সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২০

কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে স্বাধীনতার ঘোষণা

কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে স্বাধীনতার ঘোষণা  

লেখকঃ সাহাদত হোসেন খান

চট্টগ্রামে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। এ বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা প্রচারিত হওয়া মাত্র যুদ্ধের সংবাদ বিশ্বের জনগণের কাছে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের নাম চারদিকে চারদিকে ছড়িয়ে যায়। কালুরঘাটের অদূরে মদুনাঘাটে এ বেতার কেন্দ্রের তিনটি পর্যায় ছিল। 
চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের প্রথম ঘোষণা ভেসে এসেছিল ২৭ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটে গ্রীনিচ সময় ১৯.৪৫ টায়। চট্টগ্রাম বেতারের ৮ জন ও বহিরাগত ২ জন নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর ঐতিহাসিক ভূমিকায় প্রথম ঘোষণা দেয়া সম্ভব হয়েছিল। তারা হলেন বেলাল মোহাম্মদ (নিজস্ব শিল্পী), আবুল কাশেম সন্দীপ (চট্টগ্রাম ফটিকছড়ি কলেজের তৎকালীন ভাইস প্রিন্সিপাল), সৈয়দ আবদুস শাকের (বেতার প্রকৌশলী), আবদুল্লাহ আল ফারুক (অনুষ্ঠান প্রযোজক), মোস্তফা আনোয়ার (অনুষ্ঠান প্রযোজক), রাশেদুল হাসান (টেকনিক্যাল এসিসট্যান্ট), আমিনুর রহমান (টেকনিক্যাল এসিসট্যান্ট), এ এম শরফুজ্জামান (টেকনিক্যাল অপারেটর), রেজাউল করিম চৌধুরী (টেকনিক্যাল অপারেটর) ও কাজী হাবিবউদ্দিন আহমেদ মনি, রশীদুল হোসেন ও মোস্তফা মনোয়ার। তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ।
গ্রেফতার হওয়ার আগ মুহূর্তে ২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১২টা ২০ মিনিটে  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং শত্র“দের প্রতিহত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে ড. মযহারুল ইসলাম তার ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা’ শিরোনামে বইয়ের ৩৯ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথাগুলো জেনারেল ওসমানী তার ৩২ নম্বর বাড়ির একটি নিভৃত কক্ষে ইংরেজিতে লিখেন। সেখানে তাজউদ্দিন ও আমি উপস্থিত ছিলাম। বঙ্গবন্ধু নিজেই ওসমানীর হাতে কাগজ-কলম তুলে দেন। ডিক্টেশন দেন তিনি নিজেই। তাজউদ্দিন ও আমি শ্রোতা এবং দু’একটি ইংরেজি শব্দের সাহায্যকারী। ২৫ মার্চ দিবাগত রাত সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে কোনো একসময় ঘোষণাটি সম্পূর্ণভাবে বঙ্গবন্ধুর মুসাবিদায় তৈরি ও লিখিত হয়। বঙ্গবন্ধু জেনারেল ওসমানীর হস্তলিখিত ঘোষণাটি রাত ১২টার পরে ওয়ারলেসে চট্টগ্রামে প্রেরণ করেন।’
এক নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকের আলোচিত বই ‘এ টেল অব মিলিয়ন্স’-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ২৫/২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দু’টি ঘোষণা দেন। প্রথম ঘোষণায় তিনি বলেন, `This may be my last message; from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh. Final victory is ours. Joy Bangla.’ এটা আমার শেষ বার্তা হতে পারে। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ যেখানে যে অবস্থায় রয়েছে এবং যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে দখলদার বাহিনীকে শেষ শক্তি দিয়ে মোকাবিলা করার জন্য আমি তাদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটি বিতাড়িত হওয়া নাগাদ আপনারা লড়াই চালিয়ে যান। আমাদের চূড়ান্ত বিজয় হবেই। জয় বাংলা।’ 
দ্বিতীয় ঘোষণায় তিনি বলেন, Today Bangladesh is a sovereign and independent country. On Thursday night, West Pakistani armed forces suddenly attacked the police barracks of Razarbagh and the EPR headquarters at Pilkhana in Dhaka. Many innocent and unarmed have been killed in Dhaka city and other places of Bangladesh.Violent clashes between EPR and Police on the one hand and armed forces of Pakistan on the other, are going on. The Bengalis are fighting the enemy with great courage for an independent Bangladesh. May Allah aid us in our fight for freedom. Joy Bangla.' আজ বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম ও স্বাধীন রাষ্ট্র। বৃহস্পতিবার রাতে পশ্চিম পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী আকস্মিকভাবে রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক এবং ঢাকার পিলখানায় ইপিআর সদরদপ্তরে আক্রমণ চালায়। ঢাকা মহানগরী এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বহু নির্দোষ ও নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে ইপিআর ও পুলিশের তীব্র সংঘর্ষ চলছে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য বাঙালিরা শত্র“র সঙ্গে বীরবিক্রমে লড়াই করছে। আল্লাহ আমাদের সংগ্রামে সহায়তা করুন। জয় বাংলা।’
    বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ কৌশল বিভাগের অধ্যাপক নূরুল্লাহ তৎকালীন বুয়েট ছাত্রনেতা স্থপতি ড. রাশিদুল হাসান খানের সহায়তায় মুজিবের অনুমতিক্রমে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে তার বাসভবনের ছাদে ট্রান্সমিটার স্থাপন করেন। কিন্তু ট্রান্সমিটার বসাবার পর বিকল হয়ে পড়ে। পরে এ বেতার যন্ত্র সচল করা হয়। ২৬ মার্চ এ ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করা হতে থাকে। শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসভবনে পৌঁছে। ২৬ মার্চ তার স্ত্রী ডা. নূরুন্নাহার ঘোষণাটি লিপিবদ্ধ করে তা চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ অফিসে এবং চট্টগ্রামের সলিমপুর ইপিআর ক্যাম্পের নিকটস্থ ওয়ারলেস স্টেশনে পাঠান। ওয়ারলেসের টিটিআর জালাল আহমেদ তা লিখে রাখেন। সহকারি প্রকৌশলী একেএমএস আব্দুল হাকিম মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণা সলিমপুর ওয়ারলেস স্টেশনের কর্মচারি জালাল আহমদ, জুলহাস উদ্দিন টিটিআর, এমডি শফিকুল ইসলাম ইএসডব্লিউ, আবুল কাশেম খান টিটিআর এবং আবুল ফজল ক্যাশিয়ারের সাহায্যে দেশ বিদেশে প্রেরণ করেন। সলিমপুর স্টেশনের দু’টি ভিন্ন চ্যানেল ছিল। একটি ছিল আন্তর্জাতিক মেরিটাইম বিভাগের কোস্টাল অপারেশনাল স্টেশন। এ স্টেশন থেকে সমুদ্রে যে কোন স্থানে জাহাজে বার্তা প্রেরণ করা যেতো। অপরটি ছিল ভিএইচএফ ওয়ারলেস স্টেশন। নিকটে ছিল পাহাড়তলী ইপিআর ক্যাম্প। এ জন্য অনেক সময় সলিমপুর স্টেশনকে ইপিআর স্টেশন বলা হতো। চট্টগ্রামের সলিমপুর স্টেশন থেকে প্রেরিত স্বাধীনতা ঘোষণা ভারত, ব্রিটেন, জাপান, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশে পৌঁছে। ঢাকার মগবাজার ভিএইচএফ ওয়ারলেসের সুপারভাইজার মেজবাহউদ্দিন ২৬ মার্চ রাতে মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা সলিমপুর স্টেশনের কর্মচারি মাহফুজ আলীর নিকট পাঠান। তিনি তা লিখে রাখেন এবং প্রচার করেন। চট্টগ্রাম ফৌজদারহাট ওয়ারলেসের অপারেটর মাহতাবউদ্দিন ও সুপারভাইজার নূরুল আমিন ঢাকার মগবাজার ওয়ারলেস অফিস থেকে মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা  “This may be my last message” পান। তারা সে বার্তা চট্টগ্রাম সংগ্রাম অফিসসহ সকল জেলায় প্রেরণ করেন। রেডিও পাকিস্তান ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হচ্ছিল, শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যদিকে কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পাল্টা ঘোষণায় বলা হচ্ছিল, তিনি সুস্থ আছেন এবং যথাসময়ে তার কণ্ঠ শোনা যাবে। বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের এ ঘোষণা সঠিক ছিল না। তবে জাতির মনোবল অক্ষ্ণুœ রাখতে এতটুকু মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়েছিল। 
     ২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১টা ৩০ মিনিটে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে দৈনিক আজাদী অফিসে মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার টেলেক্স মেসেজ আসে। ২৬ মার্চ সকাল থেকে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ অফিস মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণা শহরে মাইকে প্রচার করে। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা প্রচারের জন্য কাস্টমস কর্মকর্তা এমএ হালিম, প্রকৌশলী মির্জা নাসিরউদ্দিন, আব্দুস সোবহান, দেলোয়ার হোসেন, রাখাল চন্দ্র বণিক, এমএনএ আতাউর রহমান কায়সার, এসপিএ মোশাররফ প্রমুখের সহায়তায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করেন।
    ২৬ মার্চ দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে এম এ হান্নান মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করেন। তিনি সান্ধ্য অধিবেশনেও স্বাধীনতা ঘোষণা প্রচার করেন। ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় ওয়াপদার প্রকৌশলী আশিকুল ইসলাম কালুরঘাট বা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ইংরেজিতে এবং পরে আবুল কাশেম সন্দ্বীপ বাংলায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। ইংরেজি থেকে বার্তাটি বাংলায় অনুবাদ করেন ড. মঞ্জুলে মাওলা। ছাত্ররা নবনির্মিত আগ্রাবাদ রেডিও স্টেশন থেকে বার্তাটি প্রচারে কর্তৃপক্ষের অনুমতি পায়নি। এসময় তারা কালুরঘাট ব্রিজ অতিক্রম করে এবং মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব্ েঅষ্টম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রবেশ করে। বাঙালি সৈন্যরা কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে প্রহরা দিচ্ছিল। চট্টগ্রামে ইপিআরে কর্মরত সিনিয়র বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করার অনুরোধ জানালে তিনি সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে মোতায়েন অষ্টম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের টু-আই-সি মেজর জিয়াউর রহমানকে খুঁজে বের করার পরামর্শ দেন। জিয়া বাঙালি সামরিক অফিসারদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র হওয়ায় তিনি এ পরামর্শ দিয়েছিলেন। যথাসময়ে মেজর জিয়াকে ষোলশহরে খুঁজে পাওয়া যায়। তাকে অনুরোধ করা মাত্র তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানে রাজি হন।
   বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে কোনো কোনো লেখক ও গবেষক প্রশ্ন তুলেছেন। এ প্রসঙ্গে ছদরুদ্দীনের ‘মুক্তিযুুদ্ধ: বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে’ নামে বইয়ের ৫১ পৃষ্ঠার একটি উক্তি উল্লেখ করার মতো। তিনি লিখেছেন, ‘২৭ মার্চ লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের বাণী নামে একটি গোপন বেতার কেন্দ্র থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। শেখ মুজিব নিজে এ বেতার বার্তা ঘোষণা করেননি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে বিশ্বাসঘাতক হিসাবে অভিযুক্ত করার কিছুক্ষণ পরেই শেখ মুজিবের এ ঘোষণা শোনা যায়। যেহেতু ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ প্রচার করা হয় ২৬ মার্চ রাত ৮টায় কাজেই এ সংবাদ অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয় ২৬ মার্চ শুক্রবার রাত ৮টার পর।
   ২৮ মার্চের অবজারভারে বলা হয়, ‘গতকাল পাকিস্তান থেকে বাঙালি বিদ্রোহের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বর্তমান ঠিকানা সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী সংবাদ পাওয়া গেছে। সরকারি পাকিস্তান রেডিওর ঘোষণা অনুযায়ী শহরে তিনি তার বাড়ি থেকে ধৃত ও বন্দি হয়েছেন। তারপর ভারতে শেখ মুজিবের নামে প্রচারিত একটি বেতার বার্তা ধরা পড়ে। এতে বলা হয়েছে, ‘আমি চট্টগ্রামে আছি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মতোই স্বাধীন। গত শুক্রবারের ঘোষণায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের নতুন নামকরণ করেছেন বাংলাদেশ।’ এই সংবাদে শুক্রবার পূর্ব পাকিস্তানের নয়া নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ অর্থাৎ ২৬ মার্চ শুক্রবার বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়।
     শুধু একটি বিষয় ছাড়া অন্যান্য সংবাদ যে পরস্পরবিরোধী ও বিভ্রান্তিকর তাতে কোনো সন্দেহ নেই। উপরোক্ত ২৭ ও ২৮ মার্চের সংবাদ থেকে আমরা জানতে পারি (ক) ২৬ মার্চ শুক্রবার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঘোষণার ‘কিছুক্ষণ পরেই’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। (খ) শেখ মুজিব নিজে স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। (গ) তিনি চট্টগ্রামে বহাল তবিয়তে ছিলেন এবং (ঘ) পূর্ব পাকিস্তানের নয়া নামকরণ করেছেন ‘বাংলাদেশ।’
২৫ মার্চ দিবাগত রাত দেড়টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় তার নিজের বাড়িতেই গ্রেফতার হন। কাজেই তার পক্ষে ২৬ মার্চ দিবাগত রাত ৮টায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঘোষণার ‘কিছুক্ষণ পরে’ চট্টগ্রামে বহাল তবিয়তে থাকা বা চট্টগ্রাম থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করা সম্ভব নয়। অগত্যা ধরে নিতে হয় যে, অন্য কেউ মুজিবের হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু ঘোষক তার হয়ে এ অভিনয় করলেন কেন? তার পরিচয়ই বা কি? এ প্রশ্ন অত্যন্ত স্বাভাবিক। অভিনয়ের কারণ অত্যন্ত স্পষ্ট। ২৫/২৬ মার্চ রাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে বা পরে স্বয়ং শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা না করলেও তিনিই যে পহেলা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাঙালিদের মুক্তি ও স্বাধীনতার বাণী শুনিয়েছেন এবং স্বাধীনতার পথে তাদের উদ্ধুদ্ধ করেছেন সে সম্পর্কে কারো দ্বিমত নেই। এসময় তিনিই ছিলেন একমাত্র বাঙালি নেতা যার সম্মোহনী নেতৃত্ব ও ভাবমূর্তি সমগ্র দেশকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল। এজন্য ২৫ মার্চের কালরাত্রির পর থেকে জাতির মনোবল অক্ষুণœ রাখার জন্য বেতার প্রচারণায় এবং নেতা উপনেতাদের ভাষণে তার নাম কারণে অকারণে বীজমন্ত্ররূপে পুনঃপুনঃ উচ্চারিত হয়েছে। এমনকি স্বাধীনতা ঘোষণার অর্ডারেও। তার নাম ভাঙিয়ে গণহত্যার বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও সংহত করতে হয়েছে। এ ছাড়া উপায় ছিল না।’ বইটির ৬২/৬৩ নম্বর পৃষ্ঠায় তার আরেকটি একটি বিশ্লেষণও উল্লেখ করার মতো। তিনি লিখেছেন, ‘মুজিব নিজেই যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন তাহলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ২৭ মার্চের ভাষণে তার বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণার অভিযোগ আনতেন। এ ভাষণে তিনি মুজিবের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ আনলেও স্বাধীনতা ঘোষণার অভিযোগ আনেননি। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই, শেখ মুজিব ২৫/২৬ তারিখ রাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে স্বাধীনতা বা যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, তাহলে এ সত্য মেনে নিতে হয় যে, তিনি নিজে স্বাধীনতা বা য্দ্ধু ঘোষণা করে শত্র“র হাতে ধরা দেয়ার জন্য হাত পা গুটিয়ে তার ধানমন্ডির বাড়িতে অবস্থান করছিলেন! এ যেমন অস্বাভাবিক, তেমনি অবিশ্বাস্য। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র অতি স্পষ্টভাবে বলেছেন, আমরা জগদ্বাসীকে জানাতে চাই যে, শেখ মুজিবুর রহমান যদি সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা গ্রহণ করতেন তাহলে যে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে তার নিজের সৈন্যদল যুদ্ধ করবে তাদের হাতে বন্দি হওয়ার সম্ভাবনা এড়িয়ে চলতেন।’ 
স্বাধীনতার ঘোষণা: স্মারক গ্রন্থ নামে একটি বইয়েও অনুরূপ প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বইটির ৫৪ পৃষ্ঠায় খোন্দকার আলী আশরাফের ‘স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছিলেন’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলার স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায় প্রকাশিত ড. সৈয়দ আনোয়ার আলীর নিবন্ধের একটি অংশ উল্লেখ করা হয়। উল্লেখিত নিবন্ধে ড. আনোয়ার বলেছেন, ‘চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ রোডে একজন লোক টেলিগ্রাম বলে চেঁচাচ্ছিল আর একটা ছোট কাগজ বিলি করছিল। গাড়ি থামিয়ে আমি একটি কাগজ সংগ্রহ করি। কাগজটা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচারিত একটি বাণী। তিনি তাতে ২৫ মার্চ ঢাকার ঘটনাবলী উল্লেখ করে বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্যের এবং দেশবাসীর প্রতি প্রতিরোধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। টেলিগ্রামের কাগজটা আমার স্ত্রী মঞ্জুলা আনোয়ারের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। দেখে প্রথমে তিনি উল্লসিত হয়েছিলেন। কিন্তু একটু পরেই নিরাশ হয়ে বললেন, এরকম একটা বাণী আমাদের কতটা অনুপ্রাণিত করবে সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। কেননা এতে স্বাধীনতার উল্লেখ নেই। যাই হোক, তিনি নিজেই উদ্যোগ নিয়ে ব্যাপক প্রচারের জন্য এই আবেদন বাংলায় অনুবাদ করে পাড়ার কিছু ছেলেমেয়েদের দিয়ে কার্বন কপি করাতে শুরু করেন। বাংলা অনুবাদে তিনি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কয়েকটি পরিবর্তন সাধন করেছিলেন আমার সঙ্গে আলাপ করে। আমার স্ত্রী এতে একটি ছোট অথচ আকাঙ্খিত শব্দ যোগ করেছিলেন। শব্দটি ছিল ‘স্বাধীনতা’। কোরআন তেলাওয়াতের পর আমার স্ত্রী মঞ্জুলার পরিবর্তিত বার্তাটি পাঠ করেন আবুল কাশেম সন্দীপ। ইংরেজি বার্তাটি পাঠ করেন ইঞ্জিনিয়ার আশিকুল ইসলাম। ফেরার পথে শুধু দেখছিলাম আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান ছোট একটি কামরায় নীরবে কী যেন লিখছেন। আমি তাকে বললাম, আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু করেছি। শিগগির কিছু বলুন, দেশবাসীকে অনুপ্রাণিত করুন। উনি বললেন, ‘আমি তাই লিখছি।’ আমি তাকে বলছিলাম, এখন লেখার সময় নয়। যা মুখে আসে তাই বলুন।’
খোন্দকার আলী আশরাফ তার আলোচিত নিবন্ধের ৫৭ নম্বর পৃৃষ্ঠায় আরো লিখেছেন, ‘ড. আনোয়ার টেলিগ্রাম বলে কথিত স্বাধীনতার ঘোষণাবিহীন যে চিরকুটটি পেয়েছিলেন তা আদৌ কোনো টেলিগ্রাম কপি ছিল কিনা আর হলেও তার উৎস কি? কে কোথা থেকে তা পাঠিয়েছিল তার প্রমাণ কি? তাতে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম থাকলেও তিনিই যে তা পাঠিয়েছিলেন তারই বা প্রমাণ কি? সেই তথাকথিত টেলিগ্রামও যে ড. আনোয়ার ও তার পত্মী মিসেস মঞ্জুলার মতো চট্টগ্রামের কোনো দেশপ্রেমিক বা দেশপ্রেমিকাদের কাজ নয় একথা কে বলতে পারে? ঐ আবেদন শেখ সাহেবের ছাড়া অন্য কারো নামে করা হলে তা যে মূল্যহীন হতো একথা কে না বুঝে? শেখ মুজিবুর রহমান আদৌ চট্টগ্রামে কোনো স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন কিনা কিংবা বিরাজমান পরিস্থিতিতে টেলিগ্রাম বা ওয়ারলেস বা অন্য কোনো বার্তা পাঠানো তার পক্ষে সম্ভব ছিল কিনা তাও ভেবে দেখতে হবে। মহাখালীর ওয়ারলেস কেন্দ্র ছিল সন্ধ্যার পর থেকে হানাদারদের নিয়ন্ত্রণে। রাত ১১টার পর থেকে রাজধানীর সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই অবস্থায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে স্বাধীনতার ঘোষণা একমাত্র টেলিপ্যাথি ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে পাঠানো সম্ভব ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমান যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েই থাকবেন তাহলে চট্টগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হোক বা না-ই হোক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আট মাসে তা একবারও প্রচার করা হলো না কেন? আমাদের তো মনে হয় তেমন কোনো ঘোষণা থাকলে তা প্রতিটি অধিবেশনে ‘বজ্রকণ্ঠ’-এর মতো প্রচার করা হতো। কেননা সেই দুর্যোগময় দিনে জাতিকে অনুপ্রাণিত করতে তার বাণীর চাইতে শক্তিশালী আর কোনো অস্ত্র ছিল না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এ নীরবতা থেকে কি শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টি হয় না? জেনারেল ওসমানী বলেছেন, তিনি রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত শেষ ব্যক্তি হিসাবে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ছিলেন। তার কাছে মুজিব বলেছিলেন, পাকিস্তানিরা শক্তিপ্রয়োগ করলে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। ঘোষণা তিনি প্রস্তুত করে রেখেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, শেখ মুজিবের বার্তায় রাজারবাগ ও পিলখানায় পাকিস্তানি সৈন্যদের হামলার কথা স্থান পেয়েছে। রাজারবাগ ও পিলখানায় হামলা হয়েছে রাত সাড়ে ১০টায়। রাত সাড়ে ১০টার ঘটনা তিনি রাত সাড়ে ৯টার আগে লিখলেন কিভাবে? পাকিস্তানি মেজর সিদ্দিক সালিক বলেছেন, তিনি রাত ১২টায় ক্ষীণস্বরে রেডিও ওয়েভে মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণা শুনতে পেয়েছেন। একই যুক্তিতে তার বর্ণনাও বাতিল হয়ে যায়।’ 
২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান সৈন্যদের নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ১৫ মাইল দূরে পটিয়া থানার করইল গ্রামে অবস্থান করছিলেন। চট্টগ্রাম বেতারের কর্মকর্তা বেলাল মোহাম্মদ সেদিন সন্ধ্যায় তাকে পটিয়া থেকে কালুরঘাটে নিয়ে আসেন। বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা জিয়াকে পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠে। ২৭ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টা। কিন্তু কি বলবেন তিনি? একটি করে বিবৃতি লেখেন আর ছিঁড়ে ফেলেন। বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা বারবার ঘোষণা করছিল আর মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে মেজর জিয়া ভাষণ দেবেন। ১৫ মিনিট পার হয়ে যায়। মেজর জিয়া মাত্র তিন লাইন লিখতে পেরেছেন। এ ব্যাপারে জিয়াউর রহমান তার ডায়েরীতে লিখেছেন, ‘২৭ মার্চ শহরের চারদিকে তখনো বিক্ষিপ্ত লড়াই চলছিল। সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায় রেডিও স্টেশনে এলাম। এক টুকরো কাগজ খুঁজছিলাম। হাতের কাছে একটি এক্সারসাইজ খাতা পাওয়া গেল। তার একটি পৃষ্ঠায় দ্রুত হাতে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম ঘোষণার কথা লিখলাম। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বভার নিয়েছি সে কথাও লেখা হলো সেই প্রথম ঘোষণায়। কিছুক্ষণের মধ্যে সে ঘোষণা বেতারে প্রচার করলাম। ২৮ মার্চ সকাল থেকে পনেরো মিনিট পর পর ঘোষণাটি প্রচার করা হলো কালুরঘাট রেডিও স্টেশন থেকে। ৩০ মার্চ দ্বিতীয় ঘোষণাটি প্রচার করা হলো রাজনৈতিক নেতাদের অনুরোধক্রমে।’ 
স্বাধীনতা ঘোষণার বিবৃতি লেখার অনেক ঝুঁকি ছিল। জিয়াউর রহমানকে শব্দচয়ন, বক্তব্য পেশ ইত্যাদি নিয়ে ভাবতে হচ্ছিল। প্রায় দেড় ঘণ্টা মুসাবিদার পর তিনি তার সেই ঐতিহাসিক ভাষণ তৈরি করেন। নিজেই তিনি বাংলা ও ইংরেজিতে এ ভাষণ পাঠ করেন। জিয়ার প্রথম ঘোষণা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের তৃতীয় খন্ডে সংযোজন করা হয়েছে। তবে এ সংযোজিত ভাষণে তার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি নেই। যেমন- তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মেজর জিয়া বলছি,’ ‘আমি বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি।’ এমনকি তার ভাষণে ইংরেজি ‘আই’ শব্দটিও নেই। এ অসম্পূর্ণতা চাপা দিতে গিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের তৃতীয় খন্ডের পাদটীকায় এক ব্যাখ্যায় বলা হয়, নিরাপত্তার কারণে জিয়ার প্রথম ভাষণের মূল কপি নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। এ দলিলপত্রে জিয়ার প্রথম ঘোষণা হিসাবে যা মুদ্রিত হয়েছে তা তার দ্বিতীয় ঘোষণার কাছাকাছি। স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের তৃতীয় খণ্ডে উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী জিয়ার প্রথম ভাষণ হলো এরকম। Major Zia, Provisional Commander-in-Chief of the Bangladesh Liberation Army, hereby proclaims, on behalf of Sheikh Mujibur Rahman, the independence of Bangladesh. 
I, also declare, we have already framed a sovereign, legal government under Skeikh Mujibur Rahman which pledges to function as per law and and the constition. The new democratic Government is committed to a policy of non-alignment in international relations. It will seek friendship with all nations and strive for international peace. I appeal to all government to mobilize opinion in their respective countries against the brutal genocide in Bangladesh.The Government under Sheikh Mujibur Rahman is sovereign and legal Government of Bangladesh and is entitled to recognition from all democratic nation of the world.’  মেজর জিয়া, বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির অস্থায়ী কমান্ডার, এতদ্বারা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।
আমি আরো ঘোষণ করছি, আমরা ইতিমধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি সার্বভৌম ও আইনানুগ সরকার গঠন করেছি। এ সরকার আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনার প্রতিশ্র“তি দিচ্ছে। নয়া গণতান্ত্রিক সরকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কে জোট নিরপেক্ষ নীতির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা সকল জাতির বন্ধুত্ব কামনা করছি এবং আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য প্রচেষ্টা চালাবো। আমরা বাংলাদেশে বর্বর গণহত্যার বিরুদ্ধে নিজ নিজ দেশে জনমত তৈরিতে সকল সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশের সার্বভৌম ও আইনানুগ সরকার এবং বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক দেশের স্বীকৃতির দাবিদার।’ 
নিজের নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ায় মরহুম শিল্পপতি একে খানসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ তাকে মৃদু ভর্ৎসনা করেন। তাদের আপত্তির মুখে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আবার বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এ ব্যাপারে কাদের সিদ্দিকী তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘স্বাধীনতা ‘৭১’-এর ৪১৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘তার বক্তৃতা রেকর্ড করার জন্য একটি টেপ রেকর্ডার আনা হলো। এখানে তিনি প্রথম নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে ঘোষণা করে বক্তব্য রাখেন। তার ঘোষণার শুরুটা ছিল এরকম। ‘আমি মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’ রেডিও সেন্টারে সম্প্রচার শুরু হলে ক্রটি ধরা পড়ে। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ জিজ্ঞেস করলে জিয়া সাহেব বলেন, ‘আমি ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। আপনারা একটা খসড়া করে দিন।’ এবার সংগ্রাম পরিষদের নেতারা চিন্তাভাবনা করে ৫/৬ লাইনের একটি খসড়া বক্তৃতা লিখে দেন।’
ওয়েবসাইট ‘দ্য উইকিপিডিয়া: দ্য ফ্রি এনসাইক্লোপিডিয়া’র বর্ণনা অনুযায়ী এই খসড়ার ভিত্তিতে তিনদিন পর ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় বেলাল মোহাম্মদ, ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়া প্রমুখের উপস্থিতিতে মেজর জিয়া তার দ্বিতীয়  ঘোষণায় বলেন, This is Shadhin Bangla Betar Kendra. I, Major Ziaur Rahman at the direction of our great national leader Bangobandhu Sheikh Mujibur Rahman, hereby declare that the independent People's Republic of Bangladesh has been established. At his direction, I have taken the command as the temporary Head of Republic. In the name of Sheikh Mujibur Rahman, I call upon all Bengalis to rise against the attack by the West Pakistani Army. We shall fight to the last to free our Motherland. By the grace of Allah, victory is ours. Joy Bangla. ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি। আমি মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ঘোষণা করছি যে, স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তার নির্দেশে আমি প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। আমি শেখ মুজিবুর রহমানের নামে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ রুখে দাঁড়ানোর জন্য সকল বাঙালির প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা আমাদের মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে লড়াই করবো। ইনশাল্লাহ আমরাই বিজয়ী হবো। জয় বাংলা।’
     বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের তৃতীয় খণ্ডে জিয়াউর রহমানের দ্বিতীয় ঘোষণাও উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এতে তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ৩১ মার্চ। এখানেও একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। ব্যাখ্যায় বলা হয়, জিয়াউর রহমান ভুল করে ৩০ তারিখের স্থলে ৩১ মার্চ লিখেছেন। উল্লেখিত বর্ণনা অনুযায়ী জিয়ার দ্বিতীয় ঘোষণা হলো এরকম। 

From Major Zia
Declaration:
Punjabis have been used 3rd Commando Battalion in Chittagong city area to subdue the valliant freedom fighters of Sadhin Bangla. But they have been thrown back and many of them have been killed.
The Punjabis have been extensivly using F-86 aircrafts to kill the civilians strongholds and vital points. They are killing the civilians, men, women and children brutally. So far at least---thousands of Bengali civilians have been killed in Chittagong area alone. 
The Sadhin Bangla Liberation Army is pushing the Punjabis--- from one place to other. At present Punjabis have utilized at least two Brigades of Army, Navy and Air force. It is in fact a combined operation.
I once again request the United Nations and the big powers to intervene and physically come to our aid. Delay will mean massacre of additional millions.’ 
                                          Signature
                            Major Ziaur Rahman
                             31.3.71
 
মেজর জিয়ার পক্ষ থেকে  
         ঘোষণা
পাঞ্জাবীরা স্বাধীন বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দমন করতে চট্টগ্রাম এলাকায় তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়ন ব্যবহার করছে। কিন্তু তাদেরকে বিতাড়িত করা হয়েছে এবং তাদের অনেকে নিহত হয়েছে। 
পাঞ্জাবীরা বেসামরিক লোকজনকে হত্যা এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংসে ব্যাপকভাবে এফ-৮৬ জঙ্গিবিমান ব্যবহার করছে। তারা বেসামরিক নর, নারী ও র্শিশুদের হত্যা করছে। এ পর্যন্ত শুধুমাত্র চট্টগ্রাম এলাকায় কমপক্ষে কয়েক হাজার বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলা মুক্তি ফৌজ পাঞ্জাবীদের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। বর্তমানে পাঞ্জাবীরা সেনাবাহিনীর অন্তত দু’টি ব্রিগেড, নৌ ও বিমান বাহিনী ব্যবহার করছে। বস্তুত এটি হচ্ছে একটি যৌথ অভিযান। 
   আমি আবারো আমাদের সহায়তায় বৈষয়িকভাবে এগিয়ে আসতে এবং হস্তক্ষেপ করার জন্য জাতিসংঘ ও বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। বিলম্ব ঘটার মানে হলো আরো কয়েক লাখ লোকের মৃত্যু।
                                          স্বাক্ষর 
                               মেজর জিয়াউর রহমান
                                  ৩১.৩.৭১    
লে. শমসের মোবিন চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘২৭ মার্চ সন্ধ্যায় মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে আসেন এবং ভাষণ দেন। ২৮ মার্চ সারাদিন আমি বেতার কেন্দ্র থেকে এ ভাষণ পাঠ করি।’ ক্যাপ্টেন এমএসএ ভূঁইয়া লিখেছেন, ‘সেখানে অষ্টম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের লে. শমসেরের সঙ্গে আমার দেখা হয়। লে. শমসের সে সময় বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের লিখিত ভাষণ বারবার প্রচার করছিলেন।’ অন্যদিকে মাহবুব-উল-আলম তার ‘রক্ত-আগুন-অশ্র“সজল-স্বাধীনতা’ নামে গ্রন্থের ৯২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,‘ আওয়ামী লীগ নেতা ডাক্তার আবু জাফর ছাড়াও চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হান্নানের দেখা হলো দলের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে। তখন তারা বেতার কেন্দ্র দখল করে সেখান থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা ব্যাপকভাবে জনগণের মধ্যে প্রচারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সে অনুযায়ী ডাক্তার আবু জাফর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করেন। এ ঘোষণাপত্র কিঞ্চিত সংশোধন করে সেদিন দুপুর আড়াইটায় তা চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটিং সেন্টার থেকে প্রচার করা হয়। হান্নান সর্বপ্রথম সে ঘোষণা করলেন। সেদিন চট্টগ্রাম থেকে প্রচারিত এই একটি ঘোষণা সারা বাংলার বুকে যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল আজো তা ভাবতে গেলে অবাক হতে হয়।’
বাংলাদেশের জনগণের উপর জিয়ার ঘোষণার প্রভাব সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের পঞ্চদশ খন্ডে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম তার দীর্ঘ নিবন্ধের ৯৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘স্নান করে খেতে যাব। হঠাৎ স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান কানে ভেসে এলো। ঘোষক বেতারে বলছেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে হাজির হতে বেতারে নির্দেশ দেয়া হলো। প্রথমে এদের নামধাম কিছুই বুঝা গেল না। ঠাওর করে উঠতে পারলাম না, কারা কোত্থেকে এই বেতার চালাচ্ছে। পরে বেতারে মেজর জিয়ার কন্ঠ শোনা গেল। তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। মেজর জিয়ার আহ্বান বেসামরিক ও সামরিক তথা বাংলার সর্বশ্রেণীর মানুষকে সংগ্রামে উজ্জীবিত করে।’ 
মেজর (অব:) রফিকুল ইসলাম পিএসসি তার ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার প্রথম প্রহর’ গ্রন্থের ৩২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘স্বাধীনতা ঘোষণার বিতর্কে না গিয়েও একটি কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বর এবং তার আহ্বানই সামরিক ও আধা সামরিক তথা গোটা বাঙালি জাতিকে নতুন আশার পথ দেখিয়েছে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সেদিন সত্যিই মেজর জিয়ার আহ্বানই সবার প্রাণে সাড়া জাগিয়েছিল। অন্ধকারে জনতা পেয়েছিল আশার সন্ধান।’ 
জিয়ার কোর্সমেট অবসরপ্রাপ্ত মরহুম লে. কর্নেল এমএ হামিদের একটি উক্তিও উল্লেখের দাবি রাখে। তিনি তার ‘একাত্তরের জয়পরাজয়: মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের দৃশ্যপট’ বইয়ের ৬৭ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘২৭ তারিখ মেজর জিয়া চট্টগ্রাম রেডিও স্টেশন থেকে স্বাধীনতার সপক্ষে তার বিখ্যাত বেতার ঘোষণা দেন যা দেশের সর্বত্র জনগণের কানে পৌঁছে গিয়ে এক অপূর্ব উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। অবশ্য তার আগের দিন ২৬ তারিখ আওয়ামী লীগ নেতা জনাব হান্নান জাতির নেতার পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেন। কিন্তু দুর্বল ট্রান্সমিটারের জন্য তা সবাই শুনতে পায়নি।’
কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার করার সামর্থ্য ছিল সীমিত। বঙ্গোপসাগরে একটি জাপানি জাহাজে এ বার্তা ধরা পড়ে। পরে এ বার্তা রেডিও অস্ট্রেলিয়া ও বিবিসি পুনঃপুন প্রচার করে। মেজর জিয়ার সেদিনের সে ঐতিহাসিক ঘোষণা শুনে দিশেহারা সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। শুরু হয় সর্বাত্মক সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ। দু’দিন পর এই বেতার কেন্দ্রের নাম থেকে বিপ্লবী শব্দটি বাদ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এই বেতার কেন্দ্রের প্রচার কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্নভাবে অগ্রসর হতে পারেনি। প্রচণ্ড বাধা আসে ৪ দিনের মধ্যে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল মেজর জেনারেল মিঠঠা কালুরঘ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ফাইটার জেটের হেলমেট

বর্তমান সময়ে আধুনিক এবং নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফিচার হচ্ছে জেট ফাইটারের ককপিটে বসা এর পাইলটের হেল...