১৫৬৬ সালের ৬ আগস্ট হাঙ্গেরীর সিগেৎভার (Szigetvar) দুর্গ অবরোধ করা হয়। সিগেৎভার দুর্গ অবরোধ ছিল সুলতান সোলেমানের জীবনের শেষ অভিযান। ১৫৬৬ সালের জানুয়ারিতে তিনি শেষবার যুদ্ধযাত্রা করেন। এ অভিযানকালে নিজের তাঁবুতে স্বাভাবিকভাবে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সিগেৎভারকে কোনো কোনো সময় সিগেত-ও (Sziget) বলা হয়। এ দুর্গ সুলতান সোলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্টের ভিয়েনা অগ্রযাত্রায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নিকোলা সুবিচ জিরিনস্কির নেতৃত্বে হ্যাবসবার্গের সৈন্যবাহিনীর সাথে সুলতান সোলেমানের নেতৃত্বে অটোমান সৈন্যবাহিনীর মধ্যে এ লড়াই হয়। হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্য অটোমান সাম্রাজ্যের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। তবে বিজয়ী হলেও একই বছর ভিয়েনায় অটোমান সম্প্রসারণ থেমে যায়। ১৬৮৩ সালে ভিয়েনা যুদ্ধের আগে এ নগরীর প্রতি অটোমান হুমকি দেখা দেয়নি। বিজয়ী হওয়ার জন্য অটোমানদের চড়া মূল্য দিতে হয়। মাত্র এক মাসে ২০ হাজারের বেশি সৈন্য নিহত হয়। রবার্ট উইলিয়াম ফ্রেসারের মতে, সিগেৎভার দুর্গ অবরোধকালে ১০ হাজারের বেশি কামানের গোলা নিক্ষেপ করা হয়।
পূর্ববর্তী ঘটনা
সোলেমান সিগেৎভার অভিযানে যোগদানে তার পুত্র সেলিমকে নির্দেশ দেননি। সেলিম ছিলেন তখন তার একমাত্র জীবিত পুত্র। তবে তিনি তাকে মদ্যপানে নিষেধ করেন। সেলিম বিরত না হলে সোলেমান তার পুত্রের মদ্যপানের এক সঙ্গীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সেলিমের পুত্র মুরাদ তার পিতার কাছে যেতে একটি গ্যালে চাইলে সোলেমান তাকে দুই মাস্তুলওয়ালা একটি জাহাজ দেন। ১৫৬২ সালের পহেলা আগস্ট তিনি বিয়ে দেয়ার জন্য সেলিমের তিন কন্যাকে ডেকে পাঠান। এসমিহান সুলতানাকে বিয়ে দেয়া হয় সকোল্লু মেহমুদ পাশার কাছে, গাভহারহান সুলতানাকে কাপুদান পাশা পিয়ালি পাশার কাছে এবং শাহ সুলতানাকে প্রধান বাজপাখি বহনকারী হাসান আগার কাছে। একইদিন তিনি দামাত আবদুল করিম পাশার কাছে মরহুম শাহজাদা মোস্তফার কন্যা নার্গিস শাহকে বিয়ে দেন। সকোল্লুকে তিনি উজিরে আজমের পাশাপাশি সারাস্কার পদে উন্নীত করেন। অটোমান বংশের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে সকোল্লু সুলতান ছাড়া সব ক্ষমতার মালিক হয়ে যান।
পবিত্র রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ম্যাক্সিমিলিয়ান ছিলেন হ্যাবসবার্গের শাসক এবং ক্রোয়েশীয় অভিজাত ও অভিজ্ঞ সেনাপতি নিকোলা সুবিচ জিরিনস্কি ছিলেন সিগেৎভার দুর্গের কমান্ডার। চূড়ান্ত লড়াইয়ে জিরিনস্কি নিজে এবং তার দুর্গের ২ হাজার তিন শো সৈন্যের প্রায় সবাই নিহত হয়। যুুদ্ধের শেষ দিন নিহত হয় ৬ শো সৈন্য। সুলতান সোলেমানের মূল লক্ষ্য ছিল উত্তর হাঙ্গেরীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ইগার (Eger)। কিন্তু তিনি শুনতে পান যে, সিকলোস শহরে জিরিনস্কি তার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছেন এবং সেখানে তিনি একটি বিরাট অটোমান সরবরাহ বহর ধ্বংস করেছেন। জিরিনস্কির এ তৎপরতার জবাবে সুলতান সোলেমান তার মূল পরিকল্পনা সংশোধন করেন এবং সিগেৎভারে জিরিনস্কির বিরুদ্ধে অগ্রযাত্রা করেন। নিকোলা সুবিচ জিরিনস্কি ছিলেন ক্রোয়েশিয়ার একজন শীর্ষ ভূস্বামী, সীমান্ত যুদ্ধে অভিজ্ঞ এবং ১৫৪২ থেকে ১৫৫৬ সাল পর্যন্ত একজন বান (ক্রোয়েশীয় রাজকীয় প্রতিনিধি)। প্রাথমিক জীবনে ভিয়েনা অবরোধে তিনি কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন এবং একটি সফল সামরিক জীবন অনুসরণ করেন।
১৫২৬ সালে মোহাকচ যুদ্ধের পর হাঙ্গেরী ও ক্রোয়েশিয়া উভয় দেশের অভিজাতরা প্রথম ফার্ডিনান্ডকে রাজা মনোনীত করেন। অন্যদিকে টান্সিলভানিয়ার ভইভড জন জাপোলিয়া হাঙ্গেরীর সিংহাসন দাবি করেন। পরস্পরবিরোধী দুজন রাজার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় হ্যাবসবার্গ ও তার মিত্রদের সাথে অটোমান সাম্রাজ্যের উপর্যুপরি যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধ লিটল ওয়ার ইন হাঙ্গেরী নামে পরিচিত। ১৫২৯-১৫৫২ সাল নাগাদ স্থায়ী যুদ্ধে উভয়পক্ষের বিপুল প্রাণহানি ঘটে। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি হাঙ্গেরী ব্যাপক ভূখণ্ড হারায়। তবে ইগার অবরোধে বিজয়ী হলে তাদের ক্ষতি অনেকটা পুষিয়ে যায়। ইগারে পরাজিত হলে অটোমানরা ১৫৬৬ সালে ইউরোপে নতুন করে দিগি¦জয় শুরু করে। সিগেৎভার অভিযান নাগাদ হাঙ্গেরীতে অটোমান অভিযান চলতে থাকে। ১৫৬৬ সালের ৬ আগস্ট থেকে ৮ সেপ্টেম্বর নাগাদ সিগেৎভার যুদ্ধ স্থায়ী হয়। এ যুদ্ধকে এত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয় যে, ফরাসি ধর্মযাজক ও রাষ্ট্রনায়ক কার্ডিনাল রিচেলিউ মন্তব্য করেছিলেন, এ যুদ্ধ সভ্যতাকে রক্ষা করেছে। সিগেৎভার যুদ্ধ হাঙ্গেরী ও ক্রোয়েশিয়ায় এখনো বিখ্যাত এবং দ্য সীজ অব সিগেৎ শিরোনামে হাঙ্গেরীর মহাকাব্যিক কবিতা এবং নিকোলা সুবিচ জিরিনস্কি শিরোনামে ক্রোয়েশিয়ান নাটক রচনায় অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
পটভূমি
১৫২৬ সালের ২৯ আগস্ট মোহাকচের যুুদ্ধে রাজা দ্বিতীয় লুইয়ের নেতৃত্বাধীন হাঙ্গেরী রাজ্যের সৈন্যবাহিনী সোলেমানের নেতৃত্বাধীন অটোমান সৈন্যবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। লড়াইকালে রাজা লুই নিহত হন। রাজা লুই নিঃসন্তান হওয়ায় হাঙ্গেরী রাজ্য ভেঙ্গে যায়। হাঙ্গেরী ও ক্রোয়েশিয়া উভয়ে বিতর্কিত ভূখণ্ডে পরিণত হয়। তাদের ওপর হ্যাবসবার্গ ও অটোমান সাম্রাজ্যের ভূখণ্ডগত দাবি ছিল। হ্যাবসবার্গ রাজবংশের সন্তান ও রোমান সম্রাট পঞ্চম চার্লসের ভাই প্রথম ফার্ডিনান্ড নিহত রাজা দ্বিতীয় লুইয়ের বোনকে বিয়ে করেন এবং হাঙ্গেরী ও ক্রোয়েশিয়া উভয় দেশের অভিজাতরা তাকে রাজা মনোনীত করেন। হাঙ্গেরীর সিংহাসন নিয়ে রাজা ফার্ডিনান্ড ও টান্সিলভানিয়ার ভইভড জন জাপোলিয়ার মধ্যে বিরোধ বাধে। সুলতান সোলেমান জাপোলিয়াকে গোটা হাঙ্গেরীর রাজা বানিয়ে দেয়ার প্রতিশ্র“তি দেন। ফার্ডিনান্ড গোটা হাঙ্গেরীতে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় অগ্রযাত্রা করেন এবং ১৫২৭ সালে জন জাপোলিয়ার কাছ থেকে রাজধানী বুদা কেড়ে নেন। ১৫২৯ সালে অটোমানদের পাল্টা হামলায় ফার্ডিনান্ড তার সব ভূখণ্ড হারান। সুলতান সোলেমান হাঙ্গেরী থেকে ফার্ডিনান্ডের সৈন্যবাহিনীকে ছুঁড়ে ফেলে দেন এবং রাজধানী বুদায় প্রবেশ করেন। বুদা প্রদেশ নামে হাঙ্গেরীর মূল ভূখণ্ডকে অটোমান সাম্রাজ্যে একীভূত করা হয়। ১৫২৯ সালে ভিয়েনা অবরোধ ছিল অস্ট্রিয়ার রাজধানী দখলে সুলতান সোলেমানের প্রথম প্রচেষ্টা। এ অবরোধ অটোমানদের শক্তির সর্বোচ্চ সীমা নির্দেশ করে এবং মধ্য ইউরোপে অটোমান সম্প্রসারণের চূড়ান্ত ধাপ হিসেবে চিিহ্নত হয়।
১৫৬৫ ও ১৫৬৬ সালের গোড়ার দিকে সুলতান সোলেমান ও পবিত্র রোমান সম্রাট ম্যাক্সিমিলিয়ানের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ম্যাক্সিমিলিয়ান অটোমান বে তেল্লি হাসান পাশার অধিকৃত ভূখণ্ড ফেরত দাবি করছিলেন। আলোচনা ব্যর্থ হলে ম্যাক্সিমিলিয়ান যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং উজিরে আজম সকোল্লু মেহমেদ পাশা তার ভাতিজা বসনিয়ার সকোল্লু মোস্তফা বে’কে ম্যাক্সিমিলিয়ানের বিরুদ্ধে অগ্রযাত্রা করার নির্দেশ দেন। মোস্তফা বে ক্রুপা ও ডাভোর দখলে সক্ষম হন। সুলতান সোলেমান অবিলম্বে রোমান সম্রাট ম্যাক্সিমিলিয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং উজিরে আজম সৈন্যবাহিনীর অগ্রযাত্রার ব্যবস্থা করেন। তিনি অগ্রভাগে যাত্রা করেন এবং সুলতানের আগমনের প্রস্তুতি নেন।
লিটল ওয়ার
১৫২৯-১৫৫২ সাল পর্যন্ত বছরগুলো লিটল ওয়ার হিসেবে পরিচিত। ১৫২৯ সালে সুলতান সোলেমানের ভিয়েনা অবরোধ ব্যর্থ হলে ১৫৩০ সালে হৃত ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারে রাজা ফার্ডিনান্ড পাল্টা হামলা চালান। জন জাপোলিয়া বুদার ওপর তার হামলা নস্যাৎ করে দেন। তবে ফার্ডিনান্ড গ্রান (ইস্টারগম) এবং গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সীমান্ত দানিয়ুব বরাবর আরো কয়েকটি বন্দর দখলে সফল হন। ১৫৩২ সালে সুলতান সোলেমান জবাব দেন। তিনি এক লাখ ২০ হাজার সৈন্য নিয়ে পুনরায় ভিয়েনা অবরোধ করেন। ফার্ডিনান্ড গান্স (কোসেগ) রক্ষায় মাত্র ৭ শো সৈন্য রেখে পিছু হটেন। এসব সৈন্যের কোনো কামান ছিল না। অটোমান উজিরে আজম ইব্রাহিম পাশা কোসেগ দুর্গের দুর্বল প্রতিরক্ষা আঁচ করতে পারেননি। অবরোধ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে সুলতান সোলেমান তার সাথে যোগদান করেন।
ক্রোয়েশীয় ক্যাপ্টেন নিকোলা জুরিসিচ ও তার ৮০০ সৈন্যের দুর্গ ২৫ দিনের বেশি অটোমানদের ঊনিশটি পূর্ণাঙ্গ হামলা এবং বিরামহীন গোলাবর্ষণ মোকাবিলা করে। উদার শর্তে শহরকে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়া হয়। সুলতান সোলেমান ও ফার্ডিনান্ডের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলে অটোমানরা পিছু হটে। হ্যাবসবার্গ রাজবংশ অটোমানদের আশ্রিত জন জাপোলিয়াকে হাঙ্গেরীর রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এ চুক্তি ফার্ডিনান্ড ও জন জাপোলিয়া কাউকে সন্তুষ্ট করতে না পারায় সীমান্ত বরাবর তাদের সৈন্যবাহিনী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ১৫৩৭ সালে ফার্ডিনান্ড চুক্তি ভঙ্গ করে ওসিজেকে জন জাপোলিয়ার সৈন্যবাহিনীকে অবরোধ করেন। মোহাকসের মতো এ অবরোধ একটি বিপর্যয়ে পরিণত হয়। অটোমান উদ্ধারকারী বাহিনী অস্ট্রীয়দের গুঁড়িয়ে দেয়। পুনরায় ভিয়েনা আক্রমণ করার পরিবর্তে সুলতান সোলেমান দক্ষিণ ইতালির ওট্রান্টোতে অভিযান চালান। ১৫৩৮ সালে প্রিভেজায় নৌযুদ্ধে অটোমানদের বিজয় হ্যাবসবার্গ-নেতৃত্বাধীন জোটের আরেকটি পরাজয় হিসেবে চিিহ্নত হয়। ১৫৪০ সালে জন জাপোলিয়া পরলোকগমন করলে তার শিশু পুত্র জন দ্বিতীয় সিগিসমান্ড জাপোলিয়া তার স্থলাভিষিক্ত হন এবং তার কাছে টান্সিলভানিয়ার শাসনভার অর্পণ করা হয়। সিগিসমান্ডের রাজত্বের অধিকাংশ সময় সুলতান সোলেমানের অব্যাহত সমর্থনে তার মা ইসাবেলা জাগিওলন দেশ শাসন করেন। ১৫৭০ সালে সিংহাসন ত্যাগ করা নাগাদ দ্বিতীয় সিগিসমান্ড হাঙ্গেরীর নামমাত্র রাজা হিসেবে বহাল থাকেন এবং দেশকে হ্যাবসবার্গ শাসনে ন্যস্ত করেন। ইসাবেলা জাগিওলনকে সহায়তা দানের আহক্ষানে অটোমানরা সাড়া দেয় এবং বুদা অবরোধ করে। ১৫৪১ সালে বুদা অবরোধে হ্যাবসবার্গ আবার শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। ১৫৪৩ সালের এপ্রিলে সুলতান সোলেমান হাঙ্গেরীতে আরেকটি অভিযান চালান এবং ব্রান ও অন্যান্য বন্দর দখল করে নেন। এতে হাঙ্গেরীর অধিকাংশ ভূখণ্ড অটোমান নিয়ন্ত্রণে ফিরে আসে। ১৫৪৩ সালের আগস্টে অটোমানরা ইস্টারগম (Esztergom) অবরোধে বিজয়ী হয়। সুলতান সোলেমান ১৫৪৩ সালের ২৫ জুলাই হাঙ্গেরীর এ শহর অবরোধ করেন এবং ১০ আগস্ট শেষ হয়। দুসপ্তাহের অবরোধে অটোমানরা বিজয়ী হয়। চুক্তি অনুযায়ী হাঙ্গেরী অভিযানে ফরাসি সৈন্যরা অটোমানদের সাথে যোগদান করে। ১৫৪৩-৪৪ সালে অটোমানদের সহায়তায় একটি ফরাসি আর্টিলারি ইউনিট পাঠানো হয়। এ ইউনিটকে অটোমান সৈন্যবাহিনীতে সংযুক্ত করা হয়। ১৫৪২ সালে অস্ট্রিয়ার রাজা ফার্ডিনান্ড বুদা পুনর্দখলের ব্যর্থ চেষ্টা করায় ইস্টারগম অবরোধ করা হয়। ইস্টারগম অবরোধ শেষ হলে তিনটি হাঙ্গেরীয় শহর শেকেসফারভার (Szekesfehervar), সিকলোস (Siklos) ও সিগেদ (Szeged) দখল করা হয়। এ তিনটি শহর দখল করা হলে বুদার নিরাপত্তা আরো নিশ্চিত হয়।
পশ্চিম ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগরে ফরাসি মিত্রদের তৎপরতার কোনো খবর না পাওয়ায় সোলেমান ভিয়েনার সামনে এগিয়ে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। অটোমানদের সফল অভিযানের পর ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের মধ্যস্থতায় ১৫৪৫ সালে রোমান সম্রাট পঞ্চম চার্লসের সাথে এক বছর মেয়াদী একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পারস্যের বিরুদ্ধে অভিযানে ব্যস্ত থাকায় সুলতান সোলেমান নিজেও বৈরিতা অবসানের পক্ষে ছিলেন। দুবছর পর ১৫৪৭ সালে আদ্রিয়ানোপল চুক্তিতে পঞ্চম চার্লস ও ফার্ডিনান্ড হাঙ্গেরীতে অটোমানদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ স্বীকার করে নেন। এমনকি ফার্ডিনান্ড উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলীয় হাঙ্গেরীতে হ্যাবসবার্গের নিয়ন্ত্রণে বিনিময়ে বার্ষিক ত্রিশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা পরিশোধে সম্মত হন। ১৫৫২ সালে কারা আহমদ পাশা ও সকোল্লু মেহমুদ পাশার নেতৃত্বে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার অটোমান সৈন্য উত্তর হাঙ্গেরীতে ইগার দুর্গ অবরোধ করে। সুলতান সোলেমান ইগার আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়া নাগাদ হ্যাবসবার্গ ও অটোমানদের মধ্যে আরেকটি চুক্তি হয়। ইস্তভান ডোবোর নেতৃত্বে হাঙ্গেরীর দুহাজার তিন শো সৈন্য অটোমান হামলা প্রতিহত এবং দুর্গ রক্ষা করে। ইগার দুর্গ অবরোধে অটোমানরা ১৬টি বৃহৎ এবং দেড় শো মাঝারি আকারের কামান এবং দুহাজার উট ব্যবহার করে। পক্ষান্তরে প্রতিরোধকারীদের কাছে ছিল ৬টি বড় কামান, এক ডজন ক্ষুদ্র কামান এবং তিন শো ট্রেন্স গান। উভয়পক্ষের শক্তিতে এ ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও ইগার দুর্গ ৫টি বৃহত্তম অটোমান হামলা এবং কামানের বিরামহীন গোলাবর্ষণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। অবরোধ শেষ হওয়ার আগে দুর্গের অভ্যন্তরে কামানের প্রায় ১২ হাজার গোলা পতিত হয়। ৩৯ দিনের রক্তক্ষয়ী অবরোধ শেষে অটোমানরা ইগার থেকে পিছু হটে। ইস্তভান ডোবোর দুজন দেহরক্ষীসহ এক-তৃতীয়াংশ প্রতিরোধকারী নিহত হয়। ইগার অবরোধ নিষ্ফল প্রমাণিত হয় এবং হ্যাবসবার্গ বিজয়ী হলে হাঙ্গেরীর ভৌগোলিক ক্ষতির অবসান ঘটে। ইগারের অস্তিত্ব বজায় থাকায় অস্ট্রীয়রা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, হাঙ্গেরী নিয়ে লড়াই তখনো শেষ হয়নি এবং ১৫৬৬ সালে হাঙ্গেরীতে অটোমানরা পুনরায় অভিযান চালায়।
১৫৬৬ সালের অভিযান
১৫৬৬ সালের জানুয়ারিতে সুলতান সোলেমান তার জীবনের শেষ যুদ্ধযাত্রা করেন। তার বয়স ছিল তখন ৭২ বছর। গেঁটে রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তিনি পাল্কিকে চড়ে যাত্রা করেন। তিনি নামমাত্র ২৩তম সামরিক অভিযানে নেতৃত্ব দেন। ১৫৬৬ সালের পহেলা মে সুলতান একটি বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে কন্সটান্টিনোপল ত্যাগ করেন। জামুনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় সৈন্যবাহিনীর একটি অংশ ভারাজদিন অতিক্রম করে এবং ভিয়েনা অভিমুখে অগ্রযাত্রা করার আগে ইগারে আঘাত হানে। নিকোলা সুবিচ জিরিনস্কি অটোমান সানজাক বে তিরহাল মোহাম্মদকে পরাজিত এবং তাকে ও তার পুত্রকে হত্যা করেন। এছাড়া তিনি ১৭ হাজার ডুকাট (স্বর্ণমুদ্রা) আটক করেন। সকোল্লু মেহমেদ পাশা কুর্ণিশ করে সুলতানকে এ খবর দেন। খবরটি খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলেও সুলতান চিন্তিত হন। তিনি সারাস্কার সকোল্লুকে বলেন, আমরা সিগেৎভারে যাবো। সকোল্লু নির্দেশ পালনে প্রস্তুত হন। সেখানে হ্যাবসবার্গ সৈন্যবাহিনী শান্তি বিনষ্ট এবং অটোমান আশ্রিত তরুণ রাজা জন সিগিসমান্ডকে হয়রানি করছিল। আরো উত্তরে এবলাউয়ে অস্ট্রীয় সৈন্যদের দেখা গিয়েছিল।
সকোল্লু সৈন্যদের যাত্রাপথ পরিবর্তনের কোনো কারণ দেখছিলেন না। সিগেৎভার ছিল পানি পরিবেষ্টিত একটি ছোট্ট গ্রাম। সেখানে একটি শক্তিশালী দুর্গ ছাড়া আর কিছু ছিল না। নিকোলা জিরিনস্কি এ দুর্গ দখল করে নিয়েছিলেন। সিগেৎভারের সাথে মাল্টার মিল থাকায় সোলেমান বিস্মিত হন। সিগেৎভারে তিনি পরাজিত হতে প্রস্তুত নন। পরদিন তিনি ঘোড়ার গাড়িতে এ গ্রামের পশ্চিমে যাবার ঘোষণা দেন। সকোল্লু মাথা তোলেন। তিনি দ্রুত চিন্তা করছিলেন। হাজার হাজার সৈন্যের যাত্রাপথ কিভাবে ঘুরিয়ে দেয়া যায় তা নিয়ে ভাবছিলেন। তিনি মুখ খোলার আগেই সোলেমান বললেন, মেহমেদ সকোল্লু, আমি সেখানে যেতে চাই। সুলতান কঠোর কণ্ঠে নির্দেশ দেয়ায় সারাস্কার নীরব হয়ে যান। সকোল্লু ভাবছিলেন তার মহান প্রভু সত্যি নির্বোধ কিনা। তিনি মাথা নিচু করে বললেন, জাঁহাপনা আমি আপনার নির্দেশ শুনতে পেয়েছি। তবে ঘোড়ার গাড়ির চেয়ে নৌকা ভালো হবে। কারাদেনিজে (কৃষ্ণসাগর) বহু গ্যালে আছে। আপনি জলপথে সিগেৎভারে যেতে পারেন। সকোল্লু নিশ্চিতভাবে সিগেৎভারের রাস্তা চিনতেন। কেননা দ্রাভি নদীর তীরে এবং পর্বতমালার পশ্চিমে ছিল তার পৈত্রিক বাড়ি।
দ্রাভি নদীতে সুলতানের জন্য একটি প্রমোদতরীর ব্যবস্থা করা হয়। এতে ছিল সোনালী রংয়ের একটি অর্ধচন্দ্র এবং চন্দ্রাতপ। সুলতান চন্দ্রাতপের নিচে শুয়ে রাস্তার দুপাশের দৃশ্য দেখছিলেন। তার বামদিকে ছিল পর্বত। তিনি রাস্তায় লোকজন দেখতে পান। প্রমোদতরীর পাশাপাশি কয়েকটি ষাড় একটি বিশাল কামান বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল। কামানের নাম ছিল কাৎজিয়ানার। অস্ট্রিয়ার সেনাপতি কাৎজিয়ানারের নামানুসারে এ কামানের নামকরণ করা হয়। একবার সেনাপতি কাৎজিয়ানার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে অটোমানদের কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সোলেমান একটি মুচকি হাসি দেন। ক্ষণকাল তিনি ভাবছিলেন কামান ও গোলাবারুদ না থাকলে অথবা সাগর পাড়ি দেয়ার জন্য জাহাজ না থাকলে কী উপায় হতো। সিগেৎভারের উপকণ্ঠে সোলেমানের জন্য একটি তাঁবু খাটানো হয়। তিনি তাঁবুর দিকে এগিয়ে গেলে জেনিসারির আগা তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য ঘোড়ার গাড়ির দরজা পর্র্যন্ত এগিয়ে যান। আগা তাকে নিচে নামতে অনুরোধ করেন। লাল টকটকে কাপড়ে সিগেৎভার দুর্গের শীর্ষদেশ আচ্ছাদিত ছিল। সোলেমান দুর্গের দিকে তাকান। এসময় অশ্বারোহী সৈন্যরা তার চারপাশে গিজগিজ করছিল এবং বাতাসে তার পতাকা উড়ছিল। দুর্গ থেকে সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছিল। খ্রিস্টানরা দুর্গে ধাতব প্লেট লাগিয়ে রাখে যাতে সূর্যের আলো ঝলসে ওঠে। সুলতান সোলেমানের আগমন টের পেয়ে দুর্গ থেকে কামানের গোলাবর্ষণ করা হয়। সুলতান সোলেমান সিগেৎভার অবরোধে উজিরে আজম সকোল্লু মেহমেদ পাশার নেতৃত্বে একটি সৈন্যবাহিনী পাঠান। অন্যদিকে তিনি অবস্থান করছিলেন হারসাঙ্গে। বুদিনের কমান্ডার আরসালান পাশা ভারপালোটা, ভেজপ্রেম ও টাটা শহর হারান। সুলতান আরসালান পাশার মাথা কেটে আনার জন্য ১৫ জন সৈন্যের একটি প্লাটুন পাঠান। কিন্তু আরসালান তিনদিন আগে তার সৈন্যদের পরিত্যাগ করেন এবং সুলতানের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য রওনা দিয়েছিলেন। সুলতান উজিরে আজম সকোল্লু মেহমেদ পাশাকে একটি চিঠি দেখান। চিঠিতে আরসালান সুলতানকে অবজ্ঞা করেছিলেন। ৩ আগস্ট আরসালান ১৫ জন ভারি অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে সুলতানের তাঁবুতে এসে উপস্থিত হন। এ সময় উজিরে আজম তার আচরণের জন্য তাকে ভর্ৎসনা করেন এবং তাকে দেশদ্রোহিতার জন্য অভিযুক্ত করেন। উজির তার পদ কেড়ে নেন এবং তার ভাতিজা সকোল্লু মোস্তফা বে’কে তার স্থলে নিয়োগ দেন। সুলতান উজিরে আজম সকোল্লু মেহমেদ পাশার পুত্র কুর্ট বে ও হাসান বে’কে সাথে নিয়ে পিসিসে এসে পৌঁছান। ৪৯ দিন অগ্রযাত্রার পর সোলেমানের সৈন্যবাহিনী ১৫৬৬ সালের ২৭ জুন বেলগ্রেডে পৌঁছে। বেলগ্রেডে তিনি জন সিগিসমান্ড জাপোলিয়ার সাথে মিলিত হন। সিকলোসে একটি অটোমান দুর্গে জিরিনস্কির সফল আক্রমণের সংবাদ পেয়ে সুলতান সোলেমান ইগারে তার অভিযান স্থগিত রাখার ঘোষণা দেন এবং জিরিনস্কির হুমকি নির্মূলে সিগেৎভার দুর্গ দখলের সিদ্ধান্ত নেন।
অবরোধ
১৫৬৬ সালের পহেলা মে উজিরে আজমসহ সুলতান সোলেমান কন্সটান্টিনোপল ত্যাগ করেন। তারা সোফিয়া, নিস ও বেলগ্রেডের মধ্য দিয়ে সেমলিনে অগ্রযাত্রা করেন। সেমলিনে তরুণ জন জাপোলিয়া সুলতানকে সম্মান জানানোর জন্য হাজির হন। তাকে আন্তরিকভাবে অভ্যর্থনা জানানো হয়। সেমলিন থেকে আরলাউ অবরোধে সুলতানের অগ্রযাত্রা করার কথা ছিল। কিন্তু তিনি মনোভাব পরিবর্তন করেন এবং শক্তিশালী সিগেৎভার দুর্গ অবরোধের সিদ্ধান্ত নেন। ১৫৬৬ সালের ২ আগস্ট অটোমান অগ্রবর্তী বাহিনী সিগেৎভারে এসে পৌঁছে। দুর্গ রক্ষকরা বের হয়ে যাবার কয়েকটি সফল অভিযান চালায় এবং এতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অটোমান সৈন্য নিহত হয়। ৫ আগস্ট সুলতান সোলেমান উজিরে আজম সকোল্লু মেহমেদ পাশার পুত্র কুর্ত বে এবং হাসান বে’সহ মূল বাহিনী নিয়ে পিসিচে পৌঁছান এবং সাইমিলিহোভ পাহাড়ে তার শাহী তাঁবু খাটান। এ তাঁবু থেকে তিনি যুদ্ধের পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করতে পারতেন। সুলতান তার তাঁবুতে অবস্থান করতেন। এখানে তিনি উজিরে আজম মেহমেদ পাশার কাছ থেকে মৌখিকভাবে যুদ্ধের অগ্রগতির খবর পেতেন। উজিরে আজম সকোল্লু মেহমেদ পাশা ছিলেন অটোমান সৈন্যবাহিনীর অপারেশনাল কমান্ডার। কাউন্ট জিরিনস্কি দেখতে পান যে, তিন শো কামানসহ দেড় লাখ শত্র“ সৈন্য তাকে অবরোধ করে ফেলেছে। তিনি অবরোধের আগে ২ হাজার তিন শো হাঙ্গেরীয় ও ক্রোয়েশীয় সৈন্য সমবেত করেছিলেন। এ বাহিনীতে ছিল তার ব্যক্তিগত এবং তার বন্ধু-বান্ধব ও মিত্রদের আরো কিছু সৈন্য। প্রতিরোধকারীদের অধিকাংশ ছিল ক্রোয়েশীয়। সৈন্যবাহিনী ও কমান্ডে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হাঙ্গেরীয় প্রতিনিধিত্ব ছিল। জলাভূমি সিগেৎভারকে তিন ভাগে বিভক্ত করে রেখেছিল। একটি ছিল পুরনো শহর, আরেকটি নয়া শহর এবং তৃতীয়টি দুর্গ। সেতু ও সড়ক এক অংশের সাথে আরেক অংশের সংযোগ রক্ষা করছিল।
সিগেৎভার দুর্গ নির্দিষ্টভাবে কোনো উঁচু ভূমির ওপর নির্মাণ করা হয়নি। তবে কোনো আক্রমণকারীর পক্ষে সেখানে সরাসরি প্রবেশ করা সম্ভব ছিল না। অন্য দুটি বেইলি ব্রিজ দখল করা ছাড়া মূল দুর্গে পৌঁছানো যেতো না। সুলতান সোলেমান দুর্গের সামনে এসে প্রাচীরে লাল কাপড় ঝুলতে দেখতে পান। মনে হচ্ছিল যেন বিশাল কোনো কামান থেকে গোলা ছুঁড়ে কোনো শক্তিশালী রাজাকে অভ্যর্থনা জানানো হবে অথবা কোনো বৌভাতের আয়োজন করা হয়েছে। সুলতান দুর্গে সর্বাত্মক হামলার নির্দেশ দিলে ৬ আগস্ট অবরোধ শুরু হয়। সাফল্যের সাথে এ হামলা প্রতিহত করা হয়। সংখ্যায় অত্যন্ত নগণ্য হলেও ভিয়েনা থেকে রাজকীয় সৈন্যবাহিনী তাদের জন্য কোনো সহায়তা পাঠায়নি। এক মাসের বেশি রক্তাক্ত লড়াইয়ের পর অবশিষ্ট প্রতিরোধকারীরা শেষ বুঝাপড়া করার জন্য পুরনো শহরে পিছু হটে। সুলতান জিরিনস্কিকে আত্মসমর্পণে রাজি করানোর চেষ্টা করেন। তাকে অটোমান সার্বভৌমত্বের অধীনে ক্রোয়েশিয়ার নেতৃত্ব গ্রহণের প্রস্তাব দেন। কিন্তু কাউন্ট জিরিনস্কি কোনো জবাব না দিয়ে লড়াই চালিয়ে যান। দুর্গের পতন অবশ্যম্ভাবী বলে প্রতীয়মান হচ্ছিল। কিন্তু অটোমান হাইকমান্ড ছিল দ্বিধান্বিত।
সুলতান সোলেমানের মৃত্যু
১৫৬৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সুলতান সোলেমান তার তাঁবুতে মৃত্যুবরণ করেন। তবে তার মৃত্যু সংবাদ গোপন রাখা হয়। শুধুমাত্র সুলতানের ইনার সার্কেল জানতো যে, তিনি ইন্তেকাল করেছেন। অটোমানরা আশঙ্কা করতো যে, সৈন্যরা সুলতানের মৃত্যু সংবাদ শুনতে পেলে লড়াই বন্ধ করে দেবে। তাই ৪৮ দিন তার মৃত্যু সংবাদ গোপন রাখা হয়। উজিরে আজম সুলতানের মৃত্যুর সব সাক্ষীকে হত্যা করেন এবং ঘোষণা করেন, সুলতান এত দুর্বল যে, তিনি দায়িত্ব পালনে সক্ষম নন। সিগেৎভারে তিনি সুস্থ হয়ে উঠছেন। তিনি সুলতানের পক্ষে কাজ করছেন। উজিরে আজম সিগেৎভার দখলে সম্পৃক্তদের পুরস্কৃত এবং সৈন্যদের বেতন বৃদ্ধি করেন। তিনি সৈন্যবাহিনীর একটি অংশকে বাবোকসা দখলে পাঠান। তাতাররা সুলতানের মৃত্যুর সংবাদ ফাঁস করে দেয়। উজিরে আজমের ভাতিজা সকোল্লু মোস্তফা বে চিঠি লিখে সোলেমানের উত্তরসূরি শাহজাদা দ্বিতীয় সেলিমকে তার পিতার মৃত্যু সংবাদ অবহিত করার উদ্যোগ নেন। সুলতানের তাঁবু থেকে তিনি একটি চিঠি দিয়ে একজন বার্তাবাহক পাঠান। ৮ দিনের মধ্যে বার্তাবাহক দূরবর্তী এশিয়া মাইনরে পৌঁছে। তবে বার্তাবাহক চিঠির বিষয়বস্তু সম্পর্কে ছিল অজ্ঞ। সেলিম অবিলম্বে স্রেমস্কা যাত্রা করেন। ভুকোভারে এসে পৌঁছলে মোস্তফা তার কাছে একটি বার্তা হস্তান্তর করেন। বার্তায় তিনি তাকে সৈন্যবাহিনীকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিনন্দন জানাতে এবং কার্যকরভাবে সাম্রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণে বেলগ্রেডে যাবার অনুরোধ করেন। সেলিম বেলগ্রেডে ফিরে যান এবং উজিরে আজম সৈন্যবাহিনীকে সেখানে যাবার নির্দেশ দেন।
১৫৬৬ সালের অক্টোবরে সৈন্যবাহিনী বেলগ্রেড অভিমুখে যাত্রা করে। সুলতানের মৃত্যুর ৪৮ দিন পর উজিরে আজম আনুষ্ঠানিকভাবে তার মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করেন। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করার সময় তিনি সুলতানের লাশে সুগন্ধি মাখান এবং সৈন্যবাহিনীকে নয়া সুলতানের সাথে সাক্ষাতে বেলগ্রেডে অগ্রযাত্রা করার নির্দেশ দেন। সুলতান সোলেমানকে কন্সটান্টিনোপলে সোলাইমানিয়া মসজিদে স্ত্রী হুররমের মাজারের পাশে সমাহিত করা হয়। পিতার দাফনে নয়া সুলতান সেলিম উপস্থিত হতে পারেননি। তিনবার যাত্রাবিরতির পর সৈন্যবাহিনী স্রেমস্কা মিট্রোভিচায় পৌঁছে। উজিরে আজম নয়া সুলতান দ্বিতীয় সেলিমকে উজির, পাশা ও সৈন্যবাহিনীকে উপঢৌকন দেয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। কিন্তু নয়া সুলতানের উপদেষ্টারা তাকে বারণ করেন। উজিরে আজম বেলগ্রেডে যান এবং সুলতান হিসেবে দ্বিতীয় সেলিমের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। সেলিম তাকে উজিরে আজম হিসেবে বহাল রাখেন। রাজধানীতে সৈন্যবাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহের আশঙ্কায় উজিরে আজম পাশা, জেনিসারি ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সুলতানের লাশ কন্সটান্টিনোপলে পাঠান। বেলগ্রেডে সুলতান দ্বিতীয় সেলিম একটি বৈঠক আহক্ষান করেন। বেলগ্রেডে অবস্থানের পঞ্চম দিন সুলতান, উজিরে আজম ও সৈন্যবাহিনী কন্সটান্টিনোপলের উদ্দেশে রওনা দেয়। রাজধানীতে পৌঁছার আগে একটি বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং শহরের রাস্তা অবরোধ করা হয়। সেলিম তার প্রথম পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। উজিরে আজম সকোল্লু মেহমেদ পাশা যতটুকু ধারণা করেছিলেন, সেলিম নিজেকে তার চেয়ে দুর্বলতর হিসেবে প্রমাণ করেন। অসংখ্য জেনিসারি অতিরিক্ত বেতনের দাবিতে সরাইয়ে তাকে অবরোধ করে। সেলিম তার তাঁবুতে আশ্রয় নেন এবং দাবি দাওয়া মনে নিতে সকোল্লু মেহমেদ পাশাকে নির্দেশ দেন। সকোল্লু ও আহমদ পাশা ঘুষ দিয়ে শহরের পথ মুক্ত করেন। সুলতান জেনিসারিদের সন্তোষজনক উপঢৌকন ও উচ্চ বেতন প্রদানের প্রতিশ্র“তি দিলে শৃঙ্খলা ফিরে আসে। পরদিন প্রত্যেক জেনিসারিকে নগদ ৪০ ডুকাট (স্বর্ণমুদ্রা) এবং বোনাস হিসেবে আরো অতিরিক্ত ২০ ডুকাট দেয়া হয়। শিগগির সামরিক বাহিনীর অন্যান্য শাখা সিপাহী ও অনিয়মিত সৈন্যরা উচ্চ বেতন দাবি করে। সুলতান সেলিম তাদের গ্রেফতার করেন এবং তাদের স্থলে অন্যদের নিয়োগ দেন।
চূড়ান্ত লড়াই
সুলতান সোলেমানের মৃত্যুর পরদিন ১৫৬৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত লড়াই শুরু হয়। ইতিমধ্যে বিস্ফোরক ও জ্বালানি কাঠ দিয়ে দুর্গের প্রাচীর ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছিল। সকালে ক্ষুদ্রাস্ত্র থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ, গ্রীক ফায়ার ও কামানের সমন্বিত গোলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে সর্বাত্মক হামলা শুরু হয়। শিগগির সিগেৎভার দুর্গে আগুন ধরে যায় এবং কাউন্ট জিরিনস্কির প্রাসাদে ছাইভস্ম পতিত হয়। অটোমান সৈন্যরা রণদামামা বাজিয়ে চিৎকার দিয়ে পঙ্গপালের মতো শহরে প্রবেশ করে। কাউন্ট জিরিনস্কি শেষ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হন এবং তার সৈন্যদের উদ্দেশে বলেন:
চলো আমরা এ জ্বলন্ত প্রাসাদ থেকে বের হয়ে খোলা জায়গায় গিয়ে আমাদের শত্র“দের মোকাবিলা করি। যে মৃত্যুবরণ করবে, সে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করবে। যে লড়াই করে বেঁচে থাকবে, বীর হিসেবে তার নাম সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। আমি প্রথমে এগিয়ে যাবো। আমি যা করবো, তোমরাও তাই করবে। ঈশ্বর সাক্ষী, হে আমার ভাই ও নাইটরা, আমি কখনো তোমাদের ছেড়ে যাবো না।
নিকোলা সুবিচ জিরিনস্কি একটি গোপন অভিসন্ধি থেকে দুর্গে চূড়ান্ত লড়াইয়ের অনুমতি দেননি। একটি সংকীর্ণ সেতু দিয়ে অটোমানরা এগিয়ে আসার চেষ্টা করলে প্রতিরোধকারীরা আকস্মিকভাবে প্রবেশদ্বার খুলে দেয় এবং ভাঙ্গা লোহা বোঝাই মর্টারের একটি বিশাল গোলা ছুঁড়ে। এতে ৬০০ অটোমান সৈন্য নিহত হয়। জিরিনস্কি আক্রমণের নির্দেশ দেন এবং তার অবশিষ্ট ৬০০ সৈন্য নিয়ে দুর্গ থেকে বের হয়ে যান। জিরিনস্কির বুকে মাস্কেটের দুটি গুলি লাগে এবং পরে মাথায় তীরবিদ্ধ হলে তিনি শিগগির নিহত হন। তার কিছু সৈন্য দুর্গে পিছু হটে। অটোমানরা দুর্গ দখল করে এবং অধিকাংশ প্রতিরোধকারীকে হত্যা করে। জেনিসারিরা কয়েকজন প্রতিরোধকারীকে রেহাই দেয়। জেনিসারিরা তাদের বীরত্বের প্রশংসা করে। অটোমানদের বেষ্টনী ভেদ করে মাত্র ৭ জন প্রতিরোধকারী পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। জিরিনস্কির শিরñেদ করা হয় এবং তার মাথা নয়া সুলতানের কাছে পাঠানো হয়। একজন তুর্কি সম্মানের সাথে তার দেহ সমাধিস্থ করে। এই তুর্কি একসময় জিরিনস্কির কাছে বন্দি ছিল। ২০১৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সিগেৎভার দুর্গ অবরোধের ৪৫০তম বার্ষিকীতে ক্রোয়েশিয়ার মেদিমুরজি কাউন্টি জাদুঘরে জিরিনস্কির তরবারি ও শিরস্ত্রাণ প্রদর্শন করা হয়।
গোলাবারুদের ম্যাগাজিনে বিস্ফোরণ
দুর্গ থেকে শেষ বার বের হয়ে যাবার চেষ্টায় নেতৃত্ব দেয়ার আগে জিরিনস্কি গোলাবারুদে ফিউজ জ্বালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। শেষ প্রতিরোধকারীদের নির্মূল করে দিয়ে অটোমানরা সিগেৎভারের অবশিষ্টাংশে পা রাখে এবং চোরাফাঁদে আটকা পড়ে। দুর্গের গোলাবারুদের ম্যাগাজিনে বিস্ফোরণ ঘটলে হাজার হাজার সৈন্য নিহত হয়। জিরিনস্কির একজন কর্মচারি উজিরে আজম সকোল্লু মেহমেদ পাশার প্রাণ রক্ষা করে। উজিরে আজম ও তার সৈন্যরা দুর্গে সম্পদের খোঁজ এবং জীবিতদের জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় এই কর্মচারি তাকে চোরাফাঁদ সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়। সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় এ বন্দি জবাব দেয় যে, সম্পদ নিঃশেষ হয়ে গেছে। তবে তাদের পায়ের নিচে তিন হাজার পাউন্ড বারুদ আছে এবং বারুদের সাথে একটি দিয়াশলাই যুক্ত। উজিরে আজম সকোল্লু মেহমেদ পাশা ও তার অশ্বারোহী সৈন্যরা ত্বরিতগতিতে পালিয়ে যান। তবে বিস্ফোরণে তিন হাজার অটোমান সৈন্য নিহত হয়।
ফলাফল
চূড়ান্ত লড়াইয়ের পর জিরিনস্কির প্রায় সব সৈন্য নিহত হয়। অটোমান সৈন্য নিহত হওয়ার সংখ্যা ছিল ব্যাপক। লড়াইয়ে তিনজন পাশা, ৭ হাজার জেনিসারি এবং ২৮ হাজার সাধারণ সৈন্য প্রাণ হারায়। বিভিন্ন সূত্র অটোমান সৈন্য নিহত হওয়ার সংখ্যা ২০ থেকে ৩০ হাজারের মধ্যে উল্লেখ করছে। লড়াইয়ের পর উজিরে আজম সকোল্লু মেহমেদ পাশা সুলতানের নামে বিজয় ঘোষণা করেন। ঘোষণায় বলা হয়, সুলতানের বর্তমান ভগ্নস্বাস্থ্য তাকে এ সফল অভিযান অব্যাহত রাখতে দিচ্ছে না। তার লাশ কন্সটান্টিনোপলে স্থানান্তর করা হয়। তবে ইনার সার্কেলের কর্মকর্তারা তার সাথে যোগাযোগ রাখার ভান করছিলেন। তুর্কি সূত্র জানায়, তিন সপ্তাহ লুকোচুরি করা হয়। এমনকি সুলতানের ব্যক্তিগত চিকিৎসককে সতর্কতা হিসেবে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। দীর্ঘ পথযাত্রা এবং অবরোধে সুলতানের স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়। সুলতানের মৃত্যু হওয়ায় অগ্রযাত্রা সমাপ্ত হয়।
সূএঃ ইন্টারনেট
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন