের সাথে নিরন্তর লড়াই করে তাকে অস্তিত্ব রক্ষা করতে হয়েছে। ভৌগোলিক সম্প্রসারণ ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম নীতি। অধীনস্ত ভূখণ্ডের কোটি কোটি মানুষের ভরণ-পোষণ এবং বিপুল পরিমাণ সম্পদ লাভে এ নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। প্রথমে অটোমান সুলতানদের শাসন ছিল অনিরাপদ। সাম্রাজ্যকে সংহত করতে অটোমান সুলতানরা ক্রীতদাস ও ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান জানবাজ যোদ্ধাদের নিয়ে গঠন করেন ক্র্যাক পদাতিক জেনিসারি। অটোমানরা অবনতিশীল বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যকে উপর্যুপরি যুদ্ধে পরাজিত করে দ্রুত পশ্চিমে তাদের সাম্রাজ্যকে সম্প্রসারিত করে। এ সাম্রাজ্য একটি শক্তিশালী নৌশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং ভূমধ্যসাগরের অধিকাংশ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অর্জন করে। এক সময় অটোমান সাম্রাজ্য ইউরোপীয় রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারে পরিণত হয়। এ সাম্রাজ্যের সাফল্য ও সামরিক ক্ষমতা ছিল রোমান সাম্রাজ্যের সমান। ইতালীয় প-িত ফ্রান্সিসকো সানসোভিনো ও ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ বোদিন অটোমান সাম্রাজ্যের ভক্ত ছিলেন। 
   প্রজাদের নিঃশর্ত আনুগত্য ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের অন্যতম উপাদান। প্রজারা অটোমান বংশের শাসনের অধিকারকে কখনো চ্যালেঞ্জ করেনি। তারা অটোমান বংশের এক সুলতানের স্থলে আরেক সুলতানের প্রতি আনুগত্য পরিবর্তনে দ্বিধা করেনি। তবে এ বংশের বাইরের কারো প্রতি তাদের আনুগত্য প্রদর্শনের কোনো উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় না। মোটামুটি সবাই একমত ছিল যে, সার্বভৌমত্ব হচ্ছে আল্লাহর হাতে। উসমান গাজীর হাতে স্বপ্নযোগে আল্লাহ এ সার্বভৌমত্ব অর্পণ করেন এবং তার পরবর্তী ৩৬ জন পুরুষ সার্বভৌমত্বের অধিকারী ছিলেন। দেশের পর দেশ জয় করলেও অটোমানরা কোথাও নিজ হাতে শাসনভার গ্রহণ করেনি। জয় করার পর তারা প্রশাসন তুলে দিতো স্থানীয় লোকদের হাতে। কখনো কখনো উপযুক্ত লোক পাওয়া না গেলে অটোমানরা মাসের পর মাস অপেক্ষা করতো। ১৫২৬ সালে হাঙ্গেরীর মোহ্যাকচ যুদ্ধে এরকম একটি দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়। অটোমানরা হাঙ্গেরীর রাজধানী বুদা লুণ্ঠন এবং স্মার্ণা দখল করে। কিন্তু ক্ষমতা বুঝে নেয়ার জন্য স্থানীয় কোনো নেতা এগিয়ে আসেননি। দেশটিতে বছরের শেষ তিন মাস ক্ষমতার শূন্যতা বিরাজ করে। রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ভেঙ্গে পড়ে। বিজয়ীরা দেশটিতে তাদের শাসন চাপিয়ে দেয়নি।
   অটোমানরা তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব সংহত এবং প্রতিবেশিদের সাথে মিত্রতা স্থাপনে বিয়েকে একটি কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করে। বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে বর ও কনের পৈত্রিক ধর্ম কখনো অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। অটোমান সুলতানগণ মুসলমান হলেও নির্দ্বিধায় খ্রিস্টান পাত্রীর পাণি গ্রহণ করেন। হেরেমে তাদেরকে পৈত্রিক ধর্ম পালনের সুযোগ দিতেন। দ্বিতীয় অটোমান সুলতান ওরহান গাজী প্রতিদ্বন্দ্বী বাইজান্টাইন সম্রাট ষষ্ঠ জন কান্টাকুজেনির কন্যা থিওডোরা কান্টাকুজেনিকে বিয়ে করেন এবং যৌতুক হিসেবে কৌশলগত গ্যালিপলি উপত্যকা লাভ করেন। পরবর্তী অটোমান সুলতান প্রথম মুরাদ ১৩৭৮ সালে বুলগেরিয়ার রাজা আইভান আলেক্সান্ডারের কন্যা মারাকে বিয়ে করেন। একইভাবে তার উত্তরাধিকারী সুলতান প্রথম বায়েজীদ তার শত্র“ সার্বিয়ার রাজা লাজারের কনিষ্ঠা কন্যা মারিয়াকে বিয়ে করেন। এ ছাড়া তিনি জার্মিয়ানের আমির সোলায়মান শাহর কন্যা সুলতানা হাতুন এবং জুলকাদিরের আমির সাবান সুলি বে’র কন্যা এমিনি হাতুনকে বিয়ে করেন। সুলতান বায়েজীদ সুলতানা হাতুনকে বিয়ে করে তার পিতার অর্ধেক রাজত্ব লাভ করেন।     
 
অটোমান সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক সীমা
পূর্বদিকে পারস্য উপসাগর থেকে উত্তর-পশ্চিমে ইউরোপের ভিয়েনা এবং উত্তরে ককেশাস পর্বতশ্রেণি থেকে পশ্চিমে মিসর পর্যন্ত অটোমান সাম্রাজ্যের সীমান্ত সম্প্রসারিত হয়েছিল। একসময় এ সাম্রাজ্যের আয়তন ২০ লাখ ৮৮ হাজার চার শো বর্গমাইলে পৌঁছে। এ সাম্রাজ্যের আওতায় ছিল দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের অধিকাংশ, মধ্য ইউরোপের অংশবিশেষ, পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়ার ককেশাস অঞ্চল, উত্তর আফ্রিকা ও আফ্রিকার শৃঙ্গ। যেসব দেশ অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল সেগুলো হলো তুরস্ক, সাইপ্রাস, মাল্টা, মিসর, গ্রীস, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, মেসিডোনিয়া, সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া, আলবেনিয়া, মোলদাভিয়া, দক্ষিণ ইউক্রেন, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, হাঙ্গেরী, ইসরাইল, ফিলিস্তিন, জর্দান, লেবানন, সিরিয়া, সৌদি আরবের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল, ইরাক, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, পূর্ব ইয়েমেন, উত্তর লিবিয়া, তিউনিসিয়া ও উত্তর আলজেরিয়া। এসব দেশ অধিকারে আসায় পূর্ব ইউরোপ ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল একজন একক শাসকের অধীনে আসে। কৃষ্ণসাগরে অটোমানদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম হলে রুশ জাহাজের প্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়। এতে সাম্রাজ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়। অটোমান সাম্রাজ্যের কোটি কোটি মানুষ অন্তত ২০টি ভাষায় কথা বলতো। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে অটোমান সাম্রাজ্যে ৩২টি প্রদেশ এবং বহু আশ্রিত রাজ্য ছিল। পরবর্তীতে কয়েকটি আশ্রিত রাজ্যকে অটোমান সাম্রাজ্যে একীভূত হয় এবং অবশিষ্টগুলোকে স্বায়ত্তশাসন মঞ্জুর করা হয়।   
(লেখাটি ‘অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থান’ থেকে নেয়া। বইটি প্রকাশ করেছে আফসার ব্রাদার্স)।

সুলতান সোলেমানের জীবনের শেষ অভিযান

১৫৬৬ সালের ৬ আগস্ট হাঙ্গেরীর সিগেৎভার (Szigetvar) দুর্গ অবরোধ করা হয়। সিগেৎভার দুর্গ অবরোধ ছিল সুলতান সোলেমানের জীবনের শেষ অভিযান। ১৫৬৬ সালের জানুয়ারিতে তিনি শেষবার যুদ্ধযাত্রা করেন। এ অভিযানকালে নিজের তাঁবুতে স্বাভাবিকভাবে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সিগেৎভারকে কোনো কোনো সময় সিগেত-ও (Sziget) বলা হয়। এ দুর্গ সুলতান সোলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্টের ভিয়েনা অগ্রযাত্রায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নিকোলা সুবিচ জিরিনস্কির নেতৃত্বে হ্যাবসবার্গের সৈন্যবাহিনীর সাথে সুলতান সোলেমানের নেতৃত্বে অটোমান সৈন্যবাহিনীর মধ্যে এ লড়াই হয়। হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্য অটোমান সাম্রাজ্যের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। তবে বিজয়ী হলেও একই বছর ভিয়েনায় অটোমান সম্প্রসারণ থেমে যায়। ১৬৮৩ সালে ভিয়েনা যুদ্ধের আগে এ নগরীর প্রতি অটোমান হুমকি দেখা দেয়নি। বিজয়ী হওয়ার জন্য অটোমানদের চড়া মূল্য দিতে হয়। মাত্র এক মাসে ২০ হাজারের বেশি সৈন্য নিহত হয়। রবার্ট উইলিয়াম ফ্রেসারের মতে, সিগেৎভার দুর্গ অবরোধকালে ১০ হাজারের বেশি কামানের গোলা নিক্ষেপ করা হয়।
 
পূর্ববর্তী ঘটনা 
সোলেমান সিগেৎভার অভিযানে যোগদানে তার পুত্র সেলিমকে নির্দেশ দেননি। সেলিম ছিলেন তখন তার একমাত্র জীবিত পুত্র। তবে তিনি তাকে মদ্যপানে নিষেধ করেন। সেলিম বিরত না হলে সোলেমান তার পুত্রের মদ্যপানের এক সঙ্গীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সেলিমের পুত্র মুরাদ তার পিতার কাছে যেতে একটি গ্যালে চাইলে সোলেমান তাকে দুই মাস্তুলওয়ালা একটি জাহাজ দেন। ১৫৬২ সালের পহেলা আগস্ট তিনি বিয়ে দেয়ার জন্য সেলিমের তিন কন্যাকে ডেকে পাঠান। এসমিহান সুলতানাকে বিয়ে দেয়া হয় সকোল্লু মেহমুদ পাশার কাছে, গাভহারহান সুলতানাকে কাপুদান পাশা পিয়ালি পাশার কাছে এবং শাহ সুলতানাকে প্রধান বাজপাখি বহনকারী হাসান আগার কাছে। একইদিন তিনি দামাত আবদুল করিম পাশার কাছে মরহুম শাহজাদা মোস্তফার কন্যা নার্গিস শাহকে বিয়ে দেন।  সকোল্লুকে তিনি উজিরে আজমের পাশাপাশি সারাস্কার পদে উন্নীত করেন। অটোমান বংশের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে সকোল্লু সুলতান ছাড়া সব ক্ষমতার মালিক হয়ে যান।                            
     পবিত্র রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ম্যাক্সিমিলিয়ান ছিলেন হ্যাবসবার্গের শাসক এবং ক্রোয়েশীয় অভিজাত ও অভিজ্ঞ সেনাপতি নিকোলা সুবিচ জিরিনস্কি ছিলেন সিগেৎভার দুর্গের কমান্ডার। চূড়ান্ত লড়াইয়ে জিরিনস্কি নিজে এবং তার দুর্গের ২ হাজার তিন শো সৈন্যের প্রায় সবাই নিহত হয়। যুুদ্ধের শেষ দিন নিহত হয় ৬ শো সৈন্য। সুলতান সোলেমানের মূল লক্ষ্য ছিল উত্তর হাঙ্গেরীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ইগার (Eger)। কিন্তু তিনি শুনতে পান যে, সিকলোস শহরে জিরিনস্কি তার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছেন এবং সেখানে তিনি একটি বিরাট অটোমান সরবরাহ বহর ধ্বংস করেছেন। জিরিনস্কির এ তৎপরতার জবাবে সুলতান সোলেমান তার মূল পরিকল্পনা সংশোধন করেন এবং সিগেৎভারে জিরিনস্কির বিরুদ্ধে অগ্রযাত্রা করেন। নিকোলা সুবিচ জিরিনস্কি ছিলেন ক্রোয়েশিয়ার একজন শীর্ষ ভূস্বামী, সীমান্ত যুদ্ধে অভিজ্ঞ এবং ১৫৪২ থেকে ১৫৫৬ সাল পর্যন্ত একজন বান (ক্রোয়েশীয় রাজকীয় প্রতিনিধি)। প্রাথমিক জীবনে ভিয়েনা অবরোধে তিনি কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন এবং একটি সফল সামরিক জীবন অনুসরণ করেন। 
    ১৫২৬ সালে মোহাকচ যুদ্ধের পর হাঙ্গেরী ও ক্রোয়েশিয়া উভয় দেশের অভিজাতরা প্রথম ফার্ডিনান্ডকে রাজা মনোনীত করেন। অন্যদিকে টান্সিলভানিয়ার ভইভড জন জাপোলিয়া হাঙ্গেরীর সিংহাসন দাবি করেন। পরস্পরবিরোধী দুজন রাজার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় হ্যাবসবার্গ ও তার মিত্রদের সাথে অটোমান সাম্রাজ্যের উপর্যুপরি যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধ লিটল ওয়ার ইন হাঙ্গেরী নামে পরিচিত। ১৫২৯-১৫৫২ সাল নাগাদ স্থায়ী যুদ্ধে উভয়পক্ষের বিপুল প্রাণহানি ঘটে। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি হাঙ্গেরী ব্যাপক ভূখণ্ড হারায়। তবে ইগার অবরোধে বিজয়ী হলে তাদের ক্ষতি অনেকটা পুষিয়ে যায়। ইগারে পরাজিত হলে অটোমানরা ১৫৬৬ সালে ইউরোপে নতুন করে দিগি¦জয় শুরু করে। সিগেৎভার অভিযান নাগাদ হাঙ্গেরীতে অটোমান অভিযান চলতে থাকে। ১৫৬৬ সালের ৬ আগস্ট থেকে ৮ সেপ্টেম্বর নাগাদ সিগেৎভার যুদ্ধ স্থায়ী হয়। এ যুদ্ধকে এত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয় যে, ফরাসি ধর্মযাজক ও রাষ্ট্রনায়ক কার্ডিনাল রিচেলিউ মন্তব্য করেছিলেন, এ যুদ্ধ সভ্যতাকে রক্ষা করেছে। সিগেৎভার যুদ্ধ হাঙ্গেরী ও ক্রোয়েশিয়ায় এখনো বিখ্যাত এবং দ্য সীজ অব সিগেৎ শিরোনামে হাঙ্গেরীর মহাকাব্যিক কবিতা এবং নিকোলা সুবিচ জিরিনস্কি শিরোনামে ক্রোয়েশিয়ান নাটক রচনায় অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। 
                                                                                                                    পটভূমি
১৫২৬ সালের ২৯ আগস্ট মোহাকচের যুুদ্ধে রাজা দ্বিতীয় লুইয়ের নেতৃত্বাধীন হাঙ্গেরী রাজ্যের সৈন্যবাহিনী সোলেমানের নেতৃত্বাধীন অটোমান সৈন্যবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। লড়াইকালে রাজা লুই নিহত হন। রাজা লুই নিঃসন্তান হওয়ায় হাঙ্গেরী রাজ্য ভেঙ্গে যায়। হাঙ্গেরী ও ক্রোয়েশিয়া উভয়ে বিতর্কিত ভূখণ্ডে পরিণত হয়। তাদের ওপর হ্যাবসবার্গ ও অটোমান সাম্রাজ্যের ভূখণ্ডগত দাবি ছিল। হ্যাবসবার্গ রাজবংশের সন্তান ও রোমান সম্রাট পঞ্চম চার্লসের ভাই প্রথম ফার্ডিনান্ড নিহত রাজা দ্বিতীয় লুইয়ের বোনকে বিয়ে করেন এবং হাঙ্গেরী ও ক্রোয়েশিয়া উভয় দেশের অভিজাতরা তাকে রাজা মনোনীত করেন। হাঙ্গেরীর সিংহাসন নিয়ে রাজা ফার্ডিনান্ড ও টান্সিলভানিয়ার ভইভড জন জাপোলিয়ার মধ্যে বিরোধ বাধে। সুলতান সোলেমান জাপোলিয়াকে গোটা হাঙ্গেরীর রাজা বানিয়ে দেয়ার প্রতিশ্র“তি দেন। ফার্ডিনান্ড গোটা হাঙ্গেরীতে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় অগ্রযাত্রা করেন এবং ১৫২৭ সালে জন জাপোলিয়ার কাছ থেকে রাজধানী বুদা কেড়ে নেন। ১৫২৯ সালে অটোমানদের পাল্টা হামলায় ফার্ডিনান্ড তার সব ভূখণ্ড হারান। সুলতান সোলেমান হাঙ্গেরী থেকে ফার্ডিনান্ডের সৈন্যবাহিনীকে ছুঁড়ে ফেলে দেন এবং রাজধানী বুদায় প্রবেশ করেন। বুদা প্রদেশ নামে হাঙ্গেরীর মূল ভূখণ্ডকে অটোমান সাম্রাজ্যে একীভূত করা হয়। ১৫২৯ সালে ভিয়েনা অবরোধ ছিল অস্ট্রিয়ার রাজধানী দখলে সুলতান সোলেমানের প্রথম প্রচেষ্টা। এ অবরোধ অটোমানদের শক্তির সর্বোচ্চ সীমা নির্দেশ করে এবং মধ্য ইউরোপে অটোমান সম্প্রসারণের চূড়ান্ত ধাপ হিসেবে চি‎িহ্নত হয়। 
    ১৫৬৫ ও ১৫৬৬ সালের গোড়ার দিকে সুলতান সোলেমান ও পবিত্র রোমান সম্রাট ম্যাক্সিমিলিয়ানের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ম্যাক্সিমিলিয়ান অটোমান বে তেল্লি হাসান পাশার অধিকৃত ভূখণ্ড ফেরত দাবি করছিলেন। আলোচনা ব্যর্থ হলে ম্যাক্সিমিলিয়ান যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং উজিরে আজম সকোল্লু মেহমেদ পাশা তার ভাতিজা বসনিয়ার সকোল্লু মোস্তফা বে’কে ম্যাক্সিমিলিয়ানের বিরুদ্ধে অগ্রযাত্রা করার নির্দেশ দেন। মোস্তফা বে ক্রুপা ও ডাভোর দখলে সক্ষম হন। সুলতান সোলেমান অবিলম্বে রোমান সম্রাট ম্যাক্সিমিলিয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং উজিরে আজম সৈন্যবাহিনীর অগ্রযাত্রার ব্যবস্থা করেন। তিনি অগ্রভাগে যাত্রা করেন এবং সুলতানের আগমনের প্রস্তুতি নেন।       
 
লিটল ওয়ার                  
১৫২৯-১৫৫২ সাল পর্যন্ত বছরগুলো লিটল ওয়ার হিসেবে পরিচিত। ১৫২৯ সালে সুলতান সোলেমানের ভিয়েনা অবরোধ ব্যর্থ হলে ১৫৩০ সালে হৃত ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারে রাজা ফার্ডিনান্ড পাল্টা হামলা চালান। জন জাপোলিয়া বুদার ওপর তার হামলা নস্যাৎ করে দেন। তবে ফার্ডিনান্ড গ্রান (ইস্টারগম) এবং গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সীমান্ত দানিয়ুব বরাবর আরো কয়েকটি বন্দর দখলে সফল হন। ১৫৩২ সালে সুলতান সোলেমান জবাব দেন। তিনি এক লাখ ২০ হাজার সৈন্য নিয়ে পুনরায় ভিয়েনা অবরোধ করেন। ফার্ডিনান্ড গান্স (কোসেগ) রক্ষায় মাত্র ৭ শো সৈন্য রেখে পিছু হটেন। এসব সৈন্যের কোনো কামান ছিল না। অটোমান উজিরে আজম ইব্রাহিম পাশা কোসেগ দুর্গের দুর্বল প্রতিরক্ষা আঁচ করতে পারেননি। অবরোধ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে সুলতান সোলেমান তার সাথে যোগদান করেন। 
   ক্রোয়েশীয় ক্যাপ্টেন নিকোলা জুরিসিচ ও তার ৮০০ সৈন্যের দুর্গ ২৫ দিনের বেশি অটোমানদের ঊনিশটি পূর্ণাঙ্গ হামলা এবং বিরামহীন গোলাবর্ষণ মোকাবিলা করে। উদার শর্তে শহরকে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়া হয়। সুলতান সোলেমান ও ফার্ডিনান্ডের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলে অটোমানরা পিছু হটে। হ্যাবসবার্গ রাজবংশ অটোমানদের আশ্রিত জন জাপোলিয়াকে হাঙ্গেরীর রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এ চুক্তি ফার্ডিনান্ড ও জন জাপোলিয়া কাউকে সন্তুষ্ট করতে না পারায় সীমান্ত বরাবর তাদের সৈন্যবাহিনী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ১৫৩৭ সালে ফার্ডিনান্ড চুক্তি ভঙ্গ করে ওসিজেকে জন জাপোলিয়ার সৈন্যবাহিনীকে অবরোধ করেন। মোহাকসের মতো এ অবরোধ একটি বিপর্যয়ে পরিণত হয়। অটোমান উদ্ধারকারী বাহিনী অস্ট্রীয়দের গুঁড়িয়ে দেয়। পুনরায় ভিয়েনা আক্রমণ করার পরিবর্তে সুলতান সোলেমান দক্ষিণ ইতালির ওট্রান্টোতে অভিযান চালান। ১৫৩৮ সালে প্রিভেজায় নৌযুদ্ধে অটোমানদের বিজয় হ্যাবসবার্গ-নেতৃত্বাধীন জোটের আরেকটি পরাজয় হিসেবে চি‎িহ্নত হয়। ১৫৪০ সালে জন জাপোলিয়া পরলোকগমন করলে তার শিশু পুত্র জন দ্বিতীয় সিগিসমান্ড জাপোলিয়া তার স্থলাভিষিক্ত হন এবং তার কাছে টান্সিলভানিয়ার শাসনভার অর্পণ করা হয়। সিগিসমান্ডের রাজত্বের অধিকাংশ সময় সুলতান সোলেমানের অব্যাহত সমর্থনে তার মা ইসাবেলা জাগিওলন  দেশ শাসন করেন। ১৫৭০ সালে সিংহাসন ত্যাগ করা নাগাদ দ্বিতীয় সিগিসমান্ড হাঙ্গেরীর নামমাত্র রাজা হিসেবে বহাল থাকেন এবং দেশকে হ্যাবসবার্গ শাসনে ন্যস্ত করেন। ইসাবেলা জাগিওলনকে সহায়তা দানের আহক্ষানে অটোমানরা সাড়া দেয় এবং বুদা অবরোধ করে। ১৫৪১ সালে বুদা অবরোধে হ্যাবসবার্গ আবার শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। ১৫৪৩ সালের এপ্রিলে সুলতান সোলেমান হাঙ্গেরীতে আরেকটি অভিযান চালান এবং ব্রান ও অন্যান্য বন্দর দখল করে নেন। এতে হাঙ্গেরীর অধিকাংশ ভূখণ্ড অটোমান নিয়ন্ত্রণে ফিরে আসে। ১৫৪৩ সালের আগস্টে অটোমানরা ইস্টারগম (Esztergom) অবরোধে বিজয়ী হয়। সুলতান সোলেমান ১৫৪৩ সালের ২৫ জুলাই হাঙ্গেরীর এ শহর অবরোধ করেন এবং ১০ আগস্ট শেষ হয়। দুসপ্তাহের অবরোধে অটোমানরা বিজয়ী হয়। চুক্তি অনুযায়ী হাঙ্গেরী অভিযানে ফরাসি সৈন্যরা অটোমানদের সাথে যোগদান করে। ১৫৪৩-৪৪ সালে অটোমানদের সহায়তায় একটি ফরাসি আর্টিলারি ইউনিট পাঠানো হয়। এ ইউনিটকে অটোমান সৈন্যবাহিনীতে সংযুক্ত করা হয়। ১৫৪২ সালে অস্ট্রিয়ার রাজা ফার্ডিনান্ড বুদা পুনর্দখলের ব্যর্থ চেষ্টা করায় ইস্টারগম অবরোধ করা হয়। ইস্টারগম অবরোধ শেষ হলে তিনটি হাঙ্গেরীয় শহর শেকেসফারভার (Szekesfehervar), সিকলোস (Siklos) ও সিগেদ (Szeged) দখল করা হয়। এ তিনটি শহর দখল করা হলে বুদার নিরাপত্তা আরো নিশ্চিত হয়। 
      পশ্চিম ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগরে ফরাসি মিত্রদের তৎপরতার কোনো খবর না পাওয়ায় সোলেমান ভিয়েনার সামনে এগিয়ে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। অটোমানদের সফল অভিযানের পর ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের মধ্যস্থতায় ১৫৪৫ সালে  রোমান সম্রাট পঞ্চম চার্লসের সাথে এক বছর মেয়াদী একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পারস্যের বিরুদ্ধে অভিযানে ব্যস্ত থাকায় সুলতান সোলেমান নিজেও বৈরিতা অবসানের পক্ষে ছিলেন। দুবছর পর ১৫৪৭ সালে আদ্রিয়ানোপল চুক্তিতে পঞ্চম চার্লস ও ফার্ডিনান্ড হাঙ্গেরীতে অটোমানদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ স্বীকার করে নেন। এমনকি ফার্ডিনান্ড উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলীয় হাঙ্গেরীতে হ্যাবসবার্গের নিয়ন্ত্রণে বিনিময়ে বার্ষিক ত্রিশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা পরিশোধে সম্মত হন। ১৫৫২ সালে কারা আহমদ পাশা ও সকোল্লু মেহমুদ পাশার নেতৃত্বে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার অটোমান সৈন্য উত্তর হাঙ্গেরীতে ইগার দুর্গ অবরোধ করে। সুলতান সোলেমান ইগার আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়া নাগাদ হ্যাবসবার্গ ও অটোমানদের মধ্যে আরেকটি চুক্তি হয়। ইস্তভান ডোবোর নেতৃত্বে হাঙ্গেরীর দুহাজার তিন শো সৈন্য অটোমান হামলা প্রতিহত এবং দুর্গ রক্ষা করে। ইগার দুর্গ অবরোধে অটোমানরা ১৬টি বৃহৎ এবং দেড় শো মাঝারি আকারের কামান এবং দুহাজার উট ব্যবহার করে। পক্ষান্তরে প্রতিরোধকারীদের কাছে ছিল ৬টি বড় কামান, এক ডজন ক্ষুদ্র কামান এবং তিন শো ট্রেন্স গান। উভয়পক্ষের শক্তিতে এ ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও ইগার দুর্গ ৫টি বৃহত্তম অটোমান হামলা এবং কামানের বিরামহীন গোলাবর্ষণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। অবরোধ শেষ হওয়ার আগে দুর্গের অভ্যন্তরে কামানের প্রায় ১২ হাজার গোলা পতিত হয়। ৩৯ দিনের রক্তক্ষয়ী অবরোধ শেষে অটোমানরা ইগার থেকে পিছু হটে। ইস্তভান ডোবোর দুজন দেহরক্ষীসহ এক-তৃতীয়াংশ প্রতিরোধকারী নিহত হয়। ইগার অবরোধ নিষ্ফল প্রমাণিত হয় এবং হ্যাবসবার্গ বিজয়ী হলে হাঙ্গেরীর ভৌগোলিক ক্ষতির অবসান ঘটে। ইগারের অস্তিত্ব বজায় থাকায় অস্ট্রীয়রা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, হাঙ্গেরী নিয়ে লড়াই তখনো শেষ হয়নি এবং ১৫৬৬ সালে হাঙ্গেরীতে অটোমানরা পুনরায় অভিযান চালায়।

১৫৬৬ সালের অভিযান
১৫৬৬ সালের জানুয়ারিতে সুলতান সোলেমান তার জীবনের শেষ যুদ্ধযাত্রা করেন। তার বয়স ছিল তখন ৭২ বছর। গেঁটে রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তিনি পাল্কিকে চড়ে যাত্রা করেন। তিনি নামমাত্র ২৩তম সামরিক অভিযানে নেতৃত্ব দেন। ১৫৬৬ সালের পহেলা মে সুলতান একটি বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে কন্সটান্টিনোপল ত্যাগ করেন। জামুনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় সৈন্যবাহিনীর একটি অংশ ভারাজদিন অতিক্রম করে এবং ভিয়েনা অভিমুখে অগ্রযাত্রা করার আগে ইগারে আঘাত হানে। নিকোলা সুবিচ জিরিনস্কি অটোমান সানজাক বে তিরহাল মোহাম্মদকে পরাজিত এবং তাকে ও তার পুত্রকে হত্যা করেন। এছাড়া তিনি ১৭ হাজার ডুকাট (স্বর্ণমুদ্রা) আটক করেন। সকোল্লু মেহমেদ পাশা কুর্ণিশ করে সুলতানকে এ খবর দেন। খবরটি খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলেও সুলতান চিন্তিত হন। তিনি সারাস্কার সকোল্লুকে বলেন, আমরা সিগেৎভারে যাবো। সকোল্লু নির্দেশ পালনে প্রস্তুত হন। সেখানে হ্যাবসবার্গ সৈন্যবাহিনী শান্তি বিনষ্ট এবং অটোমান আশ্রিত তরুণ রাজা জন সিগিসমান্ডকে হয়রানি করছিল। আরো উত্তরে এবলাউয়ে অস্ট্রীয় সৈন্যদের দেখা গিয়েছিল। 
     সকোল্লু সৈন্যদের যাত্রাপথ পরিবর্তনের কোনো কারণ দেখছিলেন না। সিগেৎভার ছিল পানি পরিবেষ্টিত একটি ছোট্ট গ্রাম। সেখানে একটি শক্তিশালী দুর্গ ছাড়া আর কিছু ছিল না। নিকোলা জিরিনস্কি এ দুর্গ দখল করে নিয়েছিলেন। সিগেৎভারের সাথে মাল্টার মিল থাকায় সোলেমান বিস্মিত হন। সিগেৎভারে তিনি পরাজিত হতে প্রস্তুত নন। পরদিন তিনি ঘোড়ার গাড়িতে এ গ্রামের পশ্চিমে যাবার ঘোষণা দেন। সকোল্লু মাথা তোলেন। তিনি দ্রুত চিন্তা করছিলেন। হাজার হাজার সৈন্যের যাত্রাপথ কিভাবে ঘুরিয়ে দেয়া যায় তা নিয়ে ভাবছিলেন। তিনি মুখ খোলার আগেই সোলেমান বললেন, মেহমেদ সকোল্লু, আমি সেখানে যেতে চাই। সুলতান কঠোর কণ্ঠে নির্দেশ দেয়ায় সারাস্কার নীরব হয়ে যান। সকোল্লু ভাবছিলেন তার মহান প্রভু সত্যি নির্বোধ কিনা। তিনি মাথা নিচু করে বললেন, জাঁহাপনা আমি আপনার নির্দেশ শুনতে পেয়েছি। তবে ঘোড়ার গাড়ির চেয়ে নৌকা ভালো হবে। কারাদেনিজে (কৃষ্ণসাগর) বহু গ্যালে আছে। আপনি জলপথে সিগেৎভারে যেতে পারেন। সকোল্লু নিশ্চিতভাবে সিগেৎভারের রাস্তা চিনতেন। কেননা দ্রাভি নদীর তীরে এবং পর্বতমালার পশ্চিমে ছিল তার পৈত্রিক বাড়ি। 
    দ্রাভি নদীতে সুলতানের জন্য একটি প্রমোদতরীর ব্যবস্থা করা হয়। এতে ছিল সোনালী রংয়ের একটি অর্ধচন্দ্র এবং চন্দ্রাতপ। সুলতান চন্দ্রাতপের নিচে শুয়ে রাস্তার দুপাশের দৃশ্য দেখছিলেন। তার বামদিকে ছিল পর্বত। তিনি রাস্তায় লোকজন দেখতে পান। প্রমোদতরীর পাশাপাশি কয়েকটি ষাড় একটি বিশাল কামান বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল। কামানের নাম ছিল কাৎজিয়ানার। অস্ট্রিয়ার সেনাপতি কাৎজিয়ানারের নামানুসারে এ কামানের নামকরণ করা হয়। একবার সেনাপতি কাৎজিয়ানার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে অটোমানদের কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সোলেমান একটি মুচকি হাসি দেন। ক্ষণকাল তিনি ভাবছিলেন কামান ও গোলাবারুদ না থাকলে অথবা সাগর পাড়ি দেয়ার জন্য জাহাজ না থাকলে কী উপায় হতো। সিগেৎভারের উপকণ্ঠে সোলেমানের জন্য একটি তাঁবু খাটানো হয়। তিনি তাঁবুর দিকে এগিয়ে গেলে জেনিসারির আগা তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য ঘোড়ার গাড়ির দরজা পর্র্যন্ত এগিয়ে যান। আগা তাকে নিচে নামতে অনুরোধ করেন। লাল টকটকে কাপড়ে সিগেৎভার দুর্গের শীর্ষদেশ আচ্ছাদিত ছিল। সোলেমান দুর্গের দিকে তাকান। এসময় অশ্বারোহী সৈন্যরা তার চারপাশে গিজগিজ করছিল এবং বাতাসে তার পতাকা উড়ছিল। দুর্গ থেকে সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছিল। খ্রিস্টানরা দুর্গে ধাতব প্লেট লাগিয়ে রাখে যাতে সূর্যের আলো ঝলসে ওঠে। সুলতান সোলেমানের আগমন টের পেয়ে দুর্গ থেকে কামানের গোলাবর্ষণ করা হয়। সুলতান সোলেমান সিগেৎভার অবরোধে উজিরে আজম সকোল্লু মেহমেদ পাশার নেতৃত্বে একটি সৈন্যবাহিনী পাঠান। অন্যদিকে তিনি অবস্থান করছিলেন হারসাঙ্গে। বুদিনের কমান্ডার আরসালান পাশা ভারপালোটা, ভেজপ্রেম ও টাটা শহর হারান। সুলতান আরসালান পাশার মাথা কেটে আনার জন্য ১৫ জন সৈন্যের একটি প্লাটুন পাঠান। কিন্তু আরসালান তিনদিন আগে তার সৈন্যদের পরিত্যাগ করেন এবং সুলতানের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য রওনা দিয়েছিলেন। সুলতান উজিরে আজম সকোল্লু মেহমেদ পাশাকে একটি চিঠি দেখান। চিঠিতে আরসালান সুলতানকে অবজ্ঞা করেছিলেন। ৩ আগস্ট আরসালান ১৫ জন ভারি অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে সুলতানের তাঁবুতে এসে উপস্থিত হন। এ সময় উজিরে আজম তার আচরণের জন্য তাকে ভর্ৎসনা করেন এবং তাকে দেশদ্রোহিতার জন্য অভিযুক্ত করেন। উজির তার পদ কেড়ে নেন এবং তার ভাতিজা সকোল্লু মোস্তফা বে’কে তার স্থলে নিয়োগ দেন। সুলতান উজিরে আজম সকোল্লু মেহমেদ পাশার পুত্র কুর্ট বে ও হাসান বে’কে সাথে নিয়ে পিসিসে এসে পৌঁছান। ৪৯ দিন অগ্রযাত্রার পর সোলেমানের সৈন্যবাহিনী ১৫৬৬ সালের ২৭ জুন বেলগ্রেডে পৌঁছে। বেলগ্রেডে তিনি জন সিগিসমান্ড জাপোলিয়ার সাথে মিলিত হন। সিকলোসে একটি অটোমান দুর্গে জিরিনস্কির সফল আক্রমণের সংবাদ পেয়ে সুলতান সোলেমান ইগারে তার অভিযান স্থগিত রাখার ঘোষণা দেন এবং জিরিনস্কির হুমকি নির্মূলে সিগেৎভার দুর্গ দখলের সিদ্ধান্ত নেন।

অবরোধ  
১৫৬৬ সালের পহেলা মে উজিরে আজমসহ সুলতান সোলেমান কন্সটান্টিনোপল ত্যাগ করেন। তারা সোফিয়া, নিস ও বেলগ্রেডের মধ্য দিয়ে সেমলিনে অগ্রযাত্রা করেন। সেমলিনে তরুণ জন জাপোলিয়া সুলতানকে সম্মান জানানোর জন্য হাজির হন। তাকে আন্তরিকভাবে অভ্যর্থনা জানানো হয়। সেমলিন থেকে আরলাউ অবরোধে সুলতানের অগ্রযাত্রা করার কথা ছিল। কিন্তু তিনি মনোভাব পরিবর্তন করেন এবং শক্তিশালী সিগেৎভার দুর্গ অবরোধের সিদ্ধান্ত নেন। ১৫৬৬ সালের ২ আগস্ট অটোমান অগ্রবর্তী বাহিনী সিগেৎভারে এসে পৌঁছে। দুর্গ রক্ষকরা বের হয়ে যাবার কয়েকটি সফল অভিযান চালায় এবং এতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অটোমান সৈন্য নিহত হয়। ৫ আগস্ট সুলতান সোলেমান উজিরে আজম সকোল্লু মেহমেদ পাশার পুত্র কুর্ত বে এবং হাসান বে’সহ মূল বাহিনী নিয়ে পিসিচে পৌঁছান এবং সাইমিলিহোভ পাহাড়ে তার শাহী তাঁবু খাটান। এ তাঁবু থেকে তিনি যুদ্ধের পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করতে পারতেন। সুলতান তার তাঁবুতে অবস্থান করতেন। এখানে তিনি উজিরে আজম মেহমেদ পাশার কাছ থেকে মৌখিকভাবে যুদ্ধের অগ্রগতির খবর পেতেন। উজিরে আজম সকোল্লু মেহমেদ পাশা ছিলেন অটোমান সৈন্যবাহিনীর অপারেশনাল কমান্ডার। কাউন্ট জিরিনস্কি দেখতে পান যে, তিন শো কামানসহ দেড় লাখ শত্র“ সৈন্য তাকে অবরোধ করে ফেলেছে। তিনি অবরোধের আগে ২ হাজার তিন শো হাঙ্গেরীয় ও ক্রোয়েশীয় সৈন্য সমবেত করেছিলেন। এ বাহিনীতে ছিল তার ব্যক্তিগত এবং তার বন্ধু-বান্ধব ও মিত্রদের আরো কিছু সৈন্য। প্রতিরোধকারীদের অধিকাংশ ছিল ক্রোয়েশীয়। সৈন্যবাহিনী ও কমান্ডে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হাঙ্গেরীয় প্রতিনিধিত্ব ছিল। জলাভূমি সিগেৎভারকে তিন ভাগে বিভক্ত করে রেখেছিল। একটি ছিল পুরনো শহর, আরেকটি নয়া শহর এবং তৃতীয়টি দুর্গ। সেতু ও সড়ক এক অংশের সাথে আরেক অংশের সংযোগ রক্ষা করছিল।    
   সিগেৎভার দুর্গ নির্দিষ্টভাবে কোনো উঁচু ভূমির ওপর নির্মাণ করা হয়নি। তবে কোনো আক্রমণকারীর পক্ষে সেখানে সরাসরি প্রবেশ করা সম্ভব ছিল না। অন্য দুটি বেইলি ব্রিজ দখল করা ছাড়া মূল দুর্গে পৌঁছানো যেতো না। সুলতান সোলেমান দুর্গের সামনে এসে প্রাচীরে লাল কাপড় ঝুলতে দেখতে পান। মনে হচ্ছিল যেন বিশাল কোনো কামান থেকে গোলা ছুঁড়ে কোনো শক্তিশালী রাজাকে অভ্যর্থনা জানানো হবে অথবা কোনো বৌভাতের আয়োজন করা হয়েছে। সুলতান দুর্গে সর্বাত্মক হামলার নির্দেশ দিলে ৬ আগস্ট অবরোধ শুরু হয়। সাফল্যের সাথে এ হামলা প্রতিহত করা হয়। সংখ্যায় অত্যন্ত নগণ্য হলেও ভিয়েনা থেকে রাজকীয় সৈন্যবাহিনী তাদের জন্য কোনো সহায়তা পাঠায়নি। এক মাসের বেশি রক্তাক্ত লড়াইয়ের পর অবশিষ্ট প্রতিরোধকারীরা শেষ বুঝাপড়া করার জন্য পুরনো শহরে পিছু হটে। সুলতান জিরিনস্কিকে আত্মসমর্পণে রাজি করানোর চেষ্টা করেন। তাকে অটোমান সার্বভৌমত্বের অধীনে ক্রোয়েশিয়ার নেতৃত্ব গ্রহণের প্রস্তাব দেন। কিন্তু কাউন্ট জিরিনস্কি কোনো জবাব না দিয়ে লড়াই চালিয়ে যান। দুর্গের পতন অবশ্যম্ভাবী বলে প্রতীয়মান হচ্ছিল। কিন্তু অটোমান হাইকমান্ড ছিল দ্বিধান্বিত। 
                                                                                                                       
সুলতান সোলেমানের মৃত্যু
১৫৬৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সুলতান সোলেমান তার তাঁবুতে মৃত্যুবরণ করেন। তবে তার মৃত্যু সংবাদ গোপন রাখা হয়। শুধুমাত্র সুলতানের ইনার সার্কেল জানতো যে, তিনি ইন্তেকাল করেছেন। অটোমানরা আশঙ্কা করতো যে, সৈন্যরা সুলতানের মৃত্যু সংবাদ শুনতে পেলে লড়াই বন্ধ করে দেবে। তাই ৪৮ দিন তার মৃত্যু সংবাদ গোপন রাখা হয়। উজিরে আজম সুলতানের মৃত্যুর সব সাক্ষীকে হত্যা করেন এবং ঘোষণা করেন, সুলতান এত দুর্বল যে, তিনি দায়িত্ব পালনে সক্ষম নন। সিগেৎভারে তিনি সুস্থ হয়ে উঠছেন। তিনি সুলতানের পক্ষে কাজ করছেন। উজিরে আজম সিগেৎভার দখলে সম্পৃক্তদের পুরস্কৃত এবং সৈন্যদের বেতন বৃদ্ধি করেন। তিনি সৈন্যবাহিনীর একটি অংশকে বাবোকসা দখলে পাঠান। তাতাররা সুলতানের মৃত্যুর সংবাদ ফাঁস করে দেয়। উজিরে আজমের ভাতিজা সকোল্লু মোস্তফা বে চিঠি লিখে সোলেমানের উত্তরসূরি শাহজাদা দ্বিতীয় সেলিমকে তার পিতার মৃত্যু সংবাদ অবহিত করার উদ্যোগ নেন। সুলতানের তাঁবু থেকে তিনি একটি চিঠি দিয়ে একজন বার্তাবাহক পাঠান। ৮ দিনের মধ্যে বার্তাবাহক দূরবর্তী এশিয়া মাইনরে পৌঁছে। তবে বার্তাবাহক চিঠির বিষয়বস্তু সম্পর্কে ছিল অজ্ঞ। সেলিম অবিলম্বে স্রেমস্কা যাত্রা করেন। ভুকোভারে এসে পৌঁছলে মোস্তফা তার কাছে একটি বার্তা হস্তান্তর করেন। বার্তায় তিনি তাকে সৈন্যবাহিনীকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিনন্দন জানাতে এবং কার্যকরভাবে সাম্রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণে বেলগ্রেডে যাবার অনুরোধ করেন। সেলিম বেলগ্রেডে ফিরে যান এবং উজিরে আজম সৈন্যবাহিনীকে সেখানে যাবার নির্দেশ দেন। 
    ১৫৬৬ সালের অক্টোবরে সৈন্যবাহিনী বেলগ্রেড অভিমুখে যাত্রা করে। সুলতানের মৃত্যুর ৪৮ দিন পর উজিরে আজম আনুষ্ঠানিকভাবে তার মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করেন। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করার সময় তিনি সুলতানের লাশে সুগন্ধি মাখান এবং সৈন্যবাহিনীকে নয়া সুলতানের সাথে সাক্ষাতে বেলগ্রেডে অগ্রযাত্রা করার নির্দেশ দেন। সুলতান সোলেমানকে কন্সটান্টিনোপলে সোলাইমানিয়া মসজিদে স্ত্রী হুররমের মাজারের পাশে সমাহিত করা হয়। পিতার দাফনে নয়া সুলতান সেলিম উপস্থিত হতে পারেননি। তিনবার যাত্রাবিরতির পর সৈন্যবাহিনী স্রেমস্কা মিট্রোভিচায় পৌঁছে। উজিরে আজম নয়া সুলতান দ্বিতীয় সেলিমকে উজির, পাশা ও সৈন্যবাহিনীকে উপঢৌকন দেয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। কিন্তু নয়া সুলতানের উপদেষ্টারা তাকে বারণ করেন। উজিরে আজম বেলগ্রেডে যান এবং সুলতান হিসেবে দ্বিতীয় সেলিমের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। সেলিম তাকে উজিরে আজম হিসেবে বহাল রাখেন। রাজধানীতে সৈন্যবাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহের আশঙ্কায় উজিরে আজম পাশা, জেনিসারি ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সুলতানের লাশ কন্সটান্টিনোপলে পাঠান। বেলগ্রেডে সুলতান দ্বিতীয় সেলিম একটি বৈঠক আহক্ষান করেন। বেলগ্রেডে অবস্থানের পঞ্চম দিন সুলতান, উজিরে আজম ও সৈন্যবাহিনী কন্সটান্টিনোপলের উদ্দেশে রওনা দেয়। রাজধানীতে পৌঁছার আগে একটি বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং শহরের রাস্তা অবরোধ করা হয়। সেলিম তার প্রথম পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। উজিরে আজম সকোল্লু মেহমেদ পাশা যতটুকু ধারণা করেছিলেন, সেলিম নিজেকে তার চেয়ে দুর্বলতর হিসেবে প্রমাণ করেন। অসংখ্য জেনিসারি অতিরিক্ত বেতনের দাবিতে সরাইয়ে তাকে অবরোধ করে। সেলিম তার তাঁবুতে আশ্রয় নেন এবং দাবি দাওয়া মনে নিতে সকোল্লু মেহমেদ পাশাকে নির্দেশ দেন। সকোল্লু ও আহমদ পাশা ঘুষ দিয়ে শহরের পথ মুক্ত করেন। সুলতান জেনিসারিদের সন্তোষজনক উপঢৌকন ও উচ্চ বেতন প্রদানের প্রতিশ্র“তি দিলে শৃঙ্খলা ফিরে আসে। পরদিন প্রত্যেক জেনিসারিকে নগদ ৪০ ডুকাট (স্বর্ণমুদ্রা) এবং বোনাস হিসেবে আরো অতিরিক্ত ২০ ডুকাট দেয়া হয়। শিগগির সামরিক বাহিনীর অন্যান্য শাখা সিপাহী ও অনিয়মিত সৈন্যরা উচ্চ বেতন দাবি করে। সুলতান সেলিম তাদের গ্রেফতার করেন এবং তাদের স্থলে অন্যদের নিয়োগ দেন।       
 
চূড়ান্ত লড়াই 
সুলতান সোলেমানের মৃত্যুর পরদিন ১৫৬৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত লড়াই শুরু হয়। ইতিমধ্যে বিস্ফোরক ও জ্বালানি কাঠ দিয়ে দুর্গের প্রাচীর ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছিল। সকালে ক্ষুদ্রাস্ত্র থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ, গ্রীক ফায়ার ও কামানের সমন্বিত গোলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে সর্বাত্মক হামলা শুরু হয়। শিগগির সিগেৎভার দুর্গে আগুন ধরে যায় এবং কাউন্ট জিরিনস্কির প্রাসাদে ছাইভস্ম পতিত হয়। অটোমান সৈন্যরা রণদামামা বাজিয়ে চিৎকার দিয়ে পঙ্গপালের মতো শহরে প্রবেশ করে। কাউন্ট জিরিনস্কি শেষ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হন এবং তার সৈন্যদের উদ্দেশে বলেন: 
    চলো আমরা এ জ্বলন্ত প্রাসাদ থেকে বের হয়ে খোলা জায়গায় গিয়ে আমাদের শত্র“দের মোকাবিলা করি। যে মৃত্যুবরণ করবে, সে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করবে। যে লড়াই করে বেঁচে থাকবে, বীর হিসেবে তার নাম সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। আমি প্রথমে এগিয়ে যাবো। আমি যা করবো, তোমরাও তাই করবে। ঈশ্বর সাক্ষী, হে আমার ভাই ও নাইটরা, আমি কখনো তোমাদের ছেড়ে যাবো না। 
    নিকোলা সুবিচ জিরিনস্কি একটি গোপন অভিসন্ধি থেকে দুর্গে চূড়ান্ত লড়াইয়ের অনুমতি দেননি। একটি সংকীর্ণ সেতু দিয়ে অটোমানরা এগিয়ে আসার চেষ্টা করলে প্রতিরোধকারীরা আকস্মিকভাবে প্রবেশদ্বার খুলে দেয় এবং ভাঙ্গা লোহা বোঝাই মর্টারের একটি বিশাল গোলা ছুঁড়ে। এতে ৬০০ অটোমান সৈন্য নিহত হয়। জিরিনস্কি আক্রমণের নির্দেশ দেন এবং তার অবশিষ্ট ৬০০ সৈন্য নিয়ে দুর্গ থেকে বের হয়ে যান। জিরিনস্কির বুকে মাস্কেটের দুটি গুলি লাগে এবং পরে মাথায় তীরবিদ্ধ হলে তিনি শিগগির নিহত হন। তার কিছু সৈন্য দুর্গে পিছু হটে। অটোমানরা দুর্গ দখল করে এবং অধিকাংশ প্রতিরোধকারীকে হত্যা করে। জেনিসারিরা কয়েকজন প্রতিরোধকারীকে রেহাই দেয়। জেনিসারিরা তাদের বীরত্বের প্রশংসা করে। অটোমানদের বেষ্টনী ভেদ করে মাত্র ৭ জন প্রতিরোধকারী পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। জিরিনস্কির শিরñেদ করা হয় এবং তার মাথা নয়া সুলতানের কাছে পাঠানো হয়। একজন তুর্কি সম্মানের সাথে তার দেহ সমাধিস্থ করে। এই তুর্কি একসময় জিরিনস্কির কাছে বন্দি ছিল। ২০১৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সিগেৎভার দুর্গ অবরোধের ৪৫০তম বার্ষিকীতে ক্রোয়েশিয়ার মেদিমুরজি কাউন্টি জাদুঘরে জিরিনস্কির তরবারি ও শিরস্ত্রাণ প্রদর্শন করা হয়।  
                                                                                                                    
গোলাবারুদের ম্যাগাজিনে বিস্ফোরণ 
দুর্গ থেকে শেষ বার বের হয়ে যাবার চেষ্টায় নেতৃত্ব দেয়ার আগে জিরিনস্কি গোলাবারুদে ফিউজ জ্বালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। শেষ প্রতিরোধকারীদের নির্মূল করে দিয়ে অটোমানরা সিগেৎভারের অবশিষ্টাংশে পা রাখে এবং চোরাফাঁদে আটকা পড়ে। দুর্গের গোলাবারুদের ম্যাগাজিনে বিস্ফোরণ ঘটলে হাজার হাজার সৈন্য নিহত হয়। জিরিনস্কির একজন কর্মচারি উজিরে আজম সকোল্লু মেহমেদ পাশার প্রাণ রক্ষা করে। উজিরে আজম ও তার সৈন্যরা দুর্গে সম্পদের খোঁজ এবং জীবিতদের জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় এই কর্মচারি তাকে চোরাফাঁদ সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়। সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় এ বন্দি জবাব দেয় যে, সম্পদ নিঃশেষ হয়ে গেছে। তবে তাদের পায়ের নিচে তিন হাজার পাউন্ড বারুদ আছে এবং বারুদের সাথে একটি দিয়াশলাই যুক্ত। উজিরে আজম সকোল্লু মেহমেদ পাশা ও তার অশ্বারোহী সৈন্যরা ত্বরিতগতিতে পালিয়ে যান। তবে বিস্ফোরণে তিন হাজার অটোমান সৈন্য নিহত হয়। 

ফলাফল 
চূড়ান্ত লড়াইয়ের পর জিরিনস্কির প্রায় সব সৈন্য নিহত হয়। অটোমান সৈন্য নিহত হওয়ার সংখ্যা ছিল ব্যাপক। লড়াইয়ে তিনজন পাশা, ৭ হাজার জেনিসারি এবং ২৮ হাজার সাধারণ সৈন্য প্রাণ হারায়। বিভিন্ন সূত্র অটোমান সৈন্য নিহত হওয়ার সংখ্যা ২০ থেকে ৩০ হাজারের মধ্যে উল্লেখ করছে। লড়াইয়ের পর উজিরে আজম সকোল্লু মেহমেদ পাশা সুলতানের নামে বিজয় ঘোষণা করেন। ঘোষণায় বলা হয়, সুলতানের বর্তমান ভগ্নস্বাস্থ্য তাকে এ সফল অভিযান অব্যাহত রাখতে দিচ্ছে না। তার লাশ কন্সটান্টিনোপলে স্থানান্তর করা হয়। তবে ইনার সার্কেলের কর্মকর্তারা তার সাথে যোগাযোগ রাখার ভান করছিলেন। তুর্কি সূত্র জানায়, তিন সপ্তাহ লুকোচুরি করা হয়। এমনকি সুলতানের ব্যক্তিগত চিকিৎসককে সতর্কতা হিসেবে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। দীর্ঘ পথযাত্রা এবং অবরোধে সুলতানের স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়। সুলতানের মৃত্যু হওয়ায় অগ্রযাত্রা সমাপ্ত হয়। 
সূএঃ ইন্টারনেট

ফাইটার জেটের হেলমেট

বর্তমান সময়ে আধুনিক এবং নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফিচার হচ্ছে জেট ফাইটারের ককপিটে বসা এর পাইলটের হেল...