Bangladesh লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
Bangladesh লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২০

মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা

মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত
ইউনিয়নের ভূমিকা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে বিশ্বে স্নায়ুযুদ্ধ বিরাজ করায় সুবিধা যেমন হয়েছিল তেমনি অসুবিধাও হয়েছিল। স্নায়ুুযুদ্ধের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল। পরোক্ষ লড়াইয়ে বিজয়ী হওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল গণতান্ত্রিক বিশ্বের একটি প্রভাব বলয় এবং বিলুপ্ত পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে গঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর আরেকটি পাল্টা প্রভাব বলয়। প্রাথমিকভাবে ভারত ছিল দু’টি প্রভাব বলয়ের বাইরে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট ভারতকে সমাজতান্ত্রিক পরাশক্তি সোভিয়েত প্রভাব বলয়ের দিকে ঠেলে দেয়। পাক-ভারত সংঘাত অনিবার্য বুঝতে পেরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে সহায়তার জন্য হাত বাড়ান।
বিশ্বে নিজ নিজ প্রভাব বলয়ের স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরস্পরবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে। এ দু’টি পরাশক্তির ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এব্যাপারে চৌধুরী এম. শামিমের লেখা ‘দ্য বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশীপ ট্রিটি: অ্যা ক্রিটিক্যাল এনালাইসিস’ শিরোনামে এক নিবন্ধে বলা হয়,
`Bangladesh was a victim of the cold war alliance system. During its war of independence it was a pawn in the chessboard of super power rivalry. The US tilted towards Pakistan while India allied with the Soviet Union.’
  ‘বাংলাদেশ ছিল স্নায়ুুযুদ্ধের শিকার। মুক্তিযুদ্ধকালে দেশটি ছিল পরাশক্তির দাবার ঘুটি। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। অন্যদিকে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে।’ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারত থেকে জাপান পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী একটি প্রভাব বলয় সৃষ্টিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাদানের সিদ্ধান্ত নেয়। মস্কো বিশ্বাস করতো যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে দুর্বল করবে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই এ অঞ্চলের প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নে শ্যেনদৃষ্টি ছিল। এ ব্যাপারে সালাহউদ্দিন আহমদের ‘বাংলাদেশ পাস্ট এন্ড প্রেজেন্ট’ বইয়ের একটি উদ্ধৃতি উল্লেখযোগ্য। তিনি তার বইয়ের ৩৪৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,‘ By the late 1960’s Kremlin seems to have come to the conclusion that the separation of Pakistan’s western and eastern wings would be in Soviet as well as India’s interest.
‘ষাটের দশকের শেষ নাগাদ ক্রেমলিন এই উপসংহারে পৌঁছেছিল যে, পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ থেকে পূর্বাংশের বিচ্ছিন্নতা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের স্বার্থের অনুকূল হবে।’ 
ভারতকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঘাটছড়া বাঁধতে দেখে যুক্তরাষ্ট্র চীনের প্রতি বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. হেনরি কিসিঞ্জারের গোপনে চীন সফরে ভারত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে। পাকিস্তানের দূতিয়ালিতে কিসিঞ্জার ১৯৭১ সালের ৯ জুলাই পিকিং সফর করেন এবং চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। ১৯৭০ সালে ওয়াশিংটন সফরকালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কোন্নয়নে মধ্যস্থতা করার অঙ্গীকার করেন। পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় চীন-মার্কিন যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় এত গোপনীয়তা রক্ষা করা হয় যে, ইসলামাবাদস্থ আমেরিকান দূতাবাস ১৯৭১ সালের মে নাগাদ কিছুই জানতে পারেনি। সোভিয়েত ভীতি যুক্তরাষ্ট্রকে বিপরীত মেরুর শক্তি চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার প্রয়াস চালাতে বাধ্য করে। চীন ছিল পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। চীনের সঙ্গে দেশটির বন্ধুত্ব পিকিংয়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সহায়ক বলে বিবেচিত হয়। ভারতকে মোকাবিলা করার কৌশলগত প্রয়োজনেই পাকিস্তান মুসলিম দেশ হয়েও বস্তুবাদে বিশ্বাসী চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষ বেধে যাওয়ায় ষাটের দশকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। তবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালে মস্কোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক চূড়ান্ত পর্বে উন্নীত হয়।
কিসিঞ্জারের চীন সফর শুরু হওয়ার ঠিক এক মাস পর ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট সোভিয়েত-ভারত ২০ বছর মেয়াদী মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে ভারতের মনোবল বৃদ্ধি পায়। চুক্তিতে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা জোরদার, অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের অবসান, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রতি ভারতের অঙ্গীকারের কথা বলা হলেও আসলে এটি ছিল নির্দিষ্টভাবে চীন ও পাকিস্তানকে মোকাবিলা এবং বিশেষভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিহত করার একটি সামরিক চুক্তি। চুক্তির ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ তার প্রমাণ। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো কোনো পক্ষের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িত তৃতীয় কোনো পক্ষকে কোনো ধরনের সহায়তা প্রদানে বিরত থাকবে। চুক্তিতে স্বাক্ষরদানকারী কোনো পক্ষ আক্রান্ত হলে অথবা হুমকির মখোমুখি হলে পক্ষগুলো তাদের নিজ নিজ দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে এ ধরনের হুমকি দূর করতে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে অবিলম্বে পারস্পরিক আলোচনায় মিলিত হবে।’ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের প্রতিরক্ষা সামর্থ্য শক্তিশালী করতে শুরু করে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বেধে গেলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে বৈষয়িক ও কূটনৈতিক সমর্থন প্রদান করে। দেশটি ভারতে সামরিক সহায়তা প্রেরণ এবং জাতিসংঘে ভারতকে কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে পাকিস্তানের ব্যবচ্ছেদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে চীনের সমর্থনপুষ্ট যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করে। যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রস্তাবে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যাহার এবং পাক-ভারত সীমান্তে পর্যবেক্ষক মোতায়েনের আহ্বান জানানো হয়। বিপরীতক্রমে ভারতের অবস্থানের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথমে পূর্ব পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তি এবং পরে যুদ্ধবিরতির দাবি জানায়। অন্যদিকে ৫ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে দেয়া সব ধরনের অর্থনৈতিক সাহায্য প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেয়। ৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট আরেকটি প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করে। এ প্রস্তাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক নিষ্পত্তির যে আহ্বান জানিয়েছিল, তার উল্লেখ ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়ন অন্য ৮টি সমাজতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে আর্জেন্টিনার উত্থাপিত অন্য একটি প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করে। আর্জেন্টিনার প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতি এবং এক দেশ থেকে অন্য দেশের সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছিল। ১৩ ডিসেম্বর অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উত্থাপিত তৃতীয় একটি প্রস্তাবেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো দেয়। তবে দেশটি পোল্যান্ডের একটি প্রস্তাব সমর্থন করে। 
যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭১ সালের সংকটকে স্নায়ুযুদ্ধের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করতো এবং মনে করতো, সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোকে দুর্বল করতে চাইছে। এ হিসাব থেকে দেশটি ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানকে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে সমর্থন দান করে। তবে দেশটি পাকিস্তানকে একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হিসাবে টিকিয়ে রাখতে মোটেও আগ্রহী ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ থেমে গেলে পশ্চিম পাকিস্তান ভাঙ্গার এবং আজাদ কাশ্মীর দখলে ভারতকে যে কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখতে চাইছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. হেনরি কিসিঞ্জার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সোভিয়েত সম্প্রসারণে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন। সোভিয়েত হুমকি মোকাবিলায় প্রেসিডেন্ট নিক্সন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় যোগাযোগ করছিলেন। ১৯৭২ সালে তিনি চীন সফরে আগ্রহী ছিলেন। চীনের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তান ছিল একটি মাধ্যম। তাই নিক্সন প্রশাসনের কাছে পাকিস্তান বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের পতন কাম্য ছিল না। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে মোটেও পছন্দ করতেন না। ১৯৭১ সালের নভেম্বরে ইন্দিরা গান্ধীর যুক্তরাষ্ট্র সফরে তার এ মনোভাবের প্রতিফলন ঘটে। ৪/৫ নভেম্বর দু’দিনব্যাপী সফরকালে ইন্দিরা প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তবে প্রথমদিনের সাক্ষাৎকার ছিল তার কাছে অত্যন্ত বিব্রতকর। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কর্মকর্তা স্যামুয়েল হসকিনসন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাকে সঙ্গে নিয়ে হোয়াইট হাউসের কূটনৈতিক প্রবেশদ্বার অতিক্রম করে বিশেষ একটি অভ্যর্থনা এলাকায় গিয়ে পৌঁছান। সেখানে পৌঁছে তিনি একটি টেলিফোন উঠিয়ে নিক্সনের সচিব রোজ ম্যারি উডসকে জানান, ‘মিসেস ইন্দিরা এখানে অপেক্ষা করছেন। অনুগ্রহ করে প্রেসিডেন্টকে জানান।’ ইন্দিরা নিজেও বললেন, তিনি এখানেই প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান। কিন্তু প্রেসিডেন্টের দেখা নেই। আধাঘন্টা কেটে যায়। মিসেস গান্ধী অস্থির হয়ে উঠেন। দৃশ্যত তাকে বিরক্ত বলে মনে হলো। হসকিনসন আবার রোজ ম্যারিকে টেলিফোন করেন। কিছুক্ষণ পর রোজ ম্যারি মিসেস গান্ধীকে রুজভেল্ট রুমে নিয়ে যেতে বলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টগণ সাধারণত বিদেশী রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সঙ্গে হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে দেখা করেন। ইন্দিরার ক্ষেত্র তার ব্যতিক্রম করা হয়। হসকিনসন ইন্দিরাকে নিয়ে রুজভেল্ট রুমে যান। আবার শুরু হয় প্রতীক্ষার পালা। তবে দীর্ঘক্ষণ নয়। তবু যতক্ষণ বিলম্ব ঘটে তা ছিল মিসেস ইন্দিরার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাবার জন্য যথেষ্ট। হঠাৎ রুজভেল্ট রুমের দরজা খুলে যায়। প্রেসিডেন্ট নিক্সন দু’হাত প্রসারিত করে প্রশস্ত হাসি দিয়ে বললেন, ‘মিসেস গান্ধী, আপনি এখানে? কই, কেউ তো আমাকে বলেনি যে, আপনি এখানে?’ ইন্দিরা ফিরতি হাসি দেন। তবে অনেক কষ্টে। বৈঠকে প্রেসিডেন্ট নিক্সন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাকে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানিয়ে দেন, পাকিস্তানের ভাঙ্গনে কোনো স্বার্থ হাসিল হবে না। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ভারত সংঘাতের সূচনা ঘটালে বৃহৎ শক্তিগুলো কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে তা নির্ভুলভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়। 
     ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ছিল প্রেসিডেন্ট নিক্সনের গভীর আবেগময় সম্পর্ক। প্রেসিডেন্ট নিক্সন মনে করছিলেন, ভারতীয় হামলায় পশ্চিম পাকিস্তানের পতন ঘটলে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে এবং এ অঞ্চলে সোভিয়েত ইউনিয়নের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম হবে। তাতে বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার সম্ভাব্য নয়া মিত্র চীনের অবস্থান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাকিস্তানের উপর মার্কিন কংগ্রেসের নিষেধাজ্ঞা সরাসরি লংঘন করে চীনের কাছে মিত্র হিসাবে নিজের আন্তরিকতার প্রমাণ দিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সন জর্দান ও ইরানের মাধমে পাকিস্তানে সামরিক সরবরাহ পাঠান। একইসঙ্গে পাকিস্তানে সমরাস্ত্র সরবরাহ বৃদ্ধি করতে চীনকে উৎসাহিত করা হয়।
পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার বিবরণ দিয়ে ঢাকাস্থ মার্কিন কূটনীতিক আর্চার্ড ব্লাড ওয়াশিংটনে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন। এ বার্তা ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ নামে পরিচিত। কিন্তু নিক্সন প্রশাসন এ বার্তা উপেক্ষা করে। ১৯৭১ সালের মার্চে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এক আলোচনায় প্রেসিডেন্ট নিক্সন ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্র“য়ারি কংগ্রেসের কাছে স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ড রিপোর্টে ইঙ্গিত দেন যে, যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযানে সমর্থন দেয়নি। আবার নিন্দাও করেনি। য্ক্তুরাষ্ট্র গণহত্যা বন্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুরতার নিন্দা করে কখনো কোনো প্রকাশ্য বিবৃতি দেয়নি বরং নীরব কূটনীতির মাধ্যমে নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানিদের সবুজ সংকেত দিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নিক্সন একটি পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের কাছে বলেছিলেন, ‘ইয়াহিয়া যুক্তরাষ্ট্রের একজন ভালো বন্ধু।’ নৃশংস সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করার পরিবর্তে তিনি আরো বলেছিলেন, ইয়াহিয়া যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তিনি সেগুলোর যৌক্তিকতা উপলদ্ধি করতে পারছেন। ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল তিনি এক নির্দেশে বলেন,To all hands. Don’t squeeze Yahya at this time- RMN.’
সবার প্রতি প্রযোজ্য। এ মুহূর্তে ইয়াহিয়াকে ঘাটাবে না- আরএমএন।’ ১৯৭১ সালে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলে কর্মরত স্যামুয়েল হসকিনসন ১৯৭১ সালে দক্ষিণ এশিয়ার সংকটকে বৃহৎ শক্তির একটি দাবা খেলা হিসাবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, ‘আমরা ইয়াহিয়াকে পছন্দ করতাম। তিনি ছিলেন সামরিক বাহিনীর লোক। তার সম্পর্কে আমরা ভালো রিপোর্ট পাচ্ছিলাম। তবে তিনি ইন্দিরার মতো রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন না। একজন সাধারণ সৈনিক যা করে সংকটে তিনি তাই করেছেন। সৈনিক বলেই তিনি যুদ্ধে গিয়েছেন। হোয়াইট হাউস বিশ্বাস করতো, মিসেস গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত প্রতিবেশী পাকিস্তানের ধ্বংস সাধনে বদ্ধপরিকর। ২৫ মার্চের পর ইসলামাবাদে মার্কিন দূতাবাসের দ্বিতীয় কর্তাব্যক্তি সিডনি সোবার ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বহুবার বৈঠকে মিলিত হন। এসব বৈঠকে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুদন্ড কার্যকর না করতে তার উপর চাপ প্রয়োগ করেন। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে তিনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে একটি বৈঠকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে য্ক্তুরাষ্ট্রের একটি পরিকল্পনা পেশ করেন। ইয়াহিয়া খান যুক্তরাষ্ট্রের এ পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও ভারত প্রত্যাখ্যান করে। তিনি আরো বলেন, শেষদিন পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান বিশ্বাস করতেন, সংকটের একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তি খুঁজে বের করা এবং পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ রাখা সম্ভব। ইয়াহিয়া আমেরিকানদের জানিয়েছিলেন, তিনি ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর বিচারপতি এআর কর্নেলিয়াস প্রণীত একটি খসড়া সংবিধান ঘোষণা করার এবং ২৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের পরিকল্পনা করছেন। 
চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতা স্থাপনে ইয়াহিয়ার গুরুত্ব এবং নিক্সন ও কিসিঞ্জারের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব থাকায় নিক্সন ঘোষণা করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র এমন কিছু করবে না যাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের জন্য পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে অথবা তিনি বিব্রতবোধ করতে পারেন। আমেরিকার স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকায় ওয়াশিংটন প্রকাশ্যে পাকিস্তানের সমালোচনা করেনি। উপমহাদেশে সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করলে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। তবে একই সঙ্গে নিক্সন প্রশাসন এ দাবি করেছে যে, তারা কোনো ভারতবিরোধী নীতি অনুসরণ করেনি। প্রকাশিত দলিলপত্রে দেখা গেছে, প্রকাশ্য বিবৃতিতে পাকিস্তানের প্রতি ঝুঁকে পড়া ছাড়াও চীনের সঙ্গে আলোচনা এবং যুদ্ধ সংক্রান্ত প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে পাকিস্তানপন্থী একটি অবস্থান গ্রহণ করে। পাকিস্তানের দূতিয়ালিতে ড. হেনরি কিসিঞ্জার অত্যন্ত গোপনে চীন সফর করেন। নয়াদিল্লি সফর শেষ করে ইসলামাবাদ এসে তিনি চীনের উদ্দেশে রওনা দেন। নয়াদিল্লিকে ফাঁকি দেয়ার জন্য একটি কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়। কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয় এজন্য যাতে ভারত এই ধারণা পোষণ না করে যে, তাদের গুরুত্বকে খাটো করে দেখা হচ্ছে। পরিকল্পনা করা হয়েছিল যে, কিসিঞ্জার নয়াদিল্লি থেকে ইসলামাবাদ এসে পৌঁছানোর পর ঘোষণা করা হবে, তিনি দীর্ঘ সফর ও উষ্ণ আবহাওয়ায় ক্লান্ত। তাই তার কয়েকদিন বিশ্রামের প্রয়োজন। কিন্তু দিল্লি থেকে ফিরে আসার পর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়, দিল্লিতে অবস্থানকালে তিনি জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন এবং খাবার গ্রহণে তার বদহজম হয়েছে। তাতে তার রাতে ভালো ঘুম হয়নি। অতএব তিনি বিশ্রাম নেবেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তার একান্ত বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে তারা নৈশভোজে মিলিত হন। এসময় উভয়ে ছিলেন অত্যন্ত ফুরফুরে মেজাজে। ইয়াহিয়া খানকে তিনি ঠাট্টা করে বলেন, ‘মি. প্রেসিডেন্ট, আপনি একজন নির্বাচিত একনায়কের মতো একটি বিশৃঙ্খলাপূর্ণ নির্বাচন করেছেন।’ 
কিসিঞ্জার পাকিস্তানিদের সঙ্গে বৈঠককালে জানতে চান পান উৎসবে কিভাবে চীনাদের সঙ্গে কথা বলবেন, কিভাবে তাদের কথার জবাব দেবেন। চীনের সঙ্গে দীর্ঘ দু’দশক যোগাযোগ না থাকায় তাদের আচার আচরণ সম্পর্কে মার্কিনীদের কোনো ধারণা ছিল না। তাই কিসিঞ্জারের জন্য তাদের ব্যাপারে ধারণা লাভ করা ছিল জরুরি। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে কিসিঞ্জার বেইজিংয়ে পৌঁছান। বেইজিং সফরকালে তিনি চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে কয়েকবার বৈঠকে মিলিত হন। কোনো কোনো সময় তিনি তার সহকারীদের সঙ্গেও বৈঠকে মিলিত হতেন। চীনে দু’দিন অবস্থান শেষে ১১ আগস্ট তিনি ইসলামাবাদ ফিরে আসেন। তাকে বহনকারী বিমান কোথায় অবতরণ করবে সে সংকেতের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও পাকিস্তানি কর্মকর্তারা অপেক্ষা করতে থাকেন। যথাসময়ে সংকেত দেয়া হয়। বার্তা পেয়ে পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বিমান বন্দরে ছুটে যান। কিসিঞ্জারকে বহনকারী বিমানটি বেইজিং থেকে দিনের বেলা ফিরে আসে। কিন্তু বিমানটি অবতরণ করে বিমান বন্দরে বিমান বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত অংশে। বিমান বন্দরে কর্মরত লোকজন বিস্মিত হয়। তারা বুঝতে পারছিল না বিমানটি কেন বিমান বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত অংশে অবতরণ করেছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব কিসিঞ্জারকে বিমান বন্দর থেকে তার হোটেল স্যুটে নিয়ে আসেন। কিসিঞ্জার খুবই উল্লসিত। চৌ এন লাইকে তিনি একজন মহান রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে আখ্যায়িত করেন এবং তার আতিথেয়তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। বেইজিংয়ে কিসিঞ্জার একটি অতিথিশালায় অবস্থান করেন। সেখানে একটি ক্ষুদ্র সেতু ছিল। অতিথিশালায় ছিল ১২টি কক্ষ। প্রতিটি কক্ষ ছিল একটি থেকে আরেকটি বিচ্ছিন্ন। পৃৃথক হওয়ায় এক কক্ষের অতিথিরা জানতো না অন্য কক্ষের অতিথি কে বা কারা। অতিথিশালায় সর্বত্র ছিল সতর্ক চীনা প্রহরী। কিসিঞ্জার সেতু অতিক্রম করে অন্য কক্ষে যাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু চীনা প্রহরীরা তাকে থামিয়ে দেয়। কিভাবে জানি চৌ এন লাই ঘটনাটি জানতে পারেন। তিনি সেখানে ছুটে আসেন এবং তার হাত ধরে সেতু অতিক্রম করেন। এসময় প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই মন্তব্য করেন, ‘আমরা যেন এ সেতুটির কথা বিস্মৃত না হই। এ সেতুর জন্য আমাদের মধ্যে সাক্ষাৎ সম্ভব হয়েছে।’ 
১৯৭১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট নিক্সন সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকোর সঙ্গে বৈঠকে তাকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়তে ভারতকে নিরুৎসাহিত করার অনুরোধ জানান। ২১ নভেম্বর ভারতীয় সৈন্যরা মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা প্রদানে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত অতিক্রম করে সামরিক তৎপরতায় জড়িত হয়ে পড়লে কিসিঞ্জার উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন। তিনি ভারতের আচরণকে পাক-ভারত যুদ্ধের সূচনা হিসাবে উল্লেখ করেন। ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ বেধে যাবার দিন তিনি পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও সিআইএ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে যুদ্ধ শুরু করার জন্য ভারতকে অভিযুক্ত করেন। ৮ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা কিসিঞ্জারের সঙ্গে টেলিফোনে পাক-ভারত যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনাকালে নিক্সন পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ এস. ফারল্যান্ডের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, তিনি সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট লিওনিদ ব্রেঝনেভকে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কাউকে আগ্রাসন চালানোর অনুমতি দেবে না।
প্রেসিডেন্টের উদ্বেগের প্রেক্ষিতে ১০ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে সিআইএ’র একটি সুরক্ষিত কক্ষে কিসিঞ্জার জাতিসংঘে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত হুয়াং হুয়ার সঙ্গে গোপন আলোচনায় মিলিত হন এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগর অভিমুখে কয়েকটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজের অগ্রসর হওয়ার ছবি এবং অতি গোপনীয় তথ্য তার কাছে হস্তান্তর করেন। তিনি চীনা রাষ্ট্রদূতকে জানান, আমরা এই মর্মে একটি গোয়েন্দা রিপোর্ট পেয়েছি যে, মিসেস গান্ধী পাকিস্তানের সেনা ও বিমান বাহিনীকে ধ্বংস করতে এবং আজাদ কাশ্মীরের দক্ষিণাংশকে তার দেশের সঙ্গে অঙ্গীভূত করতে চান। যুদ্ধে এতটুকু অগ্রগতি অর্জিত হলে তিনি যুদ্ধবিরতিতে রাজি হবেন। আমাদেরকে অবশ্যই তার এ অভিপ্রায় রুখে দিতে হবে এবং এজন্যই আপনার সঙ্গে বৈঠকের আয়োজন করেছি। কিসিঞ্জার ভারতের বিরুদ্ধে সৈন্য মোতায়েনের উদ্যোগ গ্রহণে চীনের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি চীনা রাষ্ট্রদূতকে প্রতিশ্র“তি দেন যে, এ উদ্যোগ গ্রহণ করতে গিয়ে অন্য পক্ষ চীনে হামলা চালালে যুক্তরাষ্ট্র বেইজিংয়ের সহায়তায় এগিয়ে যাবে। চীনা রাষ্ট্রদূত হুয়াং হুয়া জোর দিয়ে বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত উপমহাদেশে একটি বিপজ্জ্বনক পথে অগ্রসর হচ্ছে এবং চীনকে ঘেরাও করে ফেলতে চাইছে। চীনা রাষ্ট্রদূতের উদ্বেগ লক্ষ্য করে কিসিঞ্জার স্পষ্টাক্ষরে তাকে জানান, আমরা উভয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের উপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখবো। ১২ ডিসেম্বর চীন হোয়াইট হাউসের কাছে একটি জরুরি বার্তা পাঠায়। বার্তায় নিউইয়র্কে একটি মার্কিন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার প্রস্তাব দেয়া হয়। বার্তা পেয়ে কিসিঞ্জারের সহকারী জেনারেল আলেকান্ডার হেইগ নিউইয়র্কে ছুটে যান। তিনি ভাবছিলেন চীনারা হয়তো তাকে সিকিম অথবা নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ারে (অরুণাচল) তাদের সৈন্য সমাবেশ সম্পর্কে অবহিত করতে চায়। কিন্তু চীনা রাষ্ট্রদূত হুয়াং হুয়া বিশ্ব সংস্থায় তার সরকারের পরবর্তী অবস্থান তুলে ধরা ছাড়া আর কোনো সুসংবাদ দিতে পারেননি।
পাক-ভারত যুদ্ধে চীনের সহায়তা কামনা করার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নকে এমন ইঙ্গিতও দিয়েছিল যে, ক্রেমলিন ভারতকে সংযত না করলে বড় ধরনের সংঘাত বেধে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র অভিমত প্রকাশ করেছিল যে, যুদ্ধে চীনের ভূমিকা চূড়ান্ত নিষ্পত্তিকারী হতে পারে। কিন্তু চীন ছিল অত্যন্ত হুঁশিয়ার। ভারত সীমান্তে দেশটি সৈন্য মোতায়েন করেছিল। তবে চীন ভারতে হামলা চালানোর ঝুঁকি নেয়নি। ভারতে হামলা চালালে সোভিয়েত ইউনিয়ন চীনে পাল্টা হামলা চালিয়ে বসতে পারতো। পরিস্থিতি যদি সত্যি সে রকম হতো তাহলে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত যুদ্ধে জড়িয়ে যেতো। ১৯৭১ সালে পাক-ভারত যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাবার সকল সম্ভাবনা বিরাজ করছিল। চীনের ভূমিকার উপর নির্ভর করছিল সম্ভাব্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভবিষ্যৎ। কিন্তু দেশটি ভারতে হামলা না চালিয়ে নিজেকে এবং বিশ্বকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে রক্ষা করেছে। ২০০২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ৩১তম বিজয় দিবসে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা মোহাফেজখানা থেকে প্রকাশিত গোপন দলিলে বলা হয়, `With the Indian army and armed Bengali separatists winning, the US on 10 December 1971 urged Beijing to mobilise troops towards India, saying the US would back it if the Soviet Union became involved. China declined and on 16 December the war ended with the Indian army and Bengali separatists taking Dhaka.'
‘ ভারতীয় সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বিজয়ী হওয়ার মুহূর্তে ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটানোর জন্য বেইজিংয়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধে সম্পৃক্ত হলে যুক্তরাষ্ট্র চীনের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু চীন যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানে সাড়াদানে অস্বীকৃতি জানায় এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঢাকা দখল করার মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়।’
৯ ডিসেম্বর সিআইএ ডিরেক্টর রিচার্ড হোমস প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে সতর্ক করে দেন যে, যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বিপর্যয় ঘটতে যাচ্ছে। পূর্ব রণাঙ্গনে যুদ্ধ থেমে গেলে এখান থেকে অতিরিক্ত ভারতীয় সৈন্য পশ্চিম রণাঙ্গনে ছুটে যাবে। তখন পশ্চিম পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। সিআইএ ডিরেক্টরের কাছ থেকে এ বার্তা পেয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সন বঙ্গোপসাগরে পরমাণু শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরী ‘ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ’ পাঠানোর নির্দেশ দেন এবং নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পাকিস্তানে সামরিক সরবরাহ প্রেরণ করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন এ সংবাদ পেয়ে তাদের নৌবহরকে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেয়। ১০ ডিসেম্বর দক্ষিণ ভিয়েতনামের অদূরে টঙ্কিন উপসাগরে ইয়াঙ্কি স্টেশন থেকে ১০টি যুদ্ধজাহাজের প্রহরায় মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ‘ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ’ সিঙ্গাপুর অভিমুখে ধেয়ে আসতে থাকে। ১২ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে রওনা হয়। চারটি রাডার সজ্জিত এন্টারপ্রাইজে ছিল ৯০টি জঙ্গি ও বোমারু বিমান। এটি ছিল প্রশান্ত মহাসাগরে মোতায়েন মার্কিন সপ্তম নৌবহরের অংশ। মার্কিন নৌবাহিনীর বৃহত্তম এ বিমানবাহী রণতরীর ঘণ্টায় গতিবেগ ছিল ৩৩ দশমিক ৮ নটিক্যাল মাইল এবং দৈর্ঘ্য ছিল এক হাজার ১২৩ ফুট এবং প্রস্থ ১৩২ দশমিক ৮ ফুট। এন্টারপ্রাইজের নেতৃত্বে ‘টাস্কফোর্স-৭৪’ গঠন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এ উদ্যোগ ছিল একটি পরমাণু হুমকি। বিমানবাহী রণতরী এন্টারপ্রাইজ ছাড়াও ‘টাস্কফোর্স-৭৪’ এ ছিল উভচর যুদ্ধজাহাজ ‘ইউএসএস ত্রিপোলী’, নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র সজ্জিত তিনটি প্রহরাদানকারী যুদ্ধজাহাজ ‘ইউএসএস কিং’, ‘ডেকাটার’ ও ‘পিয়ারসন্স’, চারটি ডেস্ট্রয়ার ‘ইউএসএস বাউসেল’, ‘অরলেক’, ‘ম্যাককীন’ ও ‘এন্ডারসন’ এবং একটি পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন। সহায়তাদানকারী যুদ্ধজাহাজগুলোর পুনরায় জ্বালানি গ্রহণের জন্য টাস্কফোর্সের অগ্রযাত্রায় বিলম্ব ঘটে। ফলে টাস্কফোর্স-৭৪ কে সিঙ্গাপুরের পূর্বদিকে যাত্রাবিরতি করতে হয়। ১৩-১৪ ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী রাতে টাস্কফোর্স-৭৪ মালাক্কা প্রণালী অতিক্রম করে এবং ১৫ ডিসেম্বর সকালে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে। উভচর যুদ্ধজাহাজ ‘ইউএসএস ত্রিপোলী’তে ছিল ২৫ টি অ্যাসল্ট হেলিকপ্টার এবং ২ শো মেরিন সেনার একটি ব্যাটালিয়ন।
     ১২ ডিসেম্বর সাবেক দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গন থেকে নিউইয়র্ক টাইমসের এক রিপোর্টে বলা হয়, মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ‘এন্টারপ্রাইজ’ ও কয়েকটি প্রহরাদানকারী যুদ্ধজাহাজ মালাক্কা প্রণালীর উদ্দেশে ভিয়েতনামের জলসীমা অতিক্রম করেছে এবং বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের জন্য নির্দেশের অপেক্ষা করছে। ভারত সরকার নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এ সংবাদ থেকে মার্কিন টাস্কফোর্সের এগিয়ে আসার সংবাদ জানতে পারে। তবে ভারত টাস্কফোর্সের লক্ষ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি। এ নিয়ে ভারতীয় কর্মকর্তারা ৪ দিন পর্যন্ত মাথা ঘামান। ভারত সরকার টাস্কফোর্সের সম্ভাব্য হুমকির বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মেলভিন লেয়ার্ড বঙ্গোপসাগরে বিমানবাহী রণতরীর উপস্থিতি সম্পর্কে একটি ব্যাখ্যা দেন। তিনি তার ব্যাখ্যায় বলেন, ১২ ডিসেম্বর ব্রিটিশ বিমান বাহিনী ঢাকা থেকে ১২৪ জন আমেরিকানকে সরিয়ে নিয়েছে। তবে সেখানে এখনো ৪৭ জন আমেরিকান স্বেচ্ছায় অবস্থান করছে। তাদের অপসারণে জরুরি পরিকল্পনার অংশ হিসাবে টাস্কফোর্স পাঠানো হচ্ছে। ভারত মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এ ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করে। মুষ্টিমেয় আমেরিকানকে অপসারণে পরমাণু শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরীর নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্স পাঠানোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভারত সন্দেহ প্রকাশ করে। কেউ কেউ ধারণা করছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের চারপাশে ভারতীয় অবরোধ ভেঙ্গে মার্কিন মেরিনদের সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যদের সংযোগ সাধনে এ টাস্কফোর্স পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু ভারত এ ধারণা বাতিল করে দেয়। দিল্লি বিশ্বাস করতো যে, অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে মার্কিন মেরিনদের সংযোগ সাধন করতে হলে বঙ্গোপসাগরে সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে হবে। ভারতীয় কর্মকর্তারা ধারণা করছিলেন যে, ঢাকার পতন ঘটলে পাকিস্তানি সৈন্যদের পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নেয়া হবে। মার্কিন উভচর অ্যাসল্ট যুদ্ধজাহাজ ‘ত্রিপোলী’র উপস্থিতি থেকে তারা এ ধারণা করছিলেন। অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সৈন্যদের অপসারণে ত্রিপোলী’তে এসব জঙ্গি হেলিকপ্টার ও মেরিন ব্যাটালিয়ন মজুদ করে রাখা হয়েছে বলে ধারণা করা হতে থাকে।
মার্কিন ৭ম নৌবহর এগিয়ে আসার সংবাদ পেয়ে ১০ ডিসেম্বর ভারতীয় নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এস এম নন্দ বিচলিত হয়ে পড়েন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে যুুদ্ধের পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিফিংদানকালে তার এ বিচলিত অবস্থা ধরা পড়ে। ব্রিফিংয়ের সময় একটি বিরাট টেবিলের একপাশে বসেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা এবং অন্য পাশে বসেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এসএইচএফজি মানেকশ, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল পি সি লাল ও নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল নন্দ। ব্রিফিংয়ে ব্যাঘাত ঘটিয়ে এডমিরাল নন্দ ইন্দিরার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘ম্যাডাম মার্কিন ৭ম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে এগিয়ে আসছে।’ ইন্দিরা নিরুত্তর। ব্রিফিং চলতে থাকে। কিছুক্ষণ পর এডমিরাল নন্দ আবার প্রধানমন্ত্রীর মনোযোগ আকর্ষণ করে বলেন, ‘ম্যাডাম আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, মার্কিন ৭ম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে রওনা হয়েছে।’ ইন্দিরা তাকে তৎক্ষণাৎ থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এডমিরাল আপনার কথা আমি প্রথমবারই শুনতে পেয়েছি। চলুন আমরা ব্রিফিংয়ে মনোযোগ দেই।
ইন্দিরা উড়িয়ে দেয়া সত্ত্বেও এডমিরাল নন্দর মন খচখচ করছিল। তিনি অরোরার চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকবের কাছে টেলিফোন করেন। জ্যাকব তাকে অভয় দিয়ে বলেন, ভারতীয়দের সামান্য ভয় দেখানোর জন্য টাস্কফোর্স পাঠানো হয়েছে। অন্য কোনো কিছুর জন্য নয়। টাস্কাফোর্স এত দূরে যে, সময়মতো এটি বঙ্গোপসাগরে এসে পৌঁছতে পারবে না। তিনি তাকে আরো আশ্বস্ত করেন যে, পাকিস্তানি ডলফিন শ্রেণীর সাবমেরিন পারস্য উপসাগরে ঘোরাফেরা করছে। এ সাবমেরিন বিশাল বিস্তৃতি কভার করতে পারবে না। তারপরও এডমিরাল নন্দ বিশ্বাস করছিলেন, সমুদ্রের মধ্যে কোথাও রিফুয়েলিংয়ের ব্যবস্থা থাকা অসম্ভব নয়। 
নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল নন্দ বারবার তাগিদ দেয়ায় ভারতের টনক ন?

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ

৩ ডিসেম্বর পাক-ভারত সর্বাত্মক যুদ্ধ বেধে গেলে পাকিস্তানি সৈন্যরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ৭ ডিসেম্বর ষোড়শ ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ এবং ৯ ডিসেম্বর ৩৯তম এডহক ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল আবদুর রহিম খান আক্রান্ত হন। অলৌকিকভবে জেনারেল নজর রক্ষা পান। মিত্রবাহিনী নিকটবর্তী প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেঙ্গে ফেললে জেনারেল রহিম তার সদরদপ্তর নিয়ে চাঁদপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। পিছু হটার সময় তার কয়েকটি ফেরি চরায় আটকা পড়ে। তার পশ্চাদপসরণ বিলম্বিত হয়। নারায়ণগঞ্জের দিকে পিছু হটার সময় তার উপর ভারতীয় বিমান হামলা হয়। জেনারেল রহিমের সদরদপ্তর সম্বলিত নৌযান নিমজ্জিত হয়। ভারতীয় বিমান হামলায় কয়েক শো পাকিস্তানি সৈন্য ও অফিসার নিহত হয়। ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে অভিযানে অংশগ্রহণকারী মেজর বিলাল এখানেই প্রাণ হারান। জেনারেল রহিমও আহত হন। ১৩ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে উত্তপ্ত আলোচনা শুরু হয়। আমেরিকানরা যুদ্ধবিরতি এবং তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এ প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করে। তবে রুশরা ভারতকে জানিয়ে দেয় যে, তারা আর কোনো ভেটো প্রয়োগ করবে না। রাশিয়ার এ ইঙ্গিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাইকমান্ড উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে। পূর্ব পাকিস্তানের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ভারতীয়দের হাতে সময় ছিল খুব সামান্য। ভারতীয় হাইকমান্ডের পরিকল্পনা ছিল প্রথমে খুলনা ও চট্টগ্রাম বন্দরের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। সে লক্ষ্যে ভারতীয় সেনাসদর দপ্তর থেকে চট্টগ্রাম ও খুলনা বন্দর দখলের নির্দেশ দেয়া হয়। ১৪ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ নিঃশর্তে আত্মসমর্পণের জন্য বেতারযোগে চরমপত্র দেন। তবে তিনি এ চরমপত্র দিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে লক্ষ্য করে। বিবিসির একটি ভুল সংবাদের ভিত্তিতে তিনি এ ভুল করেন। বিবিসির সংবাদে বলা হয়েছিল যে, জেনারেল নিয়াজি পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে গেছেন এবং ফরমান আলী দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তাই তিনি তার উদ্দেশ্যে প্রেরিত বেতার বার্তায় বলেন, ‘রাও ফরমান আলী কা পয়গাম হে। হাতিয়ার ঢাল দো।’ ঢাকার আকাশে বিমান থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করার জন্য লাখ লাখ প্রচারপত্র নিক্ষেপ করা হয়। জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণে রাজি ছিলেন না। ১৫ ডিসেম্বর মধ্যরাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সম্মতিতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধানের শর্তে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে জেনারেল নিয়াজির কাছে একটি বার্তা পাঠান। 
    ১৪ ডিসেম্বর ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সৈন্যরা টঙ্গী এবং ১৬ ডিসেম্বর সকালে সাভারে এসে পৌঁছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল নাগরা মিরপুর ব্রীজে এসে পৌঁছে নিয়াজিকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানিয়ে তার কাছে একটি চিরকুট পাঠান। এ চিরকুট পেয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩৬তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল জামশেদ তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে আসেন। মেজর জেনারেল নাগরার সঙ্গে ছিলেন কাদের সিদ্দিকী। নিয়াজি ও নাগরা উভয়ে ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একই ব্যাচের অফিসার। পাকিস্তান বাহিনীতে নিয়াজি লে. জেনারেল র‌্যাঙ্কে উন্নীত হলেও নাগরা ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল র‌্যাঙ্কের অফিসার। নিয়াজির সদরদপ্তরে উভয়ে পাশাপাশি বসেন। নিয়াজি তাকে জিজ্ঞেস করেন তিনি উর্দু কবিতা বুঝেন কিনা। জবাবে নাগরা জানান, তিনি লাহোর সরকারি কলেজ থেকে ফার্সীতে এমএ পাস করেছেন। নাগরা নিয়াজির চেয়ে বেশি শিক্ষিত হওয়ায় তিনি তার সঙ্গে পাঞ্জাবী ভাষায় রসিকতা করতে শুরু করেন। জেনারেল নাগরা নিয়াজির কাছ থেকে বিদায় নেয়ার আগেই বেলা ১টায় জেনারেল জ্যাকব হেলিকপ্টারে চড়ে ঢাকায় আসেন। কুর্মিটোলা বিমান বন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানান জেনারেল নিয়াজির চীফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকী। বাকির সিদ্দিকীর সঙ্গে তার আলোচনা হয়। আত্মসমর্পণের শর্ত নিয়ে তার সঙ্গে ঐকমত্য না হওয়ায় তিনি জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন। নিয়াজি প্রকাশ্যে আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জানান। তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে তার অফিসে আত্মসমর্পণের আয়োজন করার জন্য পীড়াপীড়ি করেন। জেনারেল জ্যাকব তার প্রস্তাব নাকচ করে দেন। নিয়াজি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পরিবর্তে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করতে চাইছিলেন। জ্যাকব তাও নাকচ করে দেন। তিনি নিয়াজিকে ভেবে দেখার জন্য ৩০ মিনিট সময় দিয়ে বাইরে বের হয়ে যান। ফিরে এসে তিনি তার টেবিলে আত্মসমর্পণের দলিলটি পেশ করেন। তিন মিনিট কোনো জবাব না দেয়ায় জ্যাকব তার হাত থেকে দলিলটি নিয়ে বলেন, আমি ভারতীয় হাইকমান্ডকে বলবো, আপনি দলিলটি পাঠ করেছেন এবং তাতে স্বাক্ষর দানে সম্মতি দিয়েছেন। জ্যাকবের চাপে নিয়াজি তার শর্তেই আত্মসমর্পণে রাজি হন।
 পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতীয় বিমান ঘাঁটিগুলোতে সফল বোমাবর্ষণের সংবাদ পেয়ে ৪ ডিসেম্বর ইস্টার্ন কমান্ডের পাকিস্তানি সৈন্যরা উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। তারা ভাবছিল অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে তাদের পরিত্রাণ ঘটবে। কিন্তু সেদিন খুব সৈন্যই ভাবতে পেরেছিল যে, তাদের সামনে চরম দুঃসময় অপেক্ষা করছে। তাদেরকে জানানো হয়েছিল, পশ্চিম রণাঙ্গনে চাম্ব ও অমৃতসর দখল করে নেয়া হয়েছে। কিন্তু একসময় তাদের কাছে এ নিষ্ঠুর পরিহাস ধরা পড়ে। ৭ ডিসেম্বর যশোরের পতন ঘটলে তাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তান বিপন্ন হওয়ার সংবাদ পেয়ে পূর্ব রণাঙ্গনে তারা নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করে।   

আত্মসমর্পণের দলিল 
আত্মসমর্পণ দলিলে বল হয়ঃ
`The Pakistan Eastern Command agrees to surrender all Pakistan Armed Forces in Bangladesh to Lieutenant General Jagjit Sing Aurora, General Officer Commanding-in-Chief of the Indian and Bangladesh forces in the Eastern Theatre. This surrender includes all Pakistanland, air and naval forces as also para-military forces and civil armed forces. The forces will lay down their arms and surrender at the places where they are currently located to the nearest regular troops under the command of Lieutenant General Jagjit Singh Aurora.
The Pakistan Eastern Command shall come under the orders of Lieutenant General Jagjit Singh Aurora as soon as the Instrument has been signed. Disobedience of orders will be regarded as a breach of surrender terms and will be dealt with in accordance with the accepted laws and usages of war. The decision of Lieutenant General Jagjit Sing Aurora will be final, should any doubt arise as to the meaning or interpretation of the surrender terms.
Lieutenant General Jagjit Singh Aurora gives a solemn assurance that personnel who surrender shall be treated with the provision of Geneva Convention and guarantees safety and well-being of all Pakistanmilitary and para-military forces who surrender. Protection will be provided to foreign nationals, ethnic minorities and personnel of West  Pakistan origin by the forces under the Command of Lieutenant General Jagjit Singh Aurora.'
(Signatories)
1. Jagjit Singh Aurora
Lieutenant General
General Officer Commanding in-Chief
Indian and BangladeshForces in the Eastern Theatre
2. Amir Abdullah Khan Niazi
Lieutenant General
Martial Law Administrator
Zone `B' and Commander Eastern Command (Pakistan)

‘বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণে সম্মত হচ্ছে। পাকিস্তানের সকল স্থল, বিমান ও নৌ বাহিনী এবং সকল আধাসামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী এই আত্মসমর্পণের আওতায় পড়বে। বর্তমানে এ বাহিনীর যে যেখানে অবস্থান করছে সেখানে তারা লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কমান্ডের আওতায় নিকটবর্তী নিয়মিত সৈন্যদের কাছে তাদের অস্ত্র সমর্পণ এবং আত্মসমর্পণ করবে। আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ড লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নির্দেশের আওতায় চলে আসবে। নির্দেশ অমান্যকে আত্মসমর্পণের শর্ত ভঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করা হবে এবং অনুমোদিত আইন ও যুদ্ধের রীতিনীতি অনুযায়ী কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হবে। আত্মসমর্পণের শর্তাবলী ও ব্যাখ্যা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ দেখা দিলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার সিদ্ধান্ত হবে চূড়ান্ত। 
লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা যেসব সৈন্য আত্মসমর্পণ করবে জেনেভা কনভেনশনের ধারা অনুযায়ী সৈন্য হিসাবে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান এবং পাকিস্তান সশস্ত্র ও আধাসামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণকারী সকল সদস্যের নিরাপত্তা ও কল্যাণের নিশ্চয়তা প্রদানের দৃঢ় আশ্বাস দিচ্ছেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার অধীন সৈন্যরা বিদেশী নাগরিক, জাতিগত সংখ্যালঘু ও পশ্চিম পাকিস্তান বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের নিরাপত্তা প্রদান করবে।’
(স্বাক্ষরকারীদ্বয়) 
১. জগজিৎ সিং অরোরা 
লেফটেন্যান্ট জেনারেল
 পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়ক
 ২. আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি
লেফটেন্যান্ট জেনারেল
সামরিক আইন প্রশাসক
জোন ‘বি’ এবং ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার (পাকিস্তান) 
১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯ টায় বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করার কথা ছিল। জেনারেল জ্যাকবের সঙ্গে আলোচনা করেই সময় ৬ ঘণ্টা বৃদ্ধি করা হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা কোথায়, কিভাবে এবং কখন আত্মসমর্পণ করবে সে পরিকল্পনা জ্যাকবই করেছিলেন। বেলা ২টা ৪৫ মিনিটে জেনারেল নিয়াজি অনুস্বাক্ষর করলে আত্মসমর্পণ দলিলে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরের সময়সূচি নির্ধারণ করা হয় বিকাল ৪ টা ৩০মিনিটে। ব্রিগেডিয়ার সাহবেগ সিং ও তার সাতজন সহযোগী আত্মসমর্পণের মঞ্চ প্রস্তুত করেন। জ্যাকবের সঙ্গে ছিলেন ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল অরোরা। অরোরার সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী ভান্তি কাউর। বিমান বন্দরে ভারতীয় ও পাকিস্তানি সৈন্যরা অরোরাকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। একটি সামরিক জীপ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি ও তার সহযোগীদের নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে এসে থামে। সামরিক জীপ দেখে জেনারেল অরোরা ও তার লোকজন উড়ে দাঁড়ান। চোস্ত সামরিক কায়দায় দু’জেনারেল একে অন্যকে স্যালুট করেন। বিশাল বটগাছের নিচে একটি টেবিলের পাশে দু’টি চেয়ার পাতা। একটিতে বসেন অরোরা এবং অন্যটিতে নিয়াজি। একজন ভারতীয় সেনা অফিসার টেবিলের উপর আত্মসমর্পণের দলিল পেশ করেন। তাতে প্রথমে স্বাক্ষর করেন নিয়াজি এবং পরে অরোরা। সময় ছিল তখন বিকাল ৪টা ৩১ মিনিট। এরপর হোলস্টার থেকে নিয়াজি তার পিস্তল বের করে টেবিলের উপর রাখেন। তিনি আত্মসমর্পণের প্রতীক হিসাবে অরোরার কাছে ৩৮ নম্বর খচিত পয়েন্ট থ্রি এইট ক্যালিবারের নিজের পিস্তল তুলে দেন এবং ব্যাজ ও বেল্ট খুলে ফেলেন। দু’জেনারেল করমর্দন করেন এবং একে অন্যের সঙ্গে আলিঙ্গন করেন। এসময় তাদের উভয়ের চোখ ছিল অশ্র“সজল। উভয় জেনারেল আবার উড়ে দাঁড়ান এবং একে অন্যকে স্যালুট করেন। 
আত্মসমর্পণ দলিল স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ থেমে যায় এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসাবে স্বাধীন বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করে। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ভারতের পক্ষে অরোরা ছাড়া আরো উপস্থিত ছিলেন পূর্বাঞ্চলীয় নৌ কমান্ডের কমান্ডার ভাইস এডমিরাল এন. কৃষ্ণ, অষ্টম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল কে. ভি. কৃষ্ণ রাও (পরবর্তীতে ভারতের সেনাপ্রধান), পূর্বাঞ্চলীয় এয়ার কমান্ডের প্রধান এইচসি দেওয়ান, চতুর্থ কোর কমান্ডার লে. জেনারেল সগৎ সিং, ইস্টার্ন কমান্ডের চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জেএফআর জ্যাকব এবং ১০১তম কমিউনিকেশন জোনের কমান্ডার মেজর জেনারেল গন্ধর্ব নাগরা। বাংলাদেশ পক্ষে উপস্থিত ছিলেন গ্র“প ক্যাপ্টেন একে খন্দকার, ৩ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর সফিউল্লাহ, ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এটিএম হায়দার, বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী প্রমুখ। পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করায় হাজার হাজার মানুষ আনন্দে ফেটে পড়ে। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির মধ্য দিয়ে সৈন্যরা অরোরাকে কাঁধে তুলে নেয়। জনতার ভয়ে নিয়াজি দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের পর ৯৩ হাজারের বেশি পাকিস্তানিকে বন্দি করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার অরোরাকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করে। 
ঢাকার বাইরে অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সৈন্যরা নিকটবর্তী ভারতীয় সেনা কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ঝিনাইদহে পাকিস্তানের নবম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল এমএইচ আনসারী আত্মসমপর্ণ করেন ভারতের চতুর্থ মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল এমএস ব্রার কাছে, নাটোরে ষোড়শ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ আত্মসমর্পণ করেন ২০তম মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল লক্ষèণ সিংয়ের কাছে এবং চতুর্দশ ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল কাজী আবদুল মজিদ ভারতের ৫৭তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল বিএস গঞ্জালভেসের কাছে পিস্তল হস্তান্তর করে আত্মসমর্পণ করেন। 
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করলেও শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন প্রহরায় নিয়োজিত সৈন্যরা নিয়াজির নির্দেশ পালনে অস্বীকৃতি জানায়। ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর দু’জন ব্রিগেডিয়ার, ৪/৫ জন মেজর ও প্রায় দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্যের ঘেরাওয়ের মধ্যে তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। মিরপুরের সশস্ত্র অবাঙালি মিলিশিয়ারাও অস্ত্র সমর্পণ করতে রাজি হয়নি। তাদেরকে নিরস্ত্র করতে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মেজর মইনুল হোসেনের নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টকে মিরপুরে পাঠানো হয়। বিদ্রোহী বিহারীদের সঙ্গে ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের ভয়াবহ লড়াইয়ে ৩৯ জন সৈন্য নিহত হয়। কোনো একক লড়াইয়ে আর কখনো বাংলাদেশকে এত সৈন্য হারাতে হয়নি। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের কোম্পানি কমান্ডার লে. হেলাল মোর্শেদ খান আহত হন। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব জহির রায়হান রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যান। তিনি তার সহোদর শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজে বের করতে গিয়েছিলেন। কয়েকদিন পর কয়েকজন ভারতীয় সৈন্যের সঙ্গে জহির রায়হানের লাশ পাওয়া যায়। মতাদর্শগতভাবে তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট। কলকাতায় অবস্থানকালে জহির রায়হান আওয়ামী লীগ নেতাদের কর্মকান্ডের বেশ কিছু বিতর্কিত ছবি তুলেছিলেন। এসব ছবি নিয়ে তিনি ‘স্টপ জেনোসাইড’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন। এ চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়াই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ১৬ ডিসেম্বরের পরবর্তী দু’দিন পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্যরা নিজ নিজ অস্ত্র বহন করার সুযোগ পেয়েছিল। ভারতীয়রা তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছিল। তবে ধীরে ধীরে তাদের আচরণ রুক্ষ হতে থাকে। 
বাংলাদেশী ও ভারতীয় সূত্রের হিসাব অনুযায়ী পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের সহযোগীসহ ৯৩ হাজার লোক ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করে। বন্দিদের মধ্যে ৭৯ হাজার ৬৭৬ জন ছিল ইউনিফর্মধারী। ইউনির্ফমধারীদের মধ্যে ৫৫ হাজার ৬৯২ জন ছিল সেনাবাহিনীর সদস্য, ১৬ হাজার ৩৫৪ জন আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য, ৫ হাজার ২৯৬ জন ছিল পুলিশ বাহিনীর সদস্য, এক হাজার ছিল নৌসেনা এবং ৮ শো ছিল বিমান বাহিনীর সদস্য। বাদবাকি বন্দিরা ছিল হয়তো পাকিস্তানি সৈন্যদের পরিবারের সদস্য নয়তো সহযোগী। হামুদুর রহমান কমিশনের তালিকা অনুযায়ী বন্দিদের সংখ্যা ছিল নিম্নরূপ:
শাখাবন্দির সংখ্যা
সেনাবাহিনী                          ৫৪ হাজার ১৫৪
নৌবাহিনী                             ১ হাজার ৩৮১
বিমান বাহিনী                                  ৮৩৩
পুলিশসহ আধাসামরিক বাহিনী     ২২ হাজার
বেসামরিক লোক                     ১২ হাজার

পূর্ব রণাঙ্গনে ৮ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়। পাকিস্তানি হিসাবে ১১৫ জন অফিসার, ৪০ জন জেসিও এবং অন্যান্য র‌্যাঙ্কের ১ হাজার ১৮২ জন সৈন্য নিহত হয়। ভারতের হিসাব অনুযায়ী সাড়ে চার হাজার পাকিস্তানি সৈন্য নিহত এবং আরো চার হাজার সৈন্য আহত হয়। ভারতের পক্ষে নিহত হয় ১ হাজার ৪২১ জন, আহত হয় ৪ হাজার ৫৮ জন এবং নিখোঁজ হয় ১৫৬ জন। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে নিহত হয় ২ হাজার ৮৪৩ জন। ২০ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজি ও তার উর্ধ্বতন কমান্ডারদের বিমানে করে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিখা অনির্বাণ প্রজ্জ্বলন করা হয়। ভারতে দিবসটিকে ইস্টার্ন কমান্ড দিবস হিসাবে পালন করা হয়।

ঢাকায় ভারতীয় সৈন্য
১৬ ডিসেম্বরের পর রাজধানী ঢাকাসহ সর্বত্র ছিল শুধু ভারতীয় সৈন্য। বাংলাদেশ ভারতীয় সৈন্যরা দখল করে নিয়েছে কিনা এমন কথা বলাবলি শুরু হয়। প্রথমেই মেজর জেনারেল নাগরার নেতৃত্বে এক ডিভিশন ভারতীয় সৈন্য ঢাকায় প্রবেশ করে। তারপর ভারতের ৫৭তম মাউন্টেন ব্রিগেড অবস্থান গ্রহণ করে জাতীয় সংসদ ভবনের উল্টোদিকে মনিপুরী পাড়ায়। এভাবে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশ ভারতীয় সৈন্যে ছেয়ে যায়।। বাংলাদেশ-ভারত ২৫ বছর মেয়াদী মৈত্রী চুক্তির আওতায় ১৯৭২ সালের ১৩ মার্চ বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়।
মিত্রবাহিনীর ছদ্মাবরণে ভারতীয় সৈন্যরা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অবস্থানকালে অবাধে লুণ্ঠন চালায়। পাকিস্তানি সৈন্যদের সমর্পিত সকল সমরাস্ত্র তারা সীমান্তের বাইরে পাচার করে। নিঃসন্দেহে এসব অস্ত্র ছিল বাংলাদেশের প্রাপ্য। পাকিস্তানি সৈন্যদের সমর্পিত অস্ত্র ভারতে পাচারের বিরুদ্ধে মেজর জলিল ছাড়া আর কোনো মুক্তিযোদ্ধা রুখে দাঁড়াননি। কেউ প্রতিবাদ করেননি। ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো সরকার পাকিস্তানি সৈন্যদের ফেলে যাওয়া সমরাস্ত্র ফেরত দেয়ার জন্য ভারতের কাছে দাবি করেনি। ভারতীয়রা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের প্রতীক জেনারেল নিয়াজির সামান্য বেল্ট, ব্যাজ, পিস্তল ও মার্সিডিজ গাড়ি তুলে নেয়ার লোভ সংবরণ করতে পারেনি। আত্মসমর্পণ করার সময় শুধুমাত্র ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের অক্ষত ট্যাংক ছিল ৫০টি এবং কামান ছিল ৭ শো। এসব ভারি অস্ত্রের কোনোটাই ভারতীয়রা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেনি। সর্বাত্মক যুদ্ধকালে বাংলাদেশের সীমান্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এ সুযোগে টয়লেট সামগ্রী থেকে শুরু করে সবই লুণ্ঠন করে তারা নিজ দেশে নিয়ে যায়। ভারতে বিদেশী সামগ্রী আমদানির সুযোগ সীমিত থাকায় ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশ থেকে বিদেশী সামগ্রী নিজ দেশে নিয়ে যেতে প্রলুদ্ধ হয়। কী পরিমাণ সম্পদ তারা লুণ্ঠন করেছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান বের করা কঠিন। অটল জীপ ও শক্তিমান ট্রাকে করে লুণ্ঠিত মালামাল ভারতে পাচার করা হয়। ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল বাধা দেয়ায় তাকে গ্রেফতার করে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্যদের লুণ্ঠনের ব্যাপারে ‘বাংলাদেশ পাস্ট এন্ড প্রেজেন্ট’ পুস্তকে সালাহউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, After the war was over, India was criticised for overstaying in the Chittagong Hill Tracts. It was also alleged that the Indian army removed by convey of trucks large amounts of arms, ammunitions and machinery from Bangladesh. As a result, tension and suspicion grew up against India’s policy towards Bangladesh, apprehending that Indiawanted to turn Bangladeshinto a client state and not a self-respecting independent state.’
‘যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর ভারতীয় সৈন্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিক সময় অবস্থান করতে থাকায় ভারত সমালোচিত হতে থাকে। অভিযোগ উঠে যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী ট্রাক বহরে করে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও সাজসরঞ্জাম সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার ফলে বাংলাদেশকে আত্মমর্যাদাশালী রাষ্ট্রের পরিবর্তে ভারত একটি তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায় এমন একটি আশংকা দেখা দেয়। তাতে ভারতীয় নীতির বিরুদ্ধে উত্তেজনা ও সংশয় সৃষ্টি হয়।’  
    মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক জনাব জয়নাল আবেদীনের ‘র’ এন্ড বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি বইয়েও বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্যদের লুন্ঠনের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। বইটিতে তিনি লিখেছেন, The real Indian face lay bare after the surrender of Pakistani forces, when I saw the large scale loot and plunder by the Indian Army personnel. The soldiers swooped on everything they found and carried them away to India. Curfew was imposed on our towns, industrial bases, ports, cantonments, commercial centres and even residential areas to make the looting easier.They lifted everything from ceiling fans to military equipment, utensils to water taps. Thousands of Army vehicles were used to carry looted goods to India.
‘‘পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের পর ভারতীয় সৈন্যদের ব্যাপক লুটতরাজ দেখতে পেয়ে ভারতের প্রকৃত চেহারা আমার কাছে নগ্নভাবে ফুটে উঠে। ভারতীয় সৈন্যরা যা কিছু দেখতে পেতো তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তো এবং সেগুলো ভারতে বহন করে নিয়ে যেতো। লুটতরাজ সহজতর করার জন্য তারা আমাদের শহর, শিল্প স্থাপনা, বন্দর, সেনানিবাস, বাণিজ্যিক কেন্দ্র এমনকি আবাসিক এলাকায় কারফিউ জারি করে। তারা সিলিং ফ্যান থেকে শুরু করে সামরিক সাজসরঞ্জাম, তৈজষপত্র ও পানির টেপ পর্যন্ত উঠিয়ে নিয়ে যায়। লুণ্ঠিত মালামাল ভারতে পরিবহনের জন্য হাজার হাজার সামরিক যান ব্যবহার করা হয়।’ বইটির আরেকটি অংশে তিনি লিখেছেন, Through the independence war of Bangladesh India was immensely benefited economically, militarily, strategically and internationally. So India involved in our war of liberation for its own interest, not for us
 ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভারত অর্থনৈতিক, সামরিক, কৌশলগত ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক লাভবান হয়েছে। এ কারণে দেশটি তার নিজের স্বার্থে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে স¤পৃক্ত হয়, আমাদের স্বার্থে নয়।’ 
    সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে ভারতে সম্পদ পাচার সম্পর্কে আট নম্বর সেক্টরে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসাবে অংশগ্রহণকারী মেজর জেনারেল খোন্দকার মো: নূরন্নবী (অব:) তার ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে সেক্টর আট নামে বইয়ের ১৬৪/১৬৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘সীমান্ত খোলা পেয়ে ভারতীয় মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন এলাকায় ঢুকে পড়ে এবং স্থানীয় বাজার ও দোকানপাট থেকে সব বিদেশী মালামাল বিশেষ করে রেডিও, টেলিভিশন, খুচরা যন্ত্রাংশ, বিদেশী ওষুধপত্র অর্থাৎ যা কিছু বিদেশী সব কিনে নিচ্ছিল। এমনকি পাকিস্তানি ধাতবমুদ্রাও। এটা আমাদের জন্য একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এসময় সেক্টর কমান্ডার মেজর এমএ মঞ্জুর আমাদের এলাকায় এলেন। আমরা তাকে এ বিষয়ে অবহিত করলাম। তিনি জানালেন যশোরেও একই অবস্থা। সেক্টর কমান্ডার মাড়োয়ারীদের এ ব্যবসার ব্যাপারে ভারতের চতুর্থ মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল ব্রার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জেনারেল ব্রার সেক্টর কমান্ডারকে জানান যে, এদের নিয়ে সবাই অতিষ্ঠ।’
    বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্যদের লুন্ঠনের ব্যাপারে কানাডা প্রবাসী আজিজুল করিম ‘হোয়াই সাচ এন্টি-ইন্ডিয়ান ফিলিংস এমং বাংলাদেশী?’ শিরোনামে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে ‘অনিক’-এর রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, ‘ভারতীয় সৈন্যদের লুণ্ঠিত মালামালের মূল্য ছিল প্রায় ১ শো কোটি মার্কিন ডলার।’ বিএনপি সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী ড. কামাল সিদ্দিকী ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭২ সালে তিনি খুলনার ডিসি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সে সময় তিনি বাংলাদেশ ও ভারত উভয় সরকারের কাছে লিখিত পত্রে বলেন, ভারতীয় সৈন্যরা তার জেলা থেকে কোটি কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতি, যানবাহন ও সাজসরঞ্জাম স্থানান্তর করে ফেলেছে। মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী অভিযোগ করেছিলেন, ভারতীয় সৈন্য ও চোরাচালানীরা বাংলাদেশ থেকে ৬ হাজার কোটি রুপি মূল্যের সামগ্রী ভারতে পাচার করেছে। অরোরার পদোন্নতি না ঘটা হচ্ছে বাংলাদেশে ভারতীয় সৈনদের লুণ্ঠনের আরেকটি বড় প্রমাণ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের পহেলা জানুয়ারি ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশকে ফিল্ড মার্শাল পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। যে যুক্তিতে মানেকশর পদোন্নতি ঘটেছিল একই যুক্তিতে অরোরারও পদোন্নতি ঘটার কথা ছিল। পদোন্নতি ঘটলে মানেকশর পরে তিনি হতেন ভারতের পরবর্তী সেনাপ্রধান। কিন্তু তার কপালে পদোন্নতি ঘটেনি। মানেকশ অবসরে যাবার পর লে. জেনারেল জি. জি. বেবুর ভারতের সেনাপ্রধান হিসাবে নিযুক্তি পান। বাংলাদেশ যুদ্ধে বিজয়ী মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক অরোরাকে লে. জেনারেল র‌্যাঙ্ক থেকেই বিদায় নিতে হয়। বাংলাদেশে অবস্থানকালে তিনি সৈন্যদের মধ্যে শৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ায় তার পদোন্নতি ঘটেনি। অরোরার প্রতি অবিচার করার সত্যতা মানেকশ নিজেও স্বীকার করেছেন। একবার তিনি মন্তব্য করেছিলেন, Jaggi did the work, but I got the baton ‘বাংলাদেশ যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার কাজটি করেছেন জগি বা জগজিৎ। কিন্তু ফিল্ড মার্শালের ব্যাটন পেলাম আমি।’ 
ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল অরোরা ও তার সহযোগী মেজর জেনারেল জ্যাকবের সঙ্গে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশর কথাবার্তায়ও বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনীর লুটপাটের প্রমাণ পাওয়া যায়। এব্যাপারে জ্যাকব তার ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা: বার্থ অব অ্যা নেশন’-এ (বাংলা অনূদিত গ্রন্থের ১২৮ পৃষ্ঠা) লিখেছেন, ‘আমি মানেকশ বললাম, আমাদের সৈন্যরা যত তাড়াতাড়ি বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাবর্তন করবে ততই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক। কারণ ইতিমধ্যে তাদের কার্যকলাপ নিয়ে অভিযোগ আসতে শুরু করেছে। তার কয়েকদিন পর সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ আমাকে টেলিফোনে প্রশ্ন করেন, আপনি কি পাকিস্তানি সৈন্যদের রসদ লুট হওয়ার গুজব শুনতে পেয়েছেন? আমি বললাম, এটা গুজব। আর কিছু নয়। তিনি জানতে চাইলেন, তাহলে আমি কী শুনেছি? আমি বললাম, আমি গুজব ছড়াই না। তারপর তিনি অরোরার সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেন। পরদিন জেনারেল মানেকশ লুটপাটের গুজব তদন্ত করতে আমাকে ঢাকা যাবার নির্দেশ দেন। সেদিনই আমি ঢাকা গিয়ে কমান্ডার ও স্টাফ সদস্যদের সঙ্গে কলকাতা ও দিল্লিতে লুটপাটের যে গুজব পৌঁছেছে সে সম্পর্কে জানতে চাই। তবে এসব অভিযোগ তারা অস্বীকার করেন।’ 
মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান অস্বীকার 
পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমপর্ণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানীকে যোগদান করার সুযোগ না দিয়ে ভারতীয়রা মুক্তিযুদ্ধের পুরো কৃতিত্ব কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে। আত্মসমর্পণ দলিলে একদিকে স্বাক্ষর করেছেন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল নিয়াজি এবং অন্যদিকে স্বাক্ষর করেছেন ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল অরোরা। বাংলাদেশ যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ হওয়া সত্ত্বেও দেশটি এ দলিলের স্বাক্ষরদাতা নয়। বাংলাদেশকে এ ঐতিহাসিক দলিলে স্বাক্ষর দানের সুযোগ না দিয়ে ভারত ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধ হিসাবে চিহ্নিত করার অশুভ প্রয়াস চালিয়েছে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক কর্মকর্তা বি রমনের বইয়ের একটি উক্তি তার প্রমাণ। সাংবাদিক মাসুমুর রহমান খলিলী ও একরামুল্লাহিল কাফির যৌথ উদ্যোগে ‘র’ এর কাওবয়েরা’ নামে তার বইয়ের বাংলা অনুবাদের ১৪ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘ফিল্ড মার্শাল এসএইচএফজে মানেকশর নেতৃত্বে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী এবং পরলোকগত কে. এফ. রুস্তমজীর নেতৃত্বে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফ’র প্রকাশ্য এবং ‘র’ ও ইন্টেলিজেন্স বুুু্যুরোর গোপন কর্মকান্ড বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। তবে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যে নেতৃত্ব দিয়েছেন তা না হলে এ প্রচেষ্টায় সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হতো না।’ 
ভারত সরকার নিজেও ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে তাদের নিজস্ব যুদ্ধ হিসাবে বিবেচনা করে এবং যুদ্ধে বিজয় লাভের জন্য গৌরবান্বিত বোধ করে। এ যুদ্ধ সম্পর্কে ভারতের সংরক্ষিত সরকারি দলিলের ভূমিকায় ড. এস এন প্রসাদ লিখেছেন, India won a glorious victory against Pakistan in 1971 war. It was the first decisive victory in a major war in centuries. And it was won singlehandedly in the face of opposition and threats from a majority of the UN member states, including a super power. Every Indian felt proud of this glittering chapter in the nation’s history.

‘ভারত ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গৌরবময় বিজয় অর্জন করে। কয়েক শতাব্দীর মধ্যে এটা ছিল প্রথম চূড়ান্ত নিষ্পত্তিকারী বিজয়। একটি পরাশক্তিসহ জাতিসংঘের অধিকাংশ সদস্য দেশের বিরোধিতা ও হুমকির মুখে এককভাবে এ বিজয় অর্জিত হয়। জাতির ইতিহাসের এ উজ্জ্বল অধ্যায়ের জন্য প্রতিটি ভারতীয় গৌরব বোধ করে।’ ভারতীয় লেখক ড. সুভাষ কাপিলা তার ‘দ্য বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশীপ ট্রিটি’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে লিখেছেন, In India’s post-independence political and military history, December 16, 1971 was India’s finest hour. ‘স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ও সামরিক ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর হচ্ছে ভারতের উজ্জ্বলতম মুহূর্ত।’ লে. জেনারেল জ্যাকব তার ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা: বার্থ অব অ্যা নেশন’-এ (বাংলা অনুবাদ ১৩৪ পৃষ্ঠা) মন্তব্য করেছেন,‘ ইন্দিরা গান্ধী জাতিকে এক মহান সামরিক বিজয় এনে দিয়েছেন যা আমাদের সম্মান পুনরুদ্ধার করে এবং ভারতকে আঞ্চলিক পরাশক্তির মর্যাদা এনে দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইন্দিরা গান্ধীর শ্রেষ্ঠ কীর্তি।’  
    মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের প্রতি ভারতীয়রা অবজ্ঞা প্রদর্শন করায় মুক্তিযোদ্ধারাও ব্যথিত। এ ব্যাপারে ৩ নম্বর সেক্টরে এস ফোর্সের সাবেক কোম্পানি কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব:) সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম বীর প্রতীকের একটি উক্তি উল্লেখ করার দাবি রাখে। তিনি প্রোবনিউজে ৩৯তম বিজয় দিবস সংখ্যায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন, There is no mention of the Mukti Bahini in the surrender document and there is only little or marginalized mention of the contribution of Mukti Bahini in the dozens of books written by Indian authors, It is a pity.’ ‘আত্মসমর্পণ দলিলে মুক্তিবাহিনীর অবদানের কোনো উল্লেখ নেই এবং ভারতীয় লেখকদের ডজন ডজন বইয়ে মুক্তিবাহিনীর অবদান স্থান পেয়েছে খুব সামান্য।  নয়তো নামমাত্র। তা অত্যন্ত দুঃখজনক।’ 

প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অনুপস্থিতি
পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমপর্ণ অনুষ্ঠানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন গ্র“প ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকার। কেন সেদিন মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানী?

ফাইটার জেটের হেলমেট

বর্তমান সময়ে আধুনিক এবং নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফিচার হচ্ছে জেট ফাইটারের ককপিটে বসা এর পাইলটের হেল...