বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০

অখণ্ড ভারত কায়েমের অলীক স্বপ্ন



ঘুরে ফিরে প্রায়ই ভারতের মনের একান্ত কথা প্রকাশ পায়। দেশটি অখণ্ড ভারত কায়েম করতে চায়। তবে সরকারিভাবে কখনো এ ঘোষণা দেয়া হয়নি। মৌর্য সম্রাট অশোক-পূর্ব ভারত কায়েম তাদের লক্ষ্য। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি), রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস), বজরং, শিব সেনা এবং ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মতো মূলস্রোতের ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলো ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সমন্বয়ে একটি অখণ্ড হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের দাবি উত্থাপন করছে। অবিভক্ত ভারতের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে অখণ্ড ভারতের অংশ হিসাবে দেখানো হচ্ছে। অখণ্ড ভারতের ধারণা ভারতীয়দের কাছে অত্যন্ত আবেগময় এবং তাদের অস্তিত্বের অংশ। ভারত বিভক্তি তাদের কাছে একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। সুযোগ পেলেই কোনো কোনো ভারতীয় রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা কিংবা বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিগত পর্যায়ে মুখ খোলেন। খোলস ঝেড়ে ফেলে অখণ্ড ভারত কায়েমের খায়েশ প্রকাশ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ভারতের প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মারকান্দাইয়ে কাৎসু অখণ্ড ভারত কায়েমের আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন। 
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত এই বিচারপতি ২০১৩ সালের ৭ এপ্রিল হায়দরাবাদে ‘রিপোর্টিং টেরর: হাউ সেন্সেটিভ ইজ মিডিয়া?’ শিরোনামে এক সিম্পোজিয়ামে বলেছেন, পাকিস্তান একটি ভুয়া দেশ। একদিন বাংলাদেশসহ দেশটি ভারতের সঙ্গে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হবে। তিনি আরো বলেছেন, ভারতকে একটি শক্তিশালী শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হতে না দিতে ব্রিটিশরা ভারত বিভক্ত করেছিল। আগামী ১৫/২০ বছরের মধ্যে একটি শক্তিশালী আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারত পুনরায় একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে। 
    বিচারপতি মারকান্দাইয়ে কাৎসু আরো একবার অনুরূপ উক্তি করেছেন। ২০১৩ সালের ৪ মার্চ তামিলনাড়–র থিরুভানানথাপুরামে ইন্সটিটিউট অব পার্লামেন্ট এফেয়ার্স আয়োজিত দ্বিতীয় রাজিব গান্ধী স্মারক ভাষণে তিনি বলেছেন, ভবিষ্যতের কোনো একসময় ভারত ও পাকিস্তানের সমন্বয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র বাস্তবে রূপ নেবে। সে রাষ্ট্র ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং হিন্দু ও মুসলিম উগ্রপন্থাকে বরদাস্ত করবে না। ভারত কি? শিরোনামে এ ভাষণে তিনি আরো বলেন, ভারত বিভক্তি জাতি হিসাবে পাকিস্তানের ধ্বংসের বীজ বপন করেছে। তিনি পাকিস্তানকে স্টিভেন স্পিলবার্গ পরিচালিত বিশ্ববিখ্যাত শিহরণ সৃষ্টিকারী আমেরিকান ছবি জুরাসিক পার্কের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, দেশটির গঠনে ত্র“টি আছে। একটি ধর্মান্ধ রাষ্ট্র গঠন করা ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের লক্ষ্য। 
     বিচারপতি কাৎসু একা অখণ্ড ভারত কায়েমের কথা বলছেন তা নয়, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) সাধারণ সম্পাদক ড. মোহন ভগৎ-ও অনুরূপ উক্তি করেছেন। এ হিন্দুবাদী সংগঠনের মুখপত্র অর্গানাইজারে ‘জাতিকে রক্ষায় হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করো’ শিরোনামে তার এসব উস্কানিমূলক উক্তি প্রকাশিত হয়। উড়িষ্যার রাজধানী ভুবনেশ্বরে এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা গোলওয়ালকারের জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনের একটি অনুষ্ঠানে ভারতের বর্তমান দুর্দশায় দুঃখ প্রকাশ করে ড. মোহন ভগৎ বলেছেন, এখনো সত্যিকার স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি। আজ পরিস্থিতি এত বিপজ্জনক যে, আমরা বন্দে মাতরম গাইতে এবং গরুকে মা হিসাবে সম্মান জানাতে ইতস্তত করছি। কেবলমাত্র অখণ্ড ভারত এবং ‘সম্পূর্ণ সমাজ’ (ঐক্যবদ্ধ সমাজ) সত্যিকার স্বাধীনতা বয়ে আনতে পারে। তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় অখণ্ড ভারত গঠনের ধারণার ওপর জোর দিয়ে বলেছেন, ভারত বিভক্তি হিন্দু-মুসলিম সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। বরং তাতে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। একমাত্র অখণ্ড ভারত কায়েম করলে শান্তি আসতে পারে। 
মোহন ভগৎ আরো বলেছেন, সময় অতিক্রান্ত হওয়ায় প্রমাণিত হয়েছে যে, ভারত বিভক্তি কোনো সমস্যার সমাধান নয়। উপমহাদেশ বিভক্তি সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান করতে পারে বলে যারা বিশ্বাস করতেন ইতিহাস তাদের ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে। 
 কাশ্মীর সফরে গিয়ে মোহন ভগৎ একই কথা প্নুর্ব্যক্ত করে বলেছেন, চীন, রাশিয়া ও আমেরিকা জাতীয় স্বার্থে তাদের ভূখণ্ড সম্প্রসারণে কোনো রাখঢাক করছে না। তাই ভারতকেও একই নীতি গ্রহণ করতে হবে। অনুষ্ঠানে জম্মু ও কাশ্মীরের গভর্নর অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল এসকে সিনহা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুকরণে সার্ক দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব দিয়ে বলেছেন, এ কনফেডারেশনের নিউক্লিয়াস হবে ভারত। মোহন ভগৎ তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে এক টিভি সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান ভারতের অংশ এবং একদিন এ দু’টি দেশ ভারতে ফিরে আসবে।  
    শুধু বক্তৃতা বিবৃতি দেয়া হচ্ছে তা নয়, আনুষ্ঠানিকতাও পালন করা হচ্ছে। ২০১২ সালের ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় জিডি বিড়লা হল অব রেসিডেন্সে এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে প্রথমবার অখণ্ড ভারত দিবস পালন করা হয়। ভুপাল ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির ইলেক্ট্রোনিক্স এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. সদানন্দ সাপ্রি এ অনুষ্ঠানে ছাত্রদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। ভারতীয় ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ ও সুবক্তা ড. সাপ্রি তার ভাষণে অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার ধারণা ব্যাখ্যা করেন। তার ভাষণে মুগ্ধ হয়ে অসংখ্য ছাত্র অনুরূপ শত শত সেমিনারের আয়োজন করে দেশপ্রেমের এ সত্যিকার মন্ত্র সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার শপথ নেয়। 
  ২০১১ সালের ১৫ আগস্ট বাঙ্গালোরের বানাপ্পা পার্কে হিন্দুু জাগরণ বৈদিক নামে একটি সংগঠন অখণ্ড ভারত সংকল্প দিবস পালন করে। দিবসটি উপলক্ষে আয়োজিত এক সমাবেশে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ড. প্রবীণ ভাই তোগাড়িয়া তার মূল প্রবন্ধে অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন চিরজাগরুক রাখার উদাত্ত আহবান জানান। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বা আরএসএস-ও অখ- ভারত দিবস পালন করে।
আরএসএস তাদের প্রাত্যহিক সামরিক শাখাস বা সমাবেশে কর্মী ও সহানুভূতিশীলদের এ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার শিক্ষা দেয় যে, ভারতবর্ষের প্রাচীনতম জাতি ছিল সারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম জাতি এবং ভারতবর্ষের অধিবাসীরা ছিল সুখী, সমৃদ্ধ ও ধার্মিক। সংঘ পরিবারের নেতৃবৃন্দ কখনো একথা বলতে ভুলে যান না যে, হিন্দু জাতির অনৈক্য এবং এই পবিত্র ভূমিতে মুসলমান ও ব্রিটিশের আগ্রাসন থেকে ভারতের সকল দুঃখ দুর্দশার জন্ম হয়েছে। সংঘ পরিবারের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে কন্যাকুমারী এবং পশ্চিমে গান্ধার থেকে পূর্বদিকে ব্রহ্মদেশ পর্যন্ত অখণ্ড ভারত কায়েম করে অতীতের গৌরব ফিরিয়ে আনা। আরএসএস দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, হিন্দুত্ব কোনো ধর্ম নয়, হিন্দুত্ব হচ্ছে একটি জীবন ব্যবস্থা এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক ভারতীয় হিন্দু। 
অখণ্ড ভারত কায়েমের দূরভিসন্ধি থেকে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে। ভারতীয়দের মতে, অখণ্ড ভারত গঠনের আদর্শ ‘সাঙ্গাঠান’ (হিন্দু ঐক্য) এবং ‘শুদ্ধি’ (বিশুদ্ধিকরণ) ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত। আরএসএস নেতা এইচভি সেশারদি তার ‘দ্য ট্রাজিক স্টোরি অব পার্টিশন’ শিরোনামে গ্রন্থে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তিতে তার সীমাহীন আক্ষেপ প্রকাশ করে লিখেছেন:
 When the new viceroy Lord Mountbatten announced on 3rd June, 1947 the plan of transfer of power, it came as a stunning blow to the people. For that plan, approved by Nehru and Patel, had envisaged cutting up Bharat and creation of Pakistan. The great and trusted leaders of Congress had turned their back on the sacred oaths they had taken and the pledges they had administered to the people. What took place on August 15, 1947, was this gross betrayal of the nation’s faith, the betrayal of the dreams of countless fighters and martyrs who had plunged into the fire of freedom struggle with the vision of Akhanda Bharat in their hearts. 
অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ৩ জুন নয়া ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন যখন ক্হস্তান্তরের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন তখন তার এ ঘোষণা জাতির কাছে একটি মারাত্মক আঘাত হিসাবে বিবেচিত হয়। নেহরু ও প্যাটেল অনুমোদিত এ পরিকল্পনায় ভারতকে দ্বিখণ্ডিত এবং পাকিস্তান সৃষ্টির প্রস্তাব দেয়া হয়। কংগ্রেসের মহান ও বিশ্বস্ত নেতৃবৃন্দ তাদের পবিত্র ওয়াদা এবং জাতির কাছে প্রদত্ত প্রতিশ্র“তি থেকে পিঠটান দেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত ঘটনা ছিল জাতির বিশ্বাসের সঙ্গে একটি চরম বিশ্বাসঘাতকতা এবং হৃদয়ে অখণ্ড ভারত কায়েমের লক্ষ্য নিয়ে যেসব অগণিত যোদ্ধা ও শহীদ স্বাধীনতা সংগ্রামের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাদের স্বপ্নের সঙ্গে বেঈমানী। 
মূলস্রোতের ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দও সেশারদির অনুরূপ মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের অন্যতম স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বাঙালি ঋষি দার্শনিক স্যার অরবিন্দ ঘোষ তার জন্মদিনের বার্তায় বলেছিলেন:  
India today became free but she has not achieved Unity. The old communal devision into Hindu and Muslims seems now to have hardened into permanent political division of the country. It is hoped that this settled fact will not be accepted as  settled forever as anything more than a temporary expedient. For if it lasts, India may be seriously weakened, even crippled; civil strife may remain always possible, possible even a new invasion and foreign conquest. India’s internal development and prosperity may be impeded, her position among nations weakened, her destiny impaired or even fractured. This must not be. Partition  must go. By whatever means, in whatever way, the division must go. Unity must and will be achieved. For it is necessary for the greatness of the India’s future. (Sir Aurobinda, Complete works, Vol-26)  

অর্থাৎ আজ ভারত স্বাধীন হয়েছে তবে ঐক্য অর্জন করতে পারেনি। পুরনো হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক বিভক্তি এখন দেশের রাজনৈতিক বিভক্তিতে স্থায়ী রূপ নিয়েছে। আশা করা যাচ্ছে যে, এ মীমাংসিত সত্যকে একটি অস্থায়ী ব্যবস্থার চেয়ে চিরদিনের জন্য মীমাংসিত সত্য হিসাবে গৃহীত হবে না। কেননা এ বিভক্তি স্থায়ী হলে ভারত মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে। এমনকি পঙ্গু হয়ে যেতে পারে। গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা বরাবর বিরাজ করবে। এমনকি নয়া আগ্রাসন এবং বিদেশের পদানত হওয়ার সম্ভাবনা বিরাজ করবে। ভারতের অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে। বিশ্বের অন্যান্য জাতির মধ্যে ভারতের অবস্থান দুর্বল হবে। তার ভবিষ্যৎ বিপন্ন হবে। এমনকি ভেঙ্গে খানখান হয়ে যেতে পারে। অবশ্যই তা হতে দেয়া হবে না। বিভক্তি অবশ্যই থাকবে না। যে কোনো পন্থায় যে কোনো উপায়ে বিভক্তিকে অবশ্যই দূর করতে হবে। অবশ্যই ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও অর্জন করতে হবে। কেননা ঐক্য হলো ভবিষ্যৎ ভারতের বিশালত্বের জন্য অনিবার্য। (স্যার অরবিন্দ, পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থাবলী, ভলিউম-২৬)             
নব্বই দশকের শেষ প্রান্তে বিজেপি সরকারের আমলে সংঘ পরিবারের ২০ হাজার স্কুলে পাঠ্য ভূগোল বইয়ের মানচিত্রে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, তিব্বত, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটানকে অখণ্ড ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে দেখানো হয় এবং ভারত মহাসাগরকে হিন্দু মহাসাগর, আরব সাগরকে সিন্ধু সাগর এবং বঙ্গোপসাগরকে গঙ্গা সাগর হিসাবে আখ্যা দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, আফগানিস্তান, লাওস, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়াকেও অখণ্ড ভারতের অংশ হিসাবে কল্পনা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী হিন্দুদের সংগঠিত করে এ লক্ষ্যে পৌঁছার স্বপ্ন লালন করা হচ্ছে। খণ্ড বিখণ্ড ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করা হচ্ছে কট্টরপন্থী হিন্দু মহাসভার ঘোষিত নীতি। এ ব্যাপারে অর্পণা পাণ্ডে ‘এক্সপ্লে¬ইনিং পাকিস্তান ফরেন পলিসি’ শিরোনামে গ্রন্থের ৫৬ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লে¬খ করেছেন:

     The Hindu Maha Sabha had declared: India is one and indivisible and there can never be peace unless and until the separated parts are brought back into the Indian Union and made integral parts thereof. অর্থাৎ হিন্দু মহাসভা ঘোষণা করেছে: ভারত অভিন্ন ও অবিভাজ্য। বিচ্ছিন্ন অংশগুলো যতদিন ভারত ইউনিয়নে ফিরিয়ে এনে সেগুলোকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করা না হবে ততদিন শান্তি আসবে না।
      ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলে দুর্র্বল পশ্চিম পাকিস্তান দখল করে নেয়ার জন্য জঙ্গি হিন্দুরা দাবি তোলে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিষয়টিকে ভবিষ্যতে বিবেচনার জন্য রেখে দেন। এ সম্পর্কে লরেন্স জিরিং তার ‘পাকিস্তান অ্যাট দ্য ক্রসকারেন্ট অব হিস্ট্রি’ শিরোনামে গ্রন্থের ১১৩ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন:  Akhand Bharat, the hindu militant call for absorbing Pakistan within India, would have to wait on another day. অর্থাৎ হিন্দু জঙ্গিরা পাকিস্তানকে ভারতের অঙ্গীভূত করে নেয়ার দাবি জানায়। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী তাদের প্রস্তাব নাকচ করে দেয়ায় অখণ্ড ভারতকে আরেকটি সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।        
দ্বিজাতি তত্ত্ব হলো ভারতীয়দের চক্ষুশূল। ভারতের কংগ্রেস পার্টি কখনো দ্বিজাতি তত্ত্ব মেনে নেয়নি। ১৯৪৭ সালের ৫ জুন কংগ্রেস এক প্রস্তাবে বলেছিল:
   Geography and mountains and sea fashioned India as she is and no human agency can change that shape or come in the way of her final destiny. Once present passions had subsided the false doctrine of two nations will be discredited and discarded by all.
   র্থাৎ ভূখণ্ড, পর্বত ও সমুদ্র ভারতকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে এবং কোনো মানবীয় শক্তি ভারতের এ আকৃতি পরিবর্তন অথবা তার চূড়ান্ত ভাগ্যের পথে অন্তরায় হতে পারে না। বর্তমানে বিরাজিত মিথ্যা দ্বিজাতি তত্ত্বের আবেগ একদিন থিতিয়ে আসবে এবং সবাই তা পরিত্যাগ করবে।
‘ইন্ডিয়া’ কখনো ভারতের নাম ছিল না। ইংরেজ আমলে দেশটির এ নাম দেয়া হয়। ইন্ডাস বা সিন্ধু থেকে ইন্ডিয়া শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। আবার সিন্ধু থেকে হিন্দু শব্দটি এসেছে। ভারতীয়রা ইন্ডিয়া নামের কোনো দেশকে স্বীকার করে না। তাদেরকে এ নামটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অন্যদিকে মহাভারত, শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা ও বিষ্ণু পুরাণের মতো হিন্দু ধর্মগ্রন্থ থেকে উৎসারিত হওয়ায় ভারত বা ভারতবর্ষ নামটির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আত্মার।
কংগ্রেস ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করায় দ্বিজাতি তত্ত্বের ঘোর বিরোধিতা করেছে। মুসলিম লীগের মতো সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করলে তারাও দ্বিজাতি তত্ত্বের সমর্থক হতো। দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধিতা করার অর্থ ভারতে একটি মাত্র জাতি ছাড়া আর কোনো জাতির বসবাসের অধিকার নেই। এ ধরনের মানসিকতা সংখ্যালঘুদের অধিকার ও অস্তিত্ব অস্বীকার করার শামিল।             
ভারতীয় উপমহাদেশ পৃথিবীর এক-পঞ্চমাংশ জনগোষ্ঠীর বসতিস্থল হলেও এখানে একটি মাত্র জাতির শ্রেষ্ঠত্ব লক্ষ্যণীয়। বিশুদ্ধ আর্য জাতির দাবিদার এ জাতি ভারতের তিন-চতুর্থাংশের ওপর নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে এবং উপমহাদেশের বাদবাকি অংশে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েমের অশুভ চক্রান্তে নিয়োজিত রয়েছে। ভারতীয়দের কাছে ভারত হলো মায়ের মতো অবিভাজ্য। ব্রিটিশদের বিদায় করার স্বার্থে তারা সাময়িকভাবে ভারত বিভক্তি মেনে নিয়েছিল। পরবর্তী কার্যকলাপে ধরা পড়ে যে, অখণ্ড ভারত কায়েম করাই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এ লক্ষ্য পূরণে এক জাতিতে বিশ্বাসী এ শক্তি ধীরে ধীরে উপমহাদেশকে গ্রাস করছে। তাদের আগ্রাসী থাবায় দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাগুলোর ভবিষ্যৎ বিপন্ন। সুদূর অতীতকাল থেকে তারা অখণ্ড ভারত কায়েমের স্বপ্ন লালন করছে। বিগত ও চলতি শতাব্দীর ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, দক্ষিণ এশিয়ার অশান্তির মূলে রয়েছে ভারত। দেশটি প্রতিটি প্রতিবেশি বিশেষ করে ক্ষুদ্র প্রতিবেশিদের জন্য বরাবরই নিজেকে একটি হুমকি হিসাবে প্রমাণ করেছে। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বা সার্কের কার্যক্রমের প্রতি লক্ষ্য করলেও বুঝা যায় যে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতই সব। অন্য দেশগুলো তার ইচ্ছার কাছে জিম্মি। দক্ষিণ এশিয়াকে পদানত করতে ভারত প্রাচীন চানক্য নীতি অনুসরণ করছে। ভৌগোলিক সম্প্রসারণ হচ্ছে চানক্য নীতির মূল লক্ষ্য। উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ রাজশক্তির বিদায় লগ্ন থেকে অখণ্ড ভারত কায়েমে ভারতের ভৌগোলিক সম্প্রসারণ শুরু হয়। 
১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই প্রণীত ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তান ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেলেও মুক্তি পায়নি বহু দেশীয় রাজ্য। ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্টে বলা হয়েছিল, দেশীয় রাজ্যগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো হয়তো ভারত নয়তো পাকিস্তানে যোগদান করতে পারবে। অথবা স্বাধীন থাকতে পারবে। কিন্তু এ আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে গোয়ালিয়রে কংগ্রেসের এক সম্মেলনে নেহরু ঘোষণা করেন যে, যেসব দেশীয় রাজ্য ভারতের গণপরিষদে যোগদানে অস্বীকৃতি জানাবে তাদেরকে বৈরি হিসাবে ঘোষণা করা হবে। তিনি এ ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারত একটির পর একটি দেশীয় রাজ্য গ্রাস করে। এসব দেশীয় রাজ্য গ্রাসে ভারত যখন যেমন তখন তেমন নীতি অনুসরণ করে নিজের সীমানা সম্প্রসারিত করেছে।  
১৯৪৭ সালের ২৫ জুলাই ব্রিটিশ ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন দেশীয় রাজাদের এক সমাবেশে বলেন, তাদের রাজ্যগুলো টেকনিক্যালি ও আইনগতভাবে স্বাধীন হলেও কিছু ভৌগোলিক বাধ্যবাধকতাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তিনি রাজাদের নিজস্ব শাসন বজায় রাখতে ভারত ও পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সরকারের সঙ্গে স্থিতাবস্থা চুক্তি স্বাক্ষরের পরামর্শ দেন। মাউন্টব্যাটেন ‘ভৌগোলিক বাধ্যবাধকতা’ বলতে আসলে ভারত সংলগ্ন দেশীয় রাজ্যগুলোকে ভারতে যোগদানের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি দেশীয় রাজ্যগুলোকে ভারতে যোগদানে ব্যক্তিগতভাবে কাজ করছিলেন। অধিকাংশ রাজ্য আকার ও আয়তনে ছোট হলেও হায়দরাবাদ, জুনাগড়, জম্মু ও কাশ্মীর, যোধপুর, জয়পুর, গোয়ালিয়র, ইন্দোর, বরোদা, ত্রিবাঙ্কুর ও মহীশূর ছিল ভৌগোলিক, সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার উপযোগী।   
শক্তিপ্রয়োগ করা না হলে কাশ্মীর, হায়দরাবাদ ও জুনাগড় নিশ্চিতভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হতো। নয়তো নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পারতো। কিন্তু ভারতীয় নেতৃবৃন্দ ১৯৪৭ সালে চরম উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তে এসব রাজ্য সফর করে পরিস্থিতিতে ঘৃতাহুতি দেন। অন্যদিকে পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ গোলযোগপূর্ণ রাজ্যগুলো সফর করা থেকে বিরত থেকে নিজেদের জন্য চরম সর্বনাশ ডেকে আনেন। 
দুর্বল দেশীয় রাজ্যগুলো গ্রাসে ভারত কোনো ন্যায়নীতির তোয়াক্কা করেনি। শক্তি ও কূটকৌশল ছিল দেশটির বিজয়ের একমাত্র চাবিকাঠি। ভারত শুধু অন্যায়ভাবে দেশীয় রাজ্য গ্রাস করেছে তাই নয়, প্রতিবেশি দেশগুলোতেও দেশটি বারবার হস্তক্ষেপ করেছে এবং স্বাধীনতাকামী জনগণের মুক্তির আকাঙ্খাকে গলাটিপে হত্যা করেছে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু কখনো ছোট ও ক্ষুদ্র দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন না। তিনি মনে করতেন, ক্ষুদ্র দেশগুলোর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে এবং একদিন এসব ক্ষুদ্র দেশ ভারতে যোগদান করবে। ‘দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’র ৫৫০ নম্বর পৃষ্ঠায় নেহরু লিখেছেন:    Small nation state is doomed. It may survive as a cultural and autonomous area but not as an independent political unit. অর্র্থাৎ ক্ষুদ্র জাতি রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। এটি সাংস্কৃতিক ও স্বায়ত্তশাসিত এলাকা হিসাবে টিকে থাকতে পারে তবে স্বাধীন রাজনৈতিক ইউনিট হিসাবে নয়।   
ধর্মনিরপেক্ষতার জয়গান গাইতে গিয়ে প্রায়ই বলতে শোনা যায় যে, পাকিস্তান একটি সাম্প্রদায়িক ও ব্রিটিশদের সৃষ্ট কৃত্রিম রাষ্ট্র। কিন্তু বাস্তবতা সাক্ষ্য দিচ্ছে, পাকিস্তান নয় বরং ভারতই সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। পাকিস্তান সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হলে সে দেশে গুজরাট স্টাইলের দাঙ্গা হওয়ার কথা ছিল হাজারে হাজার। কিন্তু শিয়া-সুন্নিতে রক্তাক্ত সংঘর্ষ হলেও আজ পর্যন্ত দেশটিতে হিন্দু বিরোধী একটি দাঙ্গাও হয়নি। ব্রিটিশরা পক্ষপাতিত্ব করে থাকলে করেছে ভারতের প্রতি। পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হলে জম্মু ও কাশ্মীর, পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গে ভারতের ত্রিরঙ্গা পতাকা উড়তো না। 
সাম্প্রদায়িকতা কখনো সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু এ অঞ্চলে একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করা হয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, বিরোধিতাকারীদের অধিকাংশই হয়তো চরম সাম্প্রদায়িক নয়তো মুসলিম বিদ্বেষী। তাদের লক্ষ্য মুসলমানদের সম্প্রদায়গত স্বাতন্ত্র্য মুছে ফেলা। উপমহাদেশে মুসলমানদের আলাদা সম্প্রদায়গত পরিচিতি না থাকলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ভৌগোলিক সীমানা থাকে না। যতদিন এ দু’টি ভূখণ্ডের মানুষ নিজেদেরকে ভারতীয়দের থেকে পৃথক হিসাবে ভাববে ততদিন তাদের ভৌগোলিক সীমানা অক্ষুণœ থাকবে। নয়তো অখণ্ড ভারতে আত্মবিসর্জন হবে চূড়ান্ত পরিণতি।
 (লেখাটি 'ভারতের রাজনৈতিক ও সামরিক হস্তক্ষেপ’ থেকে নেয়া । বইটি প্রকাশ করেছে আফসার ব্রাদার্স।)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ফাইটার জেটের হেলমেট

বর্তমান সময়ে আধুনিক এবং নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফিচার হচ্ছে জেট ফাইটারের ককপিটে বসা এর পাইলটের হেল...