মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত
ইউনিয়নের ভূমিকা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে বিশ্বে স্নায়ুযুদ্ধ বিরাজ করায় সুবিধা যেমন হয়েছিল তেমনি অসুবিধাও হয়েছিল। স্নায়ুুযুদ্ধের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল। পরোক্ষ লড়াইয়ে বিজয়ী হওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল গণতান্ত্রিক বিশ্বের একটি প্রভাব বলয় এবং বিলুপ্ত পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে গঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর আরেকটি পাল্টা প্রভাব বলয়। প্রাথমিকভাবে ভারত ছিল দু’টি প্রভাব বলয়ের বাইরে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট ভারতকে সমাজতান্ত্রিক পরাশক্তি সোভিয়েত প্রভাব বলয়ের দিকে ঠেলে দেয়। পাক-ভারত সংঘাত অনিবার্য বুঝতে পেরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে সহায়তার জন্য হাত বাড়ান।
বিশ্বে নিজ নিজ প্রভাব বলয়ের স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরস্পরবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে। এ দু’টি পরাশক্তির ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এব্যাপারে চৌধুরী এম. শামিমের লেখা ‘দ্য বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশীপ ট্রিটি: অ্যা ক্রিটিক্যাল এনালাইসিস’ শিরোনামে এক নিবন্ধে বলা হয়,
`Bangladesh was a victim of the cold war alliance system. During its war of independence it was a pawn in the chessboard of super power rivalry. The US tilted towards Pakistan while India allied with the Soviet Union.’
‘বাংলাদেশ ছিল স্নায়ুুযুদ্ধের শিকার। মুক্তিযুদ্ধকালে দেশটি ছিল পরাশক্তির দাবার ঘুটি। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। অন্যদিকে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে।’ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারত থেকে জাপান পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী একটি প্রভাব বলয় সৃষ্টিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাদানের সিদ্ধান্ত নেয়। মস্কো বিশ্বাস করতো যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে দুর্বল করবে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই এ অঞ্চলের প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নে শ্যেনদৃষ্টি ছিল। এ ব্যাপারে সালাহউদ্দিন আহমদের ‘বাংলাদেশ পাস্ট এন্ড প্রেজেন্ট’ বইয়ের একটি উদ্ধৃতি উল্লেখযোগ্য। তিনি তার বইয়ের ৩৪৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,‘ By the late 1960’s Kremlin seems to have come to the conclusion that the separation of Pakistan’s western and eastern wings would be in Soviet as well as India’s interest.
‘ষাটের দশকের শেষ নাগাদ ক্রেমলিন এই উপসংহারে পৌঁছেছিল যে, পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ থেকে পূর্বাংশের বিচ্ছিন্নতা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের স্বার্থের অনুকূল হবে।’
ভারতকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঘাটছড়া বাঁধতে দেখে যুক্তরাষ্ট্র চীনের প্রতি বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. হেনরি কিসিঞ্জারের গোপনে চীন সফরে ভারত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে। পাকিস্তানের দূতিয়ালিতে কিসিঞ্জার ১৯৭১ সালের ৯ জুলাই পিকিং সফর করেন এবং চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। ১৯৭০ সালে ওয়াশিংটন সফরকালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কোন্নয়নে মধ্যস্থতা করার অঙ্গীকার করেন। পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় চীন-মার্কিন যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় এত গোপনীয়তা রক্ষা করা হয় যে, ইসলামাবাদস্থ আমেরিকান দূতাবাস ১৯৭১ সালের মে নাগাদ কিছুই জানতে পারেনি। সোভিয়েত ভীতি যুক্তরাষ্ট্রকে বিপরীত মেরুর শক্তি চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার প্রয়াস চালাতে বাধ্য করে। চীন ছিল পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। চীনের সঙ্গে দেশটির বন্ধুত্ব পিকিংয়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সহায়ক বলে বিবেচিত হয়। ভারতকে মোকাবিলা করার কৌশলগত প্রয়োজনেই পাকিস্তান মুসলিম দেশ হয়েও বস্তুবাদে বিশ্বাসী চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষ বেধে যাওয়ায় ষাটের দশকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। তবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালে মস্কোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক চূড়ান্ত পর্বে উন্নীত হয়।
কিসিঞ্জারের চীন সফর শুরু হওয়ার ঠিক এক মাস পর ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট সোভিয়েত-ভারত ২০ বছর মেয়াদী মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে ভারতের মনোবল বৃদ্ধি পায়। চুক্তিতে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা জোরদার, অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের অবসান, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রতি ভারতের অঙ্গীকারের কথা বলা হলেও আসলে এটি ছিল নির্দিষ্টভাবে চীন ও পাকিস্তানকে মোকাবিলা এবং বিশেষভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিহত করার একটি সামরিক চুক্তি। চুক্তির ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ তার প্রমাণ। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো কোনো পক্ষের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িত তৃতীয় কোনো পক্ষকে কোনো ধরনের সহায়তা প্রদানে বিরত থাকবে। চুক্তিতে স্বাক্ষরদানকারী কোনো পক্ষ আক্রান্ত হলে অথবা হুমকির মখোমুখি হলে পক্ষগুলো তাদের নিজ নিজ দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে এ ধরনের হুমকি দূর করতে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে অবিলম্বে পারস্পরিক আলোচনায় মিলিত হবে।’ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের প্রতিরক্ষা সামর্থ্য শক্তিশালী করতে শুরু করে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বেধে গেলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে বৈষয়িক ও কূটনৈতিক সমর্থন প্রদান করে। দেশটি ভারতে সামরিক সহায়তা প্রেরণ এবং জাতিসংঘে ভারতকে কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে পাকিস্তানের ব্যবচ্ছেদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে চীনের সমর্থনপুষ্ট যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করে। যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রস্তাবে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যাহার এবং পাক-ভারত সীমান্তে পর্যবেক্ষক মোতায়েনের আহ্বান জানানো হয়। বিপরীতক্রমে ভারতের অবস্থানের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথমে পূর্ব পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তি এবং পরে যুদ্ধবিরতির দাবি জানায়। অন্যদিকে ৫ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে দেয়া সব ধরনের অর্থনৈতিক সাহায্য প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেয়। ৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট আরেকটি প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করে। এ প্রস্তাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক নিষ্পত্তির যে আহ্বান জানিয়েছিল, তার উল্লেখ ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়ন অন্য ৮টি সমাজতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে আর্জেন্টিনার উত্থাপিত অন্য একটি প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করে। আর্জেন্টিনার প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতি এবং এক দেশ থেকে অন্য দেশের সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছিল। ১৩ ডিসেম্বর অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উত্থাপিত তৃতীয় একটি প্রস্তাবেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো দেয়। তবে দেশটি পোল্যান্ডের একটি প্রস্তাব সমর্থন করে।
যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭১ সালের সংকটকে স্নায়ুযুদ্ধের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করতো এবং মনে করতো, সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোকে দুর্বল করতে চাইছে। এ হিসাব থেকে দেশটি ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানকে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে সমর্থন দান করে। তবে দেশটি পাকিস্তানকে একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হিসাবে টিকিয়ে রাখতে মোটেও আগ্রহী ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ থেমে গেলে পশ্চিম পাকিস্তান ভাঙ্গার এবং আজাদ কাশ্মীর দখলে ভারতকে যে কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখতে চাইছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. হেনরি কিসিঞ্জার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সোভিয়েত সম্প্রসারণে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন। সোভিয়েত হুমকি মোকাবিলায় প্রেসিডেন্ট নিক্সন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় যোগাযোগ করছিলেন। ১৯৭২ সালে তিনি চীন সফরে আগ্রহী ছিলেন। চীনের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তান ছিল একটি মাধ্যম। তাই নিক্সন প্রশাসনের কাছে পাকিস্তান বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের পতন কাম্য ছিল না। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে মোটেও পছন্দ করতেন না। ১৯৭১ সালের নভেম্বরে ইন্দিরা গান্ধীর যুক্তরাষ্ট্র সফরে তার এ মনোভাবের প্রতিফলন ঘটে। ৪/৫ নভেম্বর দু’দিনব্যাপী সফরকালে ইন্দিরা প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তবে প্রথমদিনের সাক্ষাৎকার ছিল তার কাছে অত্যন্ত বিব্রতকর। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কর্মকর্তা স্যামুয়েল হসকিনসন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাকে সঙ্গে নিয়ে হোয়াইট হাউসের কূটনৈতিক প্রবেশদ্বার অতিক্রম করে বিশেষ একটি অভ্যর্থনা এলাকায় গিয়ে পৌঁছান। সেখানে পৌঁছে তিনি একটি টেলিফোন উঠিয়ে নিক্সনের সচিব রোজ ম্যারি উডসকে জানান, ‘মিসেস ইন্দিরা এখানে অপেক্ষা করছেন। অনুগ্রহ করে প্রেসিডেন্টকে জানান।’ ইন্দিরা নিজেও বললেন, তিনি এখানেই প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান। কিন্তু প্রেসিডেন্টের দেখা নেই। আধাঘন্টা কেটে যায়। মিসেস গান্ধী অস্থির হয়ে উঠেন। দৃশ্যত তাকে বিরক্ত বলে মনে হলো। হসকিনসন আবার রোজ ম্যারিকে টেলিফোন করেন। কিছুক্ষণ পর রোজ ম্যারি মিসেস গান্ধীকে রুজভেল্ট রুমে নিয়ে যেতে বলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টগণ সাধারণত বিদেশী রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সঙ্গে হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে দেখা করেন। ইন্দিরার ক্ষেত্র তার ব্যতিক্রম করা হয়। হসকিনসন ইন্দিরাকে নিয়ে রুজভেল্ট রুমে যান। আবার শুরু হয় প্রতীক্ষার পালা। তবে দীর্ঘক্ষণ নয়। তবু যতক্ষণ বিলম্ব ঘটে তা ছিল মিসেস ইন্দিরার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাবার জন্য যথেষ্ট। হঠাৎ রুজভেল্ট রুমের দরজা খুলে যায়। প্রেসিডেন্ট নিক্সন দু’হাত প্রসারিত করে প্রশস্ত হাসি দিয়ে বললেন, ‘মিসেস গান্ধী, আপনি এখানে? কই, কেউ তো আমাকে বলেনি যে, আপনি এখানে?’ ইন্দিরা ফিরতি হাসি দেন। তবে অনেক কষ্টে। বৈঠকে প্রেসিডেন্ট নিক্সন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাকে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানিয়ে দেন, পাকিস্তানের ভাঙ্গনে কোনো স্বার্থ হাসিল হবে না। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ভারত সংঘাতের সূচনা ঘটালে বৃহৎ শক্তিগুলো কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে তা নির্ভুলভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়।
ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ছিল প্রেসিডেন্ট নিক্সনের গভীর আবেগময় সম্পর্ক। প্রেসিডেন্ট নিক্সন মনে করছিলেন, ভারতীয় হামলায় পশ্চিম পাকিস্তানের পতন ঘটলে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে এবং এ অঞ্চলে সোভিয়েত ইউনিয়নের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম হবে। তাতে বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার সম্ভাব্য নয়া মিত্র চীনের অবস্থান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাকিস্তানের উপর মার্কিন কংগ্রেসের নিষেধাজ্ঞা সরাসরি লংঘন করে চীনের কাছে মিত্র হিসাবে নিজের আন্তরিকতার প্রমাণ দিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সন জর্দান ও ইরানের মাধমে পাকিস্তানে সামরিক সরবরাহ পাঠান। একইসঙ্গে পাকিস্তানে সমরাস্ত্র সরবরাহ বৃদ্ধি করতে চীনকে উৎসাহিত করা হয়।
পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার বিবরণ দিয়ে ঢাকাস্থ মার্কিন কূটনীতিক আর্চার্ড ব্লাড ওয়াশিংটনে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন। এ বার্তা ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ নামে পরিচিত। কিন্তু নিক্সন প্রশাসন এ বার্তা উপেক্ষা করে। ১৯৭১ সালের মার্চে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এক আলোচনায় প্রেসিডেন্ট নিক্সন ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্র“য়ারি কংগ্রেসের কাছে স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ড রিপোর্টে ইঙ্গিত দেন যে, যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযানে সমর্থন দেয়নি। আবার নিন্দাও করেনি। য্ক্তুরাষ্ট্র গণহত্যা বন্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুরতার নিন্দা করে কখনো কোনো প্রকাশ্য বিবৃতি দেয়নি বরং নীরব কূটনীতির মাধ্যমে নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানিদের সবুজ সংকেত দিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নিক্সন একটি পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের কাছে বলেছিলেন, ‘ইয়াহিয়া যুক্তরাষ্ট্রের একজন ভালো বন্ধু।’ নৃশংস সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করার পরিবর্তে তিনি আরো বলেছিলেন, ইয়াহিয়া যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তিনি সেগুলোর যৌক্তিকতা উপলদ্ধি করতে পারছেন। ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল তিনি এক নির্দেশে বলেন,To all hands. Don’t squeeze Yahya at this time- RMN.’
সবার প্রতি প্রযোজ্য। এ মুহূর্তে ইয়াহিয়াকে ঘাটাবে না- আরএমএন।’ ১৯৭১ সালে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলে কর্মরত স্যামুয়েল হসকিনসন ১৯৭১ সালে দক্ষিণ এশিয়ার সংকটকে বৃহৎ শক্তির একটি দাবা খেলা হিসাবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, ‘আমরা ইয়াহিয়াকে পছন্দ করতাম। তিনি ছিলেন সামরিক বাহিনীর লোক। তার সম্পর্কে আমরা ভালো রিপোর্ট পাচ্ছিলাম। তবে তিনি ইন্দিরার মতো রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন না। একজন সাধারণ সৈনিক যা করে সংকটে তিনি তাই করেছেন। সৈনিক বলেই তিনি যুদ্ধে গিয়েছেন। হোয়াইট হাউস বিশ্বাস করতো, মিসেস গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত প্রতিবেশী পাকিস্তানের ধ্বংস সাধনে বদ্ধপরিকর। ২৫ মার্চের পর ইসলামাবাদে মার্কিন দূতাবাসের দ্বিতীয় কর্তাব্যক্তি সিডনি সোবার ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বহুবার বৈঠকে মিলিত হন। এসব বৈঠকে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুদন্ড কার্যকর না করতে তার উপর চাপ প্রয়োগ করেন। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে তিনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে একটি বৈঠকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে য্ক্তুরাষ্ট্রের একটি পরিকল্পনা পেশ করেন। ইয়াহিয়া খান যুক্তরাষ্ট্রের এ পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও ভারত প্রত্যাখ্যান করে। তিনি আরো বলেন, শেষদিন পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান বিশ্বাস করতেন, সংকটের একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তি খুঁজে বের করা এবং পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ রাখা সম্ভব। ইয়াহিয়া আমেরিকানদের জানিয়েছিলেন, তিনি ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর বিচারপতি এআর কর্নেলিয়াস প্রণীত একটি খসড়া সংবিধান ঘোষণা করার এবং ২৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের পরিকল্পনা করছেন।
চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতা স্থাপনে ইয়াহিয়ার গুরুত্ব এবং নিক্সন ও কিসিঞ্জারের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব থাকায় নিক্সন ঘোষণা করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র এমন কিছু করবে না যাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের জন্য পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে অথবা তিনি বিব্রতবোধ করতে পারেন। আমেরিকার স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকায় ওয়াশিংটন প্রকাশ্যে পাকিস্তানের সমালোচনা করেনি। উপমহাদেশে সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করলে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। তবে একই সঙ্গে নিক্সন প্রশাসন এ দাবি করেছে যে, তারা কোনো ভারতবিরোধী নীতি অনুসরণ করেনি। প্রকাশিত দলিলপত্রে দেখা গেছে, প্রকাশ্য বিবৃতিতে পাকিস্তানের প্রতি ঝুঁকে পড়া ছাড়াও চীনের সঙ্গে আলোচনা এবং যুদ্ধ সংক্রান্ত প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে পাকিস্তানপন্থী একটি অবস্থান গ্রহণ করে। পাকিস্তানের দূতিয়ালিতে ড. হেনরি কিসিঞ্জার অত্যন্ত গোপনে চীন সফর করেন। নয়াদিল্লি সফর শেষ করে ইসলামাবাদ এসে তিনি চীনের উদ্দেশে রওনা দেন। নয়াদিল্লিকে ফাঁকি দেয়ার জন্য একটি কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়। কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয় এজন্য যাতে ভারত এই ধারণা পোষণ না করে যে, তাদের গুরুত্বকে খাটো করে দেখা হচ্ছে। পরিকল্পনা করা হয়েছিল যে, কিসিঞ্জার নয়াদিল্লি থেকে ইসলামাবাদ এসে পৌঁছানোর পর ঘোষণা করা হবে, তিনি দীর্ঘ সফর ও উষ্ণ আবহাওয়ায় ক্লান্ত। তাই তার কয়েকদিন বিশ্রামের প্রয়োজন। কিন্তু দিল্লি থেকে ফিরে আসার পর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়, দিল্লিতে অবস্থানকালে তিনি জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন এবং খাবার গ্রহণে তার বদহজম হয়েছে। তাতে তার রাতে ভালো ঘুম হয়নি। অতএব তিনি বিশ্রাম নেবেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তার একান্ত বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে তারা নৈশভোজে মিলিত হন। এসময় উভয়ে ছিলেন অত্যন্ত ফুরফুরে মেজাজে। ইয়াহিয়া খানকে তিনি ঠাট্টা করে বলেন, ‘মি. প্রেসিডেন্ট, আপনি একজন নির্বাচিত একনায়কের মতো একটি বিশৃঙ্খলাপূর্ণ নির্বাচন করেছেন।’
কিসিঞ্জার পাকিস্তানিদের সঙ্গে বৈঠককালে জানতে চান পান উৎসবে কিভাবে চীনাদের সঙ্গে কথা বলবেন, কিভাবে তাদের কথার জবাব দেবেন। চীনের সঙ্গে দীর্ঘ দু’দশক যোগাযোগ না থাকায় তাদের আচার আচরণ সম্পর্কে মার্কিনীদের কোনো ধারণা ছিল না। তাই কিসিঞ্জারের জন্য তাদের ব্যাপারে ধারণা লাভ করা ছিল জরুরি। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে কিসিঞ্জার বেইজিংয়ে পৌঁছান। বেইজিং সফরকালে তিনি চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে কয়েকবার বৈঠকে মিলিত হন। কোনো কোনো সময় তিনি তার সহকারীদের সঙ্গেও বৈঠকে মিলিত হতেন। চীনে দু’দিন অবস্থান শেষে ১১ আগস্ট তিনি ইসলামাবাদ ফিরে আসেন। তাকে বহনকারী বিমান কোথায় অবতরণ করবে সে সংকেতের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও পাকিস্তানি কর্মকর্তারা অপেক্ষা করতে থাকেন। যথাসময়ে সংকেত দেয়া হয়। বার্তা পেয়ে পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বিমান বন্দরে ছুটে যান। কিসিঞ্জারকে বহনকারী বিমানটি বেইজিং থেকে দিনের বেলা ফিরে আসে। কিন্তু বিমানটি অবতরণ করে বিমান বন্দরে বিমান বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত অংশে। বিমান বন্দরে কর্মরত লোকজন বিস্মিত হয়। তারা বুঝতে পারছিল না বিমানটি কেন বিমান বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত অংশে অবতরণ করেছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব কিসিঞ্জারকে বিমান বন্দর থেকে তার হোটেল স্যুটে নিয়ে আসেন। কিসিঞ্জার খুবই উল্লসিত। চৌ এন লাইকে তিনি একজন মহান রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে আখ্যায়িত করেন এবং তার আতিথেয়তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। বেইজিংয়ে কিসিঞ্জার একটি অতিথিশালায় অবস্থান করেন। সেখানে একটি ক্ষুদ্র সেতু ছিল। অতিথিশালায় ছিল ১২টি কক্ষ। প্রতিটি কক্ষ ছিল একটি থেকে আরেকটি বিচ্ছিন্ন। পৃৃথক হওয়ায় এক কক্ষের অতিথিরা জানতো না অন্য কক্ষের অতিথি কে বা কারা। অতিথিশালায় সর্বত্র ছিল সতর্ক চীনা প্রহরী। কিসিঞ্জার সেতু অতিক্রম করে অন্য কক্ষে যাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু চীনা প্রহরীরা তাকে থামিয়ে দেয়। কিভাবে জানি চৌ এন লাই ঘটনাটি জানতে পারেন। তিনি সেখানে ছুটে আসেন এবং তার হাত ধরে সেতু অতিক্রম করেন। এসময় প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই মন্তব্য করেন, ‘আমরা যেন এ সেতুটির কথা বিস্মৃত না হই। এ সেতুর জন্য আমাদের মধ্যে সাক্ষাৎ সম্ভব হয়েছে।’
১৯৭১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট নিক্সন সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকোর সঙ্গে বৈঠকে তাকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়তে ভারতকে নিরুৎসাহিত করার অনুরোধ জানান। ২১ নভেম্বর ভারতীয় সৈন্যরা মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা প্রদানে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত অতিক্রম করে সামরিক তৎপরতায় জড়িত হয়ে পড়লে কিসিঞ্জার উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন। তিনি ভারতের আচরণকে পাক-ভারত যুদ্ধের সূচনা হিসাবে উল্লেখ করেন। ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ বেধে যাবার দিন তিনি পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও সিআইএ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে যুদ্ধ শুরু করার জন্য ভারতকে অভিযুক্ত করেন। ৮ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা কিসিঞ্জারের সঙ্গে টেলিফোনে পাক-ভারত যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনাকালে নিক্সন পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ এস. ফারল্যান্ডের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, তিনি সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট লিওনিদ ব্রেঝনেভকে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কাউকে আগ্রাসন চালানোর অনুমতি দেবে না।
প্রেসিডেন্টের উদ্বেগের প্রেক্ষিতে ১০ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে সিআইএ’র একটি সুরক্ষিত কক্ষে কিসিঞ্জার জাতিসংঘে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত হুয়াং হুয়ার সঙ্গে গোপন আলোচনায় মিলিত হন এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগর অভিমুখে কয়েকটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজের অগ্রসর হওয়ার ছবি এবং অতি গোপনীয় তথ্য তার কাছে হস্তান্তর করেন। তিনি চীনা রাষ্ট্রদূতকে জানান, আমরা এই মর্মে একটি গোয়েন্দা রিপোর্ট পেয়েছি যে, মিসেস গান্ধী পাকিস্তানের সেনা ও বিমান বাহিনীকে ধ্বংস করতে এবং আজাদ কাশ্মীরের দক্ষিণাংশকে তার দেশের সঙ্গে অঙ্গীভূত করতে চান। যুদ্ধে এতটুকু অগ্রগতি অর্জিত হলে তিনি যুদ্ধবিরতিতে রাজি হবেন। আমাদেরকে অবশ্যই তার এ অভিপ্রায় রুখে দিতে হবে এবং এজন্যই আপনার সঙ্গে বৈঠকের আয়োজন করেছি। কিসিঞ্জার ভারতের বিরুদ্ধে সৈন্য মোতায়েনের উদ্যোগ গ্রহণে চীনের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি চীনা রাষ্ট্রদূতকে প্রতিশ্র“তি দেন যে, এ উদ্যোগ গ্রহণ করতে গিয়ে অন্য পক্ষ চীনে হামলা চালালে যুক্তরাষ্ট্র বেইজিংয়ের সহায়তায় এগিয়ে যাবে। চীনা রাষ্ট্রদূত হুয়াং হুয়া জোর দিয়ে বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত উপমহাদেশে একটি বিপজ্জ্বনক পথে অগ্রসর হচ্ছে এবং চীনকে ঘেরাও করে ফেলতে চাইছে। চীনা রাষ্ট্রদূতের উদ্বেগ লক্ষ্য করে কিসিঞ্জার স্পষ্টাক্ষরে তাকে জানান, আমরা উভয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের উপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখবো। ১২ ডিসেম্বর চীন হোয়াইট হাউসের কাছে একটি জরুরি বার্তা পাঠায়। বার্তায় নিউইয়র্কে একটি মার্কিন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার প্রস্তাব দেয়া হয়। বার্তা পেয়ে কিসিঞ্জারের সহকারী জেনারেল আলেকান্ডার হেইগ নিউইয়র্কে ছুটে যান। তিনি ভাবছিলেন চীনারা হয়তো তাকে সিকিম অথবা নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ারে (অরুণাচল) তাদের সৈন্য সমাবেশ সম্পর্কে অবহিত করতে চায়। কিন্তু চীনা রাষ্ট্রদূত হুয়াং হুয়া বিশ্ব সংস্থায় তার সরকারের পরবর্তী অবস্থান তুলে ধরা ছাড়া আর কোনো সুসংবাদ দিতে পারেননি।
পাক-ভারত যুদ্ধে চীনের সহায়তা কামনা করার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নকে এমন ইঙ্গিতও দিয়েছিল যে, ক্রেমলিন ভারতকে সংযত না করলে বড় ধরনের সংঘাত বেধে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র অভিমত প্রকাশ করেছিল যে, যুদ্ধে চীনের ভূমিকা চূড়ান্ত নিষ্পত্তিকারী হতে পারে। কিন্তু চীন ছিল অত্যন্ত হুঁশিয়ার। ভারত সীমান্তে দেশটি সৈন্য মোতায়েন করেছিল। তবে চীন ভারতে হামলা চালানোর ঝুঁকি নেয়নি। ভারতে হামলা চালালে সোভিয়েত ইউনিয়ন চীনে পাল্টা হামলা চালিয়ে বসতে পারতো। পরিস্থিতি যদি সত্যি সে রকম হতো তাহলে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত যুদ্ধে জড়িয়ে যেতো। ১৯৭১ সালে পাক-ভারত যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাবার সকল সম্ভাবনা বিরাজ করছিল। চীনের ভূমিকার উপর নির্ভর করছিল সম্ভাব্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভবিষ্যৎ। কিন্তু দেশটি ভারতে হামলা না চালিয়ে নিজেকে এবং বিশ্বকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে রক্ষা করেছে। ২০০২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ৩১তম বিজয় দিবসে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা মোহাফেজখানা থেকে প্রকাশিত গোপন দলিলে বলা হয়, `With the Indian army and armed Bengali separatists winning, the US on 10 December 1971 urged Beijing to mobilise troops towards India, saying the US would back it if the Soviet Union became involved. China declined and on 16 December the war ended with the Indian army and Bengali separatists taking Dhaka.'
‘ ভারতীয় সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বিজয়ী হওয়ার মুহূর্তে ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটানোর জন্য বেইজিংয়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধে সম্পৃক্ত হলে যুক্তরাষ্ট্র চীনের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু চীন যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানে সাড়াদানে অস্বীকৃতি জানায় এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঢাকা দখল করার মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়।’
৯ ডিসেম্বর সিআইএ ডিরেক্টর রিচার্ড হোমস প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে সতর্ক করে দেন যে, যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বিপর্যয় ঘটতে যাচ্ছে। পূর্ব রণাঙ্গনে যুদ্ধ থেমে গেলে এখান থেকে অতিরিক্ত ভারতীয় সৈন্য পশ্চিম রণাঙ্গনে ছুটে যাবে। তখন পশ্চিম পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। সিআইএ ডিরেক্টরের কাছ থেকে এ বার্তা পেয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সন বঙ্গোপসাগরে পরমাণু শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরী ‘ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ’ পাঠানোর নির্দেশ দেন এবং নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পাকিস্তানে সামরিক সরবরাহ প্রেরণ করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন এ সংবাদ পেয়ে তাদের নৌবহরকে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেয়। ১০ ডিসেম্বর দক্ষিণ ভিয়েতনামের অদূরে টঙ্কিন উপসাগরে ইয়াঙ্কি স্টেশন থেকে ১০টি যুদ্ধজাহাজের প্রহরায় মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ‘ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ’ সিঙ্গাপুর অভিমুখে ধেয়ে আসতে থাকে। ১২ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে রওনা হয়। চারটি রাডার সজ্জিত এন্টারপ্রাইজে ছিল ৯০টি জঙ্গি ও বোমারু বিমান। এটি ছিল প্রশান্ত মহাসাগরে মোতায়েন মার্কিন সপ্তম নৌবহরের অংশ। মার্কিন নৌবাহিনীর বৃহত্তম এ বিমানবাহী রণতরীর ঘণ্টায় গতিবেগ ছিল ৩৩ দশমিক ৮ নটিক্যাল মাইল এবং দৈর্ঘ্য ছিল এক হাজার ১২৩ ফুট এবং প্রস্থ ১৩২ দশমিক ৮ ফুট। এন্টারপ্রাইজের নেতৃত্বে ‘টাস্কফোর্স-৭৪’ গঠন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এ উদ্যোগ ছিল একটি পরমাণু হুমকি। বিমানবাহী রণতরী এন্টারপ্রাইজ ছাড়াও ‘টাস্কফোর্স-৭৪’ এ ছিল উভচর যুদ্ধজাহাজ ‘ইউএসএস ত্রিপোলী’, নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র সজ্জিত তিনটি প্রহরাদানকারী যুদ্ধজাহাজ ‘ইউএসএস কিং’, ‘ডেকাটার’ ও ‘পিয়ারসন্স’, চারটি ডেস্ট্রয়ার ‘ইউএসএস বাউসেল’, ‘অরলেক’, ‘ম্যাককীন’ ও ‘এন্ডারসন’ এবং একটি পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন। সহায়তাদানকারী যুদ্ধজাহাজগুলোর পুনরায় জ্বালানি গ্রহণের জন্য টাস্কফোর্সের অগ্রযাত্রায় বিলম্ব ঘটে। ফলে টাস্কফোর্স-৭৪ কে সিঙ্গাপুরের পূর্বদিকে যাত্রাবিরতি করতে হয়। ১৩-১৪ ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী রাতে টাস্কফোর্স-৭৪ মালাক্কা প্রণালী অতিক্রম করে এবং ১৫ ডিসেম্বর সকালে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে। উভচর যুদ্ধজাহাজ ‘ইউএসএস ত্রিপোলী’তে ছিল ২৫ টি অ্যাসল্ট হেলিকপ্টার এবং ২ শো মেরিন সেনার একটি ব্যাটালিয়ন।
১২ ডিসেম্বর সাবেক দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গন থেকে নিউইয়র্ক টাইমসের এক রিপোর্টে বলা হয়, মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ‘এন্টারপ্রাইজ’ ও কয়েকটি প্রহরাদানকারী যুদ্ধজাহাজ মালাক্কা প্রণালীর উদ্দেশে ভিয়েতনামের জলসীমা অতিক্রম করেছে এবং বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের জন্য নির্দেশের অপেক্ষা করছে। ভারত সরকার নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এ সংবাদ থেকে মার্কিন টাস্কফোর্সের এগিয়ে আসার সংবাদ জানতে পারে। তবে ভারত টাস্কফোর্সের লক্ষ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি। এ নিয়ে ভারতীয় কর্মকর্তারা ৪ দিন পর্যন্ত মাথা ঘামান। ভারত সরকার টাস্কফোর্সের সম্ভাব্য হুমকির বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মেলভিন লেয়ার্ড বঙ্গোপসাগরে বিমানবাহী রণতরীর উপস্থিতি সম্পর্কে একটি ব্যাখ্যা দেন। তিনি তার ব্যাখ্যায় বলেন, ১২ ডিসেম্বর ব্রিটিশ বিমান বাহিনী ঢাকা থেকে ১২৪ জন আমেরিকানকে সরিয়ে নিয়েছে। তবে সেখানে এখনো ৪৭ জন আমেরিকান স্বেচ্ছায় অবস্থান করছে। তাদের অপসারণে জরুরি পরিকল্পনার অংশ হিসাবে টাস্কফোর্স পাঠানো হচ্ছে। ভারত মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এ ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করে। মুষ্টিমেয় আমেরিকানকে অপসারণে পরমাণু শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরীর নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্স পাঠানোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভারত সন্দেহ প্রকাশ করে। কেউ কেউ ধারণা করছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের চারপাশে ভারতীয় অবরোধ ভেঙ্গে মার্কিন মেরিনদের সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যদের সংযোগ সাধনে এ টাস্কফোর্স পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু ভারত এ ধারণা বাতিল করে দেয়। দিল্লি বিশ্বাস করতো যে, অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে মার্কিন মেরিনদের সংযোগ সাধন করতে হলে বঙ্গোপসাগরে সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে হবে। ভারতীয় কর্মকর্তারা ধারণা করছিলেন যে, ঢাকার পতন ঘটলে পাকিস্তানি সৈন্যদের পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নেয়া হবে। মার্কিন উভচর অ্যাসল্ট যুদ্ধজাহাজ ‘ত্রিপোলী’র উপস্থিতি থেকে তারা এ ধারণা করছিলেন। অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সৈন্যদের অপসারণে ত্রিপোলী’তে এসব জঙ্গি হেলিকপ্টার ও মেরিন ব্যাটালিয়ন মজুদ করে রাখা হয়েছে বলে ধারণা করা হতে থাকে।
মার্কিন ৭ম নৌবহর এগিয়ে আসার সংবাদ পেয়ে ১০ ডিসেম্বর ভারতীয় নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এস এম নন্দ বিচলিত হয়ে পড়েন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে যুুদ্ধের পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিফিংদানকালে তার এ বিচলিত অবস্থা ধরা পড়ে। ব্রিফিংয়ের সময় একটি বিরাট টেবিলের একপাশে বসেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা এবং অন্য পাশে বসেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এসএইচএফজি মানেকশ, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল পি সি লাল ও নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল নন্দ। ব্রিফিংয়ে ব্যাঘাত ঘটিয়ে এডমিরাল নন্দ ইন্দিরার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘ম্যাডাম মার্কিন ৭ম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে এগিয়ে আসছে।’ ইন্দিরা নিরুত্তর। ব্রিফিং চলতে থাকে। কিছুক্ষণ পর এডমিরাল নন্দ আবার প্রধানমন্ত্রীর মনোযোগ আকর্ষণ করে বলেন, ‘ম্যাডাম আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, মার্কিন ৭ম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে রওনা হয়েছে।’ ইন্দিরা তাকে তৎক্ষণাৎ থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এডমিরাল আপনার কথা আমি প্রথমবারই শুনতে পেয়েছি। চলুন আমরা ব্রিফিংয়ে মনোযোগ দেই।
ইন্দিরা উড়িয়ে দেয়া সত্ত্বেও এডমিরাল নন্দর মন খচখচ করছিল। তিনি অরোরার চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকবের কাছে টেলিফোন করেন। জ্যাকব তাকে অভয় দিয়ে বলেন, ভারতীয়দের সামান্য ভয় দেখানোর জন্য টাস্কফোর্স পাঠানো হয়েছে। অন্য কোনো কিছুর জন্য নয়। টাস্কাফোর্স এত দূরে যে, সময়মতো এটি বঙ্গোপসাগরে এসে পৌঁছতে পারবে না। তিনি তাকে আরো আশ্বস্ত করেন যে, পাকিস্তানি ডলফিন শ্রেণীর সাবমেরিন পারস্য উপসাগরে ঘোরাফেরা করছে। এ সাবমেরিন বিশাল বিস্তৃতি কভার করতে পারবে না। তারপরও এডমিরাল নন্দ বিশ্বাস করছিলেন, সমুদ্রের মধ্যে কোথাও রিফুয়েলিংয়ের ব্যবস্থা থাকা অসম্ভব নয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পরাশক্তির ভূমিকা:
উত্তরমুছুনসোভিয়েত/রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, যুক্তরাজ্য
https://anusargo.com/%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%af%e0%a7%81%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%a7%e0%a7%87-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%b6%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b0-%e0%a6%ad/