৬৫৫ হিজরী রমজান মাস মোতাবেক ১২৫৭ সালে মোঙ্গল নেতা হালাগু খান আব্বাসীয় খলিফার নিকট দূত প্রেরণ করে। উদ্দেশ্য মূলতঃ মঙ্গু খানের নির্দেশ অনুযায়ী বাগদাদ দখল এবং খেলাফত ব্যবস্থা ধ্বংস করা। সুতরাং দূত যে পত্র নিয়ে যায় তাতে শব্দের তুলনায় হুমকি-ধমকি ছিলো বেশী৷ তাতে খিলাফত ছেড়ে দিয়ে তার পুত্রকে খলিফা ঘোষণা করা, বাগদাদকে মোঙ্গলদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া, এবং খলিফাকে একজন সাধারণ মানুষের মতো তার নিকট উপস্থিত হতে বলা হয়।
পত্র পাওয়ার পর খলিফা ঘৃণা ভরে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং উল্টো হালাগু খানকে ধ্বংস করে দেয়ার হুমকি দেন। এবং মোঙ্গল দূতকে অপমানিত হয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। খলিফার এমব ঔদ্ধত্যপূর্ণ জবাব দূতের অপমান বাগদাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয় এবং খিলাফত ধ্বংসের সীল মেরে দেয়া হয়।
হালাগু খান এবার জ্যোতিষবিদদের সাথে পরামর্শ করে আক্রমনের জন্য শুভ দিন নির্ধারণ করার হুকুম দেন। তার দলে মোঙ্গল সম্রাট মঙ্গু খানের সময়কার একজন জ্যোতির্বিদ ছিলেন, তার নাম ছিলো হুসামুদ্দীন। পেশায় জ্যোতির্বিদ হলেও ধর্মের দিক দিয়ে মুসলিম ছিলেন। তিনি খেলাফত রক্ষার জন্য বারবার হালাগু খানকে ভুল ভবিষ্যদ্বানী করে আক্রমণ থেকে বিরত থাকার জন্য চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু অপরাপর জ্যোতির্বিদরা বললেন আক্রমণ শুভ এবং হালাগু খানের বিজয় নিশ্চিত। এমন দ্বিধাদ্বন্দের কারণে হালাগু খান নাসিরুদ্দিন তুসীকে ডেকে পরামর্শ চায়। এই লোক ছিলো আব্বাসীয় খিলাফতের ঘোর বিরোধী, সে এসেই তাকে সম্ভাব্য রকম উপায়ে বাগদাদ আক্রমণের জন্য প্ররোচনা করতে থাকে।
অতঃপর ৬২৫ হিজরী মোতাবেক ১২৫৭ সালে হালাগু খান ইরানের ভিতর দিয়ে বাগদাদের দিকে অভিযান শুরু করে। এ সময় সে ইরাক সীমন্তবর্তী গোত্রগুলোকে অর্থের বিনিময়ে সৈন্যদলো যোগ করে, এবং মসুল ও পারস্য শাসকের সহোযোগিতাও লাভ করে।
যখন খলিফা বুঝলেন আগুন ধরে গেছে তখন তিনি কুটনৈতিক পন্থায় এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালান। কোনভাবেই হালাগু খানকে তার সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে না পেরে খলিফা মুতাসিম বিল্লাহ তার বন্ধু মুআইয়িদুদ্দীন আলকামির শরণাপন্ন হন। তার কাছে সমাধান চান। এই আলকামি তাকে বুদ্ধি দেয় আপনি নিজে একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে সম্রাটের সাথে সাক্ষাৎ করুন, তবেই সমস্যার সমাধান হবে। সুতরাং সেই অনুযায়ী খলিফা হালাগু খানের নিকট দূত পাঠিয়ে নিজের ইচ্ছে ব্যক্ত করেন। তবে শর্ত দেয়, খলিফা একা আসতে পারবে না সাথে তার মন্ত্রী সভা এবং নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদেরও নিয়ে আসতে হবে।
অতঃপর ৯০০ প্রতিনিধি দল নিয়ে খলিফা দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে হালাগু খানের তাবুতে উপস্থিত হন। তাবুটি একদম বাগদাদ প্রাচীর লাগোয়া অবস্থান করছিলো। এই দলের সাথে সেই আলকামিও ছিলো। তাবুর নিকটে যাওয়ার সাথে সাথেই প্রহরীরা প্রবেশে বাধা দেয় এবং খলিফাসহ মাত্র ১৭জনকে তাবুর ভিতরে যাওয়ার অনুমতি দেয়। এরফলে ঐ ১৭জন ছাড়া বাকী ৮৮৩ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
হালাগু খানের নির্দেশানুসারে-খলিফাকে ডান্ডা বেড়ী পরিয়ে বন্দী করা হয়। রাজকুমারদের হত্য করা হয়। রাজকুমারীদের বন্দী করা হয়।বায়তুল মালের সমস্ত সম্পদ দখল করা হয়। এবং বিশ্বাসঘাতক আলকামিকে দিয়ে বাগদাদ বাসীর নিকট পত্র পাঠিয়ে শহরের বাইরে ডেকে পাঠানো হয়। শহরের প্রতিটি নারী, শিশু, বৃদ্ধ, এবং আলেমদের হত্যা করা হয়। বিশেষ করে সুন্নী মতার্দর্শী আলেমদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করা হয়। এসময় খলিফা ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ অবলোকন করেন এবং বুঝতে পারেন আলকামির মতো বিশ্বাসঘাতকের কারণেই আজকের এই দশা।
টানা ৪০দিন ব্যাপী শহরটাকে ধ্বংস করে একে শ্মশানে পরিণত করা হয়। ৫০০ বছর ধরে তিলে তিলে গড়া সভ্যাতার অপার নিদর্শন বাগদাদ নগরী নিমিষেই শেষ হয়ে যায়।