একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ১০টি ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট ছিল। এসব রেজিমেন্ট হলো প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম। ৬টি ব্যাটালিয়ন অবস্থান করছিল পূর্ব পাকিস্তানে এবং বাকি তিনটি পশ্চিম পাকিস্তানে। যুদ্ধ বেঁধে যাবার মুহূর্তে দশম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট গড়ে তোলার কাজ চলছিল। যুদ্ধের ভেতর গড়ে তোলা হয় একাদশ ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট। মুক্তিযুদ্ধের সময় পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট পশ্চিম পাকিস্তানে আটকা পড়ে। ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের যেসব অফিসার মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন তারা হলেন মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কেএম সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত, মেজর কাজী নূরুজ্জামান, মেজর মীর শওকত আলী, মেজর আবুল মঞ্জুর, মেজর আবু তাহের, মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, মেজর রফিকুল ইসলাম, মেজর এটিএম হায়দার, মেজর এএনএম নূরুজ্জামান, মেজর নাজমুল হক ও মেজর এমএ জলিল। ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টগুলো বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধের হাল না ধরলে ইতিহাস হতো অন্যরকম। ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রাণশক্তি। তাই তাদের ভূমিকা ও অবস্থান নিয়ে আলোচনা করা একান্ত প্রয়োজন।
প্রথম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট
১০৭তম পাকিস্তানি ব্রিগেডের অন্তর্ভুক্ত সিনিয়র টাইগার হিসাবে পরিচিত প্রথম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট অবস্থান করছিল যশোরে। কমান্ডিং অফিসার ছিলেন লে. কর্নেল রেজাউল জলিল। ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের দিন এ ব্যাটালিয়ন যশোর সীমান্তের চৌগাছায় শীতকালীন মহড়ায় নিয়োজিত ছিল। ২৯ মার্চ তাদেরকে যশোর তলব করা হয়। যশোর সেনানিবাসে ফিরে আসা মাত্রই ২৫বালুচ রেজিমেন্ট ও ষষ্ঠ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স তাদের ঘেরাও করে। ঘেরাও করায় উত্তেজিত হয়ে বাঙালি সৈন্যরা কারো নির্দেশের অপেক্ষা না করে অস্ত্রাগার ভেঙ্গে হাতিয়ার বের করে নিয়ে আসে। উভয়পক্ষে শুরু হয় গোলাগুলি। ঘটনাস্থলে ২৫ জন বাঙালি সৈন্য নিহত হয়। আহত হয় বহু। প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে টিকতে না পেরে বাঙালি সৈন্যরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্র“পে বিভক্ত হয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে আসে এবং চৌগাছার দিকে পালিয়ে যায়। এসব সৈন্য ক্যাপ্টেন হাফিজ ও লে. আনোয়ারের নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে প্রতিরোধ লড়াই শুরু করে। লড়াইয়ের এক পর্যায়ে লে. আনোয়ার শহীদ হন। পরিবার পরিজন থাকায় এক শো পিছিয়ে যায়। নিরাপদে ফিরে আসার জন্য মাইকে তাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। পরে তাদের সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল রেজাউল জলিলকে বন্দি করে ঢাকায় আনা হয় এবং পরে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হয়। যশোর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত ৪০ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সের বাঙালি সৈন্যরাও আক্রান্ত হয়। ১ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সের বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করে। বাঙালি কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল হাই ও ক্যাপ্টেন শেখকে তাদের অফিসে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে প্রথম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট ১১ নম্বর সেক্টরে মেজর জিয়াউর রহমানের অধীনস্থ হয়। এ ব্যাটালিয়ন ‘জেড ফোর্স-এর অন্তর্ভুক্ত হলে তার নেতৃত্ব দেন প্রথমে মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী এবং পরে মেজর জিয়াউদ্দিন।
দ্বিতীয় ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট
৫৭তম পাকিস্তানি ব্রিগেডের অন্তর্ভুক্ত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট অবস্থান করছিল ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরে। এ ব্যাটালিয়নের একটি কোম্পানি অবস্থান করছিল ময়মনসিংহে এবং আরেকটি টাঙ্গাইলে। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন বাঙালি লে. কর্নেল মাসুদ। সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন মেজর কেএম সফিউল্লাহ। ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে জনতা প্রতিরোধ গড়ে তুললে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টকে ব্যারিকেড অপসারণের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু তারা এ নির্দেশ পালনে দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। লে. কর্নেল মাসুদকে ঢাকায় ডেকে এনে অন্তরীণ করা হয়। ২৪ মার্চ তার স্থলে অনুগত বাঙালি লে. কর্নেল রকিবকে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার নিয়োগ কর হয়। তিনি যখন জয়দেবপুুরে পৌঁছান তখন বাঙালি সৈন্যরা ছিল বিদ্রোহের দ্বারপ্রান্তে। ২৮ মার্চ দ্বিতীয় ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন মেজর সফিউল্লাহ। তাকে সহযোগিতা করেন মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম, লে. আজিজ, লে. এজাজ, লে. হেলাল মোর্শেদ খান, লে. সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম প্রমুখ অফিসার। ২৮ মার্চ রাতে বিদ্রোহকালে গোলাগুলিতে দু’জন বাঙালি সৈন্য এবং তিনজন অবাঙালি অফিসার ও একজন জেসিও নিহত হয়। ২৯ মার্চ এ রেজিমেন্টের উপর পাকিস্তান বিমান বাহিনী বোমাবর্ষণ করে। মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে এ ব্যাটালিয়ন টাঙ্গাইল হয়ে ময়মনসিংহের পথে রওনা দেয়। ৩১ মার্চ মেজর সফিউল্লাহ আখাউড়ায় মেজর খালেদ মোশররফের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। একত্রিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার জন্য তারা সীমান্তের দিকে এগিয়ে যান। তাদের সঙ্গে ইপিআরের সৈন্যরা যোগ দেয়। ২ নম্বর সেক্টরে মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ‘এস ফোর্স’ গঠন করা হলে এ রেজিমেন্ট কমান্ড করেন মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী। তার আগে তিনি প্রথম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট কমান্ড করেন।
তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট
মুক্তিযুদ্ধে তৃতীয় ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের অবদান অসামান্য। এ রেজিমেন্ট প্রথমে মেজর জিয়াউর রহমান এবং পরে মেজর মীর শওকতের অধীনে দায়িত্ব পালন করে। ৪ মার্চ তৃতীয় বেঙলের অবস্থান ছিল সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে। দিনটি ছিল ব্যাটালিয়নটির জধরংরহম উধু বা প্রতিষ্ঠা দিবস। পহেলা মার্চ থেকে পাক বাহিনী বাংলাদেশের অন্যান্য সেনানিবাসের মতো এখানেও তৃতীয় বেঙলকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা চালায়। সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে ৪ মার্চ এক ‘দরবার’ অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানে ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার সব র্যাঙ্কের সদস্যদের উদ্দেশে বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। ‘দরবার’ চলার সময় অত্যন্ত অস্বাভাবিক ও বিধি বহির্ভূতভাবে তৃতীয় বেঙলের আবাসিক এলাকার চারপাশে ২৫ এফএফ রেজিমেন্ট ও সশস্ত্র সেনাদল নিয়োগ করা হয়। এই ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে তৃতীয় বেঙলের সেনা সদস্যের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। এরপর থেকে তৃতীয় বেঙলের ব্যারাকগুলোর আশপাশে অস্ত্রধারী পাকসেনাদের গতিবিধি ক্রমশই বাড়তে থাকে। এর মধ্যে তৃতীয় বেঙলকে ঘিরে পরিখাও খোড়া হয়। পাকিস্তানিদের এসব উদ্দেশ্যপূর্ণ কাজকর্ম দেখে বাঙালি সেনাদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তৃতীয় বেঙলের বাঙালি সেনাসদস্যরা আত্মরক্ষা ও প্রয়োজনে স্বজাতির মুক্তির জন্য লড়াইয়ের প্রত্যয়ে বেশ কয়েকবার অননুমোদিতভাবে অস্ত্রধারণ করে।
২৫ মার্চের আগে থেকেই বাংলাদেশে অবস্থিত বেঙল রেজিমেন্টের অন্য সব ব্যাটালিয়নের মতো তৃতীয় বেঙলের শক্তি কমিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে তাদেরকে ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেয়া হয়। অজুহাত হিসাবে ভারতীয় আগ্রাসন ঠেকানোর মনগড়া কাহিনী শোনানো হয়। পাক বাহিনীর পরিকল্পনা কার্যকর করার পথে তৃতীয় বেঙল যেন সংগঠিত হয়ে বাধা দিতে না পারে সেজন্যই তাদেরকে এভাবে ছত্রখান করে দেয়া হয়। নীলনকশা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আলফা কোম্পানিকে পার্বতীপুরে পাঠানো হয়। সঙ্গে যান পাকিস্তানি মেজর সৈয়দ সাফায়েত হোসেন। চার্লি কোম্পানিকে ক্যাপ্টেন আশরাফের নেতৃত্বে ঠাকুরগাঁও পাঠানো হয়। পলাশবাড়ি/ঘোড়াঘাট এলাকায় অবস্থান নেয় ব্র্যাভো ও ডেল্টা কোম্পানি। এদের সঙ্গে পাঠানো হয় মেজর নিজামউদ্দিন, ক্যাপ্টেন মোখলেস ও লে. রফিককে। সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান করছিল উল্লেখিত কোম্পানিগুলোর রিয়ার পার্টি, ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার ও হেডকোয়ার্টার কোম্পানির কিছু সেনা সদস্য। ৩১ মার্চ পাক সেনাদের হাতে আক্রান্ত হওয়ার দিন পর্যন্ত ক্যাপ্টেন আনোয়ার, লে. সিরাজ ও সুবেদার মেজর হারিস তাদের সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান করছিলেন। সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে আরো ছিলেন সিও লে. কর্নেল ফজল করিম ও সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মেজর আকতার। এই দু’জনই ছিলেন পাকিস্তানি। সিও ফজল করিম ছিলেন প্রবলভাবে বাঙালি বিদ্বেষী।
২৫ মার্চ রাতে গণহত্যার মাধ্যমে পাক বাহিনী বাঙালিদের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করার পর ঘোড়াঘাটে অবস্থানরত তৃতীয় বেঙলের সৈন্যরা ২৮ মার্চ পলাশবাড়িতে লে. রফিকের নেতৃত্বে একটি বড় ধরনের অ্যাম্বুশ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বগুড়ার দিকে অগ্রসরমান ২৫ এফএফ রেজিমেন্টের উপর অতর্কিত আঘাত হেনে তাদেরকে নির্মূল করে দেয়া। ২৫ এফএফ রেজিমেন্টের চতুর পাকিস্তানি লে. কর্নেল গোলাগুলি শুরু হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে অনভিজ্ঞ তরুণ লে. রফিককে যুদ্ধের বদলে আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কট নিরসনের আহ্বান জানান। সিংহ হৃদয়ের অধিকারী এই তরুণ বাঙালি অফিসার সরল বিশ্বাসে পাকিস্তানি কর্নেলের কাছে যাওয়া মাত্রই পাক সেনারা তাকে জোর করে কর্নেলের গাড়িতে উঠিয়ে মুহূর্তের মধ্যে রংপুরের দিকে রওনা হয়। এই ঘটনায় দু’পক্ষের মধ্যে সঙ্গে সঙ্গে গুলিবিনিময় শুরু হয়ে যায়। প্রচণ্ড গোলাগুলির এক পর্যায়ে ২৫ এফএফ রেজিমেন্ট টিকতে না পেরে রংপুরের দিকে পালিয়ে যায়। তাদের পক্ষে অনেকে হতাহত হয়। রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধে তৃতীয় বেঙলের দু’জন সৈন্য শহীদ, একজন অফিসার বন্দি এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। এই সংঘর্ষের পর শত্র“ মিত্র চূড়ান্তভাবে চিহ্নিত হয়ে যায়। সংঘর্ষের এই খবর সৈয়দপুর পৌঁছানো মাত্র সেখানে অবস্থানরত তৃতীয় বেঙলের সৈন্যদের মধ্যে উত্তেজনা আরো বেড়ে যায়।
৩০ মার্চ তৃতীয় বেঙলের ব্যাটালিয়ন অ্যাডজুট্যান্ট সিরাজকে রংপুর ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে একটি কনফারেন্সে যোগ দেয়ার জন্য পাঠানো হয়। তার সঙ্গে ১০/১২ জন সশস্ত্র প্রহরী ছিল। পাকিস্তানিরা পথে তাদেরকে বন্দি করে এবং অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় সে রাতেই প্রায় সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে। দলটির মাত্র একজন সদস্য দৈবক্রমে বেঁচে যায়। পরে তিনি তৃতীয় বেঙলের সঙ্গে আবার মিলিত হতে পেরেছিলেন। তখন রংপুর ব্রিগেডের গুরুত্বপূর্ণ ব্রিগেড মেজর পদে আসীন ছিলেন বাঙালি মেজর আমজাদ আহমেদ চৌধুরী। ৩০ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি ২৫ এফএফ রেজিমেন্ট সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত তৃতীয় বেঙলের আবাসিক অবস্থানগুলোতে কামানের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করে। সেখানকার একমাত্র বাঙালি অফিসার আনোয়ার ছিলেন কোয়ার্টার মাস্টার। আনোয়ার ও সুবেদার হারিস মিয়ার নেতৃত্বে সেনানিবাসে অবস্থানরত তৃতীয় বেঙলের স্বল্পসংখ্যক সৈন্য দ্রুত সংগঠিত হয়ে এই আক্রমণ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে অমিত বিক্রমে রুখে দাঁড়ান। পাকিস্তানি সৈন্যরা এক পর্যায়ে কামানের গোলাবর্ষণ থামিয়ে উত্তরদিক থেকে অ্যাসল্ট লাইন বানিয়ে হামলা চালায়। তৃতীয় বেঙলের বীর সৈন্যরা অত্যন্ত ক্ষিপ্রতা ও দক্ষতার সঙ্গে এ হামলা প্রতিরোধ করে। নিজেদের পক্ষে ব্যাপক হতাহত হওয়ায় এবং আক্রমণে খুব একটা সুবিধা করতে না পারায় পাকিস্তানি সৈন্যরা তখনকার মতো রণে ভঙ্গ দেয়। কয়েক ঘন্টা পর ২৫ এফএফ রেজিমেন্ট আবার কামানের গোলার ছত্রছায়ায় আক্রমণ চালায়। এবারের আক্রমণ আসে উত্তর পশ্চিম দিক থেকে। এ পর্যায়ের প্রচণ্ড সংঘর্ষে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে আক্রমণকারী পাকিস্তানি সৈন্যরা একসময় পিছিয়ে যায়। ভোর হয়ে এলে লড়াই স্তিমিত হয়ে পড়ে। কিন্তু দিনের আলোয় রংপুুর থেকে ট্যাংক-বিধ্বংসী কামানগুলো সামরিক মহড়ার নামে সুকৌশলে ব্যাটালিয়ন থেকে সরিয়ে দিনাজপুরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এ অবস্থায় দিনের আলোয় ক্যান্টনমেন্ট থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ছিল আত্মহত্যার শামিল। নিজেদের পক্ষে প্রচুর হতাহত হওয়ায় এবং শত্র“ পক্ষ ভারি অস্ত্র সজ্জিত থাকায় আনোয়ার তৃতীয় বেঙলের সৈন্যদেরকে কৌশলগতভাবে পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দেন।
তৃতীয় বেঙলের সৈন্যরা বিক্ষিপ্তভাবে গুলি চালাতে চালাতে দুই অংশে বিভক্ত হয়ে পিছিয়ে আসে। একদল পাকিস্তানি কামানের আওতার বাইরে বদরগঞ্জে অবস্থান গ্রহণ করে। অন্য দলটি অবস্থান নেয় ফুলবাড়িতে। ক্যান্টনমেন্টের এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তৃতীয় বেঙলের প্রায় ২০ জন শহীদ এবং ৩০ থেকে ৩৫ জনের মতো সদস্য আহত হয়। এছাড়া কয়েকজন নিখোঁজ হয়েছিল। পাকিস্তানিদের পক্ষেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ক্যান্টনমেন্টের রিয়ার পার্টির উপর হামলার খবর পেয়ে ঠাকুরগাঁও এবং পার্বতীপুরে অবস্থানরত চার্লি ও আলফা কোম্পানি সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের উদ্দেশ্যে ২ এপ্রিল ফুলবাড়িতে একত্রিত হয়। ফুলবাড়িতে দিনাজপুর সেক্টরের ইপিআরের বহু সদস্য বিদ্রোহ করে এবং তৃতীয় বেঙলের সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দেয়। আলফা কোম্পানি ফুলবাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ায় একদল পাকিস্তানি সৈনা ও সশস্ত্র বিহারী পাবর্তীপুর এলাকা দখল করে নেয়। এই যুদ্ধে তৃতীয় বেঙলের একজন শহীদ ও কয়েকজন আহত হয়। প্রায় একই সময় চার্লি কোম্পানি ভুষিরবন্দরে পাকিস্তানি অবস্থানে প্রচন্ড আক্রমণ চালায়। চার্লি কোম্পানির আক্রমণের তীব্রতায় পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রথমবারের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংক ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে চার্লি কোম্পানির বেশ কয়েকজন হতাহত হলে তারা আক্রমণ বন্ধ করে এক পর্যায়ে পিছিয়ে আসে। চার্লি কোম্পানি এবার অবস্থান নেয় চরখাইয়ের কাছে খোলাহাটিতে।
ঘোড়াঘাটে মেজর নিজামের নেতৃত্বে তৃতীয় বেঙলের একটি কোম্পানি অবস্থান করছিল। ২৬/২৭ মার্চে বগুড়া থেকে ২৩তম ফিল্ড রেজিমেন্টের দু’টি ব্যাটারি সৈয়দপুরে আসার চেষ্টা করছিল। এ সংবাদ পেয়ে মেজর নিজাম লে. রফিককে একটি প্লাটুন এবং লে. মোখলেসকে আরেকটি প্লাটুন নিয়ে পলাশবাড়ি রোড জংশনে অবস্থান গ্রহণের নির্দেশ দেন। লে. রফিক যথাসময়ে পলাশবাড়ি পৌঁছান। কিন্তু লে. মোখলেসের পৌঁছতে দেরি হয়ে যায়। ইতিমধ্যে পাকিস্তানিরা পলাশবাড়ি এসে লে. রফিককে আক্রমণ করে বসে। পাকিস্তানিদের সঙ্গে সংঘর্ষে লে. রফিক ধরা পড়েন এবং তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর মেজর নিজাম তার অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে ফুলবাড়িতে সুবেদার শুক্কুরের সঙ্গে মিলিত হন। মেজর নিজাম পাবর্তীপুরে পাকিস্তানি ঘাঁটি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৭ এপ্রিল হলদিবাড়িতে একটি প্লাটুন রেখে তিনি পাবর্তীপুরে পাকিস্তানি ঘাঁটি আক্রমণ করেন। কিন্তু তার এ আক্রমণ ব্যর্থ হয়। পাবর্তীপুর যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা চরমভাবে মার খায়। অনেকে মনে করেন মেজর নিজামের ভুল সিদ্ধান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের বিপর্যয় ঘটে। পাবর্তীপুরে পাকিস্তানি ঘাঁটিতে মর্টারের কয়েকটি গোলাবর্ষণ করেই তিনি সৈন্যদের হামলা চালানোর নির্দেশ দেন। মর্টারের গোলাবর্ষণের সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা চুপচাপ ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা চার্জ করতে এগিয়ে যাওয়া মাত্র তাদের কামানগুলো একসঙ্গে গর্জে উঠে। পাবর্তীপুর থেকে পিছু হটে মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় হাবরায় পুনরায় প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করে। ১২ এপ্রিল পাকিস্তান বাহিনী ট্যাংক ও ভারি অস্ত্রের সহায়তায় হাবরায় আক্রমণ করে। পাকিস্তানি সৈন্যদের ব্যাপক আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ক্যাপ্টেন আনোয়ার তার কিছুসংখ্যক সৈন্য, ইপিআর, আনসার ও মুজাহিদ নিয়ে বদরগঞ্জে অবস্থান গ্রহণ করেন।
এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ নাগাদ প্রায় গোটা তৃতীয় বেঙল চরখাই-খোলাহাটিতে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করে। খোলাহাটিতে স্থাপন করা হয় হেডকোয়ার্টার। কয়েকটি যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে ব্যাটালিয়নের সদস্য সংখ্যা ব্যাপক হ্রাস পায়। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া কিছু সৈন্য ব্যাটালিয়নের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আশায় দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়ার বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করতে থাকেন। অফিসারদের মধ্যে একমাত্র আনোয়ার তখন ব্যাটালিয়নে। আশরাফ ও মোখলেস নিখোঁজ ও নিজামউদ্দিন শহীদ হন। তৃতীয় বেঙল খোলাহাটি থাকার সময় সম্ভবত ৯ এপ্রিল আনোয়ার রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের উদ্দেশ্যে বদরগঞ্জে রেকি করতে যান। তার সঙ্গে ছিল মাত্র কয়েকজন প্রহরী। এ সময় ভুল করে হঠাৎ তিনি জীপসহ ২৫ এফএফ রেজিমেন্টের সৈন্যদের মধ্যে ঢুকে পড়েন। পাকিস্তানি এফএফ রেজিমেন্ট আর ইপিআরের চামড়ার সরঞ্জামাদি দু’টিই কালো রংয়ের হওয়ায় এই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। মুহূর্তে দু’পক্ষই নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। শুরু হয় গুলিবিনিময়। মাত্র কয়েকজন যোদ্ধাসহ আনোয়ার বন্দি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে মরণপণ যুদ্ধ করে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। এ যুদ্ধে আনোয়ার গুলিবিদ্ধ হন। পরে কৌশলে পাকিস্তানিদের ঐ শক্তিশালী অবস্থান অতিক্রম করে তিনি ও তার সহযোদ্ধারা সেদিনই খোলাহাটিতে অবস্থানরত তৃতীয় বেঙলে ফিরে আসেন। তবে ঐ এলাকার ম্যাপসহ জীপটি শত্র“পক্ষের হাতে পড়ে যায়। ম্যাপে তৃতীয় বেঙলের বিভিন্ন কোম্পানির অবস্থান চিহ্নিত ছিল বলে বিমান আক্রমণের আশঙ্কায় সেদিনই তৃতীয় বেঙলকে দু’ভাগ করে ছড়িয়ে দেয়া হয়। এক অংশ চলে যায় চরখাই-ফুলবাড়ি এলাকায় এবং অন্য অংশ অবস্থান নেয় হিলি এলাকায়।
১৩ ও ১৪ এপ্রিল চরখাইয়ে অবস্থানরত তৃতীয় বেঙলের সৈন্য ও ইপিআরের বাঙালি সদস্যরা রেললাইন ধরে অগ্রসরমান পাকিস্তানি সৈন্যদের মোকাবিলায় ব্যাপক আকারে অ্যাম্বুশ স্থাপন করে। পাকিস্তানি সৈন্যরা রেললাইন ধরে হিলির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। রেললাইনের দু’পাশের গ্রামগুলোতে আগুন লাগাতে লাগাতে তারা অগ্রসর হচ্ছিল। অ্যাম্বুশের ফাঁদে আসা মাত্র পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে পড়ে যায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে বহু সৈন্য হতাহত হলে আত্মরক্ষার জন্য তারা পার্বতীপুরের দিকে পশ্চাদপসরণ করে। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীরও কয়েকজন হতাহত হয়। ১৪ এপ্রিল আলফা কোম্পানির প্লাটুন কমান্ডার নায়েব সুবেদার ওহাবকে ঘোড়াঘাট-হিলি রোডে পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে হামলা চালাতে পাঠানো হয়। অগ্রসরমান এই সৈন্যদলের অলক্ষ্যে পাঁচবিবি-হিলি রোড ধরে আসা আরেকটি শক্তিশালী শত্র“ বাহিনী অতর্কিতে তাদেরকে পেছন দিক থেকে হামলা করে বসে। তাদের উপর পেছনের শত্র“ অবস্থান থেকে অবিরাম মেশিনগান আর মর্টারের গোলাবর্ষণ করা হতে থাকে। একমাত্র রাস্তা ছাড়া কভার নেয়ার জন্য কোনো উঁচু স্থান ছিল না। রাস্তার দু’পাশে ছিল বিস্তৃত ধানখেত। ঐ অবস্থানে সারাদিন যুদ্ধের পর রাতের অন্ধকারে ওহাবের প্লাটুন পশ্চাদপসরণ করতে সক্ষম হয়। এই সংঘর্ষে তৃতীয় বেঙলের একজন শহীদ ও ১৩ জন আহত হয়। ওহাব আহতদের সবাইকে তাদের মূল প্রতিরক্ষা অবস্থানে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন।
মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আলফা ও চার্লি কোম্পানির যৌথ সৈন্য দল মোহনপুর ব্রিজ এলাকায় শত্র“ অবস্থানে আক্রমণ করে। এ হামলায় দু’পক্ষেরই বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। তৃতীয় বেঙলের দু’জন এনসিও নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়। এই অভিযানের দু’একদিন পর আলফা কোম্পানি দিনাজপুরের রামসাগর এলাকায় পাকিস্তানি অবস্থানে হামলা করে এবং সাফল্যের সঙ্গে শত্র“পক্ষকে পর্যুদস্ত করে ফিরে আসে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই তৃতীয় বেঙল মিত্রবাহিনীর পরামর্শ মতো অ্যাম্বুশ, রোড মাইন স্থাপন ও ব্রিজ ধ্বংসের মতো কম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে থাকে। মে মাসের মাঝামাঝি পাঁচবিবি-জয়পুরহাট রাস্তায় মাইন বিস্ফোরণে পাকিস্তান বাহিনীর একটি গাড়ি বিধ্বস্ত হলে একজন অফিসার ও ১৩ জন সৈন্য নিহত হয়। চরখাই অবস্থানকালে এপ্রিলের শেষদিকে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে তৃতীয় বেঙলের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। তৃতীয় বেঙলে তখন একজন অফিসারসহ বিভিন্ন র্যাঙ্কের ৪১৬ জন সৈন্য ছিল। পরবর্তীকালে মিত্রবাহিনীর পরামর্শে দু’টি কোম্পানি স্থানান্তরিত হয় ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকা রায়গঞ্জে। আনোয়ারের দু’টি কোম্পানি হিলি-বালুরঘাট এলাকায় থেকে যায়। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মেজর শাফায়াত জামিল এ দু’টি কোম্পানির অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন এবং বালুরঘাটের কামারপাড়া নামে একটি জায়গায় তৃতীয় বেঙলের পুনর্গঠনে হাত দেন। ১৪ জুন মুক্তিবাহিনীর ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মেজর শাফায়াত জামিল সাত নম্বর সেক্টরে সৈন্য সংগ্রহের জন্য আসেন। তিনি ইপিআরের ৫ শতাধিক সদস্যকে তৃতীয় বেঙলের অন্তর্ভুক্ত করে তাকে পুরোপুরি একটি ব্যাটালিয়নে রূপান্তরিত করেন। তৃতীয় বেঙলই ‘জেড ফোর্স’-এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
চতুর্থ ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট
২৫ মার্চ চতুর্থ ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট অবস্থান করছিল কুমিল্লায়। এ রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন বর্ষীয়ান পাঞ্জাবী লে. কর্নেল খিজির হায়াত খান। মেজর খালেদ মোশাররফ ছিলেন সেকেন্ড-ইন-কমান্ড। অন্যান্য বাঙালি অফিসারদের মধ্যে ছিলেন মেজর শাফায়াত জামিল, ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিন, ক্যাপ্টেন গাফফার, ক্যাপ্টেন আবদুল মতিন, লে. হারুন প্রমুখ। এ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি অবস্থান করছিল শমসেরনগরে এবং আরেকটি ব্রাক্ষণবাড়িয়ায়। মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে চতুর্থ বেঙল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করে। কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল খিজির হায়াতকে বন্দি করা হয়। তবে এই বিনয়ী পাকিস্তানি কর্নেলকে হত্যা না করে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ভারত সীমান্তে এগিয়ে যাবার আগে চতুর্থ ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যদের সংঘর্ষ হয়। এ রেজিমেন্টকে ব্রাক্ষণবাড়িয়া, আখাউড়া, লাকসাম প্রভৃতি জায়গায় জনতা অভিনন্দন জানায়। মেজর সফিউল্লাহর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙল ও মেজর খালেদের চতুর্থ ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট আখাউড়া, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, শমসেরনগর ও সিলেটে সম্মিলিতভাবে লড়াই করে। সেক্টর গঠিত হওয়ার পর চতুর্থ ইস্ট বেঙল ২ নম্বর সেক্টরের আওতায় লড়াই করে। চতুর্থ, নবম ও ১০ম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট নিয়ে ‘এস ফোর্স’ গঠন করা হয়। ‘এস ফোর্সে’ চতুর্থ বেঙলের নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন গাফফার।
অষ্টম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট
২৫ মার্চ অষ্টম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট চট্টগ্রামের ষোলশহরে অবস্থান করছিল। কমান্ডিং অফিসার ছিলেন পাঞ্জাবী লে. কর্নেল আবদুর রশীদ জানজুয়া। টু-আই-সি ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। অন্য বাঙালি অফিসারদের মধ্যে ছিলেন মেজর মীর শওকত, ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামন চৌধুরী, লে. শমসের মোবিন চৌধুরী। চট্টগ্রামে পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজ ‘এমভি সোয়াত’ এসে নোঙ্গর করে। জনতা এ যুদ্ধজাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসে বাধা দেয়। ব্যাপকভাবে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে মেজর জিয়াকে অস্ত্র খালাস তদারকি করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। নির্দেশ অনুযায়ী তিনি রাত সাড়ে ১১টায় রাস্তার ব্যারিকেড অপসারণ করে বন্দরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এসময় ক্যাপ্টেন খালেক ছুটে গিয়ে আগ্রাবাদে তার জীপ থামান। বন্দরে নিয়োজিত বাঙালি সৈন্যদের উপর পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিবর্ষণের সংবাদ দেয়া হলে মেজর জিয়া তৎক্ষণাৎ জীপ ঘুরিয়ে ষোলশহরে ফিরে গিয়ে বললেন, `We revolt.' আমরা বিদ্রোহ করলাম। জিয়াকে সৈন্যরা স্বাগত জানায়। পাঞ্জাবী কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জানজুয়াকে তিনি বন্দি করেন। পরে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মেজর জিয়ার নেতৃত্বে কালুরঘাট থেকে অষ্টম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট প্রতিরোধ লড়াই শুরু করে। মেজর মীর শওকত এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে রওনা দেন। ২৭ মার্চ অষ্টম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট শহর ছেড়ে চলে গেলেও শত্র“র প্রবল আক্রমণের মুখে ক্যাপ্টেন রফিক ইপিআর বাহিনী নিয়ে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহর দখলে রাখেন।
দশম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে নবগঠিত দশম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট ভালোভাবে সক্রিয় হতে পারেনি। এ ব্যাটালিয়ন ছিল একটি মিশ্র ইউনিট। ২৫ মার্চ কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল মুয়ীদসহ এ ব্যাটালিয়নের সবাইকে নিরস্ত্র করা হয়। নিরস্ত্র করা হলে এ ব্যাটালিয়ন কার্যত অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। ২৫ মার্চ রাতে বেশকিছু বাঙালি সৈন্য পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। বাকিরা বন্দি হয়। দশম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের জীবিত সৈন্যরা মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। ‘কে ফোর্স’ গঠন করা হলে দশম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের কমান্ডে লড়াই করে।
(লেখাটি ‘২৬৭ দিনের মুক্তিযুদ্ধ’ থেকে নেয়া। বইটি প্রকাশ করেছে আফসার ব্রাদার্স)
থার্ড বেঙ্গলের মেজর নিজাম শহীদ হননি, তাঁকে তার সৈনিকেরাই হত্যা করে।
উত্তরমুছুন