ডান ও ইসলামপন্থী শক্তি ও দলগুলো মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে পরবর্তীতে নিজেদের সীমাহীন ঘৃণার পাত্রে পরিণত করে। সংখ্যায় তারা ছিল নগণ্য। যেসব দল মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসালামী, নেজামে ইসলাম, পিডিপি প্রভৃতি। পাকিস্তান রক্ষায় তারা সশস্ত্র উপায়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। ভারতের প্রতি ছিল তাদের চরম অবিশ্বাস। ইতিহাসের আলোকে তারা দেখতে পেয়েছিল, উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলিম শক্তি বরাবরই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। কিন্তু ১৯৭১ সালে হিন্দু প্রধান ভারত তাদের চিরাচরিত স্বভাব পরিত্যাগ করায় এবং মুসলিম প্রধান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অকাতরে সমর্থন দেয়ায় তাদের সন্দেহ ঘনীভূত হয়। তারা আশংকা করছিল হয়তো অখন্ড ভারত কায়েম নয়তো বাংলাদেশকে তাঁবেদার রাষ্ট্র বানানোর অভিসন্ধি থেকে দিল্লি মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিচ্ছে। এ ধরনের আশংকা থেকে ইসলামপন্থী দলগুলো মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।
জামায়াতে ইসলামীর নেতা অধ্যাপক গোলাম আজমের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে অ্যান ইসলাম ইন বাংলাদেশ ওয়েবসাইটের এক ব্যাখ্যায় বলা হয়, Like all other Islamic parties and groups, he did not support the Liberation War of Bangladesh. The reasons for not supporting the Liberation War of 1971 was - he did not believe that independence from Pakistan would solve our problem. He believed in self-rule or autonomy and continued to campaign in favour of that. His main opposition to the Liberation War was that it was fully surrounded by India and therefore, gaining independence with India's support would result in the country being indirectly controlled and ruled by India. He feared that India would become a bully and would do everything in its power to dominate the politics and economy of the country.‘
‘অন্যান্য ইসলামী দল ও গ্র“পের মতো তিনি (অধ্যাপক গোলাম আজম) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেননি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে তার সমর্থন না করার পেছনে কারণ ছিল তিনি বিশ্বাস করতেন না যে, পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভে আমাদের সমস্যার সমাধান হবে। তিনি স্বশাসন বা স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাস করতেন এবং স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে প্রচারণা অব্যাহত রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করার পেছনে তার মূল কারণ ছিল বাংলাদেশ হলো পুরোপুরিভাবে ভারত পরিবেষ্টিত। অতএব ভারতের সহায়তায় স্বাধীনতা অর্জিত হলে পরোক্ষভাবে ভারত হবে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণকারী ও শাসক। তিনি আশংকা করতেন যে, ভারত উৎপীড়কে পরিণত হবে এবং এ দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় তাদের সব ধরনের শক্তি কাজে লাগাবে।’
পিস কমিটি
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কতিপয় ডানপন্থী রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধ প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তান সরকারকে সহযোগিতা প্রদানের ঘোষণা দেয়। ৪ এপ্রিল পিডিপি নেতা নূরুল আমিনের নেতৃত্বে অধ্যাপক গোলাম আজম এবং খাজা খয়েরউদ্দিনসহ ১২ জন নেতার সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধিদল ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎকারীগণ নাগরিক শান্তি কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন। ৭ এপ্রিল কনভেনশন মুসলিম লীগের নেতা খান আব্দুস সবুর খান টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন। তারই সূত্র ধরে ৯ এপ্রিল ঢাকায় ডানপন্থী বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ এক সভায় মিলিত হয়ে ১০৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি ‘নাগরিক শান্তি কমিটি’ গঠন করেন। এ সভায় নিম্নলিখিত প্রস্তাব গৃহীত হয়।
(১) ঢাকা শহর শান্তি কমিটির এ সভা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতীয় হস্তক্ষেপের তীব্র নিন্দা করছে।
(২) এ সভা দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে আরেকটি যুদ্ধ না বাধানোর জন্য ভারতের প্র্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছে।
(৩) এ সভা মনে করে, ভারত সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দেশপ্রেমকে চ্যালেঞ্জ করেছে।
(৪) এ সভা দেশের সম্মান ও ঐক্য বজায় রাখতে দেশপ্রেমিক জনগণকে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আকুল আহ্বান জানাচ্ছে।
১৪ এপ্রিল কমিটির নাম পরিবর্তন করে নাম রাখা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি।’ কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি তাদের কাজ দ্রুত ও যথোপযুক্তভাবে চালিয়ে যাওয়া ও তাদের নীতি পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করার জন্য নিম্নলিখিত ২১-সদস্যবিশিষ্ট কার্যকরী কমিটি গঠন করে। (১) আহবায়ক সৈয়দ খাজা খয়েরউদ্দিন (২) একিউএম শফিকুল ইসলাম ( ৩) অধ্যাপক গোলাম আযম (৪) মাহমুদ আলী ( ৫) আবদুল জব্বার খন্দর ( ৬) মাওলানা সিদ্দিক আহমদ (৭) আবুল কাসেম (৮) মোহন মিয়া (৯) মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ মাসুম (১০) আব্দুল মতিন (১১) অধ্যাপক গোলাম সরোওয়ার (১২) ব্যারিস্টার আখতারউদ্দিন (১৩) পীর মোহসীনউদ্দিন (১৪) এএসএম সোলায়মান (১৫) একে রফিকুল হোসেন (১৬) নূরুজ্জামান (১৭) আতাউল হক খান (১৮) তোয়াহা বিন হাবিব (১৯) মেজর আফসারউদ্দিন (২০) দেওয়ান ওয়ারাসাত আলী (২১) হাকিম ইরতেয়াজুল রহমান।
কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির অফিস স্থাপন করা হয় মগবাজারস্থ ৫ নম্বর এলিফ্যাণ্ট লেনে। জেলা, মহকুমা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে শান্তি কমিটির শাখা প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। শান্তি কমিটিকে বলা হতো ‘পিস কমিটি।’
রাজাকার বাহিনী
লে. জেনারেল টিক্কা খান ১৯৭১ সালের পহেলা জুন ‘পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স’ ‘৭১ জারি করেন। এই অর্ডিন্যান্স জারির পর ১৯৫৮ সালের আনসার অ্যাক্ট বাতিল করা হয়। ১৯৭১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত অধ্যাদেশের আওতায় রাজাকার বাহিনীকে আধাসামরিক বাহিনী হিসাবে পুনর্গঠন করা হয়। মেজর জেনারেল জামশেদ ছিলেন রাজাকার বাহিনীর কমান্ডে। তিন থেকে চার হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে এক একটি রাজাকার ব্রিগেড গঠন করা হতো। প্রতিটি রাজাকার ব্রিগেডকে দু’টি নিয়মিত পাকিস্তানি ব্রিগেডের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিল হাল্কা। উপমহাদেশে ‘রাজাকার’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করা হয় ভারত বিভক্তির সময়। ১৯৪৭ সালে হায়দ্রাবাদ রাজ্যটি ভারতভুক্ত হয়। কিন্তু ঐ রাজ্যের নিজাম বাহাদুরের ইচ্ছে ছিল হয় স্বাধীন থাকা নয়তো পাকিস্তানে যোগ দেয়া। তিনি হায়দ্রাবাদকে স্বাধীন ঘোষণা করেন এবং তার রাজ্যটি রক্ষা করার জন্য একটি বাহিনী গঠন করেন। তিনি এ বাহিনীর নাম দিয়েছিলেন ‘রাজাকার’। পার্সী এই শব্দটির আভিধানিক অর্থ ‘স্বেচ্ছাসেবক।’
রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা ছিল গ্রাম থেকে আসা অশিক্ষিত, খেটে খাওয়া মানুষ। রাজাকার হলে মাসে মাসে বেতন পাওয়া যাবে এবং এক সময় চাকরিটা স্থায়ী হবে এই প্রলোভন তাদের সামনে ছিল। আর চাকরি স্থায়ী হলে পুলিশের মতো কিছু ‘বাড়তি ইনকাম’ করা যাবে সে স্বপ্নও ছিল। আদর্শিক কারণে রাজাকার হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত কম। মাদ্রাসার কিছু গরীব ছাত্রও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। তারা দ্বিবিধ উদ্দেশ্যে রাজাকার হয়েছিল। প্রথমত : চাকরির সম্ভাবনা এবং দ্বিতীয়ত: পাকিস্তান রক্ষার তাগিদ।
কোথাও কোথাও প্রলুব্ধ করে কিংবা ভয়ভীতি দেখিয়েও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়। যারা বাধ্য হয়ে রাজাকার হয়েছিল তাদের কেউ কেউ নিজের অস্ত্রসহ পালিয়ে এসে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। আর যারা রাজাকারে যোগ দিয়ে লুটপাট এবং নারী ধর্ষণের সুযোগ পেয়েছে তারা ক্রমান্বয়ে অপকর্মের মাত্রা বৃদ্ধি করেছে।
জুনে রাজাকার বাহিনী গঠন করার পর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই বাহিনীর সদস্যরা গ্রামেগঞ্জে, শহরেবন্দরে, হাটবাজারে, পথেঘাটে সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার ও নিপীড়ন চালিয়েছে। (১) পাকিস্তানি সৈন্যদের ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধার অবস্থানের খবর পৌঁছে দেয়া ছিল তাদের দায়িত্ব। এই সুযোগে তারা ব্যক্তিগত বা পারিবারিক শত্র“কে মুক্তিযোদ্ধা বলে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে তুলে দিয়েছে। (২) রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল মূলত হাটবাজার, ফেরিঘাট, রেলব্রিজ, সড়ক সেতু, স্লুইস গেট, রেল স্টেশন প্রভৃতি স্থানে। (৩) রাজাকাররা হাটে ঢুকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল জিনিসপত্র চাল, ডাল, লবণ, তেল, মাছ, মাংস, তরকারি, শাকসবজি ইত্যাদি নিয়ে যেতো। (৪) গ্রামে ঢুকে আর্মির নাম করে গরুছাগল, হাঁসমুরগি ইত্যাদি ধরে নিয়ে যেতো। (৫) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে কিংবা নিজেদের ক্যাম্পে বাংকার তৈরির জন্য ইটবালি বহন করার কাজে কিংবা আর্মির গাড়ি চলাচলের সুবিধার জন্য গ্রামের রাস্তা মেরামতের প্রয়োজন হলে রাজাকাররা গ্রাম থেকে লোক সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করতো। রাস্তায় চলাচলকারী পথিককেও তারা এসব কাজ করতে বাধ্য করতো। আর্মির নির্দেশে রাস্তার পার্শ্ববর্তী জঙ্গল পরিষ্কার করার কাজে গ্রামের যুবক বৃদ্ধ সবাইকে বাধ্য করা হতো।
আল-বদর বাহিনী
রাজাকার বাহিনী গঠনের পর আল-বদর বাহিনী গঠন করা হয়। তবে রাজাকারের অধ্যাদেশের মতো তাদের কোনো আইনগত ভিত্তি ছিল না। ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের পটভূমি স্মরণে আল-বদর নামকরণ করা হয়। পাকিস্তানি মেজর রিয়াজ হোসেন আল-বদর গ্র“পের প্রথম ব্যাচের সমাপনী অনুষ্ঠানে এ বাহিনীর নামকরণ করেন। মাদ্রাসার ছাত্র, শিক্ষক, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি ডানপন্থী দলগুলোর বাঙালি সমর্থকদের নিয়ে এ বাহিনী গঠন করা হয়। মোহাজির বিহারীরাও এ বাহিনীতে শামিল হয়। তারা অ্যাশ কালারের প্যান্ট ও খাকি শার্ট পরতো। বদর বাহিনীর দায়িত্ব ছিল (১) অপারেশনে অংশগ্রহণ (২) মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি (৩) জিজ্ঞাসাবাদ (৪) নিয়মিত সেনাবাহিনীর গাইড হিসাবে কাজ করা (৫) গুপ্ত হত্যা (৬) মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করা (৭) অগ্রবর্তী সৈন্যদের সাপ্লাই লাইন হিসাবে কাজ করা। এ বাহিনীকে ‘ডেথ স্কোয়াড’ হিসাবে গড়ে তোলা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রহরে আল- বদর বাহিনীর সদস্যরা দেশের সেবা বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে প্রথমে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে নির্মম দৈহিক নির্যাতনের পর রায়েরবাজার বধ্যভূমি ও মিরপুর গোরস্তানে নিয়ে হত্যা করে। ১৬ ডিসেম্বর আল-বদর আত্মসমর্পণ করে। বাঙালিরা তাদেরকে বিশ্বাসঘাতক হিসাবে চিহ্নিত করে। বদর বাহিনীকে যুদ্ধবন্দি করা হয়নি। তবে এ বাহিনীর বহু সদস্যকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয় অথবা কারারুদ্ধ কর হয়। নতুবা দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। ১৯৭৩ সালে মুজিব সরকার তাদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা মঞ্জুর করে।
আল-শামস বাহিনী
আল-শামস বাহিনী গঠন করা হয়েছিল প্রধানত অবাঙালি বিহারীদের নিয়ে। ‘শামস’ একটি আরবী শব্দ যার অর্থ সূর্য। আল শামস বাহিনীর দায়িত্ব ছিল বদর বাহিনীর অনুরূপ। এ বাহিনীও ডেথ স্কোয়াড হিসাবে কাজ করেছে। আল-শামস বাহিনী পুরোপুরি সক্রিয় হওয়ার আগেই মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে যায়।
বিহারী সম্প্রদায়
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এদেশে বসবাসরত বিহারী সম্প্রদায় পাকিস্তান বাহিনীকে সমর্থন দেয়। রাজাকার বাহিনীর অধিকাংশ সদস্য ছিল বিহারী। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্তির সময় শরণার্থী হিসাবে তারা নিরাপত্তা লাভের আশায় ভারতের বিহার থেকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে অভিবাসন করে। তাদের মনে ১৯৪৬ সালে বিহারের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু জমিদারদের নির্যাতনের অমোচনীয় স্মৃতি দগদগ করছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন দেখে তারা ভয় পেয়ে যায়। এ ভয় তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অবস্থান নিতে বাধ্য করে। তাদের অবস্থা হয়েছিল ডাঙ্গায় বাঘ পানিতে কুমির থাকার মতো।
সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি পাকিস্তান সরকার বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দেয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার এক কৌশল অবলম্বন করে। ডা. এ.এম. মালিককে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসাবে নিয়োগ দান করা হয় এবং ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী ডা. মালিককে গভর্নর হিসাবে শপথ বাক্য পাঠ করান। ডা. মালিক ১৮ সেপ্টেম্বর তার মন্ত্রিসভা গঠন করেন। তাদের নাম ও দপ্তরের বিবরণ নিচে দেয়া হলো:
আবুল কাশেম অর্থ
আব্বাস আলী খান শিক্ষা
আখতারউদ্দিন আহমদ বাণিজ্য ও শিল্প এবং আইন ও পার্লামেন্ট
এএসএম সোলায়মান শ্রম, সমাজকল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনা
আউং শু প্র“ বন, সমবায় ও মৎস্য এবং সংখ্যালঘু বিষয়
মাওলানা একেএম ইউসুফ রাজস্ব, পূর্ত, বিদ্যুৎ ও সেচ দপ্তর
মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক মৌলিক গণতন্ত্র ও স্থানীয় সরকার
নওয়াজিশ আহমদ খাদ্য ও কৃষি
মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ মজুমদার স্বাস্থ্য
অধ্যাপক শামসুল হক সাহায্য ও পুনর্বাসন।
জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের শূন্য আসনগুলোতে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ঘোষণা অনুযায়ী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের শূন্য আসনে মনোনয়নপত্র জমা দানের তারিখ যথাক্রমে ২০ ও ২১ অক্টোবর এবং নির্বাচনের তারিখ যথাক্রমে ১২ থেকে ২৩ ডিসেম্বরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে বলে ধার্য করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিযোগে ৭৯ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য ও ১৭৯ জন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের সদস্যপদ বাতিল করা হয় এবং তাদের অনুপস্থিতিতে বিচার করে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। উপ-নির্বাচনের জন্য ঘোষিত জাতীয় পরিষদের ৭৯ টি শূন্য আসনের ৫৮টিতে একজন করে প্রার্থী থাকায় তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এই ৫৮ জনের দলভিত্তিক সংখ্যা ছিল :
জামায়াতে ইসলাম ১৫
পিডিপি ১২
মুসলিম লীগ (কনভেনশন) ৭
মুসলিম লীগ (কাইয়ুম) ৭
মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) ৬
নেজামে ইসলাম ৬
পিপিপি ৫
মোট ৫৮
বাকি আসনে নির্বাচনের সুযোগ হয়নি। প্রাদেশিক পরিষদের শূন্য আসনেও নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জিত হয়। শুধু পূর্ব পাকিস্তানেই বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার অভিনয় করা হয়নি, কেন্দ্রেও বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। ৬ ডিসেম্বর কেন্দ্রে পিডিপি ও পিপিপি’র কোয়ালিশন সরকার গঠন করা হয়। এ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন নূরুল আমীন এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো নিযুক্ত হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে। অক্টোবরে রাজনৈতিক দলগুলোর উপর ২৬ মার্চ আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে জাতিসংঘে প্রতিনিধি প্রেরণ করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দেশের প্রায় সকল অফিস আদালত জনশূন্য হয়ে পড়ে। সরকার ২১ এপ্রিল জারিকৃত এক প্রেসনোটের মাধ্যমে সরকারি কর্মচারিদের কাজে যোগদানের নির্দেশ দেয়। একইদিন অন্য একটি ঘোষণায় তাজউদ্দিন আহমদ, তোফায়েল আহমেদ, এসএম নজরুল ইসলাম, আবদুল মান্নান ও আবিদুর রহমানকে ঢাকাস্থ সামরিক কর্তৃপক্ষের নিকট হাজির হওয়ার নির্দেশ জারি করা হয়।
১৪ মে এক ঘোষণায় কর্নেল ওসমানীকে ২০ মে উপ-সামরিক আইন প্রশাসকের সামনে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। পহেলা জুন সমস্ত সরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দকে কাজে যোগদান এবং ২ আগস্ট থেকে ক্লাস শুরু এবং পহেলা জুলাই থেকে বেসরকারি কলেজের শিক্ষকবৃন্দকে কাজে যোগদানের নির্দেশ দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্বিন্যাসে একটি কমিটি গঠন করা হয় এবং ৩১ আগস্টের মধ্যে রিপোর্ট করতে বলা হয়। ২১ আগস্ট এক বিজ্ঞপ্তিতে রাজশাহী বিভাগের ১৪ জন এমএনএ এবং ২১ আগস্ট চট্টগ্রাম বিভাগের ১৩ জন এমএনএকে সামরিক আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেয়া হয়। ২৪ আগস্ট এক ঘোষণায় বলা হয়, আওয়ামী লীগ দলীয় ৮৮ জন এমএনএ এবং ৯৪ জন এমপিএ’র সদস্যপদ বহাল রাখা হয়েছে। ২৮ আগস্ট এসব এমএনএ এবং এমপিদের নির্ভয়ে দেশে ফিরে আসার জন্য আহ্বান জানানো হয়। পহেলা সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসাবে টিক্কা খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন অধ্যাপক যথাক্রমে ড. মনিরুজ্জামান (বাংলা বিভাগ), ড. এনামুল হক (বাংলা বিভাগ) ও ড. এবিএম হাবিবুল্লাহ (ইসলামের ইতিহাস বিভাগ) কে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন। ৩ সেপ্টেম্বর আরেক আদেশে ড. মুনির চৌধুরী (বাংলা বিভাগ), ড. নীলিমা ইব্রাহিম (বাংলা বিভাগ) ও ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (ইংরেজি বিভাগ)কে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়। ৩ সেপ্টেম্বর বাংলা বিভাগের অস্থায়ী প্রভাষক পদে কর্মরত শিক্ষক সৈয়দ আকরাম হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ২ সেপ্টেম্বর সামরিক আইন প্রশাসকের দপ্তর থেকে জারিকৃত এক আদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ জন অধ্যাপক, ১৩ জন উচ্চপদস্থ সিভিল কর্মকর্তা, ৪৮ জন এমপি এবং ৩ সেপ্টেম্বর ১৪৫ জন এমপি ও ৪৪ জন ইপিসিএস অফিসারকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। ২১ সেপ্টেম্বর প্রবাসে বাংলাদেশ আন্দোলনে তৎপর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে পাকিস্তানের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। ফরেন সার্ভিসের ৮ জনকে ২৫ সেপ্টেম্বর বরখাস্ত করা হয়। এভাবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন, অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জীবনযাত্রা সচল করার নিষ্ফল প্রয়াস চালানো হয়।
(লেখাটি ‘২৬৭ দিনের মুক্তিযুদ্ধ’ থেকে নেয়া। বইটি প্রকাশ করেছে আফসার ব্রাদার্স)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন