বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০

জুলিয়াস সিজার হত্যাকান্ড

  খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সালের ১৫ মার্চ রোমান প্রাচীন উৎসব আইডিস শোভাযাত্রায় পোম্পে নাট্যমঞ্চের কাছে একটি জায়গায় ২৩ বার ছুরিকাঘাত করে রোমান বীর জুলিয়াস সিজারকে হত্যা করা হয়। চক্রান্তকারীরা এ হত্যাকান্ডকে অভ্যুত্থান হিসেবে মানতে নারাজ। তাদের দৃষ্টিতে এ হত্যাকা- ছিল টায়রানিসাইড বা অত্যাচারী শাসক হত্যাকা-। মূল হত্যাকারী হলেন মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস। আরেকজন চক্রান্তকারীর নাম প্রায় অভিন্ন। তার নাম ডিসিমাস জুনিয়াস ব্রুটাস আলবিনাস। ব্রুটাস ছিলেন চক্রান্তকারীদের নেতা। তার স্ত্রী পোর্সিয়াও সিজার হত্যাকা-ে সম্পৃক্ত ছিলেন। চক্রান্তকারীরা মনে করতেন যে, সিজার সংবিধান লংঘন করেছেন এবং স্বৈরাচারী একনায়কে পরিণত হয়েছেন। মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস ও গিজ ক্যাসিয়াস লংগিনাস রোমান সংবিধান পুনরুজ্জীবিত করতে চাইছিলেন। মহান রাজনৈতিক চিন্তানায়ক, দার্শনিক ও বাগ্মী  মার্কাস টিলিয়াস সিসেরো ছিলেন তাদের বন্ধু। তিনি দৃঢ়ভাবে রোমান প্রজাতন্ত্রকে সাংবিধানিক শাসনের ওপর দাঁড় করানোর পক্ষপাতী ছিলেন। সিসেরো হত্যাকা-ে অংশগ্রহণ করেননি। তবে তিনি আততায়ীদের অভিনন্দন জানিয়েছিলেন এবং হত্যাকা-কে একটি মহান কাজ হিসেবে প্রশংসা করেছিলেন। প্রকৃতি ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াসকে ক্ষমা করেনি। ফিলিপ্পি যুদ্ধে তাদের উভয়ে আত্মহত্যা করেন। ব্রুটাস শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন ভেবে ক্যাসিয়াস তার মুক্ত গোলাম পিন্ডারাসকে তাকে হত্যার নির্দেশ দেন। সিজারকে তিনি যে ছোরা দিয়ে হত্যা করেছিলেন, তাকে সেই ছোরা দিয়ে হত্যা করা হয়। যেদিন তার জন্ম হয়েছিল ঠিক সেদিন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ব্রুটাস তার লাশের ওপর আছড়ে পড়ে বিলাপ করেন। একই যুদ্ধে মার্ক এন্টনির কাছে পরাজিত হওয়ার পর ব্রুটাস আত্মহত্যা করেন। তার দুজন সহযোগী তরবারি ধরে রাখে। তিনি তীক্ষè তরবারিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে জীবন বিসর্জন দেন।
 প্রায় ৪০ জন লোক সিজার হত্যাকা-ে যোগদান করেন। তাদের অর্ধেকের নাম বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। তবে যাদের নাম জানা গেছে তাদের সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায়নি। জ্ঞাত ব্যক্তিরা হলেন: গিজ ক্যাসিয়াস লংগিনাস, মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস, সার্ভিয়াস সালপিসিয়াস গালবা, কুইন্টাস লিগারিয়াস, লুসিয়াস মিনিউসিয়াস বাসিলাস, গিস সার্ভিলাস কাস্কা (পাবলিয়াস সার্ভিলিয়াস কাস্কা লংগাসের ভাই), পাবলিয়াস সার্ভিলিয়াস কাস্কা লংগাস (গিস সার্ভিলাস কাস্কার ভাই ও প্রথম আঘাতকারী), ডিসিমাস জুনিয়াস ব্রুটাস আলবিনাস, লুসিয়াস টিলিয়াস সিম্বার, গিস ট্রিবনিয়াস, লুসিয়াস ক্যাসিয়াস লংগিনাস (গিস ক্যাসিয়াস লংগিনাসের ভাই), গিস ক্যাসিয়াস পারমেনসিস, কাইসিলিয়াস (বুকোলিয়নাসের ভাই), বুকোলিয়নাস (কাইসিলিয়াসের ভাই), রুবরিয়াস রুগা, মার্কাস স্পুরিয়াস, পাবলিয়াস সেক্সটিয়াস নাসো, লুসিয়াস পন্টিয়াস আকিলা, পেট্রোনিয়াস, ডিসিমাস টুরুলিয়াস, প্যাকুভিয়াস এন্টিসটিয়াস লাবিও। 
     খ্রিস্টপূর্ব ৪৫ সালে সিজার মুন্ডা যুদ্ধে রিপাবলিকান উপদলকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করার পর ডিক্টেটর হিসেবে রোমে ফিরে এলে মার্কাস ব্রুটাস চক্রান্তকারীদের সঙ্গে যোগদান করেন। ব্রুটাসের মা সার্ভিলিয়া ছিলেন রোমান সিনেটর ক্যাটো দ্য ইয়াংগারের সৎবোন। খ্রিস্টপূর্ব ৬৪ সাল নাগাদ সার্ভিলিয়া সিজারের রক্ষিতায় পরিণত হন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সালে সিজারের হত্যাকা- নাগাদ উভয়ের সম্পর্ক অক্ষুণœ ছিল। তার প্রতি সিজারের গভীর অনুরাগ ছিল এবং গল যুদ্ধ শেষে রোমে ফিরে আসার পর তিনি তাকে একটি অমূল্য কৃষ্ণ মুক্তা উপহার দিয়েছিলেন। জুনিয়া টারশিয়া ছিলেন সিজার ও সার্ভিলিয়ার কন্যা। তবে আরেকটি সূত্রে বলা হয়, সার্ভিলিয়ার প্রতি সিজারের আকর্ষণে ভাটা পড়লে তিনি জুনিয়াকে উপহার দেন। তবে আরেকটি সূত্রে বলা হয়, জুনিয়া হলেন সিজারের কন্যা। একই সূত্র দাবি করছে যে, সিজারের হত্যাকা-ে সম্পৃক্ত মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস ছিলেন সিজারের পুত্র। তবে বয়সের হিসাবে এ ভাষ্য সঠিক হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। কেননা ব্রুটাসের জন্মের সময় সিজারের বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। রোমান প্রজাতন্ত্রের সিনেট সিজারকে ডিক্টেটর পারপিটিউ (আজীবন ডিক্টেটর) হিসেবে নিয়োগ দিলে সংকট তৈরি হয়। সিনেটের এ ঘোষণায় বহু সিনেটর আশঙ্কা করছিলেন যে, সিজার নিরঙ্কুশ একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠায় সিনেটকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চাচ্ছেন। আরো আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে, সিজারের প্লেবিয়ান বা নিন্মশ্রেণির অনুকূলে প্রণীত শাসনতন্ত্র সিনেটরদের অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধার প্রতি হুমকি হয়ে দেখা দেবে। চক্রান্তকারীরা রোমান প্রজাতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয় এবং সিজারের হত্যাকা-ের প্রতিক্রিয়ায় গৃহযুদ্ধ (লিবারেটর্স সিভিল ওয়ার) বেধে যায় এবং রোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সূচনা পর্ব শুরু হয়।  

হত্যাকা-ের পটভূমি
জীবনীকাররা বলছেন যে, সিজার ও সিনেটের মধ্যে বিরোধ এবং তার রাজা খেতাব গ্রহণের সম্ভাবনায় তাদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। এসব ঘটনা সিজার হত্যাকা-ের মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। সিনেট সিজারকে ডিক্টেটর পারপিটউ (আজীবন ডিক্টেটর) হিসেবে নিয়োগ দেয়। রোমান টাকশাল একপিঠে রাজা খেতাব ও সিজারের প্রতিকৃতি এবং অন্যপিঠে গ্রীক কৃষি দেবী সিরিজের প্রতিকৃতি এবং সিজারের অগার পন্টিফেক্স ম্যাক্সিমাস খেতাব খোদাই করে রৌপ্যমুদ্রা চালু করে। ২ শো বছর পর গ্রীক বংশোদ্ভূত রোমান ঐতিহাসিক ক্যাসিয়াস ডিওর লেখা ইতিহাসে বলা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সালে সিনেটের একটি প্রতিনিধি দল সিজারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং তাকে নয়া খেতাব প্রদানের সুসংবাদ দেয়। সিজার দেবী ভেনাসের মন্দিরে উপবিষ্ট অবস্থায় তাদের অভ্যর্থনা জানান। কিন্তু তিনি তাদের সম্মান দেখানোর জন্য ওঠে দাঁড়াননি। প্রায় দেড় শো বছর পর আরেক রোমান ঐতিহাসিক সিউটোনিয়াসের লেখা ইতিহাসে বলা হয়, ইহুদি ধনকুবের কর্নেলিয়াস বালবাস বাধা দেয়ায় সিজার ওঠে দাঁড়াননি। সিউটোনিয়াস বলেন, রোমে ফিরে এলে সিজারকে অভ্যর্থনা জানাতে একদল লোক সমবেত হয়। জনতা বেদীতে সিজারের মূর্তিতে ফুলের তোড়া অর্পণ করে। বৃহস্পতি দেবীর প্রতীক ও পূজার অর্ঘ হওয়ায় ট্রিবিউন (নির্বাচিত রোমান কর্মকর্তা) গিজ এপিডাস মারুলাস ও লুসিয়াস ক্যাসিটিয়াস ফ্লাভাস ফুলের তোড়া অপসারণে জনতাকে নির্দেশ দেন। একদল লোক রোমের রাজপথে সিজারের উদ্দেশে ‘রেক্স’ (রাজা) বলে জয়ধ্বনি দেয়। জবাবে সিজার বলেন, আমি সিজার, রেক্স নই (ইগো সিজার, নন রেক্স)। রেক্স ধ্বনি দেয়ায় এ দুজন ট্রিবিউইন সংশ্লিষ্ট লোকদের গ্রেফতার করেন। সমর্থকদের প্রতি হুমকি সৃষ্টি হওয়ায় সিজার কঠোর পদক্ষেপ নেন। তিনি  নিজস্ব ক্ষমতার জোরে এ দুজন ট্রিবিউনকে অপসারণ করেন। তারপর থেকে সিজার রাজকীয় খেতাব পরিত্যাগ করেননি। ঐতিহ্যবাহী লিউপারকালিয়া উৎসবে বেদিতে ভাষণ দানকালে মার্ক এন্টনি কয়েকবার তার মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। সিজার  দেবতা জুপিটার অপটিমাস ম্যাক্সিমাসের উদ্দেশে উৎসর্গ করার জন্য রাজমুুকুট প্রত্যাখ্যান করেন। ঐতিহাসিক প্লুটার্ক ও সিউটোনিয়াস ঘটনার অভিন্ন বর্ণনা দিয়েছেন। তবে ঐতিহাসিক ডিও এসব উপাখ্যান সমন্বয় করে লিখেছেন, সিজারের মূর্তিতে ফুলের তোড়া অর্পণ করায় এবং মাথায় মুকুট পরিয়ে দেয়ায় ট্রিবিউনরা নাগরিকদের গ্রেফতার করেন। অতঃপর সিজার জনতাকে আলবান পাহাড়ের শীর্ষে ওঠে ‘রেক্স’ ধ্বনি দেয়ার জন্য পাঠান। এ সময় ট্রিবিউনরা সংশ্লিষ্ট নাগরিকদের গ্রেফতার করেন। সিজারকে অবাধে কথা বলার সুযোগ না দেয়ায় নিন্মশ্রেণির লোকেরা প্রতিবাদ করে। সিজার ট্রিবিউনদের সিনেটের সামনে হাজির করেন এবং বিষয়টি ভোটাভুটিতে দেন। তিনি তাদের বরখাস্ত করেন এবং রেকর্ড থেকে তাদের নাম কেটে দেন। সিউটোনিয়াস আরো বলেন, লুসাস কোট্টা সিজারকে ‘রাজা’ খেতাব প্রদানে সিনেটের কাছে প্রস্তাব করেন। কেননা ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল যে, কেবলমাত্র একজন রাজা পার্থিয়া জয় করবেন। সিজার পার্থিয়ায় অভিযান চালাতে আগ্রহী ছিলেন। এ অভিযান দ্বিতীয় ট্রায়াম্ভিরেটের আমলে মার্ক এন্টনির জন্য উল্লেখযোগ্য বিড়ম্বনা বয়ে আনে। সিজারের খেতাব ও উপাধিগুলো ছিল সম্মানসূচক। তাই তিনি আরো ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করছিলেন। মূল ক্ষমতা সিনেটের হাতে ন্যস্ত থাকায় সিজারের সঙ্গে তাদের বিরোধ দেখা দেয়। ব্রুটাস তার বন্ধু এবং ভগ্নিপতি গিজ ক্যাসিয়াস লংগিনাসকে নিয়ে চক্রান্ত পাকাতে থাকেন। তারা নিজেদেরকে লিবারেটর (মুক্তিদাতা) হিসেবে দাবি করেন। 
    বহু পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করা হয়। চক্রান্তকারীরা কখনো প্রকাশ্যে মিলিত হয়নি। তবে তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ বাড়িতে কয়েকজন করে মিলিত হতেন। কিভাবে পরিকল্পনা কার্যকর করা হবে তা নিয়ে বহু আলোচনা হতো। বহু প্রস্তাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হতো। কেউ কেউ পূণ্য শোভাযাত্রায় তাদের পরিকল্পনা কার্যকর করার প্রস্তাব দেয়। সিজার পূণ্য শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতেন। নির্বাচনী অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা কার্যকর করার আরেকটি প্রস্তাব ছিল। ক্যাম্পাস মার্টিনাসে ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়োগদানে সিজারকে একটি সেতু অতিক্রম করতে হতো। প্রস্তাব করা হয় যে, সেতু অতিক্রমকালে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হবে এবং অন্যরা ছুটে গিয়ে তাকে হত্যা করবে। 
   তৃতীয় পরিকল্পনা ছিল আসন্ন দ্বন্দ্বযুদ্ধের প্রদর্শনীর জন্য অপেক্ষা করা। এ প্রদর্শনীতে পরিকল্পনা কার্যকরের সুবিধা ছিল যে, অস্ত্র বহন করা হলে কারো সন্দেহ হবে না। অধিকাংশ চক্রান্তকারী সিনেটের সভাগৃহে উপবিষ্ট অবস্থায় তাকে হত্যার পক্ষে মতামত দেয়। সিজার সেখানে উপস্থিত থাকবেন। কেননা সিনেটর ছাড়া সিনেট ভবনে অন্য কারো প্রবেশের অনুমতি ছিল না। চক্রান্তকারীরা তাদের আলখেল্লার নিচে তাদের ছোরা লুকিয়ে রাখার সুযোগ পাবেন। সেদিন এ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। নিকোলাস লিখেছেন, হত্যাকা-ের পূর্ববর্তী দিনগুলোতে সিজারকে ডাক্তার, বন্ধুবান্ধব এবং এমনকি তার স্ত্রী কালপুর্নিয়া আইডিস শোভাযাত্রায় যোগদানে নিষেধ করেন। কোনো কোনো প্রাচীন সূত্রে বলা হয়, কালপুর্নিয়া তার স্বামী হত্যাকা-ের পূর্বাভাস পেয়েছিলেন এবং তাকে সতর্ক করে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। প্রিটর (নির্বাচিত ম্যাজিস্ট্রেট) ডিসিমাস জুনিয়াস ব্রুটাস আলবিনাস চক্রান্তে জড়িত একথা না জেনে তিনি তাকে সিনেটকে একথা অবহিত করতে অনুরোধ করেন যে, সিজার অসুস্থ এবং তিনি সিনেট অধিবেশনে যোগদানে সক্ষম নন। কিন্তু সিজার এ পরিকল্পনা নাকচ করে দেন এবং ব্রুটাস তাকে প্রহরা দিয়ে শত্রুর হাতে তুলে দেন। কালপুর্নিয়া দুঃস্বপ্ন দেখেন। তিনি অস্থির হয়ে বলে উঠেন, ‘কী ভীষণ দুঃস্বপ্ন দেখলাম! প্রহরী দেখেছে আরো ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। সে দেখেছে, এক সিংহী পথে সন্তান প্রসব করেছে। কবর থেকে লাশগুলো বের হয়ে আসছে। মেঘরাশির মধ্যে দুর্দান্ত অগ্নিময় সৈন্যরা যুদ্ধ করছে। একজন ক্রীতদাস অগ্নিবান নিক্ষেপ করছে। সভাগৃহে রক্তবৃষ্টি হচ্ছে। আগুন নিভে গেলে দেখা যায় লোকটি অক্ষত। যুদ্ধের কোলাহল, অশ্বের হ্রেষাধ্বনি, মুমূর্ষু মানুষের আর্তনাদ ও ভূত প্রেতের তীব্র চিৎকারে সপ্ত নভোম-ল কেঁপে উঠছে। সিজার এসব দৃশ্য অদৃষ্টপূর্ব, অশ্রুতপূর্ব। তাই আমি ভয় পাচ্ছি।’
     সিজার মাথা নেড়ে বললেন, আমকে যেতেই হবে। কালপুর্নিয়া  ব্যাকুলকন্ঠে বলেন, আমি স্বপ্নে দেখেছি, উল্কাপি- জ্বালিয়ে দেবতারা রাজ মৃত্যুর কথা ঘোষণা করছেন। সিজার বললেন, মৃত্যুর আগে কাপুরুষ বহুবার মৃত্যুবরণ করে। বীরের মৃত্যু জীবনে একবার। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। তাই মৃত্যুকে ভয় পেয়ে লাভ নেই। এসব বাজে কথা আমার জন্য নয়। অন্যদিকে সিজারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচিত অন্যতম চক্রান্তকারী ডিসিমাস ব্রুটাস এসে সিজারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেন, ‘একি বলছো সিজার? সিনেট তোমাকে সম্মানিত করেছে এবং বিশেষভাবে তোমাকে তলব করেছে। অতএব সিনেটের তলবে সাড়া না দেয়া অসম্মান নয় কি? একজন মহিলার দুঃস্বপ্ন এবং নির্বোধ লোকদের গালগল্পে কান দেয়ার কোনো মানে আছে? তার চেয়ে বরং যা বলি শোন। বাজে কথা বাদ দাও। আমার সঙ্গে এসো। সিনেট অধিবেশন শুরু হয়েছে এবং সকাল থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।’  
   ডিসিমাস ব্রুটাসের কথা শুনে সিজারের মন গলে যায় এবং তিনি বাড়ি থেকে রওনা হন। তিনি পার্থিয়া আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মার্চের মাঝামাঝি তিনি মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশে যাত্রার পরিকল্পনা করছিলেন। চক্রান্তকারীরা তাদের চক্রান্ত বাস্তবায়নে সময় পেয়ে যায়। হত্যাকা-ের দুদিন আগে গিজ ক্যাসিয়াস লংগিনাস চক্রান্তকারীদের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাদের জানান যে, কেউ তাদের পরিকল্পনা ফাঁস করে দিলে তাকেও হত্যা করা হবে। সিজারের উত্তরসূরিরা পার্থিয়া ও জার্মানিয়া বিজয়ের চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের অভিযান সফল হয়নি।  

আইডিস শোভাযাত্রা 
খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সালের ১৫ মার্চ আইডিস শোভাযাত্রার দিন চক্রান্তকারীরা পোম্পে নাট্যমঞ্চে মল্লযুদ্ধের আয়োজন করে। আইডিস শোভাযাত্রার দিন ছিল রোমানদের ঋণ পরিশোধের শেষ দিন। সেদিন ক্যাপিটোলিন নেকড়ের সম্মানে লিউপারকালিয়া উৎসব পালন করা হতো। এ নেকড়ে রোম শহর ও রোমান প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা শিশু রোমুলাস ও রেমোসকে দুধ খাওয়াতো। ডিসিমাস ব্রুটাস মল্লযোদ্ধাদের পাঠান। তারা পোম্পে নাট্যমঞ্চের বিশাল হলে অপেক্ষা করতে থাকেন। পূর্ববর্তী দিনগুলোতে সিজার বিলম্বে হুঁশিয়ারি লাভ করেন। তাকে নিয়ে আসার জন্য ডিসিমাস ব্রুটাসকে পাঠানো হয়। ডিসিমাস ব্রুটাস তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করান। একরাত আগে মার্ক এন্টনি পাবলিয়াস সার্ভিলিয়াস কাস্কা লংগাসের (কাস্কা) কাছ থেকে অস্পষ্টভাবে এ চক্রান্তের কথা জানতে পারেন এবং অশুভ পরিণতির আশঙ্কা করে সিজারকে ফিরিয়ে রাখার জন্য তার কাছে যান। চক্রান্তকারীরা অনুমান করেছিল যে, মার্ক এন্টনি সিজারের সহায়তায় এগিয়ে আসবেন। তাই ঠিক করা হয় যে, এন্টনি অধিবেশনস্থল পোম্পে নাট্যমঞ্চের বারান্দায় এগিয়ে আসা মাত্র গিস ট্রিবনিয়াস তাকে বাধা দেবেন। সিসেরো ব্যক্তিগতভাবে এ চক্রান্তে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তবে পরবর্তীতে তিনি দাবি করেন যে, এন্টনির কার্যকলাপ সিজারের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। প্রাথমিকভাবে চক্রান্তকারীরা শুধু সিজার নয়, মার্ক এন্টনিসহ তার বহু সমর্থককে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু ব্রুটাস এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং সিজারের মধ্যে চক্রান্ত সীমাবদ্ধ রাখেন। সিজারের সঙ্গে এন্টনির যোগদানের কথা ছিল। কিন্তু অন্যতম চক্রান্তকারী ট্রিবনিয়াস পথে ওঁৎ পেতে থাকেন এবং তাকে সিনেটে প্রবেশে বাধা দেন।  

হত্যাকা-
খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সালের ১৫ মার্চ স্ত্রী কালপুর্নিয়ার বাধা উপেক্ষা করে সিজার বাইরে বের হন। রোমের রাস্তায় জনতার ভিড়। রোমের সভাগৃহে চাপা উত্তেজনা। সিজার সভাগৃহে প্রবেশ করেন। সঙ্গে ব্রুটাস, গিস ক্যাসিয়াস, গিস সার্ভিলাস কাস্কা ও ল্যাপিডাসসহ আরো অনেকে। সিজার আসন গ্রহণ করেন। তারপর সামান্য কথাবার্তা। কথা কাটাকাটি। ঠিক তখন লুসিয়াস টিলিয়াস সিম্বার সিম্বার তার নির্বাসিত ভাই পাবলিয়াসকে ফিরিয়ে আনার অনুমতি চেয়ে তার কাছে একটি আবেদন পেশ করেন। বাদবাকি চক্রান্তকারীরা একইভাবে সিজারের কাছে দরখাস্ত পেশ করার ভান করেন। সিজার সিম্বারকে দূরে ঠেলে দেন। কিন্তু সিম্বার সিজারের কাঁধ চেপে ধরেন এবং তার আলখাল্লা কেড়ে নেন। সিজার তাকে বলেন, ‘এমন আচরণ করছো কেন? এটা তো সহিংসতা (ইস্তা কুইডেম ভিস ইস্ত।) পাবলিয়াস সার্ভিলিয়াস ক্যাসকেল লংগাস (কাস্কা) প্রথম সিজারকে আঘাত করেন। কাস্কা ছোরা বের করেন এবং পেছন থেকে সিজারের গ্রীবাদেশে আঘাত করেন। সিজার দ্রুত ঘাড় ফিরিয়ে নেন এবং কাস্কার হাত ধরে ফেলেন। ঐতিহাসিক প্লুটার্কের মতে, সিজার ল্যাটিন ভাষায় বলেছিলেন, কাস্কা তুমি হলে খলনায়ক। তুমি একি করছো? ভীতসন্ত্রস্ত কাস্কা গ্রীক ভাষায় চিৎকার করে বলেন, ‘সাহায্য করছি ভাই।’ চক্রান্তকারীরা এমনভাবে আক্রমণ চালাতে থাকেন যে, তারা একে অন্যকে আঘাত করতে থাকেন। মুহূর্তের মধ্যে ব্রুটাসসহ গোটা গ্রুপ সিজারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ব্রুটাস হাতে ও পায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হন।  সিজার দূরে সরে যাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু চোখ রক্তাক্ত হয়ে যাওয়ায় হোঁচট খেয়ে পড়ে যান। সিজার বারান্দার সিঁড়িতে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকলে ঘাতকরা তাকে অব্যাহতভাবে আঘাত করতে থাকে। রোমান ঐতিহাসিক ইউট্রোপিয়াসের মতে, ৬০ অথবা তার চেয়ে বেশি লোক হত্যাকা-ে অংশগ্রহণ করে। সিজারকে ২৩ বার ছুরিকাঘাত করা হয়। সিউটোনিয়াস উল্লেখ করেন যে, সিজারের ময়না তদন্তে সংশ্লিষ্ট একজন চিকিৎসক নিশ্চিত করেন যে, একটি মাত্র  আঘাত ছিল গুরুতর। ময়না তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়, ছুরিকাঘাতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সিজারের মৃত্যু হয়। পোম্পে নাট্যমঞ্চের সভাকক্ষে সিজারকে হত্যা করা হয়। গবেষক ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে সিজারের শেষ কথা নিয়ে বিতর্ক আছে। সিউটোনিয়াস বলছেন, তিনি কোনো কিছু বলেননি। তবে অন্যরা উল্লেখ করেছেন যে, গ্রীক ভাষায় সিজারের শেষ শব্দ ছিল কাই, সিউ, টেকনোন? (তোমরা কি শিশু?) প্লুটার্ক উল্লেখ করছেন, সিজার কোনো কিছু বলেননি। চক্রান্তকারীদের মধ্যে ব্রুটাসকে দেখে তিনি আলখাল্লা দিয়ে মাথা ঢেকে ফেলেন। জীবনের প্রতি তিনি অনুরাগ হারিয়ে ফেলেন। বুঝতে পারেন যে, জীবন বড় কুৎসিত, জীবন বড় কুটিল। তিনি ল্যাটিন ভাষায় ব্রুটাসকে দেখে বলে উঠেন, ইট টু, ব্রুটি? (ব্রুটাস তুমিও?)। এ বাক্যটি উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটক থেকে নেয়া হয়েছে। মুখ থেকে এ কথা বের হওয়ার পর সিজার পড়ে যান। তবে কথাটির ঐতিহাসিক কোনো ভিত্তি নেই। শেক্সপিয়র সমকালীন সময়ে ব্যবহৃত এ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেন। ঐতিহাসিক প্লুটার্কের মতে, হত্যাকা-ের পর ব্রুটাস চক্রান্ত বহির্ভূত সিনেটরদের যেন কিছু বলতে সামনে এগিয়ে যান। ব্রুটাস বেঁচে থাকেন ইতিহাসে অবিশ্বাস আর প্রহেলিকার প্রতীক হিসেবে। 
   সিনেটররা সভাগ্রহ থেকে পালিয়ে যান। তারপর ব্রুটাস ও তার সঙ্গীরা তাদের প্রিয় শহরের জন্য কাঁদতে কাঁদতে জুপিটারের মন্দিরের দিকে যান। উচ্চৈঃস্বরে বললেন, ‘হে রোমবাসী, আমরা পুনরায় মুক্ত হলাম।’ সর্বত্র নীরবতা বিরাজ করছিল। কেননা গুজব ছড়িয়ে পড়া মাত্র রোমবাসীরা নিজ নিজ গৃহে আশ্রয় নেয়। সিউটোনিয়াসের মতে, সব চক্রান্তকারী পালিয়ে যান এবং সিজার কিছু সময়ের জন্য সেখানে প্রাণহীন অবস্থায় পড়ে থাকেন। অবশেষে তিনজন সাধারণ ক্রীতদাস তাকে ডুলিতে তুলে এবং তাকে বাড়িতে বহন করে নিয়ে যায়। এ সময় সিজারের একটি হাত ঝুলছিল। ২৩টি ছুরিকাঘাত চিহ্নিত করে ফোরামে সিজারের মোমের একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। সমবেত জনতা অগ্নিসংযোগ করে। আগুনে নিকটবর্তী কয়েকটি ভবন মারাত্মকভাবে ভস্মীভূত হয়। পরবর্তী বছরগুলোয় লিবারেটর্স সিভিল ওয়ারে রোমান প্রজাতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং রোমান সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে। 

ক্লিওপেট্রার প্রতিক্রিয়া
টাইবার নদীর তীরে সাইপ্রাস বৃক্ষে ঘেরা প্রাসাদ অলিন্দে ক্লিওপেট্রা অবস্থান করছিলেন। ভাবছিলেন, পাশে সিজার, কোলে তারই সন্তান। সিজারের সাম্রাজ্য বিশাল। সিজার হবেন সম্রাট। তিনি হবেন সম্রাজ্ঞী, রোমের অধীশ্বরী। উত্তেজনায় শিহরিত হয়ে উঠেন তিনি। ঠিক তখন খবর পান সিজার নেই। আর্তনাদ করে উঠেন ক্লিওপেট্রা। পুত্র সিজারিয়ানকে বুকে চেপে ধরেন। তার লালিত স্বপ্ন নিভে যায়। বাকি জীবন তাকে অন্ধকারে হাতড়ে মরতে হবে। শিউরে উঠেন ক্লিওপেট্রা। আতঙ্কে তার চোখের পানি শুকিয়ে যায়। মনে দুশ্চিন্তার কালোমেঘ ছায়া ফেলে। তাকে বাঁচতে হবে। বাঁচাতে হবে তার সন্তান সিজারিয়ানকে। পুত্র সিজারিয়ানকে সিজারের উত্তরাধিকারী হিসেবে নিয়োগদানের ব্যর্থ আশায় এপ্রিলের মাঝামাঝি নাগাদ তিনি রোমে অবস্থান করেন। কিন্তু সিজারের উইলে প্রপৌত্র অক্টাভিয়ানকে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করা হয়। এপ্রিলের মাঝামাঝি অক্টাভিয়ান ইতালিতে এসে পৌঁছান। একই সময় ক্লিওপেট্রা মিসরের উদ্দেশে রওনা দেন। 
    সিজারের রক্ষিতার জন্য রোমের প্রজাদের কোনো দরদ ছিল না। তাই ক্লিওপেট্রা পালানোর সিদ্ধান্ত নেন। নাটকের প্রথম অঙ্কের শুরু হয় মাত্র। তার বয়স তখন ২৬ বছর। তাকে বহুদূর যেতে হবে। কিছুদিনের মধ্যে ক্লিওপেট্রা রোম থেকে পালান। তিনি সিজারের ধর্মপত্মী ছিলেন না। তাই তার কোনো বৈধ অধিকার ছিল না। সিজারের প্রসারিত দুই বাহুতে তিনি তার শয্যা বিছিয়েছিলেন। সিজারের খাতিরে রোমের নামী দামী লোকেরা প্রাসাদে তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতেন। সম্মান করতেন। তবে তাদের কেউ সিজারের হৃদয়রানীকে রাজ্যের রানী হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। সিনেটর সিসেরো তাকে একদম দেখতে পারতেন না। ঘৃণা করতেন। আলেক্সান্ড্রিয়া থেকে কিছু মূল্যবান বই এনে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়ায় সিসেরো তাকে বেশি কিছু বলেননি। সিজার ভেনাস জেনিট্রিক্সের মন্দিরে ক্লিওপেট্রার স্বর্ণমূর্তি নির্মাণ করে তার প্রতি বিশেষ অনুরাগ প্রদর্শন করেন। সিজার তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেয়া ছাড়া তার জন্য সবই করেছিলেন। প্রজারা বিদ্রুপ করতো। বলতো, বুড়ো বয়সে সিজারকে ভিমরতিতে ধরেছে। তিনি নিজেকে একজন রক্ষিতার পায়ে বিলিয়ে দিচ্ছেন। এছাড়া সিজারই কি-ই বা করতে পারতেন। 
     ক্লিওপেট্রা কুমারী ছিলেন না। শাস্ত্রমতে তিনি ছিলেন সধবা। স্বামী চতুর্দশ টলেমি তার আশপাশে ঘুর ঘুর করতেন। ক্লিওপেট্রার সঙ্গে তার বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটেনি। যেমনি ঘটেনি কালপুর্নিয়ার সঙ্গে সিজারের বিয়ে বিচ্ছেদ। সিজার আরো কিছুদিন বেঁচে থাকলে ক্লিওপেট্রার বৃহস্পতি তুঙ্গে উঠতো। সিংহাসনে বসলে সিজার হতেন অর্ধেক পৃথিবীর সম্রাট। পাশে থাকতেন সম্রাজ্ঞী     ক্লিওপেট্রা। চতুর্দশ টলেমিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে সিজারের বেশি দিন লাগতো না। ক্লিওপেট্রা সৌভাগ্যের সিংহদ্বার থেকে ফিরে আসেন। তবু তাকে বেঁচে থাকতে হবে। একদিন তিনি সিজার ও রোমের স্মৃতিকে শেষ বিদায় জানান। একটি লম্বা নৌকা টাইবার নদীর ঢেউ ভেঙ্গে ছুটে যায়। নৌকাটি ওস্টিয়ায় পৌঁছে। সেখানে তিন সারি দাঁড়ের একটি নৌকা অপেক্ষা করছিল। ক্লিওপেট্রা এ নৌকায় আরোহণ করেন। তার গন্তব্য ছিল মিসর। মিসরে ফিরে আসেন ক্লিওপেট্রা। কিন্তু তার মন পড়ে থাকে রোমে। তিনি রোমের রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতি লক্ষ্য রাখছিলেন। 

               
অস্বাভাবিক ঘটনাবলী  
ল্যাটিন কবি ভার্জিল ‘জর্জিক্স’-এ (কবিতা) লিখেন, সিজারের হত্যাকা-ের পর কয়েকটি অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে। জার্মানি নভোম-লে লড়াইয়ের কোলাহল শুনতে পায়। ভূমিকম্পে আল্পস কেঁপে ওঠে। নিস্তদ্ধ গোরস্তানে উত্থিত একটি কানফাটা শব্দ সবাই শুনতে পায়। অদৃষ্টপূর্ব ছায়ামূর্তিগুলোকে অন্ধকারে পতিত হতে দেখা যায়। পৃথিবী মুখ ব্যাদান করে পড়ে থাকে। পশুগুলো মানুষের ভাষায় কথা বলে। মন্দিরে রক্ষিত মূর্তিগুলো বেদনায় কেঁদে ওঠে। বিন্দু বিন্দু ঘামে রৌপ্যনির্মিত মূর্তিগুলো ঢাকা পড়ে। সমুদ্রের রাজা ভয়ঙ্কর গতিতে বনভূমি ভাসিয়ে দেয় এবং গবাদি পশু ও চালা ঘরগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যায়। নির্মেঘ আকাশ থেকে বজ্রপাত হয়। উজ্জ্বল রংয়ের ধূমকেতু দৃশ্যমান হয়।

প্রতিক্রিয়া  
সিজারের হত্যাকা-ে গোটা রোম কেঁপে ওঠে। দ্রুত উল্লাস মিলিয়ে যায়। শেক্সপিয়র রচিত ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকে প্রতিক্রিয়ার একটি চিত্র অঙ্কন করা হয়। এতে দেখা যায়, হট্টগোলের মধ্যে ক্যাসিয়াস এন্টনিকে দেখতে না পেয়ে একবার চেঁচিয়ে উঠছিলেন, এন্টনিকে তো দেখতে পাচ্ছি না? তাদের বেশিক্ষণ চিন্তা করতে হয়নি। কিছুক্ষণ পর ক্যাসিয়াস ও ব্রুটাস উভয়ে এন্টনিকে দেখতে পান। এন্টনি ফিরে আসেন। খুব শান্তভাবে তিনি তাদের পাশে দাঁড়ান। ব্রুটাস ও তার বন্ধুরা এন্টনির প্রতি তীক্ষè দৃষ্টি রাখছিলেন। মনে হলো তাকে নিয়ে তাদের ভয় নেই। সিজার হত্যাকা-ে তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। প্রথমে একটু ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এন্টনি সম্পর্কে ব্রুটাস সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হন। সিজারের লাশ দেখে এন্টনি অভিভূত হয়েছিলেন। ভীতসন্ত্রস্ত জনতার উদ্দেশে ব্রুটাস বলেন, আমি সিজারকে কম ভালোবাসিনি। তবে রোমকে আমি বেশি ভালোবাসতাম। তোমরা কি চাও সিজার বেঁচে থাকুক আর আমরা সবাই তার দাসত্ব করি? নাকি সিজারের পতন ঘটুক আর আমরা সকলে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকি? সিজার আমাকে ভালোবাসতেন। তাই আমার চোখে পানি। তিনি ভাগ্যবান। আমি তাই আনন্দিত। তিনি বীর ছিলেন। আমি তাকে সম্মান করি। কিন্তু তিনি ছিলেন উচ্চাকাঙ্খী। তাই তাকে হত্যা করেছি। There is tears for his love;  joy for his fortune; honour for his valour and death for his ambition জনতা জয়ধ্বনি দেয়, ব্রুটাস দীর্ঘজীবী হোক।  
   পোম্পের নির্বাক পাথরের মূর্তির পাশে সিজার শেষ শয্যার আয়োজন করা হয়। জনসাধারণ ও সিনেটরদের উদ্দেশে ব্রুটাস বললেন, আর কোনো ভয় নেই। শান্ত হও। আকাশচুম্বী অপরাধের প্রতিশোধ নেয়া হয়েছে। সহকর্মীর ধ্বনি দেয়, অত্যাচারী নিপাত গেছে। এখন আমরা স্বাধীন, আমরা মুক্ত। ক্যাসিয়াস হঠাৎ বলে উঠেন, এন্টনি কোথায় গেল? সে তো আমাদের সঙ্গেই এখানে এসেছিল। ব্রুটাস সিজারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় এন্টনিকে বক্তব্য রাখার অনুমতি দেন। তবে শর্ত দেন যে, সিজার হত্যাকা-ের জন্য তিনি তাদের অভিযুক্ত করবেন না। এন্টনি তার পুরো বক্তৃতায় হত্যাকারীদের ‘সম্মানিত ব্যক্তি’ হিসেবে সম্বোধন করেন। কৌশলে তিনি বক্তব্য রাখতে শুরু করেন। তার বক্তব্য শেষ হলে জনতা সিজারের হত্যাকারীদের প্রতি ক্ষেপে যায়। জনতার মুখোমুখি দাঁড়ান এন্টনি। সামনে সিজারের রক্তমাখা লাশ। এন্টনি বিষণœ, গম্ভীর। জনতাকে সম্বোধন করে বললেন: Friends, Romans, Countrymen, lend me your ears রোমান বন্ধুরা, আমার প্রিয় দেশবাসী, ব্রুটাস অনুমতি দেয়ায় আমি তোমাদের উদ্দেশে কয়েকটি কথা বলতে চাই। আমি সিজারকে সমাহিত করতে এসেছি, তার প্রশংসা করতে নয়। সিজার ছিলেন আমার বিশ্বস্ত বন্ধু। ব্রুটাস দাবি করছেন, তিনি নাকি উচ্চাকাঙ্খী ছিলেন। কিন্তু মনে রেখো, পরাজিত বন্দিদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করে তিনি রোমের ভা-ার সমৃদ্ধ করেছিলেন। দরিদ্রদের দুঃখে কেঁদেছেন। সবাই দেখেছে লিউপারকালিয়া উৎসবের দিন আমি সিজারকে তিনবার রাজমুকুট পরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তিনবারই তিনি মুকুট প্রত্যাখ্যান করেছেন। এন্টনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তিনি জনতাকে ধৈর্য ধারণ করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, যেসব সম্মানিত লোক ছুরিকাঘাত করে সিজারকে হত্যা করেছেন, তিনি উইল পাঠ করলে তারা ভুল প্রমাণিত হবেন। জনতা উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং চক্রান্তকারীদের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং উইল পাঠ করার জন্য এন্টনিকে অনুরোধ করে। কিন্তু তিনি তৎক্ষণাৎ উইল পাঠের পরিবর্তে সিজারের রক্তাক্ত লাশের প্রতি মনোযোগ দেয়ার জন্য জনতার প্রতি আহ্বান জানান। এন্টনি সিজারের ক্ষতের প্রতি ইঙ্গিত করেন এবং সিজারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার ওপর জোর দেন। তিনি অস্বীকার করেন যে, তিনি তাদের উত্তেজিত করতে চাচ্ছেন না। তিনি বলেন, ব্রুটাস তার বাগ্মিতার জোরে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তিনি আরো বলেন, তিনি ব্রুটাসের মতো বাগ্মি হলে সিজারের প্রতিটি ক্ষতের জবাব দিতে পারতেন।এন্টনি সিজারের রক্তমাখা জামা দেখিয়ে বলেন: Look! In this place ran Cassius dagger through.  See what a rent the envious Casca made through this the well-beloved Brutas stabbed.ক্যাসিয়াস আঘাত করেছেন। কাস্কাও আঘাত করেছেন। কিন্তু সবচাইতে মারাত্মক আঘাত করেছেন ব্রুটাস। দেখ, আঘাতে ক্ষতবিক্ষত সিজারের নিথর দেহ পড়ে আছে। জনতা চিৎকার করে ওঠে: Most noble Caeser. We’ll revenge his death.মহান সিজারের মৃত্যুর প্রতিশোধ চাই। সবশেষে এন্টনি জনতার সামনে সিজারের উইল প্রকাশ করেন। তার ভাষণ শেষ হলে জনতা দাঙ্গায় লিপ্ত হয় এবং চক্রান্তকারীদের হত্যার জন্য তাদের বাড়িতে ছুটে যায়। জনমত চক্রান্তকারীদের বিপক্ষে ধাবিত হয় এবং মার্ক এন্টনি ক্ষমতা দখল করেন।  

দ্বিতীয় ট্রায়াম্ভিরেটের যাত্রা শুরু
সিজার হত্যাকা-ের পর মার্ক এন্টনি সিনেট অধিবেশন তলব করেন এবং একটি আপোস ফর্মূলা বের করতে সক্ষম হন। এতে অপরাধের জন্য আততায়ীদের শাস্তি না দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। হত্যাকা-ের পর সিনেট আততায়ীদের ক্ষমা মঞ্জুর করে একটি আইন পাস করে। সিজারের বন্ধু ও কো-কন্স্যাল মার্ক এন্টনি সাধারণ ক্ষমার এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। গণবিক্ষোভের মুখে ব্রুটাস ও  অন্য চক্রান্তকারীরা রোম থেকে পালিয়ে যান। খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সাল থেকে ৪২ সাল পর্যন্ত ব্রুটাস ক্রীটে বসবাস করেন। সাধারণ ক্ষমার প্রস্তাবে বলা হয়, চক্রান্তকারীদের তাদের কার্যকলাপের জন্য শাস্তি দেয়া যাবে না। সিজারের সব নিয়োগ বজায় রাখা হয়। মনে হয় এন্টনি সরকারে ঐক্য বজায় রাখার জন্য এ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে একই সঙ্গে তিনি চক্রান্তকারীদের উদ্দেশ্য খর্ব করেন। আততায়ীরা তাদের কৃতকর্মের ভবিষ্যৎ অনুমান করতে পারেননি। সিজারের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রোমান প্রজাতন্ত্রের অবসান ঘটে। সিজারের সমর্থক নিন্মশ্রেণি ক্ষুদ্ধ হয় এবং এন্টনি তাদের ক্ষোভকে পুঁজি করেন। সিজার তার প্রপৌত্র গিস অক্টাভিয়াসকে তার একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। পালিত পিতার মৃত্যু সংবাদ শুনে অক্টাভিয়াস এপোলোনিয়ায় তার পড়াশোনা বাদ দেন এবং ব্রুন্ডিসিয়ামের উদ্দেশে আড্রিয়াটিক সাগর পাড়ি দেন। তিনি গিজ সিজার অক্টাভিয়ানাস (মহান সিজারের পুত্র) বা অক্টাভিয়ান নাম গ্রহণ করেন এবং উত্তরাধিকার সূত্রে রোমের অধিকাংশ নাগরিকের আনুগত্য লাভ করেন। সিজারের মৃত্যুর সময় অক্টাভিয়ানের বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর। তিনি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দেন। অন্যদিকে নয়া গৃহযুদ্ধের প্রথম পর্বে এন্টনি ডিসিমাস ব্রুটাসকে মোকাবিলা করেন। অক্টাভিয়ান তার নড়বড়ে অবস্থান সংহত করেন।
  বয়সে তরুণ ও অনভিজ্ঞ হওয়ায় প্রাথমিকভাবে এন্টনি অক্টাভিয়ানকে একটি সত্যিকার রাজনৈতিক হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেননি। কিন্তু শিগগির অক্টাভিয়ান সিজারের বন্ধু ও সমর্থকদের সমর্থন ও প্রশংসা অর্জন করেন। ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াস গ্রীসে বিশাল সৈন্যবাহিনী সমাবেশ করছিলেন। তাদেরকে মোকাবিলা করার জন্য এন্টনির সৈন্য, অর্থ এবং সিজারের নাম ব্যবহারের বৈধতার প্রয়োজন ছিলো।...... 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ফাইটার জেটের হেলমেট

বর্তমান সময়ে আধুনিক এবং নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফিচার হচ্ছে জেট ফাইটারের ককপিটে বসা এর পাইলটের হেল...