ভারত ১৯৭৪ সালের ১৮ মে প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায়। এ পরীক্ষা ছিল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য দেশের বাইরে অন্য কোনো দেশের প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণ। ভারতীয় পদার্থ বিজ্ঞানী হোমি জাহাঙ্গীর বাবা হলেন ভারতের পারমাণবিক কর্মসূচির জনক। ভারত তার পারমাণবিক বিস্ফোরণকে ‘শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক বিস্ফোরণ’ হিসেবে দাবি করছিল। এ বিস্ফোরণ আংশিকভাবে ব্যর্থ হওয়ার আশংকা ছিল। ভারতের প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষার বিস্ফোরণ ক্ষমতা ছিল ১২ কিলোটন। ডিভাইসটি একটি লম্বা চোঙ্গার মধ্যে স্থাপন করা হয় এবং ভূগর্ভের ১২০ মিটার নিচে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বিস্ফোরণের ক্ষমতা ছিল প্রকৃতপক্ষে ৪ থেকে ৬ কিলোটন। বিস্ফোরণে ৪৭ থেকে ৭৫ মিটার ব্যাসার্ধের ১০ মিটার গভীর একটি গর্ত সৃষ্টি হয়।
১৯৪৪ সালে ভারত তার নিজস্ব পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করে। এ সময় হোমি জাহাঙ্গীর বাবা টাটা ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। পদার্থ বিজ্ঞানী রাজা র্যামন পারমাণবিক অস্ত্র প্রযুক্তি গবেষণায় অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি পারমাণবিক অস্ত্রের বৈজ্ঞাানিক গবেষণার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করেন এবং তিনি পারমাণবিক পরীক্ষা পর্যবেক্ষণকারী একটি ক্ষুদ্র বিজ্ঞানী টিমের নেতৃত্ব দেন। ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বিজ্ঞানী হোমি বাবার নেতৃত্বে পারমাণবিক কর্মসূচির উন্নয়ন অনুমোদন করেন। ভারত পারমাণিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) আন্দোলনে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিল। কিন্তু দেশটি এ চুক্তিতে স্বাক্ষর দান না করার সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৭২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পারমাণবিক ডিভাইস তৈরি এবং তা পরীক্ষা করার জন্য বাবা এটমিক রিসার্চ সেন্টারের (বেএআরসি) বিজ্ঞানীদের মৌখিকভাবে অনুমোদন দেন। তার অনুমোদন দানের পর ডিভাইসের প্রকৌশল কাজ শুরু হয়। একইসঙ্গে একটি উপযুক্ত পরীক্ষাস্থল খুঁজে বের করার এবং তার জরিপ কাজও শুরু হয়। নির্মাণকালে ‘পিসফুল নিউক্লিয়ার এক্সপ্লে¬াসিভ’ হিসেবে আখ্যায়িত এ ডিভাইস সাধারণভাবে ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’ হিসেবে পরিচিত। বাবা এটমিক রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক ড. রাজা র্যামন ছিলেন পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রধান রূপকার। অন্যদের মধ্যে ছিলেন পিকে আয়াঙ্গার, রাজাগোপাল চিদাম্বরাম ও নাগাপট্টিনাম সম্বাসিব ভেঙ্কটেশ্বর। বিস্ফোরণ ঘটানোর সমন্বয় সাধনে রাজা র্যামন প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার (ডিআরডিও) পরিচালক ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ড. বাসন্তী দুলাল নাগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভবে কাজ করছিলেন। র্যামনের সহকারী হিসেবে পিকে আয়াঙ্গার পারমাণবিক ডিভাইস উদ্ভাবনের দিকনির্দেশনায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। অন্যদিকে ড. আর. চিদাম্বরাম নিউক্লিয়ার সিস্টেম ডিজাইন তৈরিতে নেতৃত্ব দেন।
১৯৬৭-১৯৭৬ সাল পর্যন্ত এ প্রকল্পে ৭৫ জন বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীর বেশি লোক নিয়োগ করা হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত আমেরিকান ডিজাইনের ভিত্তিতে চন্ডিগড়ে টার্মিনাল ব্যালিস্টিক রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে (টিবিআরএল) উদ্ভাবিত এ ডিভাইসে উচ্চ বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়। তবে ভারতীয় ডিজাইন ছিল আমেরিকান ডিজাইনের চেয়ে মামুলি ও অনগ্রসর। স্বাভাবিক ঘনত্ব দ্বিগুণ করার প্রয়োজনে ডিভাইসের মূল অংশকে সংকুচিত করা হয়। এ লক্ষ্যে উচ্চতাপ সৃষ্টিকারী সিস্টেম ব্যবহার করা হয়। ভারতীয়রা ১৯৪৫ সালে আমেরিকার প্রথম আণবিক বিস্ফোরণ ‘ট্রিনিটি’র অনুরূপ আরডিএক্স ও টিএনটির একটি মিশ্রণকে ত্বরিত বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহার করে। ধীর বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহার করা হয় ব্যারাটল (ব্যারিয়াম নাইট্রেট ও টিএনটি)। অভ্যন্তরীণ ধীর বিস্ফোরক যন্ত্রটি ছিল শিব লিঙ্গের মতো। ডিভাইসে ১২টি লেন্স ব্যবহার করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে আমেরিকা ৩২ লেন্সের ‘সসার বল’ সিস্টেম উদ্ভাবন করেছিল। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত নাগাপট্টিনাম ডেঙ্কটেশ্বর টিবিআরএল-এ ডিভাইস নির্মাণকালে ৫ শতাধিক লেন্স পরীক্ষা করেন। ডিভাইসের জন্য যেসব ডেটোনেটর উদ্ভাবন করা হয় সেগুলো ছিল সীসা দিয়ে তৈরি স্পার্ক গ্যাপ ডেটোনেটর। এসব ডেটোনেটর ছিল উচ্চ তাপ সৃষ্টিকারী সিস্টেমের জন্য প্রয়োজনীয় তীব্র গতিসম্পন্ন। তবে এগুলো ছিল আমেরিকার ম্যানহাটন প্রকল্পে বৈজ্ঞানিক আলভারেজ উদ্ভাবিত অত্যাধুনিক ডেটোনেটরের চেয়ে নিম্মমানের। স্পার্ক গ্যাপ ডেটোনেটর সবচেয়ে অনিরাপদ ডেটোনেটর। বিস্ফোরণকালে স্থায়ীভাবে আণবিক কণা বিদারণ অথবা শক্তি উৎপন্ন হলে এগুলো ভস্মীভূত হয়ে যেতে পারে। ভারতে এ জাতীয় ডেটোনেটর কেবলমাত্র ১৯৭৪ সালের বিস্ফোরণে ব্যবহার করা হয়। পরে এগুলোর স্থলাভিষিক্ত হয় আরো আধুনিক ডেটোনেটর। ডিভাইসে বিস্ফোরণ ঘটাতে উচ্চ গতিসম্পন্ন গ্যাস টিউব সুইচ তৈরি করা হয়। ডিভাইসের জন্য প্লুটোনিয়াম সরবরাহ একটি সমস্যা হয়ে দেখা দেয়।
১৯৭০ সালে ফোনিক্স প্লুটোনিয়াম প্লান্টে গুরুতর ফাটল ধরা পড়ে এবং ফাটল দেখা দেয়ায় এ প্ল¬ান্ট বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল যে, এক বছরের মধ্যে এ প্ল্যান্টে উৎপাদন শুরু করা যাবে। কিন্তু ১৯৭২ সালের গোড়ার দিকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সেখানে প্লুটোনিয়ামকে বিযুক্ত করতে আরো এক বা দুবছর সময়ের প্রয়োজন হবে। পূর্ণিমা প্ল¬ান্ট নির্মাণের পর সেখান থেকেও পর্যাপ্ত প্লুটোনিয়াম পাওয়া যায়নি। ৮ মাস পর উৎপাদন শুরু হলে ড. র্যামন ১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে এ প্লান্ট বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেন যাতে প্ল¬ান্টের জ্বালানি নিউক্লিয়ার ডিভাইস তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। তখনকার ভারতীয় ডিজাইনের জন্য প্রয়োজন ছিল ৬ কেজি প্লুটোনিয়াম। ‘ট্রিনিটি’ ও ‘ফ্যাট ম্যান’ আণবিক বোমায় যুক্তরাষ্ট্র ৬ দশমিক ২ কেজি কওে প্লুটোনিয়াম ব্যবহার করেছিল। ভারতীয় ডিভাইস ছিল অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র। পূর্ণিমায় প্লুটোনিয়াম ছিল মাত্র ১৮ কেজি। অতএব ১৯৭৪ সালে ভারতের কাছে তিনটির বেশি বোমা বানানোর প্লুটোনিয়াম ছিল না। বাবা এটমিক রিসার্চ সেন্টারের রেডিও মেটালারজি বিভাগের পিআর. রায়ের নেতৃত্বে একটি টিম সত্যিকার প্লুটোনিয়াম কোর বা মূল যন্ত্র উদ্ভাবন করে। এ টিম পূর্ণিমা প্লান্টের জন্য প্লুটোনিয়াম জ্বালানি রডও তৈরি করে।
১৯৭২ সালের মাঝামাঝি নিউট্রন বিদারণ কাজ শুরু হয় এবং এ কাজ প্রকল্পের একটি জটিল অধ্যায়ে পরিণত হয়। ১৯৭৪ সালের মে নাগাদ প্রস্তুতি সম্পন্ন করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ভিকে আয়া কাজের জটিলতা অনুধাবনে সক্ষম হন। শুরুতে টিএস. মূর্তি হিসাব করেছিলেন যে, প্রয়োজনীয় সবকিছু পেলে ১৮ মাসের মধ্যে প্লুটোনিয়াম তৈরি করা যাবে। তবে বিপুল পরিমাণ প্লুটোনিয়াম উৎপাদন এবং এগুলো ব্যবহারের কৌশল না জানা ছিল আরেকটি বিরাট সমস্যা। নিউট্রন বিদারণের সাংকেতিক নাম দেয়া হয় ‘ফ্লাওয়ার’। এ ধরনের নামকরণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ভারতীয় বিজ্ঞানী চেনগাপ্পা বলেন, ধারণা করা হচ্ছিল যে, ভারতীয় টিম পদ্মফুল আকৃতির একটি যন্ত্রের ওপর প্লুটোনিয়াম স্থাপন করেছে এবং প্লুটোনিয়াম ভর্তি যন্ত্রটি একটি ধাতব আবরণে আবৃত করে রাখা হয়েছে।
বাবা এটমিক রিসার্চ সেন্টারের সাইরাস রিঅ্যাক্টরে উৎপাদিত ৬ কেজি প্লুটোনিয়ামের সাহায্যে ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’ ডিভাইস তৈরি করা হয়। ১৯৭২ সালের মধ্যে মৌলিক ডিজাইন তৈরি হয়ে যায়। প্লুটোনিয়াম বিযুক্তকরণ, শোধন ও উৎপাদন এবং উচ্চ তাপ সৃষ্টিকারী লেন্স সিস্টেম ও আনুষঙ্গিক ইলেকক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনে লেগে যায় দুবছর। অধিকাংশ কাজ সম্পন্ন করা হয় বিএসআরসিতে। তবে ডিফেন্স রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ডিআরডিও) বিস্ফোরণোক্ষম লেন্স তৈরি করে। নিউট্রন বিদারক ছিল একটি পুলোনিয়াম-২১০ বেরিলিয়াম টাইপের।
বিস্ফোরণস্থলে পরিবহন করে নিয়ে যাবার আগে পুরো ডিভাইটি ট্রম্বেতে সংযোজন করা হয়। পুরোপুরিভাবে সংযোজিত ডিভাইসে এক দশমিক ২৫ মিটার ব্যাসের ষড়ভুজাকৃতির একটি ক্রস সেকসন ছিল এবং তার ওজন ছিল এক হাজার ৪ শো কেজি। ভারতের রাজস্থানের থর মরভূমিতে পোখরান পরীক্ষা ক্ষেত্রে সকাল ৮টা ৫ মিনিটে এ বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সরকারিভাবে বিস্ফোরণ ক্ষমতা ১২ কিলোটন দাবি করা হলেও বাইরের হিসাবে ২ থেকে ২০ কিলোটন দাবি করা হয়।
১৯৭৪ সালের ১৮ মে গৌতম বুদ্ধের জন্মদিন বুদ্ধ জয়ন্তী হওয়ায় বিস্ফোরণ প্রকল্পের সাংকেতিক নাম দেয়া হয় ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’। তবে আমেরিকার সামরিক সূত্র অনুযায়ী এ প্রকল্পের সাংকেতিক নাম ছিল ‘অপারেশন হ্যাপি কৃষ্ণ’। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে বিস্ফোরণস্থলে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন অনুপস্থিত। বিস্ফোরণ ঘটানোর সংবাদ ইন্দিরা মন্ত্রিসভায় জানতেন একমাত্র তিনি এবং তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও সাবেক মুখ্য সচিব পিএন হাক্সার এবং মুখ্য সচিব ডিপি ধর। প্রতিরক্ষামন্ত্রীসহ কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে অবহিত করা হয়নি। ১৯৭৪ সালের ১৮ মে সফল বিস্ফোরণের পর ড. র্যামন এ সুসংবাদ প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন বহু দূরে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হটলাইন অকেজো হয়ে গেলে তিনি নিকটবর্তী গ্রামে যান এবং একটি সাধারণ টেলিফোনে প্রধানমন্ত্রীকে জানান, ‘ম্যাডাম অবশেষে বুদ্ধ হেসেছে।’
পোখরান হচ্ছে রাজস্থান রাজ্যের জয়সিলমার জেলার একটি ছোট্ট গ্রামের নাম। এখানে ভারতের চারটি অনুশীলন ক্ষেত্রে রয়েছে। একটির নাম রেঞ্জ-এ। এখানে সর্বোচ্চ ৪০ কিলোমিটার পাল¬ার কামানের গোলাবর্ষণ অনুশীলন করা হয়। রেঞ্জ বি-তে চালানো হয় ট্যাঙ্কের মহড়া। রেঞ্জ-সি ভারতীয় বিমানবাহিনীর ব্যবহৃত একটি ক্ষেত্র। রেঞ্জ-ডি হচ্ছে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটানোর স্থল। রেঞ্জ-ডি পরিবেষ্টন করে রাখা হয় এবং এ রেঞ্জ হচ্ছে একটি সংরক্ষিত এলাকা।
রাজস্থানের রাজধানী যোধপুরে মোতায়েন ৬১তম ভারতীয় প্রকৌশল রেজিমেন্টকে পোখরান পরীক্ষা ক্ষেত্রে গভীর খাদ খনন করার দায়িত্ব দেয়া হয়। ড. র্যামন গভীর কূপ খনন করার জন্য ১৯৭৩ সালের মে মাসে এ রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুব্রাওয়ালের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জেনারেল বেবুরকে নির্দেশ দেয়ার আগে জুন নাগাদ সেনাবাহিনী কোনো সহযোগিতা করেনি। গভীর কূপ খননে এ ইউনিটের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় ঝামেলা হলেও কাজ এগিয়ে চলে। কূপ খননের সাংকেতিক নাম ছিল ‘অপারেশন ড্রাই এন্টারপ্রাইজ’। প্রকৌশলী ও সৈন্যদের জানানো হয় যে, পোখরান অঞ্চলে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহে এ কূপ খনন করা হচ্ছে। ১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পে বিপর্যয় দেখা দেয়। খননকালে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর উন্মোচিত হয়ে পড়ে। ফলে পানি উঠতে থাকে। প্রবাহ বন্ধের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। পানি ওঠা বন্ধ করতে না পারায় কূপটি পরিত্যক্ত হয়। জনবসতিশূন্য গ্রাম মালকির কাছে একটি নয়া কূপ খনন শুরু হয়। ১৯৭৪ সালের ফেব্র“য়ারিতে কূপ খনন শুরু হয় এবং ১৮ মে’র কয়েক দিন আগে শেষ হয়।
তার মানে হলো ভারত ১৯৭৪ সালে দুটি পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায়। তবে প্রথম বিস্ফোরণটি ব্যর্থ হয়। বিস্ফোরণের আগে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বেশ কটি বৈঠক হয়। এসব বৈঠকে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন ড. র্যামন, এটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান হোমি শেঠ, ডিআরডিও’র প্রধান নাগ চৌধুরী, পিএন হাক্সার ও ডিপি ধর। প্রথম বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় ফেব্র“য়ারিতে। বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ায় এই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল যে, পারমাণবিক ডিভাইস তৈরি সম্পন্ন হওয়ার পথে। ১৮ মে বিস্ফোরণের কয়েক সপ্তাহ আগে চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ডিপি ধর ও হাক্সার বিস্ফোরণের বিরোধিতা করেন। অন্যদিকে পিএনই কর্মসূচির নেতৃবৃন্দ দৃঢ়ভাবে বিস্ফোরণের প্রতি সমর্থন জানান। উভয়পক্ষের বাদানুবাদের মুখে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিস্ফোরণ ঘটানোর নির্দেশ দেন।
চিদাম্বরাম ও রায়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সেনাবাহিনীর একটি সাঁজোয়া যানে ট্রম্বে থেকে পোখরানে মূল কাঠামো বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়। প্লুটোনিয়াম ছিল একটি বিশেষ বাক্সে প্যাকেটকরা। সাঁজোয়া যানে র্যামনও ছিলেন। ৯ শো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে তিনদিন সময় লাগে। টিবিআরএল থেকে ট্রাকে করে বিস্ফোরক লেন্স ও বিপুল তাপ উৎপাদনকারী অন্যান্য যন্ত্রপাতি পাঠানো হয়। বিস্ফোরণের ক্ষমতা রেকর্ড করার জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরাও পাঠানো হয়। কূপ থেকে ৪০ মাইল দূরে একটি কুঁড়েঘরে ডিভাইস সংযোজন করা হয়। সোনি, কাকোদগার, আয়াঙ্গার, ভেঙ্কটেশ্বর ও বালাকৃষ্ণকে নিয়ে গঠিত একটি টিম ১৩ মে থেকে ডিভাইসের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সংযোজন শুরু করে। সংযোজন প্রক্রিয়াকালে প্লুটোনিয়ামে তৈরি মূল অংশ তামার একটি ডিস্কে উঠানো হয়। মরুভূমির উত্তপ্ত তাপমাত্রায় মূল অংশ যথাযথভাবে সংযোজন করা যায়নি। তাতে সংযোজন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরদিন সকালে পুনরায় সংযোজন প্রচেষ্টা শুরু করা হলে সফলতা আসে। প্রতিটি লেন্সের ওজন ছিল আনুমানিক এক শো কেজি। প্রতিটি লেন্স বহনের জন্য প্রয়োজন ছিল ৪ জন লোক। ডিভাইসের উভয় অংশ সংযোজন সম্পূর্ণ হয়। প্রতিটি অংশে ছিল ৬টি করে লেন্স। নির্দিষ্ট জায়গায় স্থাপন করার জন্য ক্রেন দিয়ে প্রথম অংশটি উঠানো হয়। উঠানোর সময় একটি লেন্স পতিত হয়। মাটিতে পড়ে গিয়ে লেন্সটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়। প্রতিস্থাপনের জন্য তখন একটি মাত্র লেন্স হাতে ছিল। রাত নেমে আসার পর সংযোজন প্রক্রিয়া শেষ হয়। হেক্সাগোনাল নামে ডিভাইসটি একটি ধাতব তেপায়ার ওপর উঠানো হয় এবং রেলগাড়িতে করে কূপে নিয়ে যাওয়া হয়। সেনাবাহিনী বালি দিয়ে কূপটি ঢেকে রেখেছিল।
১৫ মে ভোরে ডিভাইস কূপে নামানো হয়। এল আকৃতির কূপের কোণে একটি গর্তের শেষ মাথায় ডিভাইসটি স্থাপন করা হয়। কূপের পাশে পিচ্ছিল কাদা থাকায় ফায়ারিং সার্কিটের নির্ভুলতা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দেয়। ফায়ারিং সার্কিট পরীক্ষা করার জন্য বালাকৃষ্ণ নিচে নামেন। অবশেষে বালি ও সিমেন্ট দিয়ে কূপটি সীল করে দেয়া হয়। বিস্ফোরণে নিয়োজিত টিম ১৮ মে পরীক্ষাস্থল থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে বিশ্রাম গ্রহণ করে। পিএনই প্রজেক্টের সিনিয়র নেতৃবৃন্দসহ সবাই উপস্থিত ছিলেন। সংযোজনের দায়িত্বে নিয়োজিত টিম ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন র্যামন, ভিএস শেঠি, নাগ, চৌধুরী, চিদাম্বরাম, সিক্কা, শ্রীনিবাস, দস্তগীর, মূর্তি, রায়, জেনারেল বেবুর ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুব্রাওয়াল। সকাল ৮ টায় বিস্ফোরণ ঘটানোর কথা ছিল। কিন্তু টিবিআরএল’র প্রকৌশলী ভিএস শেঠি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরা পরীক্ষা করতে গিয়ে পরীক্ষাস্থলে আটকা পড়েন। তার জীপ স্টার্ট নিচ্ছিল না। নির্ধারিত সময়ে বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য তিনি হাজির হন। কিন্তু তার জীপটি উদ্ধারে সেনাবাহিনীর প্রচেষ্টায় বিস্ফোরণে ৫ মিনিট বিলম্ব করা হয়। অবশেষে সকাল ৮টা ৫ মিনিটে দস্তগীর বোতামে টিপ দেন।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম কখন বিস্ফোরণের কথা জানতে পেরেছিলেন এ ব্যাপারে দ্বিমত রয়েছে। পার্কোভিচের ভাষ্য অনুযায়ী তিনি ৮ মে জানতে পেরেছিলেন। তবে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মতামত নেয়া হয়নি। অন্যদিকে চেনগাপ্পা দাবি করেছেন, বিস্ফোরণ ঘটানোর পর তাকে অবহিত করা হয়। পার্কোভিচ আরো দাবি করেন, ৪৮ ঘণ্টা আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংকে জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীকে বিস্ফোরণের খবর পাঠাতে কয়েকটি সমস্যা দেখা দেয়। ভিএস শেঠি বাংকারে স্থাপিত একটি ফিল্ড টেলিফোনের মাধ্যমে ডিপি ধরের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি সংবাদটি দেয়ার আগে লাইন অকেজো হয়ে যায়। কর্নেল সুব্রাওয়াল অন্য একটি টেলিফোনে চেষ্টা করার জন্য শেঠিকে পোখরান গ্রামে নিয়ে যান। কিন্তু শেঠি ধরের টেলিফোন নাম্বার ভুলে যান। সুব্রাওয়াল টেলিফোন অপারেটরের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন। তবে জেনারেল বেবুর তার ১০ মিনিট আগে পোখরান গ্রামের একটি টেলিফোনের মাধ্যমে ধরকে সফল বিস্ফোরণের সংবাদ দেন।
আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়ার পর থেকে ভারতের প্রথম আণবিক বিস্ফোরণ ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’ নামে পরিচিত। সম্ভবত ডিপি ধর এ নামকরণ করেছিলেন। নামকরণের জট খোলা কঠিন। প্রকৃতপক্ষে পরীক্ষার কোনো আনুষ্ঠানিক সাংকেতিক নাম ছিল না। চেনগাপ্পা এ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, এটি একটি কল্পকাহিনী। মৃত্যুর আগে পিএন হাক্সার এক সাক্ষাৎকারে স্মাইলিং বুদ্ধ নামকরণের সত্যতা নিশ্চিত করতে অস্বীকার করেন। শেঠিও এ ধরনের সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করার সত্যতা অস্বীকার করেন। ডিপি ধর তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, এ ধরনের কোনো শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয়নি এবং তিনি এ সাংকেতিক নাম দেননি। র্যামন দাবি করেন, শেঠি তাকে জানিয়েছেন, এ সাংকেতিক শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে এবং এ কটি শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন ডিপি ধর। শেঠি বিশ্বাস করেন যে, বিস্ফোরণের পর ধর এ সাংকেতিক নাম দিয়ে থাকবেন।
স্মাইলিং বুদ্ধ-এর বিস্ফোরণ ক্ষমতা কত ছিল তা নিয়ে বির্তক রয়েছে। পত্রপত্রিকার খবরে প্রায়ই বিস্ফোরণের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ২০ এবং সর্বনিম্ন ২ কিলোটন হিসেবে উল্লে¬খ করা হয়। সরকারিভাবে বিস্ফোরণ ক্ষমতা ১২ কিলোটন নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে ভূকম্পন জরিপ এবং সৃষ্ট গর্তের নমুনা আভাস দিচ্ছে যে, বিস্ফোরণ ক্ষমতা ছিল স্বল্পমাত্রার। বিশে¬ষণকগণ বিস্ফোরণ ক্ষমতাকে ৪ থেকে ৬ কিলোটন হিসেবে উল্লে¬খ করেন। পরবর্তী সময়ে হোমি শেঠি ও পিকে আয়াঙ্গার স্বীকার করেন যে, বিস্ফোরণের ক্ষমতা সম্পর্কে সরকারি দাবি ছিল অতিরঞ্জিত। আয়াঙ্গার প্রায়ই বলতেন, বিস্ফোরণ ক্ষমতা চিল ৮ থেকে ১০ কিলোটন।
পারমাণবিক ডিভাইস পরীক্ষার পর সংশি¬ষ্ট বিজ্ঞানীগণ জাতীয় বীরে পরিণত হন। ১৯৭৫ সালে বিজ্ঞানী শেঠি, র্যামন ও নাগ চৌধুরীকে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব পদ্মভূষণ-এ ভূষিত করা হয়। অন্যদিকে বিজ্ঞানী আয়াঙ্গার, চিদাম্বরাম, ভেঙ্কটেশ্বর, দস্তগীর ও শেষাদ্রিকে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পদ্মশ্রী খেতাব দেয়া হয়। পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটানোর পর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্দীর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হয়।
লেখাটি ‘আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিরোধ’ থেকে নেয়া। বইটি প্রকাশ করেছে আফসার ব্রাদার্স।)