বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০

নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতা ও রায় নিয়ে বিতর্ক

নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতা ও রায় নিয়ে বিতর্ক
 
নাৎসি জার্মানির আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেমে গেলেও মানবজাতি এখনো এ যুদ্ধের স্মৃতি ভুলতে পারেনি। পরাজিত জার্মানির সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিচারে নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। কিন্তু ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতা ও তাদের রায় তখন থেকেই বিতর্কের একটি বিষয়বস্তু। নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল বিশ্বের জন্য বিপজ্জনক নজির স্থাপন স্থাপন করেছে। এ ট্রাইব্যুনাল বিচারে দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করেছে। 
  ১৯৩৯ সালে জার্মানির পাশাপাশি সোভিয়েত ইউনিয়নও পোল্যান্ডে আগ্রাসন চালায়। পোল্যান্ডে আগ্রাসন চালানোর অপরাধে জার্মান ফিল্ড মার্শাল উইলিয়াম কিটেল, জেনারেল জোডল ও জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী রন রিবেনট্রপকে অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু একই অপরাধে সোভিয়েত ইউনিয়নের কারো বিচার হয়নি। ১৯৩৯ সালে দুটি দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত অনাক্রমণ চুক্তির আওতায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও জার্মানি তাদের প্রতিবেশি পোল্যান্ড আক্রমণ করে। নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল ১৯৩৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে জার্মানির অনাক্রমণ চুক্তিকে ‘জাল’ হিসেবে উল্লেখ করে। শুধু তাই নয়, ইরানে অ্যাংলো-সোভিয়েত আগ্রাসন এবং উইন্টার ওয়ার বা ফিনল্যান্ডে -সোভিয়েত অভিযানকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়নি। এসব ক্রটি থাকায় যুুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি হারলাক ফিস্কে স্টোন নুরেমবার্গ ট্রায়ালকে একটি প্রতারণা হিসেবে আখ্যা দেন।       
  আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত যুদ্ধ হয়েছে তার মধ্যে ভয়াবহতার দিক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে অন্য কোনো যুদ্ধের তুলনা নেই। এ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পৃথিবী দু’টি সামরিক শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়। একদিকে ছিল জার্মানির নেতৃত্বে অক্ষশক্তি এবং আরেকদিকে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মিত্রপক্ষ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। অক্ষশক্তিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে জার্মানি ছাড়া ছিল ইতালি, জাপান ও তুরস্ক। মিত্রপক্ষে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়াসহ ব্রিটিশ কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো। ১৯৩৯ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর যুদ্ধ শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৯৪৫ সালের ৮ মে। যুদ্ধে অক্ষশক্তি পরাজিত হয়ে মিত্রপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করে। অকল্পনীয় নির্যাতনের ভয়ে নাৎসি জার্মানির চ্যান্সেলর ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নায়ক এডলফ হিটলার আত্মহত্যা করেন। বিজয়ী মিত্রপক্ষ তার দেশকে দু’ভাগে বিভক্ত করে ফেলে। আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিম জার্মানি নামে পুঁজিবাদী একটি দেশ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পূর্ব জার্মানি নামে সমাজতান্ত্রিক আরেকটি দেশ আত্মপ্রকাশ করে। জাপানকে ভৌগোলিকভাবে বিভক্ত করা হয়নি একথা সত্যি। কিন্তু দেশটিকে দীর্ঘদিন আমেরিকার দখলদারিত্বের আওতায় কাটাতে হয়েছে। পরাজিত হলে কী নির্মম যাতনা সহ্য করতে হয় জার্মানি ও জাপান হলো তার জ্বলন্ত প্রমাণ।          

  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান খুব সামান্য। আমাদের মধ্যে অনেককে যুদ্ধাপরাধ ও যুদ্ধের নৃশংসতা নিয়ে প্রায়ই আলোচনা করতে দেখা যায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, যত দোষ সব অক্ষশক্তি বা জার্মানির ঘাড়ে ঢেলে দিয়ে সবাই আলোচনা শেষ করেন। কারো আলোচনায় যুদ্ধের নিরপেক্ষ চিত্র ফুটে উঠে না। বন্দি শিবিরে জার্মানদের নির্যাতন, ইহুদী নিধন হলোকাস্ট, জাতিগত শুদ্ধি অভিযান এবং পূর্ব রণাঙ্গনে রুশ বন্দিদের সঙ্গে অমানবিক আচরণের উপাখ্যান অনেকেরই জানা। এসব ঘটনা যুদ্ধের একটি পৃষ্ঠা। কিন্তু অন্য পৃষ্ঠার ঘটনাবলী অনেকের কাছেই অজ্ঞাত। যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ মিত্রশক্তি আন্তর্জাতিকভাবে এমন একটি অপ্রতিহত অবস্থানে পৌঁছে যায় যেখানে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল না এবং এখনো সম্ভব নয়। সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় মিত্রশক্তি পরাজিত দেশগুলোর যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞা নির্ধারণ এবং তাদের বিচার করে। নুরেমবার্গ ট্রায়াল বিচারের নামে বিশ্বে এমন এক বিপজ্জনক নজির স্থাপন করেছে যে, পরবর্তীকালে বহু বিজয়ী শক্তি তাদের পরাজিত প্রতিপক্ষকে নির্মূলে অনুরূপ প্রহসনসূলক বিচারের আয়োজন করে। ১৯৪৫ সালে পরাজিত জার্মানির সঙ্গে মিত্রবাহিনীর আচরণকে অমানবিক বললেও কম বলা হবে। জার্মানির আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেমে গিয়েছিল সত্যি। কিন্তু একইসঙ্গে শুরু হয়েছিল জার্মানদের নজিরবিহীন দুর্ভোগ। বিজয়ী মিত্রবাহিনী ধ্বংস, লুটতরাজ, দুর্ভিক্ষ, ধর্ষণ, জাতিগত নির্মূল অভিযান এবং গণহত্যার এক ভয়ংকর যুগের সূচনা ঘটায়। আন্তর্জাতিক টাইম ম্যাগাজিন পরাজিত জার্মানির এ পরিণতিকে ইতিহাসের সবচেয়ে ‘বিভীষিকাময় শান্তি’ হিসাবে আখ্যায়িত করে। অধিকাংশ রাজনীতিবিদ, প-িত, ঐতিহাসিক ও গবেষক ইতিহাসের এ ‘অজ্ঞাত হলোকাস্ট’কে এড়িয়ে যাচ্ছেন।                                                     
   দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে নির্মোহ আলোচনা করলে দেখা যাবে যে, পরাজিত অক্ষশক্তির চেয়ে বিজয়ী মিত্রবাহিনীর অপরাধের সংখ্যা বেশি। যুদ্ধের সবচেয়ে নির্মম ট্র্যাজেডি হলো এটাই যে, বিজয়ীদের তুষ্টি অনুযায়ী ইতিহাস লিখা হয়। ইতিহাসে পরাজিতরা অপরাধী হিসাবে সাব্যস্ত হয়। তাদের পক্ষে কেউ দাঁড়ায় না। তার মানে এই নয় যে, তাদের পক্ষে কোনো কালে কেউ দাঁড়াবে না। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ এন্থনি বীভার, নরম্যান নাইমাক, নিয়েল ফার্গুসান এবং জার্মান ইতিহাসবিদ অনিতা গ্রোসম্যান অত্যন্ত শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। এসব বিবেকবান ঐতিহাসিক মানবজাতির সামনে অজানা অধ্যায় উন্মোচিত করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি অক্ষশক্তির বেসামরিক লোক ও সৈন্যদের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন নৃশংসতা দেখিয়েছে। তাদের এসব আচরণ যুদ্ধের আইনের সুস্পষ্ট লংঘন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে অক্ষশক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করা হয়। এসব বিচারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রায়াল। লন্ডন চার্টারের কর্তৃত্ব বলে এসব আদালত গঠন করা হয়। লন্ডন চার্টারে কেবলমাত্র অক্ষশক্তির যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ বিবেচনা করা হয়। মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বহু অভিযোগ ছিল। এসব অভিযোগ তদন্ত করে অভিযুক্তদের সামরিক আদালতে বিচার করা হয়। কিন্তু এসব বিচার নুরেমবার্গ বা টোকিও ট্রাইব্যুনালের মতো ছিল না। এছাড়া মিত্রশক্তির যুদ্ধাপরাধের কয়েকটি অভিযোগ তদন্ত করা হয়নি। জেনেভা কনভেনশনে যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হলেও যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক আদালতের মানদ- নির্ধারণ করা হয়নি। জেনেভা কনভেনশনে যদি এমন শর্ত থাকতো যে, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষের নিয়ন্ত্রণ, প্রভাব কিংবা কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না তাহলে এত বছর পরও নুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রাইব্যুনালের রায় নিয়ে প্রশ্ন উঠতো না। এছাড়া নিজেদের অপরাধ আড়াল করার জন্য মিত্রশক্তি বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপর জেনেভা কনভেনশন থেকে তাদের প্রত্যাহার করে নেয়। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন কখনো জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষর দান করেনি। নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের মানদ- নিরপেক্ষভাবে প্রয়োগ করা হলে আমেরিকান, সোভিয়েত এবং মিত্রপক্ষের বহু সামরিক ও রাজনৈতিক নেতাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে হতো। পরাজিত হলে জার্মানির প্রতি বিজয়ীদের আচরণ কী হতে পারে সে সম্পর্কে সজাগ থাকায় যুদ্ধের চূড়ান্ত মাসগুলোতে জার্মানরা মরিয়া হয়ে যুদ্ধ অব্যাহত রাখে। যুদ্ধের দু’বছর পর জার্মানির প্রতি আমেরিকা ও ব্রিটিশদের নীতিতে পরিবর্তন আসে। এ দু’টি দেশ জার্মানদের সম্ভাব্য মিত্র হিসেবে ভাবতে শুরু করে এবং তাদের সমর্থন কামনা করে। কোনো মানবিক তাগিদে নয়, সোভিয়েত সম্প্রসারণের ভয়ে পাশ্চাত্যের নীতিতে জার্মানির প্রতি তাদের মনোভাবে বদলে যায়। 
  
নুরেমবার্গ ট্রায়াল
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও হলোকাস্টে জড়িত নাৎসিদের দু’টি পৃথক বিচারের সাধারণ নাম নুরেমবার্গ ট্রায়াল বা নুরেমবার্গ বিচার। ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত জার্মানির নুরেমবার্গ শহরে নুরেমবার্গ প্যালেস অব জাস্টিসে এ বিচার অনুষ্ঠিত হয়। এসব বিচারের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত বিচার ছিল আন্তর্জাতিক সামরিক আদালত বা আইএমটিতে মূল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এ আদালতে নাৎসি জার্মানির ২৪ জন গুরুত্বপূর্ণ নেতার বিচার করা হয়। ১৯৪৫ সালের ২০ নভেম্বর থেকে ১৯৪৬ সালের পহেলা অক্টোবর পর্যন্ত এ বিচার চলে। ১৯৪৫ সালের ৮ আগস্ট ঘোষিত লন্ডন সনদের ভিত্তিতে এ বিচারের আইনগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। লন্ডন সনদে এ বিচার ইউরোপীয় অক্ষ দেশগুলোর মূল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। এ সনদে এটাও উল্লেখ করা হয় যে, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে মিত্রপক্ষের বিরুদ্ধে উত্থাপিত যুদ্ধাপরাধের বিচার করা হবে না। জার্মানির আত্মসমর্পণের দলিলে বর্ণিত শর্তাবলী ছিল এ আদালতের এখতিয়ারের আইনগত ভিত্তি। আত্মসমর্পণ করায় জার্মানির রাজনৈতিক কর্তৃত্ব এলায়েড কন্ট্রোল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত হয়। ২৪ জন শীর্ষ জার্মান যুদ্ধবন্দির মধ্যে ২১ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তারা হলেন মার্টিন বোরম্যান (নাৎসি দলের সেক্রেটারি), এডমিরাল কার্ল ডোয়েনিৎস (জার্মান নৌবাহিনী প্রধান), হ্যান্স ফ্রাঙ্ক (অধিকৃত পোল্যান্ডে জার্মানির গভর্নর জেনারেল), উইলহেম ফ্রিক (নাৎসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী), হ্যান্স ফ্রিৎজশি (নাৎসি প্রচার মন্ত্রণালয়ের বার্তা বিভাগের প্রধান), ওয়ালথার ফ্রাঙ্ক (অর্থমন্ত্রী), ফিল্ড মার্শাল গোয়েরিং (জার্মান বিমান বাহিনী প্রধান), রুডলফ হেস (জার্মানির ডেপুটি ফুয়েরার), জেনারেল আলফ্রেড জোডল (জার্মান সেনাবাহিনী প্রধান), জেনারেল আর্নেস্ট কার্লটেনব্রুনার (এসএস কমান্ডার), ফিল্ড মার্শাল উইলহেম কিটেল (জার্মান সেনাবাহিনীর কমান্ডো প্রধান), গুস্তাভ ভন বোহলেন (শীর্ষ নাৎসি শিল্পপতি), রবার্ট লে (জার্মান শ্রমিক দলের প্রধান), কন্সটান্টাইন ভন নিউরথ (জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী), ফ্রাঞ্জ ভন পাপেন (হিটলারের আমলে জার্মান উপ-চ্যান্সেলর), এডমিরাল এরিক রিডার (জার্মান নৌবাহিনী প্রধান), ভন রিবেনট্রপ (জার্মান পররাষ্ট্র্রমন্ত্রী), আলফ্রেড রোজেনবার্গ (জার্মান বর্ণবাদী তাত্ত্বিক ও মন্ত্রী), আর্নেস্ট ফ্রেডারিক সাউকেল (জেনারেল প্রোনিপোটেনশিয়ারি), ড. হাজেলমার সাচেৎ (জার্মান ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ), বালডর ভন শিরাচ (হিটলারের যুব শাখার প্রধান), আর্থার সেচ ইনকুয়ার্ট (অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর), আলবার্ট স্পিয়ার (জার্মান সমরমন্ত্রী), জুলিয়াস স্ট্রেচার (ডার স্টারমারের প্রকাশক ও প্রতিষ্ঠাতা)।
   নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের বিচারক জন জে. পার্কার ও ফ্রান্সিস বিডল ছিলেন আমেরিকান, লে. কর্নেল আলেক্সান্ডার ভোলচকোভ ও মেজর জেনারেল আইয়নো নিকিৎচেনকো ছিলেন সোভিয়েত, কর্নেল স্যার জিওফ্রে লরেন্স ও নরম্যান বিরকেট ছিলেন ব্রিটিশ, অধ্যাপক হেনরি দনিদিউ দ্য ভাবরেজ ও রবার্ট ফলকো ছিলেন ফরাসি। নুরেমবার্গ ট্রায়ালে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে মুখ্য কৌঁসুলি ছিলেন রবার্ট এইচ. জ্যাকসন, ব্রিটেনের পক্ষে হার্টলি শক্রুজ, সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষে জেনারেল আরএ রুদেনকো এবং ফ্রান্সের পক্ষে ফ্রাঙ্কো দ্য মেনন ও অগাস্টি শাম্পি টিয়ার দ্য রিবেস।
   বিবাদীদের আপিল করার সুযোগ ছিল না। এ ছাড়া বিচারক নিয়োগে তাদের আপত্তি করাও সম্ভব ছিল না। এসব ত্রুটি ও অসঙ্গতি থাকায় বিভিন্ন গ্রুপ ও ব্যক্তি এ ট্রাইব্যুনাল গঠনের  বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কেউ কেউ বলছেন, বিজয়ী শক্তি বিচারক নিয়োগ করায় এ ট্রাইব্যুনাল নিরপেক্ষ ছিল না এবং প্রকৃত বিবেচনায় তাকে আদালত হিসাবে গণ্য করা যায় না। নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষতা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছিল তা একেবারে অমূলক ছিল না। ১৯৩৬-৩৮ সালে নুরেমবার্গ ট্রায়ালে নিয়োজিত প্রধান সোভিয়েত বিচারক নিকিৎচেনকো মস্কোয় স্টালিনের শো ট্রায়ালে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ফলে নুরেমবার্গ ট্রায়ালের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়। পূর্বে কৃত অপরাধের ভিত্তিতে বিবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। কোনো নির্দিষ্ট দেশের নিজস্ব আইনে এসব অভিযোগ আনা হয়নি। বিবাদী পক্ষের কোনো আইনজীবী ছিল না। আদালতে একচেটিয়া ছিল বিজয়ী মিত্রশক্তির প্রতিনিধিত্ব। আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠন সংক্রান্ত সনদের ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল: ‘এ আদালত সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণে টেকনিক্যাল রীতিনীতি মানতে বাধ্য নয়।’ এতে আরো বলা হয়েছিল: ‘এ আদালত রায়দানে যতদূর সম্ভব নিজস্ব বিচারবুুদ্ধি ও নন-টেকনিক্যাল পদ্ধতি অনুসরণ করবে এবং প্রয়োজনীয় বলে বিবেচনা করলে যে কারো সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারবে।’

বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন
নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের পরতে পরতে ছিল ক্রটি। বিচার প্রক্রিয়ার সর্বত্র ছিল ধোঁকা ও প্রতারণা। আমেরিকানরা যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত জার্মানদের নৃশংসতার একটি প্রামাণ্য চিত্র বিবাদীদের দেখতে বাধ্য করে। এ প্রামাণ্য চিত্রে প্রতারণা করে জার্মান শহর ও শিল্প কারখানায় মিত্রবাহিনীর ভয়াবহ বোমাবর্ষণে নিহতদের ছবিও সংযোজন করা হয়। কয়েকজন জার্মানের কাছে প্রতারণা ধরা পড়ে। জার্মান বিমান বাহিনীর একজন সাবেক কর্মকর্র্তা বলেছিলেন: ‘তিনি প্রামাণ্য চিত্রে তার নিজের ছবি দেখতে  পাচ্ছেন।’ আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা ‘ওএসএস’ (সিআইএর পূর্বসূরি) চাইছিল সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা এনকেভিডি স্টাইলে প্রহসনের বিচারে গুলি করে হত্যার বিচার। এ নিয়ে ওএসএস প্রধান ‘ওয়াইল্ড বিল’ ডানোভানের সঙ্গে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের এসোসিয়েট বিচারপতি ও মুখ্য আমেরিকান কৌঁসুলি রবার্ট এইচ. জ্যাকসনের গুরুতর মতপার্থক্য দেখা দেয়। জ্যাকসন তাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন: If we want to shoot Germans as a matter of policy, let it be done as such, but don’t hide the deed behind the court. If you are determined to execute a man in any case, there is no occasion for a trial; the world yields no respect to courts that are merely organized to convict. It would bring the law into contempt if mock tribunals were held with the verdict already decided.’ 
 অর্থাৎ দনীতিগত কারণে আমরা যদি জার্মানদের গুলি করে হত্যা করতে চাই তাহলে সেভাবেই তা করা হোক। তবে আদালতের ভূমিকাকে আড়াল করবেন না। আপনি যদি কোনো মামলায় কাউকে মৃত্যুদ- দিতে চান তাহলে আদালতের প্রয়োজন নেই। কাউকে অভিযুক্ত করার জন্য আদালত গঠন করা হয়ে থাকলে বিশ্ব এ আদালতকে সম্মান করবে না। পূর্বনির্ধারিত রায়ের ভিত্তিতে প্রহসনের আদালত গঠন করা হলে তা হবে আইনের অবমাননা।’ (সূত্র: নুরেমবার্গ: দ্য লাস্ট ব্যাটল: ডেভিড আরভিং: পৃষ্ঠা নম্বর ১৪) 
   ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে এক চিঠিতে নুরেমবার্গ ট্র্রায়ালের ক্রটি নিয়ে প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যানের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে মুখ্য মার্কিন কৌঁসুলি রবার্ট জ্যাকসন লিখেছিলেন,That the Allies have done or are doing some of the very things we are prosecuting the Germans for. The French are so violating the Geneva Convention in the treatment of German prisoners of war that our command is taking back prisoners sent to them [for forced labor in France]. We are prosecuting plunder and our Allies are practicing it. We say aggressive war is a crime and one of our allies asserts sovereignty over the Baltic States based on no title except conquest.’ 
  অর্থাৎ ‘জার্মানদের আমরা যেসব অপরাধে বিচার করছি, আমরাও একই ধরনের কিছু অপরাধ করেছি এবং এখনো করছি। ফরাসিরা জার্মান যুদ্ধবন্দিদের প্রতি তাদের আচরণে জেনেভা কনভেনশন এত লংঘন করেছে যে, আমাদের কমান্ড ফ্রান্সের শ্রম শিবিরে প্রেরিত যুদ্ধবন্দিদের ফিরিয়ে আনছে। আমরা লুণ্ঠনের বিচার করছি এবং আমাদের মিত্ররা এ ঘৃণ্য চর্চা করছে। আমরা আগ্রাসী যুদ্ধকে একটি অপরাধ হিসাবে আখ্যায়িত করছি। কিন্তু আমাদের অন্যতম মিত্র (সোভিয়েত ইউনিয়ন) কোনো বৈধতা ছাড়া শুধুমাত্র সামরিক অভিযানের মাধ্যমে বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোতে নিজের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করছে।’   
    রায় ঘোষণার পরপর নুরেমবার্গ ট্রায়ালে জার্মান জেনারেলদের বিচারে সভাপতিত্বকারী আইওয়া সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি চার্লস এফ. ওয়েনার্সট্রাম মন্তব্য করেছিলেন: ‘আজ আমি যা বুঝতে পারছি, ৭ মাস আগে তা বুঝতে পারলে কখনো এখানে আসতাম না। ঘোষণা করা হয়েছিল একটি মহান আদর্শকে সমুন্নত রাখতে এ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। কিন্তু সে আদর্শের প্রতিফলন ঘটেনি।’ তিনি সতর্কতার সঙ্গে নুরেমবার্গ বিচার প্রক্রিয়ায় ব্যাপকভাবে ইহুদী সম্পৃক্ততা উল্লেখ করে বলেন: ‘এখানকার পুরো পরিবেশ অসুস্থ। বিগত কয়েক বছর আগে যেসব ব্যক্তি আমেরিকান হয়েছে তাদেরকে আইনজীবী, ক্লার্ক, দোভাষী ও গবেষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদের অতীত ইউরোপের ঘৃণা ও প্রতিহিংসায় ভরপুর। নাৎসি নেতৃবৃন্দের অপরাধ সম্পর্কে জার্মানদের বিশ্বাস অর্জন করা ছিল বিচারের উদ্দেশ্য। কিন্তু বিচারে জার্মানদের শুধু এই ধারণা দেয়া হয়েছে যে, প্রবল শক্তিশালী প্রতিপক্ষের কাছে তাদের নেতৃবৃন্দ যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন।’                
   যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হারল্যান ফিস্কে স্টোন নুরেমবার্গ ট্রায়ালকে একটি প্রতারণা হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, Jackson is away conducting his high-grade lynching party in Nuremberg. I don't mind what he does to the Nazis, but I hate to see the pretense that he is running a court and proceeding according to common law. This is a little too sanctimonious a fraud to meet my old-fashioned ideas. 
 অর্থাৎ ‘জ্যাকসন (মুখ্য মার্কিন কৌঁসুলি) নুরেমবার্গে উচ্চ পর্যায়ের ফাঁসি দানে দূরে অবস্থান করছেন। তিনি নাৎসিদের যা করছেন তাতে আমি অসন্তুষ্ট নই। তবে তিনি সাধারণ আইনের ছল ছুঁতায় আদালত ও শুনানি পরিচালনা করায় আমি তাকে ঘৃণা করি। এটা হচ্ছে আমার পুরনো ধারণাকে সত্যি প্রমাণে অতি বকধার্মিক প্রতারণা।’  
  নুরেমবার্গ: দ্য লাস্ট ব্যাটলের রিভিউতে ডানিয়েল ডব্লিউ. মাইকেল লিখেছেন, As Irving shows, the victorious Allies who sat in judgement at Nuremberg were guilty of of many of the same actions or crimes for which they tried (and hanged) the German defendants. Indeed, the Allies very probably outdid the Germans in crimes and atrocities. In some cases, the Nuremberg defendants were charged with or held guilty of crimes that were actually committed by the Allies. Most noteworthy, perhaps, is the massacre of Katyn and elsewhere.’ 
  অর্থাৎ ‘আরভিং দেখিয়েছেন যে, নুরেমবার্গ আদালতে বিচারকের আসনে উপবিষ্ট বিজয়ী মিত্রশক্তি বিবাদী জার্মানদের যেসব অপরাধে বিচার করছেন (ফাঁসি দিয়েছেন), তারা নিজেরাও একই ধরনের বহু কার্যকলাপ অথবা অপরাধে অভিযুক্ত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নুরেমবার্গ ট্রায়াল ঐসব অপরাধে বিবাদীদের দোষী সাব্যস্ত অথবা অভিযুক্ত করেছিল, সত্যিকারভাবে যেসব অপরাধ করেছিল মিত্রপক্ষ। কাতিন এবং অন্যান্য হত্যাযজ্ঞের উদাহরণ সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য।’   
   
টোকিও ট্রাইব্যুনাল 
টোকিও ট্রাইব্যুনালের বৈশিষ্ট্যও ছিল অভিন্ন। টোকিও যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল নামে পরিচিত দূরপ্রাচ্য সংক্রান্ত ট্রায়ালে জাপান সাম্রাজ্যের নেতৃবৃন্দের তিন শ্রেণীর যুদ্ধাপরাধের শাস্তিদানে ১৯৪৬ সালের ২৯ এপ্রিল বিচার শুরু হয়। যুদ্ধ শুরুর যৌথ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত এবং সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ব্যক্তিদের অপরাধকে ‘এ’ শ্রেণী এবং প্রচলিত এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িতদের অপরাধকে ‘বি’ শ্রেণী এবং পরিকল্পনা, নির্দেশ, অনুমোদন অথবা কমান্ড কাঠামোর সর্বোচ্চ পর্যায়ে গৃহীত অপরাধমূলক সিদ্ধান্তে বাধা দানে ব্যর্থ ব্যক্তিদের অপরাধকে ‘সি’ শ্রেণীভুক্ত করা হয়। ২৮ জন জাপানি সামরিক ও রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে ‘এ’ শ্রেণীর এবং ৫ হাজার ৭ শো জনের বেশি জাপানি নাগরিকের বিরুদ্ধে ‘বি’ ও ‘সি’ শ্রেণীর অভিযোগ আনা হয়। জাপান সম্রাট হিরোহিতো এবং রাজপরিবারের সকল সদস্যকে বিচার থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ১৯৪৬ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ম্যাকআর্থার দূরপ্রাচ্য বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনাল (আইএমটিএফই) গঠনের নির্দেশ জারি করেন। একইদিন তিনি আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালের সনদ অনুমোদন করেন। এ সনদে নুরেমবার্গ ট্রায়ালের মডেল অনুসরণ করা হয়। টোকিও ট্রাইব্যুনালের সব ক’জন বিচারক ছিলেন বিদেশি। স্যার উইলিয়াম ওয়েব ট্রাইব্যুনালের সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার কুইবেকের কিংস বেঞ্চ কোর্টের বিচারক। প্রধান কৌঁসুলি জোসেফ বি. কীনানও ছিলেন আমেরিকান। 
    অভিযুক্তদের অধিকাংশ ছিলেন সামরিক ও সরকারি কর্মকর্তা। ‘এ’, ‘বি’, ও ‘সি’ ক্যাটাগরির অপরাধে যেসব বেসামরিক ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয় তারা হলেন প্রধানমন্ত্রী কিকো হিরোতা, প্রিভি কাউন্সিলের সভাপতি ব্যারন কিচিরো হিরানুমা, মুখ্য কেবিনেট সচিব নাওকি হোশিনো, প্রিভি সীলের লর্ড কীপার মার্কিস কোইচি কিডো, ইতালিতে নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত তোশিও শিরাতোরি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিগেনোরি তোগো, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মামুরো শিগামিৎসু, অর্থমন্ত্রী ওকিনোরু কায়া ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউসুকি মাৎসুকা। সামরিক কর্মকর্তাগণ হলেন সাবেক সমরমন্ত্রী ও জাপানের রাজকীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল হাদেকি তোজো, সমরমন্ত্রী জেনারেল সাদাও আরাকি, সাবেক সমরমন্ত্রী ফিল্ড মার্শাল শুনরোকু হাতা, নৌমন্ত্রী ও জাপানের নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল শিগাতারো শিমাদা, চিফ অব মিলিটারি এফেয়ার্স ব্যুরো লে. জেনারেল কেনরায়ো সাতো, কোরিয়ার গভর্নর জেনারেল ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী জেনারেল কুনিয়াকি কোইসো, চিফ অব দ্য ব্যুরো অব নেভাল এফেয়ার্স ভাইস এডমিরাল তাকাজুমি ওকা, জার্মানিতে নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত লে. জেনারেল হিরোশি ওশিমা, জাপানি রাজকীয় নৌবাহিনীর জেনারেল স্টাফ ফ্লিট এডমিরাল নাগানো ওসামি, কোরিয়ায় নিযুক্ত জাপানের সাবেক গভর্নর জেনারেল জিরো মিনামি, মাঞ্চুকুর (চীনের মাঞ্চুরিয়া) গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল কেনজি দোইহারা, বার্মা এরিয়া কমান্ডার জেনারেল হাইতারো কিমুরা, সাংহাই এক্সপিডিশনারী ফোর্সের কমান্ডার জেনারেল আইওয়ানি মাৎসুই, চতুর্দশ আর্মির চিফ অব স্টাফ লে. জেনারেল আকিরা মুতো, সাকুরাকাইয়ের প্রতিষ্ঠাতা কর্নেল কিঙ্গরো হাশিমতো, কোয়াংটাং আর্মির কমান্ডার জেনারেল ইউশিজিরো ইউমেজু, কেবিনেট প্ল্যানিং বোর্ডের প্রধান লে. জেনারেল তেইচি সুজুকি। 
   যুদ্ধাপরাধে ৬ জনকে ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করার রায় দেয়া হয়। তারা হলেন মাঞ্চুকুর গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল কেনজি দোইহারা, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোকি হিরোতা, সমরমন্ত্রী জেনারেল সেইশিরো ইতাগাকি, চতুর্দশ আর্মির চিফ অব স্টাফ লে. জেনারেল আকিরা মুতো, বার্মা এরিয়া কমান্ডার জেনারেল হাইতারো কিমুরা, কোয়াংটাং আর্মির কমান্ডার জেনারেল ইউশিজিরো ইউমেজু। বি ও সি ক্যাটাগরির অপরাধে সাংহাই এক্সপিডিশনারী ফোর্সের কমান্ডার জেনারেল আইওয়ানি মাৎসুইকে ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করার রায় দেয়া হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর ইকেবকুরোর সুগামো কারাগারে তাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। জাপানি জনগণের বৈরি হয়ে উঠার আশঙ্কায় জেনারেল ম্যাকআর্থার প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যানের নির্দেশ অমান্য করেন এবং যে কোনো ধরনের ছবি তোলা নিষিদ্ধ করেন।  
   ১৬ জন অভিযুক্তকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়। তিনজন (কোইসি, শিরাতোরি ও ইউমেজু) কারাগারে মারা যান। বাদবাকি ১৩ জনকে ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে প্যারোলে মুক্তি দেয়া হয়। শতাধিক আইনজীবী অভিযুক্তদের পক্ষে আদালতে দাঁড়ান। তাদের ৭৫ শতাংশ ছিলেন জাপানি এবং ২৫ শতাংশ আমেরিকান। আসামী পক্ষ ১৯৪৭ সালের ২৭ জানুয়ারি তাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন এবং ২২৫ দিনে তাদের বক্তব্য শেষ করেন। বিবাদী পক্ষ যুক্তি দেয় যে, এ আদালত তার আইনগত বৈধতা, নিরপেক্ষতা ও পক্ষপাতহীনতার সন্দেহ থেকে কখনো মুক্ত হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র ট্রাইব্যুনাল পরিচালনায় প্রয়োজনীয় তহবিল ও লোকবল সরবরাহ করে এবং প্রধান কৌঁসুলি নিয়োগ করে।
    বিজয়ী পক্ষ আদালতে এ ধরনের প্রভাব বিস্তার করায় বিচারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। তখন এ ধারণা তৈরি হয় যে, এ ট্রাইব্যুনাল বিজয়ীদের ইচ্ছা পূরণের একটি বাহন। নুরেমবার্গ ট্রায়ালের চেয়ে টোকিও ট্রায়াল ছিল আরো বেশি পক্ষপাতদুষ্ট। মিত্রপক্ষের ১১টি দেশের বিচারক থাকলেও আমেরিকার নেতৃত্বে কৌঁসুলি ছিল মাত্র একটি দেশের। টোকিও ট্রায়ালে সরকারি সমর্থন ছিল নুরেমবার্গ ট্রায়ালের চেয়ে কম। টোকিও ট্রায়ালে মিত্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি সাবেক সহকারি মার্কিন এটর্নি জেনারেল বি. কীনানের অবস্থান ছিল নুরেমবার্গ ট্রায়ালে নিয়োজিত মুখ্য আমেরিকান কৌঁসুলি রবার্ট এইচ. জ্যাকসনের চেয়ে দুর্বল। টোকিও ট্রায়ালের অন্যতম বিচারক ফিলিপাইনের কর্নেল ডেলফিন জারানিলাকে জাপানিরা বন্দি করেছিল। তিনি বাতান ‘ডেথ মার্চ’ থেকে পালিয়ে যান। তার নিরপেক্ষতা নিয়ে গুরুতর সন্দেহ থাকায় বিবাদী পক্ষ বেঞ্চ থেকে তাকে অপসারণের দাবি করে। এ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা হয়। টোকিও ট্রায়ালের আরেক বিচারক ভারতের রাধাবিনোদ পাল পাশ্চাত্যের ঔপনিবেশবাদ এবং জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্রের আণবিক বোমা নিক্ষেপকে আদালতের বিচার্য বিষয়ের তালিকা থেকে বাদ দেয়ায় এবং বেঞ্চে পরাজিত দেশগুলোর বিচারক না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন: ‘এ ট্রায়াল বিজয়ীদের প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে।’ ভারতীয় জুরিদের মধ্যে রাধাবিনোদ একা নন, কলকাতার বিখ্যাত ব্যারিস্টার বিচারপতি বিভিএ রোলিং-ও পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তিনি লিখেছেন: ‘টোকিও ট্রাইব্যুনাল বিচারকের উয়িগে একটি তরবারির চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। অবশ্যই আমরা মিত্রবাহিনীর বোমাবর্ষণে ইয়োকোহামা, টোকিও এবং অন্য বড় শহরগুলোকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার ব্যাপারে সচেতন ছিলাম। আমরা যুদ্ধের আইনকে সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্যে টোকিও ট্রায়ালে অংশগ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু আমরা প্রতিদিন মিত্রবাহিনীকে ভয়ংকরভাবে যুদ্ধের আইন লংঘন করতে দেখেছি।’  
টোকিও ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হওয়ার ১০ দিন পর ১৯৪৬ সালের ১৪ মে বিবাদী পক্ষের কৌঁসুলি ক্যাপ্টেন জর্জ ফার্নেস দ্বিতীয় বিশ্বযুুদ্ধে বিজয়ীদের পরিচালিত ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষতা নিয়ে গুরুতর সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন: ‘এ ট্রাইব্যুনালের সদস্যদের ব্যক্তিগত জ্ঞাত সততা নির্বিশেষে আমরা বলতে চাই যে, তাদের নিযুক্তির শর্ত অনুযায়ী তারা নিরপেক্ষ হতে পারেন না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আজ অথবা ইতিহাসের যে কোনো সময় এমন একটি ট্রাইব্যুনাল তাদের বৈধতা, নিরপেক্ষতা ও পক্ষপাতিত্ব থেকে মুক্ত হতে পারে না।’ এ যুক্তি দেখিয়ে ক্যাপ্টেন ফার্নেস যুদ্ধের প্রতিহিংসা ও ঘৃণা থেকে মুক্ত নিরপেক্ষ দেশের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি জানান।  
    ফার্নেসের যুক্তিতর্ক শেষ হওয়ার পর বিবাদী পক্ষের আরেকজন কৌঁসুলি মেজর বেন ব্রুস ব্ল্যাকেনি বলেন, যুদ্ধ হলো একটি জাতির সিদ্ধান্ত। কোনো ব্যক্তির সিদ্ধান্ত নয়। অতএব যুুদ্ধে কোনো হত্যাকা-কে খুন হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। তিনি তার যুক্তির সপক্ষে হিরোশিমায় আণবিক বোমা নিক্ষেপের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন, পার্ল হারবারে জাপানি বোমাবর্ষণে নিহত এডমিরাল কিডের মৃত্যুকে খুন হিসেবে সাব্যস্ত করা হলে হিরোশিমায় কারা আণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছিল আমরা তাদের নাম জানি। আমরা আণবিক বোমা নিক্ষেপের পরিকল্পনাকারী চিফ অব স্টাফ এবং দায়ী রাষ্ট্রের নাম জানি। তারা কি সজ্ঞানে খুন করেছেন? এ ব্যাপারে আমাদের সন্দেহ আছে। সশস্ত্র সংঘাতে একপক্ষের কার্যকলাপ ন্যায় এবং শত্রুপক্ষের কার্যকলাপ অন্যায় হিসেবে সাব্যস্ত করা যাবে না। পার্ল হারবারে জাপানি হামলায় নিহত আমেরিকানদের হত্যাকা-কে ‘খুন’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হলে একই যুক্তিতে আণবিক বোমাবর্ষণের জন্য দায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যান এবং মার্কিন সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল জর্জ সি. মার্শালকে খুনের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা যেতে পারে। কৌঁসুলি মেজর ব্ল্যাকেনি আরো বলেন, হিরোশিমায় জাপানি নাগরিকদের ওপর আণবিক বোমা নিক্ষেপ চতুর্থ হেগ কনভেনশন এবং স্থল যুদ্ধের রীতিনীতির স্পষ্ট লংঘন। 
   ইয়োকোহামায় ‘বি’ শ্রেণীর যুদ্ধাপরাধীদের একটি বিচারে জাপানি শহরগুলোতে আমেরিকান বি-২৯ বোমারু বিমানের বোমাবর্ষণ আদালতের উত্তপ্ত আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন জেনারেল ওকাদা তাসুকু। জেনারেল তাসুকু যথাযথ কোর্ট মার্শাল ছাড়া নাগোয়া সিটিতে ভূপাতিত আমেরিকান বি-২৯ বোমারু বিমানের পাইলটদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। জেনারেল ওকাদার প্রধান কৌঁসুলি আমেরিকান আইনজীবী ড. জোসেফ ফিদারস্টোন তার যুক্তিতর্কে বলেন, আমেরিকান বি-২৯ বোমারু বিমানের পাইলটদের নির্বিচার বোমাবর্ষণে অগণিত জাপানি হতাহত হওয়ায় তারা যুদ্ধবন্দি নয় বরং তারা ছিলেন যুদ্ধাপরাধী। অতএব আমেরিকান পাইলটদের মৃত্যুদ- কার্যকর করা ছিল বৈধ। আদালত জেনারেল ওকাদাকে মৃত্যুদ-ে দ-িত করলেও ফিদারস্টোনের যুক্তি ওকাদার অধঃস্তনদের লঘু শাস্তিদানে আদালতকে প্রভাবিত করেছিল।
দ্বিমুখী নীতি
পশ্চিমা মিত্রশক্তি দাবি করছে যে, তাদের সামরিক বাহিনীকে হেগ ও জেনেভা কনভেনশন মেনে চলতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল এবং তাদের যুদ্ধ ছিল আত্মরক্ষামূলক এবং ন্যায়যুদ্ধ। অনিয়ন্ত্রিত সাবমেরিন যুদ্ধ এবং যুদ্ধ শেষে অক্ষশক্তির সঙ্গে কর্মরত রুশ নাগরিকদের বলপূর্বক সোভিয়েত ইউনিয়নে বহিষ্কারের মতো ঘটনায় এসব আন্তর্জাতিক চুক্তি লংঘন করা হয়। সোভিয়েত সশস্ত্র বাহিনী প্রায়ই যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত হয়। পরবর্তীতে জানা গেছে যে, সোভিয়েত সরকারের নির্দেশেই এসব যুদ্ধাপরাধ করা হয়েেেছ। এসব অপরাধের মধ্যে ছিল আগ্রাসী যুদ্ধ ঘোষণা, ব্যাপক হত্যাকা-, যুদ্ধবন্দিদের গণহত্যা এবং বিজিত দেশগুলোর জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক এন্থনি বীভার জার্মানির পতনকালে জার্মান মহিলাদের ধর্ষণকে ইতিহাসের বৃহত্তম গণধর্ষণ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। তার হিসাবে শুধুমাত্র পূর্ব প্রুশিয়া, পোমেরানিয়া ও সাইলেসিয়ায় কমপক্ষে ১৪ লাখ মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়। ঐতিহাসিক বীভার আরো বলেছেন, বন্দি শিবির থেকে মুক্ত রুশ ও পোলিশ মহিলারাও ধর্ষণের শিকার হয়। 
   জর্গ ফ্রেডারিকসহ কয়েকজন ইতিহাসবিদ বলছেন, জার্মানির কোলন, হামবুর্গ ও ড্রেসডেন, ইতালির ?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ফাইটার জেটের হেলমেট

বর্তমান সময়ে আধুনিক এবং নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফিচার হচ্ছে জেট ফাইটারের ককপিটে বসা এর পাইলটের হেল...