সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী ১৮৩১ সালে শিখ বিরোধী জেহাদে বর্তমান পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের বালাকোটে শহীদ হন। ভারতের উত্তর প্রদেশের রায়বেরিলীতে তার জন্ম। তিনি হলেন তরিকা-ই-মোহাম্মদিয়ার অন্যতম নেতা। তাকে ভারতে ওয়াহাবী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করা হয়। অনুসারীরা তাকে আমিরুল মোমেনীন খেতাবে ভূষিত করেছিল। পাঞ্জাবে শিখদের হাতে নির্যাতিত মুসলমানরা সহায়তার জন্য সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীকে অনুরোধ করে। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি নিপীড়নমূলক শিখ শাসনের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। তিনি শাহ ওয়ালিউল্লাহর পুত্র শাহ আবদুল আজিজের চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়েছিলেন।
১৮৩৯ সালে শিখ রাজা রনজিৎ সিংয়ের মৃত্যুর পর পেশোয়ার শহরে তরিকা-ই-মোহাম্মদিয়ার নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয়। বৈরি স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় শিখরা তাকে আটক করে এবং কয়েক শো অনুসারীসহ হত্যা করে। সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পেশোয়ারে তার ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। রায়বেরিলীতে বসবাস করায় তিনি সৈয়দ আহমদ বেরেলভী বা ব্রেলভী নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৮২৬ সালে সৈয়দ আহমদ পেশোয়ার উপত্যকায় এসে পৌঁছলে শিখ বিরোধী মুসলিম প্রতিরোধ আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে। তার সঙ্গে ছিলেন অগণিত শিষ্য ও নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তিগত বন্ধু। ব্রেলভীর আন্দোলন ছিল মূলত ব্রিটিশ বিরোধী। কিন্তু ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীকে অধিক শক্তিশালী দেখতে পেয়ে তিনি পাঞ্জাবের শিখ রাজা রনজিৎ সিংয়ের বিরুদ্ধে তার জেহাদ পরিচালনা করেন। জেহাদ পরিচালনার ক্ষেত্র হিসেবে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশকে বেছে নেয়ার পেছনে তার একটি যুক্তি ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সীমান্ত প্রদেশের সব মুসলমান এবং প্রতিবেশি মুসলিম দেশ আফগানিস্তান তাকে নিরংকুশ সমর্থন দেবে। শিখ অধিকৃত কাশ্মীর ছিল তার পরবর্তী লক্ষ্যস্থল। ভারতকে দারুল হরব থেকে দারুল ইসলামে রূপান্তরিত করা ছিল
তার চূড়ান্ত লক্ষ্য। রায় বেরিলীতে দুই স্ত্রী রেখে তিনি সীমান্ত প্রদেশে অভিবাসন করেন। চিত্রলে ফাতেমা নামে এক মহিলাকে তিনি তৃতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন।
প্রাথমিক জীবন
১৭৮৬ সালে সৈয়দ আহমদ রায়বেরিলীর এক সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে পিতার মৃত্যু হলে তিনি স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি তার আগ্রহ ছিল কম। খেলাধূলা, শারীরিক অনুশীলন ও জিকিরের প্রতি তার ঝোঁক ছিল। উচ্চশিক্ষা লাভে ১৮ বছর বয়সে তিনি দিল্লির রহমানিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহর পুত্র শাহ আবদুল আজিজ। বহু অনুরোধের পর শাহ আবদুল আজিজ সৈয়দ আহমদের বায়াত গ্রহণ করেন এবং তাকে সূফিবাদে দীক্ষাদানে সম্মত হন। তিনি সৈয়দ আহমদকে কাদরিয়া ও নকশবন্দিয়া তরিকার পাঠ দেন। সৈয়দ আহমদের দ্রুত আধ্যাত্মিক অগ্রগতি ঘটে। চার বছর পর শাহ আবদুল আজিজ তাকে ইজাজাত ও খিলাফত দান করেন। ১৭৬২ সালে শাহ ওয়ালিউল্লাহর মৃত্যুর পর পুত্র আবদুল আজিজ তার স্থলাভিষিক্ত হন এবং তিনি তার পিতার ধর্মীয় আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান। ব্রিটিশরা দিল্লি অভিমুখে ধেয়ে আসতে শুরু করলে তিনি ভারতকে দারুল হরব (دار الحرب ) বা শত্র“ অধিকৃত ভূখণ্ড হিসেবে ঘোষণা করে জেহাদের ডাক দেন। ১৮০৩ সালে ব্রিটিশ সৈন্যরা দিল্লিতে অগ্রযাত্রা করলে এবং মোগল সম্রাট ব্রিটিশদের ক্রীড়নকে পরিণত হলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জেহাদ শুরু এবং গৌরবোজ্জ্বল ইসলামী শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহবান জানিয়ে তিনি একটি ফতোয়া জারি করেন।
সামরিক জীবন
২৫ বছর বয়সে সৈয়দ আহমদ একজন অশ্বারোহী হিসেবে নবাব আমির খানের নেতৃত্বে একটি মিলিশিয়া বাহিনীতে যোগদান করেন। আধুনিক যুদ্ধ কৌশল আয়ত্ত এবং ইউরোপীয় অস্ত্রশস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ গ্রহণে শাহ আবদুল আজিজ তাকে নবাবের মিলিশিয়া বাহিনীতে যোগদানের নির্দেশ দেন। একটি ক্ষুদ্র পরগনার বিনিময়ে আমির খান ব্রিটিশদের সঙ্গে আপোস করায় তিনি ৬ বছর পর মিলিশিয়া বাহিনী ত্যাগ করেন। সৈয়দ আহমদের দৃষ্টিতে আমির খানের এ উদ্যোগ ছিল ভারতে মুসলমানদের বৃহত্তম হুমকির কাছে আত্মসমর্পণ করার শামিল। মিলিশিয়া বাহিনী ছেড়ে সৈয়দ আহমদ দিল্লিতে ফিরে আসেন এবং সাবেক শিক্ষক শাহ আবদুল আজিজের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। সৈয়দ আহমদের ক্যারিশমা ও পরিপক্কতায় শাহ আবদুল আজিজ এত মুগ্ধ হন যে, তিনি তার ভাতিজা শাহ ইসমাইল ও তারা জামাতা মৌলভী আবদুল হাইকে তার হাতে বায়াত গ্রহণের পরামর্শ দেন। এ দু’জন সৈয়দ আহমদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অনুসারীতে পরিণত হন। শাহ আবদুল আজিজের অনুমোদন লাভ করায় সৈয়দ আহমদের সুনাম ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। হাজার হাজার লোক তার কাছে ছুটে আসে। এমনকি কলকাতায় অগণিত মানুষ তার পা ছুঁয়ে সালাম করে। ১৮২২ সালে সৈয়দ আহমদ হজ পালনে ভারত ত্যাগ করেন। যাত্রাপথে তিনি বহু জায়গায় বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে তিনি জেহাদের চেতনা ছড়িয়ে দেন। দূরদূরান্ত সফরকালে ব্রেলভী মুসলমানদের মধ্যে অমুসলিম সংস্কৃতির চর্চা দেখতে পান। মুসলমানদের হিন্দুদের পূজায় যোগদান করতে দেখে তিনি ব্যথিত হন। মুসলমানদের বিচ্যুতিতে মর্মাহত হলেও তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে, তাদের মূল চেতনা অক্ষত। মক্কায় তিনি তুরস্কের সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বাংলাদেশের হাজী শরিয়তউল্লাহ ও নিসার আলী তিতুমীর ছিলেন তার সমসাময়িক। মক্কায় তাদের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। তিনি তাদের সূচিত ফরায়েজী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দেন। ১৮২৬ সালে সৌদি আরব থেকে ভারতে ফিরে আসার পথে তিনি বহু বৈঠকে মিলিত হন। এসময় পাঞ্জাব ছিল শিখ রাজা রনজিৎ সিংয়ের নিয়ন্ত্রণে। রনজিৎ সিং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পর্যন্ত তার রাজ্যের সীমান্ত সম্প্রসারণ করেন। শিখ শাসনে মুসলমানরা দুর্ভোগের শিকার হয়। পাঞ্জাবে মুসলমানদের সংখ্যা ৬৬ থেকে ৫৫ শতাংশে নেমে আসে। কোনো কোনো জায়গায় আজান দেয়া নিষিদ্ধ ছিল। শিখদের আচরণ ছিল সৈয়দ আহমদের কাছে অসহ্য। তিনি পাঞ্জাব থেকে অমুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে জেহাদ পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেন। সৈয়দ আহমদ শিখদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মুজাহিদ সংগ্রহে পাঞ্জাব ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ সফর করেন। মুজাহিদ বাহিনী গঠনে তিনি শত শত মাইল ভ্রমণ করেন। এমনকি তিনি রাজস্থান, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও আফগানিস্তান পর্যন্ত ভ্রমণ করেন। আফগানিস্তানের আমির দোস্ত মোহাম্মদ খানের সঙ্গে তিনি সাক্ষাত করেন এবং শিখদের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা প্রতিহত করার জন্য তার কাছে সামরিক ও নগদ অর্থ সহায়তা চান। তিনি শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণায় তার দৃঢ়সংকল্প প্রকাশ করেন। দোস্ত মোহাম্মদ খান তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন এবং তাকে সম্ভব সব ধরনের সহায়তা প্রদানের প্রস্তাব দেন। এমনকি তিনি তাকে সহায়তা প্রদানে তার ভাই ও পেশোয়ারে আফগান গভর্নর সুলতান মোহাম্মদ খান ও ইয়ার মোহাম্মদ খানকে চিঠি লিখেন। মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর ব্রেলভীর জেহাদে যোগদানের চেতনার প্রতি সমর্থন জানান। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি ছেড়ে অনেকে শিখ বিরোধী জেহাদে যোগ দেয়। গোটা ভারতের মুসলমানরা ব্রেলভীর তহবিলে অর্থ যোগান দেয়। সৈয়দ আহমদ জেহাদের পতাকা উত্তোলন করেন এবং পশতু সম্প্রদায়ের লোকজনকে তার পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করেন। তিনি দেখতে পান যে, আফগান সৈন্যরা পরস্পরের প্রতি সন্দিহান এবং তার সঙ্গে জেহাদে যোগদানে প্রস্তুত নয়। ১৮২৬ সালে সৈয়দ আহমদ পেশোয়ারের কাছে আকোরা খাটকের সমভূমিতে তার সদরদপ্তর স্থাপন করেন। তিনি রাজা রনজিৎ সিংয়ের কাছে একটি বার্তা পাঠান। বার্তায় তিনি তাকে মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা মেনে নিতে অথবা মুজাহিদদের মোকাবিলা করার চরমপত্র দেন। রনজিৎ সিং চরমপত্র নাকচ করে দিলে সৈয়দ আহমদ আক্রমণ করতে বাধ্য হন। ইউসূফজাই বিদ্রোহ দমনে সহায়তা করার জন্য চার হাজার সৈন্যসহ বুধ সিং সন্ধানওয়ালিয়া আটক অভিমুুখে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু মহারাজা রনজিৎ সিংয়ের নির্দেশে তাকে ইয়ার মোহাম্মদ খান বারাকজাইয়ের কাছ থেকে রাজস্ব সংগ্রহে পেশোয়ার অভিমুখে রওনা দিতে হয়। সিন্ধু নদ অতিক্রম করার পরই সন্ধানওয়ালিয়া প্রথম ব্রেলভীর তৎপরতার কথা জানতে পারেন এবং খায়েরাবাদ দুর্গের কাছে তাঁবু খাটান। রনজিৎ সিং শয্যাগত অবস্থায় একটি বিশাল ইউসূফজাই বাহিনী নিয়ে ব্রেলভীর অগ্রযাত্রার সংবাদ পান। নওশেরা লড়াইয়ে ইউসূফজাইদের সাহস তখনো তার স্মৃতিতে উজ্জ্বল ছিল। এ সংবাদ পেয়ে তিনি সব সৈন্য সমবেত করেন এবং অবিলম্বে তাদেরকে সীমান্তে পাঠান।
পেশোয়ার বারাকজাই নামে পরিচিত চার ভাই ইয়ার মোহাম্মদ খান, সুলতান মোহাম্মদ খান, সাঈদ মোহাম্মদ খান ও পীর মোহাম্মদ খান দৃশ্যত শিখদের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করলেও গোপনে গোপনে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীকে সহায়তা করতেন। ব্রেলভী নওশেরা অভিমুখে অগ্রযাত্রা করলে বুধ সিং সন্ধানওয়ালিয়া তার অভিপ্রায় জানতে চান। জবাবে ব্রেলভী জানান, তিনি প্রথমে আটক দুর্গ দখল করবেন এবং পরে সন্ধানওয়ালিয়ার সঙ্গে লড়াই করবেন। ১৮২৬ সালের ২১ ডিসেম্বর তিনি খায়েরাবাদে শিখ দুর্গ অবরোধ করেন। সৈন্য সংখ্যা মুষ্টিমেয় হওয়ায় কিল্লাদার বুধ সিং সন্ধানওয়ালিয়া পিছিয়ে যান। পরবর্তীতে ব্রেলভী হাজরোথিতে শোচনীয়ভাবে শিখদের পরাজিত হন। শিখ গভর্নর সরদার হরি সিং নালওয়া ৮ হাজার সৈন্য নিয়ে নিকটবর্তী চাচে অবস্থান করছিলেন। পরিস্থিতি জানানো হলে তিনি একদিনের মধ্যে খায়েরাবাদে গিয়ে পৌঁছান। সৈয়দ আহমদের বিজয় তাকে একজন সফল সামরিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং তার সঙ্গে জেহাদে যোগদানে অন্যান্য গোত্রকে উৎসাহিত করে। শিগগির তার সৈন্য সংখ্যা দেড় লাখে উন্নীত হয়। তবে এসব সৈন্য ছিল বিভিন্ন গোত্র ও উপজাতির। তাদের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধের ঘাটতি ছিল মারাত্মক। অন্যদিকে তাদের প্রতিপক্ষ শিখরা ছিল উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্রের অধিকারী। অভিযান পরিচালনার কৌশল নিয়ে মুজাহিদদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। শিখরা অনৈসলামিক হিসেবে আখ্যা দিয়ে তাদের মধ্যকার মতবিরোধকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। তারা আরো দাবি করে যে, শাহ ওয়ালিউল্লাহর শিক্ষা গ্রহণ করে সৈয়দ আহমদের অনুচররা মুসলিম হিসেবে পরিচয় দেয়ার যোগ্যতা হারিয়েছে এবং তারা হলো ওয়াহাবী। তবে মুসলিম নেতৃবৃন্দ শিখদের এ ভ্রান্ত অভিমত মেনে নেননি।
১৮২৭ সালে সৈয়দ আহমদকে একজন ইমাম হিসেবে মনোনীত করে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ধর্মীয় ব্যাপারে তার ফয়সালাকে বাধ্যতামূলক বিবেচনা করা হতো এবং তার ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ব মুজাহিদ বাহিনী গঠনে বিভিন্ন মুসলিম গ্র“পগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে সহায়তা করে। সৈয়দ আহমদের হুমকি মোকাবিলায় মহারাজা রনজিৎ সিং সেনাপতি কুনওয়ার শের সিং ও ফরাসি ভাড়াটিয়া জেনারেল ভেঞ্চুরাকে পাঠান। সৈয়দ আহমদ ওকারার কাছে আটকে ৩৫ হাজার শিখ সৈন্যের ওপর আক্রমণ চালানোর প্রস্তুতি নেন। তবে তিনি জানতেন না যে, শিখরা ঘুষ দিয়ে পেশোয়ারে নিযুক্ত আফগান গভর্নর ইয়ার মোহাম্মদ খানকে বশ করে ফেলেছে। ইয়ার মোহাম্মদ খান রণাঙ্গন পরিত্যাগ করলে সৈয়দ আহমদের বাহিনী পরাজিত হয়। তিনি কাশ্মীরের কাছে তার সদরদপ্তর স্থানান্তরে বাধ্য হন। পরবর্তীতে মুজাহিদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইয়ার মোহাম্মদ নিহত হলেও তার ভাই সুলতান মোহাম্মদ খান লড়াই অব্যাহত রাখেন। শিখ মহারাজা রনজিৎ সিং তাকে পেশোয়ারের গভর্নর পদে নিযুক্তি দেন। তিনি মহারাজাকে তার নিহত ভাই ইয়ার মোহাম্মদ খানের বিখ্যাত ঘোড়া লেলি উপহার দেন। রনজিৎ সিং দীর্ঘদিন থেকে ঘোড়াটি নিজের অধিকারে নেয়ার চেষ্টা করছিলেন। ইয়ার মোহাম্মদ খান জীবিত থাকাকালে তিনি তাকে ৫০টি ঘোড়া ও অর্থ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইয়ার মোহাম্মদ সম্মত হননি। সেনাপতি কুনওয়ার শের সিং লেলিকে মহারাজা রনজিৎ সিংয়ের সামনে পেশ করলে তিনি খুশিতে আত্মহারা হয়ে যান।
সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী এমন একটি চুক্তিতে পৌঁছান যে, ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী খান ও সাধারণ মানুষ তাদের নিজ নিজ এলাকা শাসন করবে। তিনি উসর (উৎপন্ন শস্যের এক-দশমাংশ রাজস্ব) আদায়ের চেষ্টা করেন। তিনি তিনদিনের মধ্যে সকল বিধবা হিন্দু মহিলাকে বিয়ে দেয়ার জন্য চরমপত্র দিয়ে বলেন, নয়তো তাদের আত্মীয় স্বজনদের বাড়িঘর লুট করা হবে। তার এ চরমপত্রের প্রতিবাদে ইফসূফজাই সম্প্রদায়ের বহু লোক তাকে পরিত্যাগ করে। অনিচ্ছুক খানদের ওপর বলপ্রয়োগ করায় হোতি প্রধান সৈয়দ আহমদের প্রতি বৈরি হয়ে ওঠেন। তিনি পেশোয়ারের গভর্নর সুলতান মোহাম্মদের সঙ্গে একটি শক্তিশালী জোট গঠন করেন। এ জোট পরাজিত হলে ইসলামী সংস্কারবাদীরা চূড়ান্তভাবে পেশোয়ার দখল করে নেয়। ১৮৩০ সালে কয়েক মাস সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতাসীন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আপোস করার চেষ্টা করেন। ১৮৩০ সাল শেষ হওয়ার আগে একটি পরিকল্পিত অভ্যুত্থান ঘটে এবং পেশোয়ার ও সমভূমিতে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর অনুচরদের হত্যা করা হয়। মুসলমানদের বিরুদ্ধে অব্যাহত আত্মঘাতি লড়াইয়ে বিতৃষ্ণ হয়ে সৈয়দ আহমদ কাশ্মীর ও হাজারা মুক্ত করার উদ্দেশ্যে বালাকোটে যান। তিনদিকে পাহাড় পর্বত থাকায় বালাকোটকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। এখানেই সৈয়দ আহমদ জীবনের শেষ যুদ্ধে শাহাদাৎ বরণ করেন। স্থানীয় নেতৃবৃন্দ শিখদের কাছে পাহাড়ের ভেতরের একটি রাস্তার সন্ধান ফাঁস করে দিলে অপ্রস্তুত অবস্থায় তাকে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়।
২৬ এপ্রিল বন্ধু টঙ্কের নবাবের কাছে ব্রেলভীর চিঠি
আমি পাখলিতে (জায়গার নাম) অবস্থান করছি। এখানকার লোক উষ্ণ আতিথেয়তার সঙ্গে আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছে এবং তারা আমাদেরকে থাকার জন্য জায়গা দিয়েছে। তারা জেহাদে আমাদেরকে সাহায্য করার প্রতিশ্র“তি দিয়েছে। বর্তমানে আমি বালাকোট শহরে তাঁবু খাটিয়েছি। জায়গাটি কুনার গিরিপথে (নদী)। কাফের সৈন্যরা আমাদের কাছ থেকে খুব বেশি দূরে নয়। বালাকোটের তিনদিকে পাহাড় এবং একদিকে নদী থাকায় আল্লাহর রহমতে কাফেররা আমাদের কাছে পৌঁছতে পারবে না। অবশ্যই আমরা আমাদের নিজেদের উদ্যোগে যুদ্ধ শুরু করতে পারি। আগামী দু’তিন দিনের মধ্যে আমরা যুদ্ধ শুরু করার আশা করছি। আল্লাহর সহায়তায় আমরা বিজয়ী হবো। যুদ্ধে আমরা বিজয়ী হলে কাশ্মীর রাজ্যসহ ঝিলাম নদী বরারব সকল ভূখণ্ড দখল করবো। আমাদের বিজয়ের জন্য দিন রাত আল্লাহর কাছে দোয়া করো।
বালাকোটের যুদ্ধ
শিখ গভর্নর হরি সিং নালওয়া বালাকোট অবরোধে নেতৃত্ব দেন। তার সঙ্গে ছিলেন ফরাসি ভাড়াটিয়া জেনারেল জ্যা ফ্রাঁসোয়া অ্যালার্ড। হরি সিং বালাকোট ঘেরাও এবং মোজাফফরাবাদে খালসা বাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন পাঠাতে ক্যাপ্টেন শের সিংকে নির্দেশ দেন। লাহোর থেকে অতিরিক্ত সৈন্য এসে পৌঁছানো নাগাদ তিনি আটকে অবস্থান করেন। তিনি জানতে পারেন যে, সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর সঙ্গে মুজাহিদের সংখ্যা কয়েক হাজার। মিত্তি কোট পাহাড় ঘেরাওয়ে আরো কয়েকটি শিখ কোম্পানি অংশগ্রহণ করেছিল। ১৮৩১ সালের ৬ মে শুক্রবার সকালে আকস্মিকভাবে বালাকোটের যুদ্ধ শুরু হয়। সেদিনের সকালের একটি তুচ্ছ ঘটনা থেকে যুদ্ধ বেধে যায়। মুজাহিদদের তখনো নাস্তা শেষ হয়নি। মিত্তি কোট পাহাড় থেকে শত্র“ শিখদের গতিবিধির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছিল। এসময় পাতিয়ালার সৈয়দ চেরাগ আলী ক্ষীর খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সকালের মেন্যুতে ক্ষীর না থাকায় তিনি প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জাম সংগ্রহ করে ক্ষীর পাক করতে শুরু করেন। একদিকে তিনি পাতিলে হাতা দিয়ে নাড়ছিলেন এবং অন্যদিকে শিখদের প্রতি উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে খেয়াল রাখছিলেন। এসময় কাউকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে তিনি বলে উঠলেন: আমি লাল পোশাক পরিহিত একজন হুর দেখতে পাচ্ছি। সে আমাকে ডাকছে। এই বলে তিনি হাতা ফেলে দিয়ে বললেন, তিনি একমাত্র হুরের হাত থেকে ক্ষীর খাবেন। চেরাগ আলী সোজা পাহাড়ে ছুটে যান। ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটে যায় যে, কেউ কিছু বুঝতে পারেনি। ততক্ষণে চেরাগ আলী ধানখেতের মাঝে। তিনি কাদা মাড়িয়ে দৌড়াচ্ছিলেন। শিখরা দৃশ্যটি কিছুটা উপভোগ করে এবং রাইফেল দিয়ে ধানখেতের কাদায় গুলি করে তাকে হত্যা করে। সৈয়দ চেরাগ আলী হলেন বালাকোট যুদ্ধের প্রথম শহীদ। তার বোকামীর জন্য বালাকোটে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ মুজাহিদ সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীসহ কয়েক শত অকুতোভয় মুসলিম যোদ্ধাকে শহীদ হতে হয়। সৈয়দ চেরাগ আলী যাকে দেখছিলেন সে ছিল একজন শিখ সৈন্য। এসব শিখ সৈন্য মুজাহিদদের ওপর নজরদারি করছিল। অনিয়ন্ত্রিত আবেগে উচ্ছ্বসিত চেরাগ আলী কাদায় পূর্ণ ধানখেতের মধ্য দিয়ে সামনে ছুটে যান। এ ধানখেত ছিল শিখদের জন্য সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর পাতা একটি ফাঁদ। তিনি ধারণা করছিলেন যে, শিখরা পাহাড়ের চূড়া থেকে মিত্তি কোটে নেমে এসে মুজাহিদদের ওপর আক্রমণ চালাবে। এ ধারণা থেকে তিনি বালাকোট শহর ও মিত্তি কোট পাহাড়ের মধ্যকার ধানখেত পানিয়ে সয়লাব করে দেন। তিনি ভাবছিলেন আক্রমণকারী শিখরা কাদায় আটকা পড়বে এবং মুজাহিদরা হাঁসের মতো ধরে তাদের যমালয়ে পাঠাবে। অন্যদিকে শিখদের পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। তারা তাদের অবস্থানে অনড় থাকে। শিখরা চাইছিল মুজাহিদরা আগে হামলা করুক।
গুলিতে মারাত্মক বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে। সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী তার ইতিপূর্বের পরিকল্পনা পরিত্যাগ করেন এবং শিখদের ওপর আক্রমণ চালাতে তার অনুসারীদের নির্দেশ দেন। মুজাহিদরা সামনে ছুটে যায় এবং ধানখেতের কাদায় আটকা পড়ে। একইসঙ্গে শিখরাও এগিয়ে আসে। মুজাহিদদের আল্লাহু আকবর এবং শিখদের ওহে গুরুজি কি ফাতেহ ধ্বনির মধ্য দিয়ে সারাদিন তীব্র লড়াই অব্যাহত থাকে। শিখ গোলন্দাজ বাহিনী দু’ঘণ্টা কামানের গোলাবর্ষণ করে। বিপর্যয়ের মুখে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান। শিখরা পরাজিত মুজাহিদদের ৬ মাইল পর্যন্ত ধাওয়া করে তাদের সকল কামান, সুইভেল গান, উট ও রসদ দখল করে। ঢাক ঢোল পিটিয়ে ও গোলা ছুঁড়ে লাহোরে এ বিজয় উদযাপন করা হয়। ধরা পড়লে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী ও তার কমান্ডার শাহ ইসমাইলসহ বহু মুজাহিদকে শহীদ করা হয়। বালাকোটে তাদের সমাহিত করা হয়। সেখানে তাদের সম্মানে মাজার নির্মাণ করা হয়। ব্রেলভীর পরিবার টঙ্কের নবাবের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করে। শাহাদাৎ বরণের সময় ব্রেলভীর বয়স হয়েছিল ৪৬ বছর।
প্রায় দুই শো বছর পর ২০০৫ সালের ৬ অক্টোবর ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পে বালাকোট শহর মাটির সঙ্গে মিশে গেলেও অলৌকিকভাবে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী ও শাহ ইসমাইলের কবর ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। শহীদ মুজাহিদদের সংখ্যা তিন শো থেকে এক হাজার তিন শো পর্যন্ত উল্লেখ করা হচ্ছে। বালাকোট যুদ্ধে মুজাহিদদের পরাজয় ছিল জেহাদের জন্য একটি গুরুতর বিপর্যয়। ১৮৬৩ সাল পর্যন্ত উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পাহাড়ে এ আন্দোলন অব্যাহত ছিল। মুজাহিদদের হুমকি মোকাবিলায় ব্রিটিশরা একটি শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী পাঠায়। এই প্রথম ভারতের ইতিহাসে অত্যাচারী অমুসলিম শাসকের নির্যাতন থেকে মুসলমানদের মুক্তিদানে জেহাদ পরিচালনা করা হয়। পাটনা ছিল এ আন্দোলনের সদরদপ্তর। ঢাকা থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত ছিল তাদের নেটওয়ার্ক। এ সংগঠনের ভিত্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে সতীশ চন্দ্র মিত্তাল হরিয়ানা :: অ্যা হিস্ট্রিক্যাল পারস্পেক্টিভ শিরোনামে গ্রন্থের ৬৫ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন : Probably this was the first planned and highly organised revolutionary movement after the uprising of 1857. অর্থাৎ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ছাড়া এটাই ছিল সম্ভবত প্রথম পরিকল্পিত ও অত্যন্ত সংঘটিত বৈপ্লবিক আন্দোলন।
গাধার অলৌকিক গুণ
বালাকোটে যাবার পথে মুজাহিদরা বর্তমান এবোটাবাদের কাছে কোথাও তাঁবু খাটায়। তাদের সরবরাহ পথ বিচ্ছিন্ন করে দিতে শিখরা রাস্তার পাশের পাহাড়ের শীর্ষে সৈন্য মোতায়েন করে। পাহাড়ের মধ্য দিয়ে বহর পাঠানো ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় মুজাহিদরা চালক ছাড়া একটি গাধা যোগাড় করে। গাধা একবার কোনো রাস্তা পারাপার হলে চিরদিন স্মরণ রাখতে পারে। চালকের প্রয়োজন পড়ে না। মাল বোঝাই করে পাছায় একটি টোকা দিলেও হলো। গাধার এ অলৌকিক গুণের কথা শিখদের জানা না থাকায় সে রাত দিন রসদ নিয়ে আসা যাওয়া করতো। বুঝতে শিখদের অনেক সময় লাগে। একরাতে মাল বহনের সময় শিখরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। মুজাহিদরা তার মৃত্যুতে ব্যথিত হয় এবং একটি কবরে সম্মানের সঙ্গে তাকে সমাহিত করে। গাধার কবর খোটা কবর নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
(লেখাটি ‘মোগল সাম্রাজ্যের পতন’ থেকে নেয়া। বইটি প্রকাশ করেছে আফসার ব্রাদার্স)।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন