বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০

অটোমান সাম্রাজ্য


অটোমান সাম্রাজ্য (دولت عليه عثمانیه‎) হলো ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ ও দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্য। পাশ্চাত্যের বাইরের একমাত্র সাম্রাজ্য হিসেবে অটোমান সাম্রাজ্য মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত টিকে থাকে এবং এ সাম্রাজ্য ইউরোপ ও বিশ্বরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সাম্রাজ্যের ইতিহাস মধ্যপ্রাচ্য, বলকান উপদ্বীপ, মধ্য ও পশ্চিম ইউরোপের জাতিগুলোর ভাগ্য নির্ধারণ করেছে। একটি বৃহৎ শক্তি হিসেবে অটোমান সাম্রাজ্য পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে খ্রিস্টান বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের স্থলাভিষিক্ত হয় এবং নিজেকে ইসলামি খিলাফতের উত্তরাধিকারী হিসেবে দাবি করে। এমন এক সময় অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে যে সময় চেঙ্গিস খান এশিয়া ও ইউরোপ জয় করছিলেন এবং চীন থেকে পোল্যান্ড পর্যন্ত একটি বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলছিলেন। প্রায় একই সময় ইউরোপে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধ শুরু করার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। তখনো আজকের আমেরিকা আবিষ্কার হয়নি। তবে স্পেন ও পর্তুগাল এই নয়া পৃথিবী আবিষ্কারে তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। তুরস্ক ছাড়া অন্য কোনো দেশ নিজেকে অটোমান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী রাষ্ট্র হিসেবে দাবি করছে না। এ দেশটি হলো দুটি মহাদেশ জুড়ে। মূল অংশ এশিয়ায় এবং সাবেক রাজধানী ইস্তাম্বুল ইউরোপে। দুটি অংশের মাঝে দার্দানেলিস ও বসফোরাস প্রণালী এবং মারমারা সাগর। এ তিনটি জলপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ইউরোপের সাথে এশিয়ার এবং খ্রিস্টানদের সাথে মুসলমানদের শত শত বার লড়াই হয়েছে।      
    অস্তাচলে হলেও এখনো প্রতিটি মুসলমান এ সাম্রাজ্যকে নিয়ে গর্ব করে। উত্থানের পর পতন অনিবার্য। এক বিশেষ পরিস্থিতিতে আধুনিক তুরস্কের মূল ভূখণ্ডে আকস্মিকভাবে অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে এবং প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে একসময় এ সাম্রাজ্য বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। তবে তার রেশ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। ইতিহাস অটোমান সুলতান ও অটোমান সাম্রাজ্যকে চিরদিন মনে রাখবে। সুলতান সোলেমানকে নিয়ে মুহতাসিম ইউজিল (দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট সেঞ্চুরি), সুলতান দ্বিতীয় মোহাম্মদকে নিয়ে ফাতিহ ১৪৫৩ এবং অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উসমান গাজীর পিতা আরতুগ্র“লকে নিয়ে দিরিলিজ আরতুগ্র“ল চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রমাণ করছে যে, তাদের আবেদন এখনো ফুরিয়ে যায়নি। এ সাম্রাজ্যের ইতিহাসের সাথে শুধু অটোমান নয়; তুর্কি, আরব, পার্সি, গ্রীক, সার্ব, রুশ, পোলিশ, চেক, আর্মেনীয়, বুলগেরীয়, হাঙ্গেরীয়, আলবেনীয়, ভেনিসীয়, জেনোয়িজ, ইতালীয়, স্পেনীয়, ফরাসি, জার্মান, পর্তুগীজ ও মামলুকসহ আরো বহু জাতি জড়িত।     
   একটি নির্দিষ্ট তারিখে অটোমান সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হয়। কিন্তু কবে এ সাম্রাজ্যের যাত্রা শুরু হয়েছিল তা বলা কঠিন। ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয় যে, ১২৯৯ সালে এ সাম্রাজ্যের সূচনা হয়েছিল। কোনো স্মরণীয় যুদ্ধ, কোনো স্বাধীনতা ঘোষণা কিংবা কোনো বিখ্যাত দুর্গের পতন ঘটা ছাড়া ইতিহাসের একটি বৃহত্তম সাম্রাজ্যের যাত্রা শুরু হয়েছিল। বছরটি ছিল হিজরি ৬৯৯-৭০০ সাল। খ্রিস্টান ও ইসলামি বর্ষপঞ্জিতে একই সময় শতাব্দীর শুরু হয়। সম্ভবত এ বিবেচনায় ১২৯৯ সালকে অটোমান সাম্রাজ্যের শুরু হিসেবে ধরা হয়। ১৩০০ সালে অটোমানরা ছিল পূর্ব বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অংশ আনাতোলিয়ায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নিয়োজিত মধ্য এশিয়া থেকে বিতাড়িত অগণিত তুর্কমেন গোষ্ঠীর অন্যতম। আনাতোলিয়া হলো কৃষ্ণসাগর, ভূমধ্যসাগর ও এজিয়ান সাগর পরিবেষ্টিত তুরস্কের বৃহত্তম ভূখণ্ড। আনাতোলিয়াকে এশিয়া মাইনরও বলা হয়। এশিয়া মাইনর মানে হলো ছোট এশিয়া। 
     ষোড়শ শতাব্দীতে অটোমানদের পাশাপাশি আরো দুটি বৃহত্তম মুসলিম শক্তির উত্থান ঘটে। একটি ছিল ইরানের সাফাভি এবং আরেকটি ভারতে মোগল। তৈমুরের উত্তরসূরি মোগলরা ভারতের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাফাভিরা ছিল সুফি। এসব সুফি আজারবাইজানের আরদাবিলে একটি মাজারের কাছে বসবাস করতো। তাদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সাইফউদ্দিন। সাইফউদ্দিন নিজেকে বিশ্বনবীর (সা.) বংশধর বলে দাবি করতেন।     
    অটোমানরা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার অনেক আগে তুর্কমেনরা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে লুণ্ঠন চালাতো। সেলজুক তুর্কিরা হলো তুর্কমেনদের মধ্যে সবচেয়ে সফল। সেলজুক তুর্কিরা যাযাবর হিসেবে মধ্য এশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও আনাতোলিয়ায় অভিবাসন করে। সে  সময় অভ্যন্তরীণ গোলযোগে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক। সেলজুক তুর্কিরা খুব সামান্য প্রতিরোধের মুখোমুখি হয় এবং ১০৭১ সালে আনাতোলিয়ার উত্তরে সুলতান আল্প আরসালানের নেতৃত্বে মানজিকারাত যুদ্ধে একটি বাইজান্টাইন বাহিনীকে পরাজিত করে।  এ বিজয় তুর্কমেনদের পশ্চিমে অভিবাসনের দরজা খুলে দেয়। ৮ শো বছরের দিগি¦জয়ে মুসলমানরা স্পেন এবং ভূমধ্যসাগরের কয়েকটি দ্বীপ ছাড়া আর কোনো ভূখণ্ড হারায়নি। মরক্কো থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত ভূখণ্ডে একটির পর একটি মুসলিম রাষ্ট্র। এখানে কোনো অমুসলিম রাষ্ট্র নেই। যেন মুসলিম রাষ্ট্রগুলো একে অন্যের পিঠে হেলান দিয়ে প্রাচীরের মতো দাঁড়ানো। সামরিক দিক থেকে কেউ অটোমান তুর্কিদের সমকক্ষ ছিল না। ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিকে অটোমান অগ্রযাত্রা মন্থর হয়ে যায়। কেননা সংখ্যায় তুর্কিরা ছিল তাদের খ্রিস্টান প্রতিপক্ষদের তুলনায় স্বল্প।  
     এমন এক সময় ছিল যখন চীন সীমান্ত থেকে আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূল পর্যন্ত মুসলমান ছাড়া অন্য কোনো জাতির নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এশিয়ার দক্ষিণ ভাগে ছিল মোগল সাম্রাজ্য, তার লাগোয়া ছিল পারস্যের সাফাভি সাম্রাজ্য, মধ্যভাগে সেলজুক সাম্রাজ্য ও মামলুক সালতানাত এবং পশ্চিমে শেষ মাথায় অটোমান সাম্রাজ্য। সেলজুক সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের ওপর অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, অটোমান সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। সুলতান দ্বিতীয় বায়েজীদ স্পেনের মুসলমানদের রক্ষায় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি শুধু মুসলমান নন, ইহুদিদেরও রক্ষা করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি এডমিরাল কামাল রইসকে স্পেনে পাঠান। তবে তিনি পূর্বাঞ্চলে মামলুক হুমকিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সুলতান সোলেমানের আমলে সুদূর ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে কুরতোগলু খিজির রইসের নেতৃত্বে অটোমানরা অভিযান চালিয়েছিল। ভারত মহাসাগরে প্রথম অভিযান চালিয়েছিলেন সোলায়মান পাশা। সোলায়মান পাশার পর অভিযান চালান যথাক্রমে পিরি রইস, মুরাদ রইস ও সৈয়দ আলী রইস। কাপুরুষের মতো পালিয়ে আসায় পিরি রইসকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। প্রলয়ঙ্করী ঝড়ে নৌবহর ল-ভ- হয়ে গেলে সৈয়দ আলী রইস দিল্লিতে মোগল সম্রাট হুমায়ুনের দরবারে আশ্রয় নেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান চালানোর সামর্থ্য অটোমানদের ছিল। কিন্তু তাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিল পশ্চিম ভূমধ্যসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগর। এ অঞ্চলে অটোমানরা আজকের শক্তিশালী ইউরোপীয় জাতিগুলোকে কোণঠাসা করে রেখেছিল।  
     ১৬৮৩ সালের পর অটোমানরা আর কখনো ইউরোপের প্রতি হুমকি হয়ে উঠতে পারেনি। তারা দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে ২ শো বছরের বেশি নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখে এবং আধুনিক বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, গ্রীস, রুমানিয়া, হাঙ্গেরী ও অন্য দেশগুলোতে প্রাধান্য বিস্তার করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত আধুনিক তুরস্ক, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, ইসরাইল, ফিলিস্তিন, জর্দান ও সৌদি আরবের অধিকাংশ ছিল এ সাম্রাজ্যের অংশ। ১৯২২ সালে বিলুপ্তির কয়েক দশক আগে অটোমান সাম্রাজ্যের কোনো ইউরোপীয় প্রদেশ ছিল না। ১৮৭৮ সালে বার্লিন চুক্তির আগে অটোমান সাম্রাজ্যকে একটি ইউরোপীয় শক্তি হিসেবে গণ্য করা হতো। শেষ দিনগুলোতে তাকে একটি এশীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের শক্তি বলে মনে হতো। 
    দুটি ভিন্ন রুটে ইউরোপে ইসলাম প্রবেশ করে। একটি রুট ছিল জিব্রাল্টার প্রণালী এবং আরেকটি বসফোরাস প্রণালী। অটোমানরা দ্বিতীয় রুটে ইসলামকে ইউরোপীয় ভূখণ্ডে নিয়ে যায়। ১৩৫৪ সালে অটোমানরা ইউরোপে প্রবেশ করে এবং বলকান অঞ্চল বিজয়ের মধ্য দিয়ে অটোমান বেলিক একটি আন্তঃমহাদেশীয় সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হয়। ১৪৫৩ সালে সুলতান দ্বিতীয় মোহাম্মদ কন্সটান্টিনোপল বিজয় সম্পন্ন করলে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে মহান সুলতান সোলেমানের রাজত্বকালে শক্তির চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছার সময় অটোমান সাম্রাজ্য ছিল বহুজাতিক ও বহুভাষী। কন্সটান্টিনোপল রাজধানী হওয়ায় এবং ভূমধ্যসাগরের আশপাশের ভূখণ্ডগুলো নিয়ন্ত্রণ করায় অটোমান সাম্রাজ্য ৬ শো বছর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে।
    তিনটি মহাদেশ জুড়ে অটোমান সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করেছিল। প্রাথমিকভাবে বাইজান্টাইন ভূখণ্ডে অটোমান সাম্রাজ্যের বীজ উপ্ত হয়েছিল। পরে মধ্য এশিয়া ও ইউরোপে এ সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ঘটে। একসময়ের অখ্যাত উসমান গাজীর বংশধররা পরবর্তী ২ শো বছরের মধ্যে আড্রিয়াটিক উপকূলের দুরাজ্জো থেকে পূর্ব আনাতোলিয়ার ইরজুরুম পর্যন্ত ভূখণ্ডের ওপর প্রভুত্ব কায়েম করে। ইউরোপের সাথে নিরন্তর লড়াই করে তাকে অস্তিত্ব রক্ষা করতে হয়েছে। ভৌগোলিক সম্প্রসারণ ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম নীতি। অধীনস্ত ভূখণ্ডের কোটি কোটি মানুষের ভরণ-পোষণ এবং বিপুল পরিমাণ সম্পদ লাভে এ নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। প্রথমে অটোমান সুলতানদের শাসন ছিল অনিরাপদ। সাম্রাজ্যকে সংহত করতে অটোমান সুলতানরা ক্রীতদাস ও ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান জানবাজ যোদ্ধাদের নিয়ে গঠন করেন ক্র্যাক পদাতিক জেনিসারি। অটোমানরা অবনতিশীল বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যকে উপর্যুপরি যুদ্ধে পরাজিত করে দ্রুত পশ্চিমে তাদের সাম্রাজ্যকে সম্প্রসারিত করে। এ সাম্রাজ্য একটি শক্তিশালী নৌশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং ভূমধ্যসাগরের অধিকাংশ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অর্জন করে। এক সময় অটোমান সাম্রাজ্য ইউরোপীয় রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারে পরিণত হয়। এ সাম্রাজ্যের সাফল্য ও সামরিক ক্ষমতা ছিল রোমান সাম্রাজ্যের সমান। ইতালীয় প-িত ফ্রান্সিসকো সানসোভিনো ও ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ বোদিন অটোমান সাম্রাজ্যের ভক্ত ছিলেন। 
   প্রজাদের নিঃশর্ত আনুগত্য ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের অন্যতম উপাদান। প্রজারা অটোমান বংশের শাসনের অধিকারকে কখনো চ্যালেঞ্জ করেনি। তারা অটোমান বংশের এক সুলতানের স্থলে আরেক সুলতানের প্রতি আনুগত্য পরিবর্তনে দ্বিধা করেনি। তবে এ বংশের বাইরের কারো প্রতি তাদের আনুগত্য প্রদর্শনের কোনো উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় না। মোটামুটি সবাই একমত ছিল যে, সার্বভৌমত্ব হচ্ছে আল্লাহর হাতে। উসমান গাজীর হাতে স্বপ্নযোগে আল্লাহ এ সার্বভৌমত্ব অর্পণ করেন এবং তার পরবর্তী ৩৬ জন পুরুষ সার্বভৌমত্বের অধিকারী ছিলেন। দেশের পর দেশ জয় করলেও অটোমানরা কোথাও নিজ হাতে শাসনভার গ্রহণ করেনি। জয় করার পর তারা প্রশাসন তুলে দিতো স্থানীয় লোকদের হাতে। কখনো কখনো উপযুক্ত লোক পাওয়া না গেলে অটোমানরা মাসের পর মাস অপেক্ষা করতো। ১৫২৬ সালে হাঙ্গেরীর মোহ্যাকচ যুদ্ধে এরকম একটি দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়। অটোমানরা হাঙ্গেরীর রাজধানী বুদা লুণ্ঠন এবং স্মার্ণা দখল করে। কিন্তু ক্ষমতা বুঝে নেয়ার জন্য স্থানীয় কোনো নেতা এগিয়ে আসেননি। দেশটিতে বছরের শেষ তিন মাস ক্ষমতার শূন্যতা বিরাজ করে। রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ভেঙ্গে পড়ে। বিজয়ীরা দেশটিতে তাদের শাসন চাপিয়ে দেয়নি।
   অটোমানরা তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব সংহত এবং প্রতিবেশিদের সাথে মিত্রতা স্থাপনে বিয়েকে একটি কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করে। বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে বর ও কনের পৈত্রিক ধর্ম কখনো অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। অটোমান সুলতানগণ মুসলমান হলেও নির্দ্বিধায় খ্রিস্টান পাত্রীর পাণি গ্রহণ করেন। হেরেমে তাদেরকে পৈত্রিক ধর্ম পালনের সুযোগ দিতেন। দ্বিতীয় অটোমান সুলতান ওরহান গাজী প্রতিদ্বন্দ্বী বাইজান্টাইন সম্রাট ষষ্ঠ জন কান্টাকুজেনির কন্যা থিওডোরা কান্টাকুজেনিকে বিয়ে করেন এবং যৌতুক হিসেবে কৌশলগত গ্যালিপলি উপত্যকা লাভ করেন। পরবর্তী অটোমান সুলতান প্রথম মুরাদ ১৩৭৮ সালে বুলগেরিয়ার রাজা আইভান আলেক্সান্ডারের কন্যা মারাকে বিয়ে করেন। একইভাবে তার উত্তরাধিকারী সুলতান প্রথম বায়েজীদ তার শত্র“ সার্বিয়ার রাজা লাজারের কনিষ্ঠা কন্যা মারিয়াকে বিয়ে করেন। এ ছাড়া তিনি জার্মিয়ানের আমির সোলায়মান শাহর কন্যা সুলতানা হাতুন এবং জুলকাদিরের আমির সাবান সুলি বে’র কন্যা এমিনি হাতুনকে বিয়ে করেন। সুলতান বায়েজীদ সুলতানা হাতুনকে বিয়ে করে তার পিতার অর্ধেক রাজত্ব লাভ করেন।     
 
অটোমান সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক সীমা
পূর্বদিকে পারস্য উপসাগর থেকে উত্তর-পশ্চিমে ইউরোপের ভিয়েনা এবং উত্তরে ককেশাস পর্বতশ্রেণি থেকে পশ্চিমে মিসর পর্যন্ত অটোমান সাম্রাজ্যের সীমান্ত সম্প্রসারিত হয়েছিল। একসময় এ সাম্রাজ্যের আয়তন ২০ লাখ ৮৮ হাজার চার শো বর্গমাইলে পৌঁছে। এ সাম্রাজ্যের আওতায় ছিল দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের অধিকাংশ, মধ্য ইউরোপের অংশবিশেষ, পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়ার ককেশাস অঞ্চল, উত্তর আফ্রিকা ও আফ্রিকার শৃঙ্গ। যেসব দেশ অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল সেগুলো হলো তুরস্ক, সাইপ্রাস, মাল্টা, মিসর, গ্রীস, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, মেসিডোনিয়া, সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া, আলবেনিয়া, মোলদাভিয়া, দক্ষিণ ইউক্রেন, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, হাঙ্গেরী, ইসরাইল, ফিলিস্তিন, জর্দান, লেবানন, সিরিয়া, সৌদি আরবের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল, ইরাক, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, পূর্ব ইয়েমেন, উত্তর লিবিয়া, তিউনিসিয়া ও উত্তর আলজেরিয়া। এসব দেশ অধিকারে আসায় পূর্ব ইউরোপ ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল একজন একক শাসকের অধীনে আসে। কৃষ্ণসাগরে অটোমানদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম হলে রুশ জাহাজের প্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়। এতে সাম্রাজ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়। অটোমান সাম্রাজ্যের কোটি কোটি মানুষ অন্তত ২০টি ভাষায় কথা বলতো। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে অটোমান সাম্রাজ্যে ৩২টি প্রদেশ এবং বহু আশ্রিত রাজ্য ছিল। পরবর্তীতে কয়েকটি আশ্রিত রাজ্যকে অটোমান সাম্রাজ্যে একীভূত হয় এবং অবশিষ্টগুলোকে স্বায়ত্তশাসন মঞ্জুর করা হয়।   
(লেখাটি ‘অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থান’ থেকে নেয়া। বইটি প্রকাশ করেছে আফসার ব্রাদার্স)।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ফাইটার জেটের হেলমেট

বর্তমান সময়ে আধুনিক এবং নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফিচার হচ্ছে জেট ফাইটারের ককপিটে বসা এর পাইলটের হেল...