মানবতার বিরুদ্ধে এসব
অপরাধের দায় কার?
লেখকঃ সাহাদত হোসেন খান
আপনি কান পাতলে শুধু শুনবেন ‘ইসলামী জঙ্গি’, আর ‘ইসলামী জঙ্গি।’ হ্যাঁ, কিছু জঙ্গি কিছু সন্ত্রাসী তো থাকতেই পারে। কিন্তু তাদেরকে জঙ্গি বানিয়েছে কে? যাদেরকে জঙ্গি বলে সাব্যস্ত করা হচ্ছে তাদের সবাই মুসলমান। মুসলমানদের ভূখন্ড কেড়ে নিয়ে আপনি হবেন সাধু আর জুলুমের শিকার মুসলমানরা হবে জঙ্গি, সন্ত্রাসী তাই না? বিশ্বের এ অন্যায় মানি না। কয়েক বছর ধরে জঙ্গি বলতে একটি শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু তার আগে এবং পরে কারা বিশ্ববাসীর শান্তি কেড়ে নিয়েছিল? নিশ্চয়ই কথিত জঙ্গিরা নয়। এসব অপরাধীর নাম কেউ উচ্চারণ করে না। কিন্তু ইতিহাস থেকে তাদের অপরাধের চিত্র মুছে দেয়া সম্ভব নয়। ইতিহাসের পাতায় পাতায় তাদের অপরাধের স্বাক্ষর খুঁজে পাওয়া যায়। তাদের কার্যকলাপ মানবতার বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ। এসব অপরাধী হলো সাম্রাজ্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী, আধিপত্যবাদী ও কমিউনিস্ট। তাদের কেউ কথিত ইসলামী জঙ্গি নয়।
হিরোশিমায় আণবিক বোমা নিক্ষেপ
প্রথমেই সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যাক হিরোশিমায় বিশ্বের প্রথম আণবিক বোমা নিক্ষেপের উপাখ্যান নিয়ে। কে হিরোশিমায় আণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছিল, ইসলামী জঙ্গির? না, বহুল কথিত ইসলামী জঙ্গিরা নয়, আণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছিল সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা। অক্ষশক্তির গুরুত্বপূর্ণ শরীক জাপানকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে মার্কিন সামরিক বাহিনী ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোশিমায় বিশ্বের প্রথম আণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। প্রথম আণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তা বিদ্যমান থাকা অবস্থায় তিন দিন পর ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে বিশ্বের দ্বিতীয় আণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়। জাপানে আণবিক বোমা নিক্ষেপের আগে বিশ্বে আর কখনো, কোথাও এ বিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সাড়ে তিন বছরে প্রায় ৩ লাখ লোক নিহত হয়। অর্ধেক লোক নিহত হয় জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে। ধ্বংস এবং আরো ধ্বংসের ভীতি সৃষ্টি করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্রুত নিষ্পত্তি টানাই ছিল আণবিক বোমা নিক্ষেপে নির্দেশ দানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যানের আনুষ্ঠানিক যুক্তি। আণবিক বোমা নিক্ষেপে তাৎক্ষণিক নিহত হয় এক লাখ ২০ হাজার লোক এবং পরে প্রাণ হারায় তার দ্বিগুণ। আণবিক বোমা নিক্ষেপের পর ১৫ আগস্ট জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করে। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা নিক্ষেপের ঘটনা এ বোমা ব্যবহারে ইতিহাসের প্রথম ও একমাত্র ঘটনা। প্রতি বছর ৬ আগস্ট হিরোশিমা এবং ৯ আগস্ট নাগাসাকি দিবস পালিত হয়। ৬ আগস্ট সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে হিরোশিমায় পৃথিবীর প্রথম আণবিক বোমা নিক্ষিপ্ত হয়। মহাপ্রলয় থেকে একটি ঘড়ি রক্ষা পায়। সে ঘড়ির কাটা চিরদিনের জন্য ৮ টা ১৫ মিনিটে এসে থেমে আছে।
নাগাসাকিতে দ্বিতীয় আণবিক বোমাবর্ষণ
১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র জাপানের নাগাসাকিতে ১৯-২৩ কিলোটন শক্তিসম্পন্ন আণবিক বোমাবর্ষণ করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দ্রুত সমাপ্তির পথে অগ্রসর হয়। আণবিক বোমা নিক্ষেপে তৎক্ষণাৎ ৭০ হাজার লোক নিহত এবং পরে বোমার প্রতিক্রিয়ায় তার চেয়ে বেশি লোকের মৃত্যু হয়। নাগাসাকি ছিল দক্ষিণাঞ্চলীয় জাপানের অন্যতম বৃহৎ সমুদ্র বন্দর। যুদ্ধকালে অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধজাহাজ, সামরিক সাজসরঞ্জাম ও অন্যান্য রণসম্ভার তৈরি হওয়ায় শহরটির সামরিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। হুঁশিয়ারি ছাড়াই নাগাসাকিতে মানববিধ্বংসী মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়। ৮ আগস্ট লিফলেট ফেলা হলেও সেগুলো ১০ আগস্টের আগে পাওয়া যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির সিদ্ধান্ত ছিল যে, আমরা জাপানিদের কোনো হুঁশিয়ারি দিতে পারি না। এ সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও রেডিও সাইপেনের মাধ্যমে জাপানকে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছিল।
জাপানি মহিলাদের গণধর্ষণ
এশিয়ায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাব তুঙ্গে থাকায় প্রথমদিকে যুদ্ধে সাফল্য অর্জন করলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে জাপান পরাজিত হয়। ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জাপান মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। যুদ্ধকালে মার্কিন সৈন্যরা জাপানে গণধর্ষণে মেতে উঠে। এত বছর পর আজো ওকিনাওয়ায় ধর্ষিতাদের আর্তচিৎকার শোনা যায়। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুদ্ধের শেষ মাসগুলোয় ওকিনাওয়া যুদ্ধ এবং জাপানে দখলদারিত্বকালে মিত্র সৈন্যরা অসংখ্য ধর্ষণে লিপ্ত হয়। ১৯৫২ সাল নাগাদ জাপানে মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত ছিল। ওকিনাওয়ায় মিত্রবাহিনী বিশেষ করে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ স্থায়ী হয়েছিল আরো দু’দশক। সানফ্রান্সিসকো চুক্তি বলবৎ হলে ১৯৫২ সালের ২৮ এপ্রিল জাপানের অধিকাংশ ভূখ- মিত্রবাহিনীর দখলমুক্ত হয়। ওকিনাওয়ায় দখলদারিত্ব শেষ হয় ১৯৭২ সালের ১৫ মে। ১৯৪৫ সালের মধ্যে মার্কিন সৈন্যরা জাপানের ভূখ-ে প্রবেশ এবং দখল করতে শুরু করে। ১৯৪৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মার্কিন সৈন্যরা আইয়োজিমায় অবতরণ করে এবং পহেলা এপ্রিল অবতরণ করে ওকিনাওয়ায়। ১৯৪৫ সালে জাপান আত্মসমর্পণ করলে মিত্রবাহিনী দেশটির মূল ভূখ-ে ঢুকে পড়ে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে জাপানে দখলদারিত্ব কায়েম করে। ২০০০ সালের পহেলা জুন ক্যালভিন সিমস নিউইয়র্ক টাইমসে ‘থ্রি ডেড মেরিন্স এন্ড অ্যা সিক্রেট অব ওয়ারটাইম ওকিনাওয়া’ শিরোনামে এক রিপোর্টে লিখেছেন: ‘এ ভয়ংকর যুদ্ধে আমেরিকান ও জাপানি উভয়ের হাতে নৃশংস দুর্ভোগ নিয়ে বহু লেখালেখি ও বিতর্ক হয়েছে। এ যুদ্ধে ২ লাখের বেশি সৈন্য ও বেসামরিক লোক নিহত হয়। নিহত বেসামরিক লোকের এক-তৃতীয়াংশ ছিল ওকিনাওয়ার।’ জাপানি রাজকীয় সৈন্যদের ধর্ষণ নিয়ে ইউকি তানাকা ‘জাপান‘স কম্ফোর্ট উইমেন: সেক্সুয়াল সেøভারি এন্ড প্রসটিটিউশন ডিউরিং ওয়ার্ল্ড ওয়ার সেকেন্ড’ শিরোনামে একটি বিখ্যাত বই লিখেছেন। তার বইয়ে উল্লেখিত ধর্ষিতাদের সংখ্যা হচ্ছে জাপানি সূত্র থেকে প্রাপ্ত।
ভিয়েতনামে সামরিক হস্তক্ষেপ
ভিয়েতনামের নাম এখন কারো মুখে উচ্চারিত না হলেও কয়েক দশক আগে বিশ্বের সব নিপীড়িত ও সংগ্রামী জনতা তাদের নামে শ্লোগান দিতো। ভিয়েতনাম সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি প্রতীকে পরিণত হয়। আজও কোথাও কোনো জাতি মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লে ভিয়েতনামের মুক্তিসংগ্রামের অবিস্মরণীয় ইতিহাস গর্বের সঙ্গে স্মরণ করে। এ আত্মবিশ্বাস জেগে ওঠে যে, মুক্তিসংগ্রাম কখনো পরাজিত হয় না। বৈদেশিক ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেই ভিয়েতনামীরা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অন্তরে শ্রদ্ধার আসনে ঠাঁই নিয়েছে। ১৯৭৩ সালে প্যারিস শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেমে গেছে, এ কথা সত্যি। কিন্তু এ যুদ্ধের স্মৃতি এখনো সাম্রাজ্যবাদীদের তাড়া করে ফিরে। কোথাও সামরিক আগ্রাসন চালাতে গেলেই ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি তাদের মনে পড়ে। ভয় পায় না জানি আরেকটি ভিয়েতনাম সৃষ্টি হয়। ভিয়েতনামীরা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, একটি জাতির সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম কখনো পাশবিক শক্তি প্রয়োগে দমন করে রাখা যায় না। প্রায় এক শো বছর দুটি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে তারা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ বন্দি মার্কিনীদের মধ্যে ছিলেন চার তারকা জেনারেলের পুত্র নেভি পাইলট আরিজোনার রিপাবলিকান সিনেটর জন ম্যাককেইন ও স্বনামধন্য মার্কিন চিত্রপরিচালক অলিভার স্টোন।
ভিয়েতনামের মাই লাইয়ে গণহত্যা
মাই লাইয়ের নাম এ প্রজন্মের অনেকেই জানে না। পৃথিবীর ইতিহাসে আজ পর্যন্ত যতগুলো গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে ভিয়েতনামের মাই লাই গণহত্যার স্থান শীর্ষে। আজকের প্রজন্ম হয়তো মাই লাইয়ের নামই জানে না। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকগুলোতে মাই লাই নামটি প্রায় সবার মুখে উচ্চারিত হতো। বিশ্ব মানবতা যে ক’টি অপরাধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে ঘৃণা করে তার মধ্যে এ গণহত্যা হচ্ছে অন্যতম। মাই লাই গণহত্যা হচ্ছে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সবচেয়ে মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি। মাই লাই ছিল একটি ক্ষুদ্র পল্লীর সাংকেতিক নাম। মার্কিন সামরিক বাহিনী চারটি ক্ষুদ্র পল্লীকে তাদের মানচিত্রে মাই লাই নামকরণ করে। চতুর্থ বা চার নম্বর মাই লাইয়ে সংঘটিত হয় গণহত্যা। ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামে সামরিক হস্তক্ষেপ করে। ভিয়েতনাম ছিল তখন দু’ভাগে বিভক্ত। একটি উত্তর এবং আরেকটি দক্ষিণ। মার্কিন সৈন্যরা অবস্থান করতো দক্ষিণ ভিয়েতনামে। শুধু উত্তর ভিয়েতনামী কমিউনিস্ট গেরিলারা নয়, দক্ষিণ ভিয়েতনামের গেরিলারাও মার্কিন সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। দক্ষিণ ভিয়েতনামী গেরিলাদের বলা হতো ‘এনএলএফ’ বা ভিয়েতকং গেরিলা। এ গেরিলাদের বিরুদ্ধে মার্কিন সৈন্যদের অপারেশনকালে ঘটে মাই লাই ট্র্যাজেডি। এতগুলো নিরস্ত্র ও নির্দোষ বেসামরিক লোক নিহত হলেও যুক্তরাষ্ট্র আজ পর্যন্ত ভিয়েতনামীদের কাছে ক্ষমা চায়নি। আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখও প্রকাশ করেনি।
ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত
ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুতা নতুন নয়। উপসাগরীয় দেশটিকে ওয়াশিংটন বরাবরই নিজের পক্ষপুটে রাখতে চেয়েছে। এ অভিসন্ধি থেকে ১৯৫৩ সালে ইরানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে ক্যু করে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। ১৯৫৩ সালে সংঘটিত ইরানের অভ্যুত্থান ‘২৮ মোরদাদ অভ্যুত্থান’ হিসেবে পরিচিত। ১৯৫৩ সালের ১৯ আগস্ট অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ড. মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তাকে অপসারণে অভ্যুত্থান ঘটানো হয় দুবার। প্রথমবার ঘটানো হয় ১৯৫৩ সালের ১৫ আগস্ট এবং দ্বিতীয় বার ১৯ আগস্ট। প্রথমবারের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে দ্বিতীয়বার উদ্যোগ নেয়া হয়। তাকে অপসারণে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যথাক্রমে ‘অপারেশন অ্যাজাক্স’ এবং ‘অপারেশন বুট’ সাংকেতিক নামে অভিযান পরিচালনা করে। আইসেনহাওয়ার প্রশাসন ‘অপারেশন অ্যাজাক্স’কে একটি সুদূরপ্রসারী সাফল্য হিসেবে দেখতে পায়। রাতারাতি সিআইএ মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রীয় অংশে পরিণত হয় এবং বিশ্বের ঘটনাবলীর গতিধারা নিয়ন্ত্রণে গোয়েন্দা তৎপরতা অত্যন্ত সহজ ও কার্যকর উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেক অ্যাংলো-আমেরিকান তেল কোম্পানির (এআইওসি) হিসাবপত্র পরীক্ষা এবং ইরানি তেল মজুদে কোম্পানির প্রবেশে শর্ত পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। এ অপরাধে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
গুয়াতেমালায় অভ্যুত্থান
পশ্চিম গোলার্ধে কমিউনিজমের প্রসার রোধে যুক্তরাষ্ট্র ল্যাটিন আমেরিকান দেশ গুয়াতেমালায় অভ্যুত্থান ঘটায়। ইতিমধ্যে কিউবায় সমাজতন্ত্র কায়েম এবং দেশটি সোভিয়েত বলয়ভুক্ত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল। ১৯৫৪ সালে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) গোপন তৎপরতায় গুয়াতেমালার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জ্যাকব আরবানেজ গুজম্যান ক্ষমতাচ্যুত হন এবং গুয়াতেমালা বিপ্লবের অবসান ঘটে। ‘অপারেশন পিবিসাকসেস’ সাংকেতিক নামে এ অপারেশনে কর্নেল কার্লোস কাস্টিলো আরমাসের সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ অভ্যুত্থান ছিল সে দেশে সংঘটিত উপর্যুপরি সামরিক অভ্যুত্থানের অন্যতম। অপারেশন পিবিসাকসেসের আগে পরিচালনা করা হয়েছিল ‘অপারেশন পিবিফরচুন।’ এ অপারেশন ব্যর্থ হওয়ার পর গ্রহণ করা হয় ‘অপারেশন পিবিসাকসেস।’ নিছক একটি সন্দেহ থেকে গুয়াতেমালার সংস্কারবাদী প্রেসিডেন্ট আরবানেজ গুজম্যানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। কমিউনিস্ট না হলেও সিআইএ সন্দেহ করতো যে, তিনি কমিউনিস্ট ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রীড়নক এবং পশ্চিম গোলার্ধে কমিউনিজম আমদানি করছেন। আরবানেজ সরকার গুয়াতেমালা শ্রমিক দলকে বৈধ রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ৫৮-আসনের সিনেটে তাদের আসন ছিল মাত্র চারটি। সোভিয়েত ইউনিয়ন অথবা কমিউনিজমের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। তার অপসারণ রোধে সোভিয়েত ইউনিয়ন কোনো উদ্যোগও নেয়নি। আমেরিকার কফি উৎপাদনকারী ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির (ইউএফসি) অবৈধ ভোগ দখল থেকে গুয়াতেমালার উর্বর ভূমি কেড়ে নেয়ায় আরবানেজকে চরম মূল্য দিতে হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে গুয়াতেমালার অধিগ্রহণকৃত এসব জমির প্রকৃত মূূল্য বাবদ এক কোটি ৫৮ লাখ ৫৪ হাজার ৮৫৯ ডলার পরিশোধে আরবানেজ সরকারের কাছে দাবি জানায়। আরবানেজ সরকার এ দাবিকে জাতীয় সার্বভৌমত্বের লংঘন হিসেবে নাকচ করে দেয়।
হাঙ্গেরীতে সোভিয়েত সামরিক অভিযান
পূর্ব ইউরোপের সাবেক কমিউনিস্ট দেশ হাঙ্গেরী সোভিয়েত ব্লকভুক্ত হলেও গণঅভ্যুত্থান নস্যাতে লাল ফৌজ দেশটিতে পর পর দুবার সামরিক অভিযান চালায়। ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরীর এ গণঅভ্যুত্থান ‘হাঙ্গেরী বিপ্লব’ নামেও পরিচিত। হাঙ্গেরী রিপাবলিক সরকার এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের চাপিয়ে দেয়া নীতিমালার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ বিপ্লব ঘটে। ১৯৫৬ সালের ২৩ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বিপ্লব স্থায়ী হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে নাৎসি বাহিনীকে বিতাড়িত এবং পূর্ব ইউরোপকে পদানত করার পর এটা ছিল সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে বৃহত্তম হুমকি। নেতৃত্বহীন অবস্থায় অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল। ব্যর্থ হলেও হাঙ্গেরীর অভ্যুত্থান ছিল অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং কয়েক দশক পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কঙ্গোর প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিস লুমুম্বা হত্যাকান্ড
মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইয়ের চক্রান্তে কঙ্গোর প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিস লুমুম্বা হত্যাকা-ের শিকার হন। লুমুম্বা সামনের দরজা দিয়ে ইতিহাসে প্রবেশ করেন। কিউবার জন্য ফিদেল ক্যাস্ট্রো, মিসরের জন্য জামাল আবদেল নাসের, ঘানার জন্য নক্রুমা, চীনের জন্য চেয়ারম্যান মাও সে তুং এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য ভøাদিমির লেনিন ছিলেন যা, কঙ্গোর জন্য লুমুম্বা ছিলেন তাই। ১৯৬১ সালের ১৭ জানুয়ারি কঙ্গোর (বর্তমান নাম ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো) গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিস ইমেরি লুমুম্বা ফায়ারিং স্কোয়াডে প্রাণ হারান। তার হত্যাকাণ্ডকে বিংশ শতাব্দীতে আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করা হয়। লুমুম্বা ১৯৬০ সালের ২৩ জুন থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮১ দিন কঙ্গোর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ঐক্যবদ্ধ কঙ্গোর সমর্থক ছিলেন এবং জাতিগত ও আঞ্চলিক ধারায় দেশ বিভক্তির বিরোধিতা করেন। দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা করতে গিয়ে তিনি দেশি ও বিদেশি চক্রান্তে প্রাণ দিয়েছেন। তার হত্যা চক্রান্তে আমেরিকার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ও ব্রিটিশ সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-৬ এবং কঙ্গোর ঔপনিবেশিক প্রভু বেলজিয়াম প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। মুভমেন্ট ন্যাশনাল কঙ্গোলিজের (এমএনসি) সম্মোহনী নেতা ও প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে লুমুম্বা ১৯৬০ সালে বেলজিয়ামের কাছ থেকে কঙ্গোর স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব দেন। কঙ্গো সংকটে এক অভ্যুত্থানে মাত্র ১২ সপ্তাহের মধ্যে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। বেলজিয়ামের সমর্থনপুষ্ট খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ কাতাঙ্গা প্রদেশের বিচ্ছিন্নতার বিরোধিতা করায় তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
কিউবায় সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন
১৯৬২ সালে কিউবায় সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়ন নিয়ে দুই পরাশক্তি পরমাণু যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল এবং ১৩ দিন পৃথিবী পরমাণু যুদ্ধের জন্য প্রহর গুনছিল। ১৯৬১ সালে কিউবায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘বে অব পিগস’ সাংকেতিক নামে একটি অভিযান এবং তুরস্ক ও ইতালিতে আমেরিকার তৈরি মাঝারি পাল্লার জুপিটার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের জবাবে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ ভবিষ্যতে যেকোনো আগ্রাসন মোকাবিলায় এ দ্বীপে পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনে কিউবার অনুরোধে একমত হন। ১৯৬২ সালের জুলাইয়ে সোভিয়েত নেতা ক্রুশ্চেভ ও কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মধ্যে একটি গোপন বৈঠকে এ বিষয়ে ঐকমত্য হয় এবং একই বছর গ্রীষ্মের শেষদিকে কিউবায় বেশ কয়েকটি পরমাণু নিক্ষেপকারী স্থাপনা তৈরির কাজ শুরু হয়।
চেকশ্লোভাকিয়ায় সামরিক অভিযান
চেকশ্লোভাকিয়া ছিল পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘনিষ্ঠ মিত্র। তাদের কৌশলগত মিত্রতায় কখনো কখনো ফাটল দেখা দেয়। এ ফাটল রোধে সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশটিতে দুবার সামরিক অভিযান চালায়। একবার ১৯৫৬ সালে এবং আবার ১৯৬৮ সালে। চেকশ্লোভাকিয়া বলতে আজ আর কোনো দেশ নেই। দেশটি শান্তিপূর্ণভাবে ১৯৯২ সালে দুটি দেশে পরিণত হয়েছে। একটি দেশের নাম চেক প্রজাতন্ত্র এবং আরেকটির নাম সোভাকিয়া। সোভিয়েত হস্তক্ষেপকালে দেশ হিসেবে সোভাকিয়ার অস্তিত্ব না থাকলেও জাতি হিসেবে সোভাকদের অস্তিত্ব ছিল। চেকশ্লোভাক সংকটের মূল নায়ক আলেক্সান্ডার ডুবেক ছিলেন সোভাক। চেকশ্লোভাকিয়া সোভিয়েত জোটভুক্ত হলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন এ দেশে ১৯৬৮ সালে সামরিক অভিযান চালিয়েছিল।
অভ্যুত্থানে চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দে নিহত
তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে কোনো না কোনো পরাশক্তির আশীর্বাদ থাকতো। পরাশক্তির সমর্থন ছাড়া কোথাও সামরিক অভ্যুত্থান ঘটার নজির নেই। ১৯৭৩ সালে চিলিতে সংঘটিত অভ্যুত্থান হচ্ছে তার দৃষ্টান্ত এবং এ অভ্যুত্থান চিলির ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। রক্ষণশীল নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেস এবং সমাজবাদী প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দের মধ্যকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংঘাত এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের নির্দেশিত অর্থনৈতিক যুদ্ধের পরিণামে সশস্ত্র বাহিনী ও জাতীয় পুলিশ আলেন্দেকে ক্ষমতাচ্যুত করে। আলেন্দে ক্ষমতাচ্যুত হলে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল অগাস্টো পিনোশে ক্ষমতা দখল করেন। সামরিক জান্তা ১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চিলি শাসন করে। ক্ষমতা দখলকারী জান্তা চিলির কংগ্রেস ভেঙ্গে দেয় এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর কঠোর নির্যাতন চালায়। আলেন্দের হাজার হাজার সমর্থককে হত্যা করা হয়। পিনোশের স্বৈরশাসনের আগে কয়েক দশক পর্যন্ত চিলিকে গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার একটি আলোকবর্তিকা হিসেবে প্রশংসা করা হতো। চিলির অভ্যন্তরে আলেন্দে সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীলরা পিনোশে সরকারের বিরুদ্ধে একটি দুর্বল প্রতিরোধ অব্যাহত রাখে। ১৯৮৮ সালে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি গণভোটে পিনোশে অপসারিত হন।
আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসন
আফগানিস্তান পৃথিবীর এক হতভাগ্য দেশ। অতীতকাল থেকে দেশটি বাইরের শক্তির লক্ষ্যবস্তু। প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশটিতে সামরিক অভিযান চালায়। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র। যেন সে দেশে পালাক্রমে বাইরের দেশের হস্তক্ষেপ চলছে। ১৯৭৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর খ্রিস্টানদের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব বড়দিনে আফগানিস্তানে সোভিয়েত সামরিক আগ্রাসন ঘটে। এ দেশটিতে যতবার বিদেশিরা আগ্রাসন চালিয়েছে ততবার আর কোনো দেশে আগ্রাসন ঘটার নজির নেই। দৃশ্যত মনে হতো আফগান মুজাহিদরা সোভিয়েত সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। কিন্তু আফগান প্রতিরোধ আন্দোলনের চালিকা শক্তি ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে পরোক্ষ লড়াইয়ে জড়িত হয়ে পড়ে। দুর্দিনে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পাশ্চাত্যের মিত্রদের কাছে আফগান মুজাহিদরা জঙ্গি, মৌলবাদী, সন্ত্রাসী অথবা গোঁড়া বলে বিবেচিত হয়নি। অনেকের চোখ কপালেও উঠলেও একথা দিবালোকের মতো সত্য যে, মুজাহিদরা হোয়াইট হাউজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হয়। সোফায় বসে তাদের খোশগল্প করার দৃশ্য এখনো ক্যামেরাবন্দি হয়ে আছে। হোয়াইট হাউজে আফগান মুজাহিদ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট রিগ্যান বলেছিলেন: ‘হাতে বহনযোগ্য অস্ত্র নিয়ে আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে আফগান মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।’
১৯৯০ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ
১৯৯০ সালে ইরাক নিকট প্রতিবেশি কুয়েত দখল করে নিলে উপসাগরীয় সংকটের সৃষ্টি হয়। ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট থেকে ১৯৯১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ সংকট বিরাজ করে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম’ পরিচালনা করা হলে কুয়েতে ইরাকি দখলদারিত্বের অবসান ঘটে। উপসাগরীয় যুদ্ধ ছিল আসলে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সর্বাধুনিক অস্ত্রের একটি প্রদর্শনী। এ যুদ্ধে অত্যাধুনিক মার্কিন জঙ্গিবিমান এফ-১৬, এফ-১৫ ও এফ-১৮ হর্নেট এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে ব্যবহৃত ভয়াল বোমারু বিমান বি-৫২ অংশগ্রহণ করে। এছাড়া এম-১-এ-১ অ্যাবরামস ট্যাঙ্ক এবং ব্র্যাডলি সাঁজোয়া যান ব্যবহার করা হয়। সৌদি আরবে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য মোতায়েন ও সমরসজ্জার সাংকেতিক নাম ‘অপারেশন ডেজার্ট শিল্ড।’ যুদ্ধে ইরাক পরাজিত হয় এবং কুয়েতে মোতায়েন ইরাকি সৈন্যরা হয়তো আত্মসমর্পণ করে নয়তো পালিয়ে যায়। দক্ষিণাঞ্চলে শিয়া এবং উত্তরাঞ্চলে কুর্দিরা বিদ্রোহ করে। ইরাক পরাজিত হলেও প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের পতন ঘটেনি। সাদ্দাম হোসেনকে অপসারণে ২০০৩ সালের মার্চে পুনরায় দেশটিতে আগ্রাসন চালানো হয়। অতি উৎসাহী হয়ে অনেকে ভেবেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাবে। কিন্তু ¯œায়ুুযুদ্ধ বলবৎ থাকা সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়ন তার ঘনিষ্ঠ মিত্র ইরাককে রক্ষায় এগিয়ে আসেনি।
২০০৩ সালে ইরাকে আগ্রাসন
কথিত নিষিদ্ধ অস্ত্র তৈরির অভিযোগে আন্তর্জাতিক জনমত উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্র ২০০৩ সালে ইরাকে সামরিক আগ্রাসন চালায়। তার আগে আগ্রাসন চালানো হয়েছিল ১৯৯১ সালে। ১৯৯১ সালে ইরাকে সামরিক অভিযান চালানোর একটি যুক্তি ছিল। অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য যাই থাকুক, দৃশ্যত উদ্দেশ্য ছিল ইরাককে কুয়েত থেকে বিতাড়ন। কিন্তু ২০০৩ সালে দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধের কোনো যুক্তি ছিল না। আন্তর্জাতিক আইনে এ যুদ্ধ ছিল অবৈধ। জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব পরলোকগত কফি আনান ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি আভাস দিয়েছি যে, এ যুদ্ধ জাতিসংঘ সনদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং জাতিসংঘ সনদের আলোকে এ যুদ্ধ অবৈধ। তিনি দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে ইরাকের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যুদ্ধকে অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করেন।
২০০১ সালে আফগানিস্তানে হামলা
আফগানিস্তানই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে পৃথিবীর দুটি পরাশক্তি মাত্র ২২ বছরের ব্যবধানে দুবার সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে যে, আফগানিস্তানে কখনো কোনো বিদেশি দখলদার শক্তি বিজয়ী হতে পারেনি। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইর্য়কে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিশোধ গ্রহণে একই বছরের ৭ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র মিত্রদের সহায়তায় আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসন চালায়। মার্কিন সামরিক আগ্রাসনে তালেবান সরকারের পতন ঘটে এবং শীর্ষ তালেবান নেতা মোল্লা ওমর ও আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন পালিয়ে যান। যুদ্ধে মার্কিন বাহিনী নিষিদ্ধ গুচ্ছ বোমা এবং দুর্ধর্ষ কমান্ডো নেভি সীল ও গ্রীন ব্যারেট ব্যবহার করে। গুচ্ছ বোমা ব্যবহার করে শুধু প্রতিপক্ষ তালেবান নয়, পাহাড় পর্বতও ঝাঝরা করে দেয়া হয়। এ যুদ্ধ ‘আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ’ হিসেবে পরিচিত। আল-কায়েদাকে ধ্বংস এবং তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করার মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানে আল-কায়েদাকে নিরাপদে তৎপরতা চালানোর সুযোগ না দেয়া ছিল যুদ্ধের ঘোষিত লক্ষ্য। এ যুদ্ধে যুক্তরাজ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। দেশটি যুদ্ধের শুরু থেকে সামরিক তৎপরতায় সহায়তা দেয়। আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে ব্রিটেনের আচরণ কোনো মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্রের মতো মনে হয়নি। মনে হয়েছে দেশটি যেন যুক্তরাষ্ট্রের জমজ ভাই। ডাক দেয়ার আগেই হাজির। সাম্রাজ্যবাদীদের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে মুসলিম শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সত্যি। তবে একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক দেশের দাবিদার এসব দেশের মুসলিম বিদ্বেষী চেহারাও স্পষ্ট হয়ে গেছে।
কাশ্মীর গ্রাস
ব্রিটিশ ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলো শান্তিপূর্ণভাবে হয়তো পাকিস্তানে নয়তো ভারতে যোগদান করে। যেসব রাজ্যের রাজা ও প্রজার ধর্ম ছিল বিপরীত সেসব রাজ্যে গোলমাল দেখা দেয়। এসব রাজ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জুনাগড়, হায়দরাবাদ ও কাশ্মীর। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ছিল দেশীয় রাজ্যগুলোর ভারত অথবা পাকিস্তানে যোগদানের শেষদিন। ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন কাশ্মীরের মহারাজা হরিসিংকে ১৫ আগস্টের মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আহ্বান জানান। মহারাজা সিদ্ধান্ত গ্রহণে আরো সময় চান। এসময় তিনি কাশ্মীরে স্থিতাবস্থা চুক্তি স্বাক্ষরে পাকি কাশ্মীরের স্থানীয় বাহিনীকে বলা হতো স্টেট ফোর্স। মেজর জেনারেল স্কটের নেতৃত্বে এ স্টেট ফোর্সে ছিল চারটি ব্রিগেড ও আর্মি হেডকোয়ার্টার। ব্রিগেডগুলো হলো জম্মু ব্রিগেড, কাশ্মীর ব্রিগেড, মিরপুর ব্রিগেড ও পুঞ্জ ব্রিগেড। এসব ব্রিগেডে সৈন্য ছিল মাত্র ৮ ব্যাটালিয়ন। স্টেট ফোর্সে কোনো গোলন্দাজ ও সাঁজোয়া যান ছিল না। এ ক্ষুদ্র বাহিনী গিলগিট থেকে সুচেতগড় পর্যন্ত ৫ শো কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত ছিল। পাকিস্তানি উপজাতীয় গেরিলাদের অগ্রাভিযানে কাশ্মীরের এ রাজ্য বাহিনী পলায়ন করে। ১৯৪৭ সালের ২৪ অক্টোবর ভারত সরকার কাশ্মীরে পাকিস্তানিদের অভিযানের কথা জানতে পারে। ততক্ষণে ডোমেল ও মোজাফফরাবাদের পতন ঘটেছিল। পাকিস্তানিরা শ্রীনগরের দিকে ধেয়ে আসছিল। ২৪ অক্টোবর রাতে কাশ্মীরের মহারাজা হরিসিং ভারতের কাছে এসওএস সংকেত পাঠান। সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, জম্মু ও কাশ্মীর আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতে যোগদানের আগে ভারত সৈন্য পাঠাতে পারে না। তখনি মহারাজার ভারতে যোগদানের একটি চিঠি ইস্যু করা হয়। কাশ্মীরে সৈন্য প্রেরণে ভারত শুরুতেই কতগুলো প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়। শ্রীনগর ছিল ভারত সীমান্তের যে কোনো জায়গা থেকে ৪৮০ কিলোমিটার দূরে। পূর্ব পাঞ্জাবে মোতায়েন ভারতীয় সৈন্যরা ছিল শরণার্থীদের পুনর্বাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত। বিমান যোগে সৈন্য প্রেরণই ছিল একমাত্র বিকল্প। তবে শ্রীনগর বিমান বন্দর ছিল পুরোপুরি বোঝাই পরিবহন বিমান অবতরণের জন্য অযোগ্য। এ প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠার উপায় বের করা হয়। অপারেশনের সাংকেতিক নাম দেয়া হয় অপারেশন জ্যাক। ঐ সময় গোরগাঁওয়ে অবস্থানকারী লে. কর্নেল ডিআর রায়ের নেতৃত্বাধীন ফার্স্ট শিখ ব্যাটালিয়নকে সর্বপ্রথম পাঠানো হয়। ২৭ অক্টোবর দিল্লি থেকে চারটি ডাকোটা বিমান উড্ডয়ন করে এবং একইদিন ভোরে শ্রীনগরে গিয়ে পৌঁছে। ২৮ অক্টোবর প্রথম সংঘর্ষ বাধে। যুদ্ধে ভারতের পক্ষে প্রথম প্রাণ হারান লে. কর্নেল রায়।
হায়দরাবাদ গ্রাস
ব্রটিশ ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশীয় রাজ্য হায়দরাবাদের সঙ্গে স্থিতাবস্থা চুক্তি বলবৎ থাকা সত্ত্বেও ভারত ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বরে এ স্বাধীন দেশটি কেড়ে নেয়। আগ্রাসন চালানোর অজুহাত হিসাবে বলা হয়েছিল, নিজাম চুক্তি ভঙ্গ করেছেন। স্বাধীনতা রক্ষায় নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবকদের চিহ্নিত করা হয় ‘বর্বর’ হিসাবে। তাদেরকে বর্বর হিসাবে চিহ্নিত করা ছিল ভারতীয় প্রচারণার অংশ। তাদেরকে নির্দোষ হিন্দুদের হত্যা, হিন্দু মহিলাদের ধর্ষণ এবং হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুণ্ঠনের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। সমসাময়িক লেখকগণ স্বীকার করেছেন, কয়েকটি এলাকায় স্বেচ্ছাসেবকরা হিন্দুদের ওপর সহিংসতা চালিয়েছিল। তবে এ সহিংসতা ব্যাপক ছিল না। স্বেচ্ছাসেবকদের সহিংসতার অধিকাংশ ঘটনা ছিল অসত্য ও অতিরঞ্জিত।
১৩ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে উভয়পক্ষের মধ্যে বিক্ষিপ্ত লড়াই চলছিল। ৬ সেপ্টেম্বর চিলাকালু গ্রামের কাছে একটি ভারতীয় চৌকিতে স্বেচ্ছাসেবক ইউনিট ভারি গোলাবর্ষণ করে। এ হামলার জবাব দানে ভারতীয় সেনাবাহিনী আবি সিংয়ের নেতৃত্বে পুনা হর্সের এক স্কোয়াড্রন ট্যাঙ্ক এবং ২/৫ গুর্খা রাইফেলসকে পাঠায়। পুনা হর্সের ট্যাঙ্ক স্কোয়াড্রন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে হায়দরাবাদ ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে কোডরে পিছু হটিয়ে দেয়। কোডরে হায়দরাবাদ সেনাবাহিনীর প্রথম ল্যান্সারের সাঁজোয়া বহর পুনা হর্সের গতিরোধ করে। এক সংক্ষিপ্ত সংঘর্ষে পুনা হর্স হায়দরাবাদ ল্যান্সারের একটি সাঁজোয়া যান ধ্বংস করে এবং কোডরে হায়দরাবাদ রাজ্যের গ্যারিসনকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। হায়দরাবাদ দখল এবং একীভূতকরণে ভারত সরকারের নির্দেশ লাভের পর ভারতীয় সেনাবাহিনী ‘গোডার্ড পরিকল্পনা’ বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার-ইন-চিফ লে. জেনারেল গোডার্ড এ পরিকল্পনা প্রণয়ন করায় তার নামে অভিযানের নামকরণ করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী হায়দরাবাদ রাজ্যের রাজধানী আওরঙ্গাবাদের দু’দিক থেকে মূল অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পূর্বদিকে বিজয়বাড়া থেকে একটি এবং পশ্চিমদিকে শোলাপুর থেকে আরেকটি বাহিনীকে হায়দরাবাদ অভিমুখে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়। সার্বিক কমান্ড ন্যস্ত করা হয় ডিএসও লে. জেনারেল রাজেন্দ্র সিংয়ের হাতে। মেজর জেনারেল জেএন চৌধুরীর নেতৃত্বে শোলাপুর থেকে একটি বাহিনী এগিয়ে আসে। তার অধীনস্থ বাহিনীতে ছিল চারটি টাস্ক ফোর্স।
জুনাগড় গ্রাস
আরব সাগরের কূল ঘেষা জুনাগড় ছিল গুজরাটে ব্রিটিশ ভারতের একটি দেশীয় রাজ্য। তার চারদিকে ভারত। বেরাবাল বন্দরের একটি সংযোগ পথে আরব সাগরের সঙ্গে তার যোগাযোগ। জুনাগড়ের আয়তন ৩ হাজার ৩৩৭ বর্গমাইল এবং ১৯৪১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী লোকসংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৭০ হাজার ৭১৯ জন। এ রাজ্য তার ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নিয়েও টিকে থাকতে পারেনি। ভারতের সামরিক শক্তির কাছে তাকে হার মানতে হয়। আজ এ রাজ্য ভারতের গুজরাট রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। স্বকীয়তা হারিয়ে যাওয়ায় অনেকে জুনাগড়ের নামও ভুলে গেছে। কিন্তু ইতিহাসে এ রাজ্যের করুণ উপাখ্যান এখনো উজ্জ্বল। জুনাগড় রা?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন