বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০

নাইন ইলেভেন পরবর্তী আমেরিকা

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বে গণতন্ত্রের অভিভাবক এবং আইনের শাসনের প্রতিভূ বলে গণ্য করা হয়। একথা সর্বজনবিদিত যে, দেশটিতে ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতা স্বীকৃত এবং মানবিক মূল্যবোধ সমুন্নত। কিন্তু এসব কিছু আজ কেতাবী কথায় পরিণত হতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র আমূল বদলে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশটিতে মানবাধিকারের রেকর্ড তৃতীয় বিশ্বের কোনো কোনো দেশের চেয়ে নিকৃষ্ট। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, নিরাপত্তার জন্য মুসলমানদেরকে তাদের ধর্মীয় পরিচয় গোপন করতে হচ্ছে।
   গবেষক তারিক রামাদান তার ওয়েস্টার্ন মুসলিমস এন্ড দ্য ফিউচার অব ইসলাম শিরোনামে বইয়ের ২৩৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ÔAfter the events of 11 September 2001, the situation has deteriorated in the United States: the civil rights of numerous citizens or residents of Muslim faith has been clearly flouted. The same is true in some European countries where `security reasons’ legitimate all kinds of interventions irrespective of the law. These are the situations that tend to confirm in the mind of Muslims that they are not at home and that there is no willingness to consider them as such. (১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে: অসংখ্য নাগরিক অথবা মুসলমানের নাগরিক অধিকার স্পষ্টত লংঘন করা হয়েছে। ইউরোপের কয়েকটি দেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সেখানে  আইন কানুন নির্বিশেষে ‘নিরাপত্তার অজুহাতে’ সব ধরনের হস্তক্ষেপ বৈধ করা হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মুসলমানদের মনে একথা নিশ্চিত হয়েছে যে, তারা স্বচ্ছন্দে নেই এবং নিজেদেরকে তারা সুখি ভাবতে প্রস্তুত নয়।’  
নাইন ইলেভেন পরবর্তী আমেরিকায় মুসলমানদের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস বৃদ্ধি পায় এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকার সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলাার প্রচেষ্টা জোরদার করে এবং আগ্রাসী পররাষ্ট্র নীতি অনুুসরণ করে। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ বিরোধী লড়াই আমেরিকার একটি গুরুত্বপূূর্ণ নীতিতে রূপান্তরিত হয়। নাইন ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলায় আমেরিকার রাজনীতি ও বৈদেশিক নীতিতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। অভ্যন্তরীণভাবে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয়ে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ. বুশের পাশে দাঁড়ায় এবং প্যাট্রিয়ট অ্যাক্ট পাস করে এবং আফগানিস্তান যুদ্ধের প্রতি সমর্থন দেয়। সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইনের আওতায় মামলার সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। নতুন করে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয়।
    নাইন ইলিভেনের আগে যুক্তরাষ্ট্রে যেসব বিদেশি অথবা আমেরিকান নাগরিকদের নির্দোষ হিসেবে বিবেচনা করা হতো পরবর্তীতে তাদের বহু কার্যকলাপ সন্দেহের চোখে দেখা হয়। পোশাক ও গায়ের রং আরবদের মতো হলে সন্দেহের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। বিমানে নামাজ আদায়ের চেষ্টা করায় ৬ জন মুসলিম ইমামকে ফ্লাইট থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও পুলিশ আশপাশের লোকদের অস্বাভাবিক আচরণের প্রতি খেয়াল রাখতে এবং প্রকাশ্য স্থানে সেঁটে দেয়া নিদর্শন সম্পর্কে রিপোর্ট করতে আমেরিকানদের নির্দেশ দিয়েছে। মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ নাগরিকদের সতর্ক থাকতে, আশপাশের প্রতি নজরদারি করতে এবং সন্দেহজনক বস্তু ও আচরণ সম্পর্কে অবিলম্বে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নজরে আনার নির্দেশ দিয়েছে। নাইন ইলেভেনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আরব, মুসলিম, শিখ ও দক্ষিণ এশীয় আমেরিকান এবং এ ধরনের লোক হুমকি, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের শিকার হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার বিষয়ক এটর্নি জেনারেল টমাস ই. পেরেজ আরব, মুসলিম, শিখ ও দক্ষিণ এশীয় আমেরিকানদের মানবাধিকার লংঘন মোকাবিলায় সক্রিয়ভাবে কাজ করতে সিভিল রাইটস ডিভিশনের ন্যাশনাল অরিজিন ওয়ার্কিং গ্র“পকে নির্দেশ দিয়েছেন। কোনো কোনো আমেরিকান বিমানে ভ্রমণে ভীত হয়ে পড়ায় গাড়িতে চলাফেরা করে। ২০০৮ সালের এক রিপোর্টে বলা হয়, গাড়িতে চলাচল বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০০৮ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা এক হাজার ৫৯৫-এ পৌঁছে। ২০০১ সালের এগারোই সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা সম্প্রচার ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। কোনো কোনো চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু স্থগিত, বাতিল কিংবা সংশোধন করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে যেসব ছবি ও রূপকথার বিষয়বস্তু সন্ত্রাসবাদ, বিমান ছিনতাই, বোমা হামলা কিংবা বিপর্যয় ছিল সেসব ছবির পরিকল্পিত প্রদর্শন স্থগিত অথবা বাতিল করতে হয়। অসংখ্য ছবি নির্মাণ বাতিল ও সংশোধন করতে হয়। সংশোধনের সবচেয়ে সহজ উপায় ছিল ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ছবি মুছে দেয়া অথবা অস্পষ্ট করে দেয়া। সংশোধনের কারণ হিসেবে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং ভাবাবেগকে এড়িয়ে যাবার কথা উল্লেখ করা হয়। নাইন ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষিতে সব মিলিয়ে মোট ৪৫টি ছবি সংশোধন অথবা স্থগিত রাখা হয়।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১১ সাল নাগাদ সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইনে এক লাখ ১৯ হাজার ৪৪ জন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয় এবং ৬৬টি দেশে ৩৫ হাজার ১১৭ জনকে শাস্তি দেয়া হয়। নাইন ইলেভেনের আগে প্রতি বছর সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে মাত্র কয়েক শো লোককে শাস্তি দেয়া হতো। নাইন ইলিভেন সন্ত্রাসী হামলার জবাবে মার্কিন সরকার ২০০২ সালের ২৫ ডিসেম্বর হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ (ডিএইচএস) গঠন করে। এ বিভাগের কাছে সন্ত্রাসী হামলা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ড রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়। এক লাখ ৮৪ হাজার জনবলসম্পন্ন এ বিভাগ হলো যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মন্ত্রিসভার তৃতীয় বৃহত্তম বিভাগ। আমেরিকান পুরুষ, মহিলা, যুবক, বৃদ্ধ, শিক্ষিত ও অশিক্ষিতদের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ বিদ্যমান। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ সমান নয়। পুরুষদের মধ্যে মহিলাদের চেয়ে বিদ্বেষের মাত্রা বেশি। নাইন ইলিভেনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জননিরাপত্তার প্রতি ইসলামী সন্ত্রাসবাদের হুমকি তুলনামূলকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বিচ্ছিন্ন কিছু ব্যক্তি বোস্টন ম্যারাথনে বোমা হামলার মতো কয়েকটি বিচ্ছিন্ন সহিংসতা চালিয়েছে। তবে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা যতটা আশঙ্কা করেছিলেন, উগ্র হামলার আশঙ্কা তার চেয়ে অনেক কম। ১৯৯৫ সালের এপ্রিলে ওকলাহোমাসিটিতে বোমা হামলার পর মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মুসলমানরা প্রাথমিকভাবে বর্ণবাদী হামলার শিকার হন। কেফোর-টিভি চ্যানেলের খবরে বলা হয়েছিল, আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম সংগঠন ন্যাশন অব ইসলামের একজন সদস্য এ হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে। সারাদিন কেফোর-টিভি চ্যানেল এ খবর প্রচার করে। ঘটনার তিনদিন পর আরব আমেরিকান ইন্সটিটিউটের এক রিপোর্টে বলা হয়, তিনদিনের মধ্যে আরব আমেরিকান ও আমেরিকান মুসলমানদের বিরুদ্ধে দুই শতাধিক গুরুতর বর্ণবাদী হামলা চালানো হয়েছে। ২০০১ সালের এগারোই সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে বোমা হামলার পরও একই ধরনের বর্ণবাদী হামলা চালানো হয়। রেডিওতে সকল আরব আমেরিকানকে বন্দি শিবিরে আটক রাখারও প্রস্তাব করা হয়।
২০১২ সালের এপ্রিলে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের খবরে বলা হয় যে, জয়েন্ট ফোর্সেস স্টাফ কলেজ ইসলাম বিরোধী একটি কোর্স চালু করেছে। এ কোর্সে শিক্ষা দেয়া হয়েছিল যে, আমেরিকানরা যা কিছু সমর্থন করে মুসলমানরা সেগুলো ঘৃণা করে এবং মুসলমানরা কখনো আমেরিকানদের সঙ্গে সহাবস্থান করবে না। এতে বেসামরিক লোকের মৃত্যু বিবেচনা না করে নির্বিচারে পবিত্র মক্কা ও মদিনা ধ্বংস করে দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। একজন ছাত্র বিষয়বস্তু সম্পর্কে আপত্তি করলে এ কোর্স স্থগিত করা হয়। ২০১২ সালে আগস্টের গোড়ার দিকে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য জো ওয়ালেস এক টাউন হলে ভাষণে বলেন, কট্টরপন্থী মুসলমানরা প্রতি সপ্তাহে আমেরিকানদের হত্যা করার চেষ্টা করছে। তার উস্কানিমূলক ভাষণের পর ১২ আগস্ট তারাবীহ নামাজের সময় ইলিনয়ের লোম্বার্ডে একটি মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসিড হামলাসহ মুসলমানদের বিরুদ্ধে তার নিজ জেলাসহ বহু জায়গায় বেশ কয়েকটি হামলা চালানো হয়। ১৬ আগস্ট একটি মুসলিম গোরস্তানে ঘৃণামিশ্রিত শ্লোগান লিখে রাখা হয়। কয়েকটি মসজিদে গুলিবর্ষণ, এসিড, ডিম ও পশুর বর্র্জ্য নিক্ষেপ করা হয়। এসব হামলাকে বর্ণবাদী অপরাধ হিসেবে চি‎িহ্নত করা হয়।
নাইন ইলেভেনের প্রতিক্রিয়ায় শিল্পগুলো তাদের নীতিমালা পরিবর্তন করেছে, মার্কিন সরকার নতুন নতুন সংস্থা গঠন করেছে এবং আমেরিকার জনগণের হৃদয়-মন পাল্টে গেছে। ২০০১ সালের সন্ত্রাসী হামলায় যুক্তরাষ্ট্র ৬টি ক্ষেত্র স্থায়ীভাবে বদলে গেছে।

বিমান বন্দর
নাইন ইলেভেনের পরপর যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার ট্রান্সপোর্টেশন সিকিউরিটি এডমিনিস্ট্রেশন (টিসিএ) গঠন করে এবং ২০০১ সালের ১৯ নভেম্বর মার্কিন কংগ্রেস এভিয়েশন এন্ড ট্রান্সপোর্টেশন সিকিউরিটি অ্যাক্ট পাস করে। এ আইন কার্যকর হওয়ায় বিমানে আরোহণের আগে যাত্রীদের জুতা খুলতে হয় এবং তরল পদার্থ বহন নিষিদ্ধ করা হয়। নাইন ইলেভেনের আগে বিমান বন্দরে নামমাত্র যাত্রীদের লাগেজ তল্লাশি করা হতো। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল শিথিল। ফেডারেল এভিয়েশন এডমিনিস্ট্রেশন বিমান ছিনতাই প্রতিরোধে বেশকিছু নীতি গ্রহণ করায় নাইন ইলেভেনের পর বিমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পাল্টে যায়। বর্তমানে বিমানের ককপিট বন্ধ রাখা হয় এবং কেবলমাত্র পাইলট ককপিটের ভেতর থেকে বিমানের দরজা খুলতে পারেন।

সরকারের প্রতি আস্থা
নাইন ইলেভেনের পরবর্তী দিনগুলোতে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর মার্কিন নাগরিকদের বিরাট আস্থা ছিল। বস্তুত নিউইয়র্কে সন্ত্রাসী হামলার জবাবে সরকারের প্রতি আস্থা তুঙ্গে পৌঁছে। পিউ রিসার্চ গবেষণার উপাত্ত অনুযায়ী ১৯৭০-এর দশকের পর থেকে সরকারের প্রতি এমন আস্থা কখনো দেখা যায়নি। তবে ২০০৮ সালের মন্দা, ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধ, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে উদ্বেগ এবং ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক বিভাজনে এ আস্থায় চিড় ধরে। পিউ রিসার্চের মতে, ২০১৩ সাল নাগাদ সরকারের প্রতি আমেরিকানদের আস্থা ১৯ শতাংশ হ্রাস পায়। ২০১৪ সালে গ্যালপ জরিপে বলা হয়, সরকারের প্রতি মার্কিনীদের আস্থা ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে। ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাস এবং কংগ্রেসের অকার্যকারিতায় অবিশ্বাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আস্থাশীলদের সংখ্যা ক্রমেই কমছে। ২০১৫ সালের জুনে পরিচালিত গ্যালপ জরিপে বলা হয়, কংগ্রেসের প্রতি মার্কিনীদের আস্থা মাত্র ৮ শতাংশ।

পর্যটন
নাইন ইলেভেনের পরবর্তী তিন বছর যুক্তরাষ্ট্রে পর্যটন হ্রাস পায়। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক পর্যটন আবার রেকর্ড সংখ্যায় পৌঁছে। ২০০৭ সালে ৬ কোটি বিদেশি যুক্তরাষ্ট্র সফর করে। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ৭ কোটি ৪৮ লাখে পৌঁছে। বাইরের দেশগুলোতে আমেরিকানদের সফর দ্বিগুণ হয়। ২০১৪ সালে ৬ কোটি ৮২ লাখ আমেরিকান বিদেশ সফর করে। নিউইয়র্কে নাইন ইলেভেন পর্যটন হলো সন্ত্রাসী হামলার আরেকটি বিতর্কিত উপজাত। ম্যানহাটানে নাইন ইলেভেন স্মৃতিস্তম্ভ এবং জাদুঘরে লাখ লাখ পর্যটকের ভিড় হয়। লোয়ার ম্যানহাটানে গাইডেড ট্যুর হচ্ছে দৈনন্দিন ঘটনা। টুইন টাওয়ার্সের ধ্বংসাবশেষে নির্মিত ফ্রিডম টাওয়ার্স ও ওয়ান ওয়ার্ল্ড অবজারভেটরি হচ্ছে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র।

আমেরিকার মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন
নাইন ইলেভেনের পর আমেরিকা মনস্তাত্ত্বিকভাবে বদলে গেছে। বিদেশি হুমকি অথবা আমেরিকা পুরোপুরিভাবে নিরাপদ নয় এমন একটি ধারণা আমেরিকানদের মনস্তত্ত্বে প্রভাব ফেলেছে। প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব সত্ত্বেও কিছুটা ভীতি বিরাজ করছে। জীবন ও ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি গভীর অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। নাইন ইলেভেনের পর মার্কিন গোয়েন্দা তৎপরতার ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পায়। টেলিফোন ও ইমেইলে আড়িপাতা হচ্ছে। কিভাবে কোটি কোটি আমেরিকানের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে গেছে, সিআইয়ের স্বপক্ষত্যাগী বিশ্লেষক এডওয়ার্ড স্লোডেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। ২০১৩ সালে গোয়েন্দা সংস্থার পেছনে মার্কিন সরকারকে ৫২৬ কোটি ডলার ব্যয় করতে হয়। ১৬টি গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মচারির সংখ্যা এক লাখ ৭ হাজারের বেশি। অডিট রিপোর্টে দেখা গেছে, এককভাবে জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা বার্ষিক কমপক্ষে ৫৬ হাজার ইমেইল পরীক্ষা করেছে।

অভিবাসন
নাইন ইলেভেনের পর হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাক্ট, এনহ্যান্সড বর্ডার সিকিউরিটি অ্যাক্ট ও ভিসা এন্ট্রি রিফর্ম অ্যাক্ট চালু হওয়ায় আমেরিকার অভিবাসন নীতিতে মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। পর্যটক, ছাত্র ও বিদেশি নাগরিকদের জন্য ভিসা প্রাপ্তি কঠিন হয়ে উঠেছে। তাদের আঙ্গুলের ছাপ নেয়া হয় এবং বায়োমেট্রিক উপাত্ত গ্রহণ করা হয়। ২০০২ সালের ২৫ নভেম্বর গঠিত হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ এবং ২০০৩ সালে গঠিত ইমিগ্রেশন এন্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্টকে (আইসিই) যুক্তরাষ্ট্র এবং সে দেশের সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। নাইন ইলেভেনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকলেও মেক্সিকো ও ল্যাটিন আমেরিকার লোক এ নীতিমালায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা নজরদারি
নাইন ইলেভেনের দুমাসের মধ্যে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ. বুশ প্যাট্রিয়ট অ্যাক্টে স্বাক্ষর করেন। পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০১১ সালে এ আইন নবায়ন করেন। এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার মার্কিন নাগরিক, বিদেশি নাগরিক ও বিদেশি সরকারগুলোর ব্যাপারে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির (এনএসএ) ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। এনএসএ’র ক্ষমতা বৃদ্ধির আওতা প্রকাশ করা না হলেও এ সংস্থার এজেন্ট এডওয়ার্ড স্লোডেন ২০১৩ সালে অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা নজরদারির ব্যাপকতা ফাঁস করে দেন। এনএসএ বিনা পরোয়ানায় সেলফোন, ইমেইল ও ল্যান্ডফোনের তথ্যে নজরদারি করার ক্ষমতা লাভ করে।
২০১৩ সালে সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক ট্রায়াঙ্গল সেন্টার এবং হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের একটি রিপোর্টে দেখানো হয় যে, ২০১৩ সালে সন্দেহভাজন মুসলিম আমেরিকান সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসীদের সংখ্যা কমে এসেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুসলিম-আমেরিকানদের প্রতি মার্কিনীদের দৃষ্টিভঙ্গি আরো নেতিবাচক হয়ে উঠেছে। নাইন ইলেভেনের পর পিউ ফোরাম পরিচালিত ৮টি জরিপের অধিকাংশ জরিপে প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকানদের কাছে জানতে চাওয়া হয় মুসলিম আমেরিকানদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুকূল নাকি প্রতিকূল। উত্তরদাতাদের অধিকাংশ প্রতিকূল মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। ২০০৬ সালের আগে পাঁচটি জরিপে প্রতিকূল মনোভাব পোষণকারীদের সংখ্যা ছিল ২৬ অথবা তার চেয়ে কম এবং ২০০৬ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে পরিচালিত চারটি জরিপের মধ্যে একটিতে প্রতিকূল মনোভাব দেখা গেছে। এ সংখ্যা ইতিবাচক মনোভাব পোষণকারীদের চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণভাবে কম। আমেরিকার জনগোষ্ঠীর একটি ক্রমবর্ধমান অংশ মুসলিম-আমেরিকানদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশে আগ্রহী। জরিপে মুসলিম-আমেরিকানদের প্রতি নয়, সাধারণভাবে মুসলমানদের প্রতি এ নেতিবাচক প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র প্যাট্রিয়ট অ্যাক্টের আওতায় বেশকিছু সংগঠনকে সন্ত্রাসী হিসেবে চি‎িহ্নত করেছে। নিচে তার বিবরণ দেয়া হলো:

সংগঠনের নাম  দেশের নাম নিষিদ্ধ করার তারিখ
আবু নিদাল অর্গানাইজেশন ফিলিস্তিন ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
আবু সায়াফ গ্র“প ফিলিপাইন ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
ওম শিনরিকো  জাপান ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
বাস্ক ফাদারল্যান্ড এন্ড লিবার্টি স্পেন ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
জামা আল-ইসলামিয়া  মিসর ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
হরকাকুল মুজাহিদীন (হুম)  পাকিস্তান ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
হামাস প্রতিরোধ আন্দোলন  ফিলিস্তিন ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
হরকাতুল মুজাহিদীন  পাকিস্তান ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
হেযবুল্লাহ  লেবানন ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
কাচ এন্ড কাহানি চাই  ইসরাইল ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি  তুরস্ক  ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
এলটিটিই  শ্রীলঙ্কা  ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি  কলম্বিয়া  ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
প্যালেস্টাইন লিবারেশন ফ্রন্ট  ফিলিস্তিন  ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
ইসলামী জিহাদ গ্র“প  ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন  ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
পিএফএলপি জেনারেল কমান্ড  ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
রেভলিউশনারী আর্মড ফোর্সেস অব কলম্বিয়া  ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
রেভলিউশনারী পিপলস লিবারেশন পার্টি ফ্রন্ট  ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
শাইনিং পাথ  পেরু  ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
আল-কায়েদা  ১৯৯৯ সালের ৮ অক্টোবর
উজবেক ইসলামী মুভমেন্ট উজবেকিস্তান  ২০০০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর
রিয়্যাল আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি  ২০০১ সালের ১৬ মে
জয়শ-ই-মোহাম্মদ  পাকিস্তান  ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর
লস্কর-ই-তাইয়্যেবা  পাকিস্তান  ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর
আল-আকসা মার্টায়ার্স ব্রিগেড  ২০০২ সালের ২৭ মার্চ
আসবাত আসবাত আন-আনসার  লেবানন  ২০০২ সালের ২৭ মার্চ
আল-কায়েদা ইন দ্য ইসলামিক মাগরেব  ২০০৪ সালের ১৩ জুলাই
ফিলিপাইন কমিউনিস্ট পার্টি  ২০০২ সালের ৯ আগস্ট
জামা আল-ইসলামিয়া  মিসর  ২০০২ সালের ২৩ অক্টোবর
লস্কর-ই-জাংভি  পাকিস্তান  ২০০৩ সালের ৩০ জানুয়ারি
আল-কায়েদা কার্দিস ব্যাটালিয়ন  ২০০৪ সালের ২২ মার্চ
কনটিনিউয়িটি আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি  ২০০৪ সালের ১৩ জুলাই লিবিয়ান ইসলামিক ফাইটিং গ্র“প  লিবিয়া  ২০০২ সালের ২৭ মার্চ
ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড লিভেন্ট  ২০০৪ সালের ১৭ডিসেম্বর
ইসলামিক জিহাদ ইউনিয়ন  ২০০৫ সালের ১৭ জুন
হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী (হুজি-বি)  ২০০৮ সালের ৫ মার্চ
আল-শাবাব  সোমালিয়া  ২০০৮ সালের ১৮ মার্চ
রেভলিউশনারী স্ট্রাগল   গ্রীস  ২০১০ সালের ১৮ মে
কাতায়েব হেযবুল্লাহ  ২০০৯ সালের ২ জুলাই
আল-কায়েদা ইন দ্য অ্যারাবিয়ান পেনিনস্যুলা  ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি
হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী (হুজি)  ২০১০ সালের ৬ আগস্ট
তেহরিক-ই-তালেবান  পাকিস্তান  ২০১০ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর
জুনদাল্লাহ  ইরান  ২০১০ সালের ৪ নভেম্বর
আর্মি অব ইসলাম  ফিলিস্তিন  ২০১১ সালের ২৩ মে
ইন্ডিয়ান মুজাহিদীন  ভারত  ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর
জামা আনসারুত তাওহীদ  ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর
আবদুল্লাহ আজাম ব্রিগেড  ২০১৩ সালের ৩০ মে
হাক্কানি নেটওয়ার্ক  আফগানিস্তান  ২০১২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর
আনসার আদ-দীন  মালি  ২০১৩ সালের ২২ মার্চ
বোকো হারাম  নাইজেরিয়া  ২০১৩ সালের ১৪ নভেম্বর
আনসারু   ২০১৩ সালের ১৪ নভেম্বর
আল-মুলাদামুন ব্রিগেড  আলজেরিয়া  ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর
আনসার আল-শরিয়াহ ইন  বেনগাজী  ২০১৪ সালের ১৩ জানুয়ারি আনসার আনসার আল-শরিয়াহ ইন দারনাহ লিবিয়া  ২০১৪ সালের ১৩ জানুয়ারি আনসার আল-শরিয়াহ ইন  তিউনিসিয়া  ২০১৪ সালের ১৩ জানুয়ারি
আনসার বায়েত আল-মাকদিস মিসর  ২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল
আল-নুসরা ফ্রন্ট  সিরিয়া  ২০১৪ সালের ১৫ মে
মুজাহিদীন শুরা কাউন্সিল  মিসর  ২০১৪ সালের ২০ আগস্ট

যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ ঘোষিত ৫৯টি জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে ১১টি হলো অমুসলিম এবং বাদবাকি ৪৮টি মুসলিম। অমুসলিম জঙ্গি সংগঠনগুলো হলো ওম শিনরিকো, বাস্ক ফাদারল্যান্ড এন্ড লিবার্টি (ইটিএ), কাচ এন্ড কাহানি চাই, লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম এলটিটিই, ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি, রেভলিউশনারী আর্মড ফোর্সেস অব কলম্বিয়া, শাইনিং পাথ, রিয়্যাল আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি, ফিলিপাইন কমিউনিস্ট পাটি, কনটিনিউয়িটি আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি ও রেভলিউশনারী স্ট্রাগল। এসব গ্র“পের বাইরে যেসব গ্র“পকে নিষিদ্ধ করা হয়নি সেগুলো হলো ক্লু ক্লাক্স ক্লান (কে কে কে), মেগডালিন ড্রাগ কার্টেল, আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি, এন্টি-ক্যাস্ট্রো গ্র“প, মর্মন চরমপন্থী গ্র“প, কমিউনিস্ট বিরোধী ভিয়েতনামী গ্র“প, জিউইশ ডিফেন্স লীগ, জিউইশ অ্যাকশন মুভমেন্ট, ইউনাইটেড জিউইশ আন্ডারগ্রাউন্ড, থান্ডার জায়ন, মে নাইনটিন কমিউনিস্ট অর্ডার, শিকানো লিবারেশন ফ্রন্ট, জিউইশ আর্মড রেজিট্যান্স, আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুভমেন্ট, গে লিবারেশন ফ্রন্ট, আরিয়ান নেশন, জিউইশ অ্যাকশন মুভমেন্ট, ন্যাশনাল ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব কিউবা, ফোর্থ রাইখ স্কিনহেড ইত্যাদি। এছাড়া সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক গবেষক আরেফ এম. আল-খাত্তার দ্য কভনেন্ট, দ্য সোর্ড এন্ড দ্য আর্ম অব দ্য লর্ড (সিএসএ), গর্ভপাত বিরোধী সংগঠন ডিফেন্সিভ অ্যাকশন এবং মন্টানা ফ্রিমেন, দ্য কভনেন্ট, দে সোর্ড এন্ড দ্য আর্মি অব গড (সিএসএ) এবং আরো কয়েকটি খ্রিস্টান মিলিশিয়া গ্র“পকে চরম ডানপন্থী সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করছেন। কিন্তু মার্কিন সরকার এসব শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী সন্ত্রাসী গ্র“পকে অজ্ঞাত কারণে নিষিদ্ধ করেনি।
 (লেখাটি ‘পাশ্চাত্যে ইসলামভীতি’ থেকে নেয়া। বইটি প্রকাশ করেছে ‘প্রচলন।’)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ফাইটার জেটের হেলমেট

বর্তমান সময়ে আধুনিক এবং নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফিচার হচ্ছে জেট ফাইটারের ককপিটে বসা এর পাইলটের হেল...