১৯১৪ সালের ২৯ অক্টোবর কৃষ্ণসাগরের রুশ উপকূলে আকস্মিক অটোমান নৌহামলার মধ্য দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্য যোগদান করে। কৃষ্ণসাগরের উপকূলে ওডেসায় গোলাবর্ষণের জবাবে রাশিয়া ১৯১৪ সালের পহেলা নভেম্বর অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ৫ নভেম্বর রাশিয়ার মিত্র ব্রিটেন ও ফ্রান্স যুদ্ধ ঘোষণা করে। কোনো বৃহৎ শক্তির সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে জোটবদ্ধ না থাকায় অটোমান হামলার তাৎক্ষণিক কারণ স্পষ্ট হয়নি। কৃষ্ণসাগরীয় উপকূলে গোলাবর্ষণের সিদ্ধান্ত লাখ লাখ অটোমানকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় এবং পর্যায়ক্রমে এ সাম্রাজ্যের পতন ডেকে আনে এবং অটোমান সালতানাতের বিলুপ্তি ঘটে। দুটি কারণে অটোমান সাম্রাজ্য সেন্ট্রাল পাওয়ার্সের পক্ষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করে। এক: জার্মানির চাপ এবং দুই: অটোমান যুদ্ধমন্ত্রী আনোয়ার পাশার চক্রান্ত। অন্য কারণগুলোর মধ্যে ছিল যুদ্ধের প্রাথমিক দিনগুলোতে জার্মানির বিজয় এবং ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের সঙ্গে তুরস্কের বিবাদ। তুরস্ককে শত্রুর সঙ্গে যোগদান করা থেকে বিরত রাখা এবং রুমানিয়া ও বুলগেরিয়াকে সেন্ট্রাল পাওয়ার্সের সঙ্গে যোগদানে উৎসাহিত করা ছিল জার্মানির লক্ষ্য। তুরস্কে নিযুক্ত জার্মান সামরিক মিশন প্রধান জেনারেল অটো লিমান ভন স্যান্ডার্স তুরস্ক-জার্মান জোট গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
পটভূমি
ইয়াং টার্ক মুভমেন্ট সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদকে অটোমান পার্লামেন্ট পুনরুজ্জীবিত এবং ১৮৭৬ সালের সংবিধান পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বাধ্য করে। ১৮৭৮ সালে সুলতান আবদুল হামিদ পার্লামেন্ট ও প্রথম সাংবিধানিক শাসন স্থগিত রাখেন। ইয়াং টার্ক মুভমেন্ট কার্যকরভাবে দ্বিতীয় সাংবিধানিক শাসন চালু করে এবং গোপনে তৎপরতা চালানোর সময় তারা তাদের নিজস্ব দল গঠন করে। এসব দলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কমিটি অব ইউনিয়ন অব প্রোগ্রেস (সিইউপি) এবং লিবারেল ইউনিয়ন (এলইউ) নামে পরিচিত ফ্রিডম এন্ড একর্ড পার্টি। ১৯০৮ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সিইউপি বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ঐতিহ্যবাহী অটোমান সৈন্যবাহিনীকে সংস্কার করে তাকে একটি আধুনিক বাহিনীতে রূপান্তরিত করা হয়। এ বাহিনী প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এসময় অটোমান সৈন্যবাহিনী ১৯১১ সালে ইতালি-তুর্কি যুদ্ধ, ১৯১২-১৩ সালে বলকান যুদ্ধ এবং কয়েকটি বিদ্রোহ ও সাম্রাজ্যের অব্যাহত রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে। ১৯০৯ সালে একবার এবং ১৯১২ সালে দ্বিতীয়বার অভ্যুত্থান ঘটে। দ্বিতীয় অভ্যুত্থানের পর ১৯১৩ সালে অটোমান সাবলাইম পোর্টিতে (সদরদপ্তর) হামলা হয়। অতএব দেখা যাচ্ছে যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে অটোমান সৈন্যবাহিনী পূর্ববর্তী তিন বছর অব্যাহত লড়াইয়ে সম্পৃক্ত ছিল।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল বহুমাত্রিক। কোথাও কোনো একটি একক রাষ্ট্র অথবা দুই তিনটি রাষ্ট্র আধিপত্য বিস্তার করেনি। বিশ্ব রাজনীতি বহুমাত্রিক হওয়ায় অটোমানরা এক রাষ্ট্রকে অন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঠেলে দিতে পারতো। ঐতিহাসিক মাইকেল র্যানল্ডস বলেছেন, অটোমানরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এ কৌশল ব্যবহার করেছে। জার্মানি সুলতান আবদুল হামিদের সরকারকে সমর্থন করতো এবং এ সমর্থনের বিনিময়ে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে। প্রাথমিকভাবে সিইউপি ও এলইউ ব্রিটেনের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। অটোমান সাম্রাজ্য জার্মানি ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ব্রিটেনকে সন্তুষ্ট করে পোর্টির জন্য বৃহত্তর সুবিধা অর্জনের আশা করছিল।
অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরী বসনিয়া ও হারজেগোভিনা দখল করে নিলে দেশটির মিত্র জার্মানির প্রতি বৈরিতা বৃদ্ধি পায়। সিইউপিপন্থী তানিন এতদূর পর্যন্ত উল্লেখ করে যে, সাংবিধানিক সরকার উৎখাত করাই ভিয়েনার এসব কার্যকলাপের অভিপ্রায়। দুটি দেশের মধ্যে সম্ভাব্য সহযোগিতার বিষয় নিয়ে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার এডওয়ার্ড গ্রে ও স্যার চার্লস হার্ডিঞ্জের সঙ্গে আলোচনার জন্য সিইউপির দুজন শীর্ষ নেতা আহমদ রিজা ও ড. নাজিমকে লন্ডনে পাঠানো হয়। আলোচনায় জোট গঠনের ব্যাপারে স্যার এডওয়ার্ড গ্রে বলেন, অন্য দেশের সঙ্গে আঁতাত ও বন্ধুত্ব করলেও হাত স্বচ্ছ রাখাই আমাদের নীতি। এটা সত্যি যে, জাপানের সঙ্গে আমরা জোট গঠন করেছি। তবে এ জোট দূরপ্রাচ্যে কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অটোমান প্রতিনিধিদল জবাবে বলেন, এ সাম্রাজ্য হলো দূরপ্রাচ্যের জাপান। আপনাদের সঙ্গে আমাদের সাইপ্রাস চুক্তি হয়েছে। এ চুক্তি এখনো বহাল।
বলকান যুদ্ধ শেষ হলে সিইউপি বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, কেবলমাত্র ব্রিটেনের সঙ্গে একটি জোট বা আঁতাত অটোমান সাম্রাজ্যের অবশিষ্টাংশের অস্তিÍত্ব রক্ষার নিশ্চয়তা দিতে পারে। এ ধরনের জল্পনা কল্পনার জবাবে ১৯১৪ সালে পোর্টিতে নিয়োজিত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার লুই ম্যালেট বলেন, আমাদের সঙ্গে একটি জোট গঠন অথবা ত্রিপক্ষীয় আঁতাতে যোগ দেয়া হচ্ছে তুরস্কের স্বাধীনতা রক্ষার একমাত্র উপায়। তবে আমি মনে করি, তুরস্কের স্বাধীনতা ও ভৌগোলিক অখ-তার প্রতি সকল বৃহৎ শক্তির সম্মান প্রদর্শনে একটি চুক্তি স্বাক্ষর কিংবা ঘোষণা হচ্ছে কম ঝুঁকিপূর্ণ পন্থা। দেশটি নিরপেক্ষতা রক্ষা করবে এবং অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ ও সংস্কার সাধনে বৃহৎ শক্তিগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে।
সিইউপি এ প্রস্তাবে সম্মত হতে পারেনি। অটোমানদের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় শক্তিগুলো বলকান যুদ্ধে পক্ষপাতমূলত আচরণ করায় তারা তাদের প্রতি আস্থা রাখতে পারেনি। অটোমানরা বিশ্বাস করতে পারেনি যে, ইউরোপীয়রা অটোমান সাম্রাজ্যের স্বাধীনতা ও ভৌগোলিক অখ-তা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে। সম্ভবত স্যার লুই ম্যালেট এ সত্য পুরোপুরি বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিলেন। তার পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করার পেছনে যুক্তি ছিল। বিগত শতাব্দীগুলোতে ইউরোপের বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে বড় ধরনের যুদ্ধ হয় খুব কম। তবে তাদের মধ্যে ‘গ্রেট গেইম’ নামে একটি গোপন প্রতিযোগিতা চলছিল। উত্তেজনা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যে, তা মীমাংসা করার প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৯০৭ সালে স্বাক্ষরিত অ্যাংলো-রুশ চুক্তিতে তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয় এবং সীমান্ত চিহ্নিত হলে পারস্য ও আফগানিস্তানে তাদের নিজ নিজ নিয়ন্ত্রণ জোরদার হয়। এ চুক্তি ত্রিপক্ষীয় আঁতাত গঠনে একটি অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। এ চুক্তির মধ্য দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়ে যায়।
রাশিয়ার অবস্থান
রাশিয়ার অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ দ্রুত অস্বস্তিদায়কভাবে অটোমান প্রণালীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। রাশিয়ার রপ্তানি বাণিজ্যের এক-চতুর্থাংশ পণ্য পরিবহন করা হতো দুটি অটোমান প্রণালীর মধ্য দিয়ে। ইয়াং টার্ক মুভমেন্ট এবং ১৯০৯ সালে পাল্টা অভ্যুত্থানের মতো বিশৃঙ্খলার সময় রাশিয়া ইস্তা¤ু^লে সৈন্য পাঠানোর বিষয় বিবেচনা করছিল। ১৯১৩ সালের মে’তে জার্মান সামরিক মিশন জেনারেল অটো লিমান ভন স্যান্ডার্সকে অটোমান সৈন্যবাহিনীকে প্রশিক্ষণদানের দায়িত্ব দেয়। জার্মানির এ উদ্যোগ ছিল সেন্ট পিটার্সবার্গের কাছে অসহ্য। প্রতিশোধ গ্রহণে রাশিয়া কৃষ্ণসাগরীয় বন্দর ট্রাবজোন অথবা পূর্বাঞ্চলীয় আনাতোলিয়ার বায়েজীদ শহরে হামলা এবং দখল করার পরিকল্পনা উদ্ভাবন করে। তবে দেশটি তখন সম্ভাব্য পূর্ণাঙ্গ সামরিক অভিযানকে কোনো সমাধান হিসেবে দেখতে পায়নি। ইস্তা¤ু^লে নৌ আধিপত্য কায়েমের বিকল্প ছিল রুশ ককেশাস আর্মিকে পুনর্গঠন করা। নিজেদের সৈন্যবাহিনীকে সহায়তাদানে রাশিয়া অটোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে বিভিন্ন আঞ্চলিক গ্রুপের সঙ্গে স্থানীয় যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে। রুশরা দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয় যে, অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় পরিবহন সমস্যা মোকাবিলায় একযোগে কাজ করবে এবং সেনা ও নৌবাহিনীকে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হবে। উভচর অভিযানের সাফল্যের জন্য সৈন্য ও কামানের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। সৈন্য সমাবেশকালে এসব লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। রুশরা অটোমান সাম্রাজ্য পর্যন্ত ককেশাস রেলওয়ে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯১৩ সালে রাশিয়ার যুদ্ধ প্রস্তুতি শেষ হয়ে যায়। একই সময় রাশিয়া আর্মেনীয় সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের দাবি জানায়।
বাগদাদ-বার্লিন রেলওয়ে
ঐক্যবদ্ধ জার্মান সাম্রাজ্য অটোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান তৎপরতা দেখাতে থাকে। এসব তৎপরতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাগদাদ রেলওয়ে। এ রেলওয়ে বাগদাদ-বার্লিন রেলওয়ে নামে পরিচিত। বাগদাদ থেকে জার্মানরা পারস্য উপসাগরে একটি বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা করে। এক হাজার ৬ শো কিলোমিটার দীর্ঘ এ রেলপথ আধুনিক তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরাকের সঙ্গে ইউরোপকে যুক্ত করে। এজন্য বসফোরাস প্রণালীতে একটি ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। রেলপথ নির্মাণে কয়েক দশক লাগে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনালগ্নে রেলপথ ছিল লক্ষ্যস্থল থেকে ৯৬০ কিলোমিটার দূরে। জার্মান ডয়েস ব্যাংক এবং ফিলিপ হোলসম্যান কোম্পানি এ রেলপথ নির্মাণের তহবিল, প্রকৌশল ও নির্মাণ ব্যয় বহন করে। এ রেলপথের মাধ্যমে অটোমান সাম্রাজ্য আরব উপদ্বীপে নিয়ন্ত্রণ বজায় এবং লোহিত সাগরের ওপারে খেদিভ শাসিত মিসরে প্রভাব সম্প্রসারণ করতে চেয়েছিল। এ রেললাইন নির্মাণ করে জার্মানি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে এবং অটোমান সাম্রাজ্য তাদের প্রতিদ্বন্দ্বি রাশিয়াকে মোকাবিলা করতে চেয়েছিল। বাগদাদ রেলওয়ে রাশিয়ার প্রতি হুমকি হয়ে দেখা দেয়। কেননা এতে ককেশাস ফ্রন্ট এবং উত্তর পারস্য পর্যন্ত জার্মানির অর্থনৈতিক প্রভাব সম্প্রসারিত হয়। ১৮৭২ সালে অটোমান সরকার তুরস্কে রেলওয়ে নির্মাণে জার্মান রেলওয়ে প্রকৌশলী উইলহেম ভন প্রেসেলকে নিয়োগ করে। ১৮৮৮ সালে ওয়াটেম্বারগিসি ভারেন্সব্যাঙ্কের ম্যানেজার আলফ্রেড ভন কুলা এবং ডয়েস ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক জর্জ ভন সিমেন্স একটি সিন্ডিকেট গঠন এবং তুরস্কের কাছ থেকে ছাড় পেলে কন্সটান্টিনোপল থেকে বাগদাদ পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
১৮৯২ সালের ডিসেম্বরে আঙ্কারা পর্যন্ত লাইন সম্পন্ন হলে এস্কিসেহিরে রেলওয়ে ওয়ার্কশপ নির্মাণ করা হয় এবং এস্কিসেহির থেকে কোনিয়া পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণে অনুমোদন নেয়া হয়। ১৮৯৬ সালের জুলাই নাগাদ এ লাইন নির্মাণ সম্পন্ন হয়। এ দুটি লাইন ছিল বাগদাদ রেলওয়ের প্রথম দুটি সেকশন। একই সময় জার্মানরা প্রকৌশলীরা হেজাজ রেলওয়ে নির্মাণ করে। অটোমান সাম্রাজ্য রেললাইনকে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর কামানের পাল্লার বাইরে রাখে। এজন্য আলেক্সান্ড্রেটা থেকে আলেপ্পো পর্যন্ত উপকূল এড়িয়ে যাওয়া হয়। ১৯০৩ সালের পর রাশিয়া, ফ্রান্স ও ব্রিটেনে গ্রেট বাগদাদ-বার্লিন রেলওয়ে নির্মাণে জার্মানির পরিকল্পনার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। কূটনৈতিক আপত্তি সত্ত্বেও ধীরে ধীরে রেললাইন নির্মাণ শুরু হয়। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বাধায় এ রেললাইন নির্মাণ সম্পন্ন হয়নি। ১৯১৩ সালে ব্রিটেন ও অটোমান সরকারের মধ্যে বাগদাদ রেলওয়ে নির্মাণ নিয়ে একটি চুক্তি হয়। চুক্তিতে বলা হয়, তুরস্কের এশীয় অংশে কোনো রেললাইন নির্মাণে বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না। ব্রিটিশ সরকার অনুমোদিত দুজন ব্রিটিশ প্রতিনিধিকে বাগদাদ রেলওয়ে কোম্পানির বোর্ডে রাখতে হবে। বসরায় রেললাইন নির্মাণ শেষ করতে হবে। ব্রিটিশ সরকারের সম্মতি ছাড়া বসরা থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত কোনো রেললাইন নির্মাণ করা যাবে না। ১৯১৪ সালের ১৫ জুন লন্ডনে অনুরূপ শর্তে অ্যাংলো-জার্মান চুক্তি হয়। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে এসব চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও কার্যকর হয়নি।
জোট গঠন
১৯১৩ সালের ২২ জুলাই অটোমান যুদ্ধমন্ত্রী আনোয়ার পাশা কন্সটান্টিনোপলে নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত ব্যারন হ্যান্স ফ্রিহার ভন ওয়ানগেনহেইমের কাছে জার্মান-অটোমান জোট গঠনের প্রস্তাব দেন। তুরস্কের মূল্যবান কিছু দেয়ার নেই বিবেচনা করে জার্মানি এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। উজিরে আজম সৈয়দ হালিম পাশা অস্ট্রো-হাঙ্গেরী রাষ্ট্রদূতের কাছে অনুরূপ প্রস্তাব দেন। ১৯০৯ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত আনোয়ার পাশা সামরিক অ্যাটাশে হিসেবে বার্লিনে দায়িত্ব পালন করেন। তবে জার্মান সামরিক মিশন বিশেষ করে জেনারেল অটো লিমান ভন স্যান্ডার্সের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো ছিল না। তিনি তার সৈন্য ও সৈন্যবাহিনীর প্রতি আস্থা রাখেন এবং জার্মান সামরিক হস্তক্ষেপে গভীর অনুতপ্ত হন। জার্মানির সঙ্গে জোট গঠনে আনোয়ার পাশা ও সৈয়দ হালিম পাশার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে ১৯১৪ সালের জুলাইয়ে নৌমন্ত্রী কামাল পাশাকে প্যারিসে পাঠানো হয়। তিনি সামরিক পদক নিয়ে ইস্তাম্বুলে ফিরে আসেন। কিন্তু তিনি ফ্রান্সের সঙ্গে জোট গঠনে সক্ষম হননি। প্রাথমিকভাবে অটোমান সরকার বিশেষ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তালাত পাশা ব্রিটিশের সঙ্গে জোট গঠনের প্রতি সমর্থন দেয়। কিন্তু ব্রিটেন ইউরোপে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখে এবং জোট গঠনে সিইউপি’র প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই ব্রিটিশ ফার্স্ট লর্ড অব দ্য এডমিরাল্টি উইন্সটন চার্চিল তাদের শিপইয়ার্ডে নির্মাণাধীন দুটি অটোমান যুদ্ধহাজাজ অধিগ্রহণের নির্দেশ দেন। একটি যুদ্ধজাহাজ সুলতান উসমান-ই-ঈভেলের নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং জাহাজটি তুরস্কের উদ্দেশে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এ ধরনের অধিগ্রহণের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও ৩১ জুলাই ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার একটি বৈঠকে তুরস্ককে মূল্য পরিশোধের প্রস্তাব পাস হয়। ৩ আগস্ট অটোমান সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে দুটি জাহাজ জব্দ করার সিদ্ধান্ত অবহিত করা হয়। ইতিমধ্যে ২৯ জানুয়ারি থেকে তিন পাশা তাদের দুটি জাহাজ আটক হওয়ার কথা জানতে পেরেছিলেন। কেননা আনোয়ার পাশা জানতেন যে, ব্রিটেনের সঙ্গে তাদের জোট গঠন সম্ভব হবে না। তাই তিনি জার্মানির সঙ্গে নতুন করে জোট গঠনের চেষ্টায় তাদের কাছে ব্রিটেনে আটক দুটি জাহাজ বিক্রি করে দেয়ার প্রস্তাব দেন। জার্মানির কাছে আনোয়ার পাশার ২২ জুলাইয়ের প্রস্তাব নাকচ হয়ে যাবার পরও জার্মান কাইজার দ্বিতীয় উইলহেম জোট গঠনের সম্ভাবনা পুনর্বিবেচনার নির্দেশ দেন। ২৮ জুলাই নতুন করে আনোয়ার পাশা, তালাত পাশা ও সৈয়দ হালিম পাশার সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়। পহেলা আগস্ট দুটি দেশের মধ্যে গোপন প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে জার্মানি প্রতিশ্রুতি দেয় যে, অটোমান সাম্রাজ্য আক্রান্ত হলে জার্মানি তাকে রক্ষা করবে। আরো বলা হয়, অস্ট্রিয়ার সঙ্গে চুক্তির শর্ত পালনে জার্মানি যুদ্ধে যোগদান করলে তুরস্ক তার পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেবে। তবে বুলগেরিয়া যুদ্ধে যোগদান না করলে অটোমান সাম্রাজ্য যুদ্ধে যোগ দেবে না। ১৯১৪ সালের ২ আগস্ট অটোমান সাম্রাজ্য সাবির্ক সৈন্য সমাবেশের নির্দেশ দেয় এবং ঘোষণা করে যে, তারা যুদ্ধে নিরপেক্ষতা রক্ষা করবে। অটোমান কর্র্তৃপক্ষ আশা করছিল যে, চার সপ্তাহের মধ্যে সৈন্য সমাবেশ সম্পন্ন হবে। সৈয়দ হালিম পাশা জার্মানির সঙ্গে পরবর্তী আলোচনায় মিলিত হওয়ার আগে পরিস্থিতির ওপর নজর রাখার পক্ষপাতি ছিলেন। তিনি গ্রীস, রুমানিয়া ও বুলগেরিয়ার সঙ্গে আলোচনার ফলাফল দেখতে চাইছিলেন। সৈয়দ হালিম দুটি সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমত: তিনি জার্মান রাষ্ট্রদূতকে সামরিক বিষয়ে এবং জার্মান কমান্ডার জেনারেল লিমান ভন স্যান্ডার্সকে রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নির্দেশ দেন। দ্বিতীয়ত: তিনি ফরাসি ও রুশ রাষ্ট্রদূতদ্বয়ের সঙ্গে পুনরায় আলোচনার নির্দেশ দেন। ৯ আগস্ট আনোয়ার পাশা জেনারেল লিমান ভন স্যান্ডার্সকে ফার্স্ট আর্মির কমান্ডার পদে নিয়োগ করেন। রাশিয়া এ নিয়োগদানকে দার্দানেলিস ও বসফোরাস প্রণালীর প্রতিরক্ষা জোরদারের একটি উদ্যোগ হিসেবে ব্যাখ্যা করে। প্রকৃতপক্ষে জেনারেল স্যান্ডার্সকে ফার্স্ট আর্মিতে নিয়োগ দিয়ে তাকে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী অবস্থান থেকে দূরে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। আগস্টের মাঝামাঝি জেনারেল স্যান্ডার্স আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে অব্যাহতিদান এবং জার্মানিতে ফিরে যাবার অনুমতি প্রার্থনা করেন। তার স্টাফ ওডেসা যুদ্ধের তথ্য ফাঁস করে দিলে তিনি পুুরোপুরি বিস্মিত হন। ১৯১৪ সালের ৩ আগস্ট অটোমান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকার ঘোষণা দেয়। ৫ আগস্ট আনোয়ার পাশা রাশিয়াকে জানান, তিনি রুশ সীমান্ত বরাবর সৈন্য সংখ্যা হ্রাস এবং পূর্বাঞ্চলীয় থ্রেসে সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করতে চান।
৯ আগস্ট সৈয়দ হালিম পাশা জার্মানদের অবহিত করেন যে, রুমানিয়া একটি ত্রিপক্ষীয় নিরপেক্ষ জোট গঠনে কন্সটান্টিনোপল ও এথেন্সের দারস্থ হয়েছে। ৬ আগস্ট রাত একটায় সৈয়দ হালিম পাশা জার্মান রাষ্ট্রদূত হ্যান্স ফ্রিহার ভন ওয়ানগেনহেইমকে তার অফিসে ডেকে পাঠান এবং তাকে অবহিত করেন যে, অটোমান মন্ত্রিসভা সর্বসম্মতিক্রমে জার্মান ব্যাটলক্রুজার গোয়েবেন এবং হাল্কা ক্রুজার ব্রেসলাউয়ের জন্য দুটি প্রণালী খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি এ দুটি জার্মান যুদ্ধজাহাজকে ধাওয়া করছিল। তারপর সৈয়দ হালিম পাশা জার্মান রাষ্ট্রদূত ওয়ানগেনহেইমের কাছে ৬টি প্রস্তাব পেশ করেন। জার্মান রাষ্ট্রদূত তৎক্ষণাৎ এসব প্রস্তাব গ্রহণ করেন।
(১) বিদেশি শক্তি বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে অটোমান সাম্রাজ্যের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বাতিলে সমর্থনদান।
(২) রুমানিয়া ও বুলগেরিয়ার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের আলোচনায় সমর্থনদান।
(৩) যুদ্ধে জার্মানির কোনো শত্রু অটোমান ভূখ- দখল করে নিলে এসব ভূখ- ফিরিয়ে দেয়া নাগাদ জার্মানি শান্তি চুক্তি মেনে নেবে না।
(৪) গ্রীস যুদ্ধে যোগদান করলে এবং অটোমান সাম্রাজ্যের কাছে পরাজিত হলে তাকে এজিয়ান সাগরের দ্বীপগুলো অটোমানদের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।
(৫) মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রুশ আজারবাইজানের সঙ্গে সংযোগ সাধনে ককেশাসে অটোমান সীমান্ত পুনর্বিন্যাস করতে হবে।
(৬) যুুদ্ধের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
পরবর্তীতে জার্মান সরকার এসব প্রস্তাব অনুমোদন করে। ১৯১৪ সালের ৯ আগস্ট আনোয়ার পাশা রুশ রাষ্ট্রদূত গায়ার্সের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদের আলোচনা এতদূর পর্যন্ত পৌঁছে যে, আনোয়ার পাশা সেদিনই অটোমান-রুশ জোট গঠনের প্রস্তাব দেন। আনোয়ার পাশার অবস্থান সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা দুধরনের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। একদল বিশ্বাস করছেন, এ প্রস্তাব ছিল জার্মানির সঙ্গে জোট গোপন করার একটি অজুহাত। আরেকদল বিশ্বাস করছেন, আনোয়ার পাশা সৈয়দ হালিম পাশার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করছিলেন এবং এ সন্ধিক্ষণে তারা সাম্রাজ্যকে যুদ্ধের বাইরে রাখার একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে চাইছিলেন। একথা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, অটোমান সরকারের কেউ যুদ্ধে যোগদানের পক্ষে ছিলেন না। যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে তারা বহু বিকল্প নিয়ে ভাবছিলেন।
অটোমান-বুলগেরিয়া জোট গঠন
১৯১৪ সালের ১৯ আগস্ট প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রারম্ভিক মাসে সোফিয়ায় অটোমান-বুলগেরিয়া জোট গঠন করা হয়। সে সময় দুটি দেশ ছিল নিরপেক্ষ। অটোমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তালাত পাশা এবং অটোমান পার্লামেন্টের স্পীকার হালিল বে অটোমান সাম্রাজ্যের পক্ষে এবং প্রধানমন্ত্রী ভাসিল রাদোস্লাভ বুলগেরিয়ার পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। অটোমান সাম্রাজ্য ও বুলগেরিয়া একে অন্যের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করছিল। কেননা বলকান যুদ্ধে তারা উভয়ে ভূখ- হারিয়েছিল। গ্রীসের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল তিক্ত। এ অঞ্চলে সুবিধাজনক অবস্থান অর্জনে সহায়ক নীতি ছিল তাদের জন্য হিতকর এবং স্বাভাবিক। তুরস্ক যুদ্ধে যোগদান করলে এ চুক্তি বুলগেরিয়ার সেন্ট্রাল পাওয়ার্সের সঙ্গে যোগদানে একটি পূর্বশর্ত হতে পারতো। চুক্তিতে অনুচ্ছেদ ছিল ৭টি। চুক্তিটি ছিল পুরোপরি আত্মরক্ষামূলক। চুক্তিতে বলা হয়েছিল, কোনো বলকান দেশ স্বাক্ষরদানকারী কোনো দেশ আক্রমণ করলে অন্য দেশ যুদ্ধে যোগদান করবে। দুটি দেশ পারস্পরিক আলোচনা ছাড়া কোনো বলকান দেশ আক্রমণ না করতে সম্মত হয়। চুক্তির চতুর্থ অনুচ্ছেদে বুলগেরিয়ার ভূখ-ের মধ্য দিয়ে অন্য দেশ আক্রমণে অটোমান সৈন্যদের সুযোগ দেয়া হয়। পূর্বে আলোচনা ছাড়া যুদ্ধ বেধে গেলে তারা নিরপেক্ষতা রক্ষার অঙ্গীকার করে। বুলগেরিয়া তার ভূখ-ে যেকোনো ধরনের বিদেশি সৈন্য সমাবেশ সম্পর্কে তুরস্ককে অবহিত করার প্রতিশ্রুতি দেয়। চুক্তির পঞ্চম অনুচ্ছেদে তুরস্ক রুমানিয়াকে নিরপেক্ষ রাখার জন্য আলোচনা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। যুদ্ধ শেষ হওয়া নাগাদ চুক্তি গোপন রাখার অঙ্গীকার করা হয়। বুলগেরিয়ার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের পর অটোমানরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক জোট গঠনের চেষ্টা অব্যাহত রাখে। তবে তাদের চেষ্টা সফল হয়নি। ২২ আগস্ট উজিরে আজম সৈয়দ হালিম পাশা স্পষ্টাক্ষরে বলেন, অটোমান-জার্মান চুক্তি অনুযায়ী জার্মানির পাশাপাশি তার দেশ যুদ্ধে যোগদানে বাধ্য নয়। তিনি মন্ত্রীদের রুমানিয়া, রাশিয়া, গ্রীস ও ফ্রান্সের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। রুমানিয়ার সঙ্গে রুশ বিরোধী জোট গঠনের আলোচনা ব্যর্থ হলে ৩০ আগস্ট অটোমানরা তাদের জার্মান মিত্রদের অবহিত করে যে, সার্বিয়া ও গ্রীসের বিরুদ্ধে বুলগেরিয়ার সঙ্গে জোট গঠন করা সম্ভব। জার্মানরা আপত্তি জানায়। কিন্তু অটোমানরা বুলগেরীয় জেনারেল স্টাফের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে একজন কর্নেলকে সোফিয়ায় পাঠায়। যুদ্ধে যোগদান করার পরও অটোমানরা ১৯১৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর নাগাদ জার্মানদের কাছে বুলগেরিয়ার সঙ্গে জোট গঠনের সত্যতা স্বীকার করেনি। ১৯১৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সোফিয়া চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়া নাগাদ বুলগেরীয়রা সেন্টাল পাওয়ার্সের পক্ষে যুদ্ধে যোগদানে সম্মত হয়নি। ১৯১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর অটোমান কেন্দ্রীয় সরকার একতরফাভাবে বিদেশি শক্তিগুলোকে প্রদত্ত সুবিধা বাতিল করে। ব্রিটিশ, ফরাসি, রুশ, ইতালীয়, অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় ও জার্মান রাষ্ট্রদূতরা একটি যৌথ প্রতিবাদলিপিতে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু একান্তভাবে অস্ট্রো-হাঙ্গেরী ও জার্মান রাষ্ট্রদূতদ্বয় অটোমান উজিরে আজম সৈয়দ হালিম পাশাকে অবহিত করেন যে, তারা এ ইস্যুতে চাপ প্রয়োগ করবেন না। পহেলা অক্টোবর অটোমান সরকার আবগারি শুল্ক উত্তোলন করে এবং সকল বিদেশি পোস্ট অফিস বন্ধ করে দেয়। ২৮ সেপ্টেম্বর তুরস্কের দুটি প্রণালীতে নৌচলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এ দুটি প্রণালী ছিল পশ্চিমা মিত্র ও মস্কোর মধ্যে বাণিজ্যিক যোগাযোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
যুদ্ধে যোগদান
অটোমান নৌমন্ত্রী ও নৌবহরের কমান্ডার-ইন-চিফ আহমদ কামাল পাশা ব্রিটিশ সামরিক মিশনের মাধ্যমে ব্রিটিশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি অটোমান নৌবাহিনীর উন্নয়নে এ সম্পর্ক কাজে লাগান। ১৯১২ সাল থেকে এডমিরাল আর্থার লিম্পাস ব্রিটিশ সামরিক মিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ব্রিটিশ সামরিক উপদেষ্টারা ছিলেন মূলত নৌবাহিনীর। অটোমান নৌবাহিনীর ওপর তাদের প্রভাব ছিল সামান্য। ব্রিটেনের যুদ্ধে যোগদানের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের প্রেক্ষিতে ১৯১৪ সালের সেপ্টেম্বরে এডমিরাল আর্থার লিম্পাসকে প্রত্যাহার করা হয়। তাকে প্রত্যাহার করা হলেও অটোমান জাহাজগুলোতে ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীর রং ব্যবহার করা হতো এবং অফিসারদের পোশাক ছিল ব্রিটিশের মতো। এডমিরাল উইলহেম এন্টন সৌচন ভূমধ্যসাগরে কাইজারলিচি মেরিনের (জার্মান রাজকীয় নৌবাহিনী) নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। ব্যাটল ক্রুজার এসএমএস গোয়েবেন এবং হাল্কা ক্রুজার এসএমএস ব্রেসলাউয়ের সমন্বয়ে ভূমধ্যসাগরে জার্মান নৌবাহিনী গড়ে উঠেছিল। যুদ্ধের শুরুতে ভূমধ্যসাগরীয় ব্রিটিশ নৌবাহিনী জার্মান যুদ্ধজাহাজকে ধাওয়া করে। জার্মান যুদ্ধজাহাজ ব্রিটিশ নৌবহরকে এড়িয়ে যায় এবং ১৯১৪ সালের ৪ আগস্ট নিরপেক্ষ দেশ ইতালির মেসিনা বন্দরে গিয়ে ভিড়ে। ইতালীয় কর্তৃপক্ষ জোর দিয়ে জানায়, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জার্মান যুদ্ধজাহাজ বন্দর ছেড়ে গেছে। এডমিরাল সৌচন জানতে পারেন যে, অস্ট্রো-হাঙ্গেরী ভূমধ্যসাগরে কোনো নৌসহায়তা প্রদান করবে না এবং অটোমান সাম্রাজ্য তখনো নিরপেক্ষ। এ পরিস্থিতিতে তার কন্সটান্টিনোপলের উদ্দেশে যাত্রা করা উচিত ছিল না। কিন্তু তিনি যেকোনোভাবে কন্সটান্টিনোপলের উদ্দেশে এগিয়ে যান।
১৯১৪ সালের ৬ আগস্ট রাত ১টায় অটোমান উজিরে আজম সৈয়দ হালিম পাশা জার্মান রাষ্ট্রদূত হ্যান্স ফ্রিহার ভন ওয়ানগেনহেইমকে তার অফিসে ডেকে পাঠান এবং তাকে অবহিত করেন যে, অটোমান মন্ত্রিসভা সর্বসম্মতিক্রমে জার্মান ব্যাটলক্রুজার গোয়েবেন এবং হাল্কা ক্রুজার ব্রেসলাউ এবং তাদের সঙ্গী অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় জাহাজের জন্য দুটি প্রণালী খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ৯ আগস্ট তিনি কল্পিত বিক্রির অজুহাতে গোয়েবেনকে তুরস্কের নিয়ন্ত্রণে হস্তান্তরের অনুরোধ করেন। জার্মান সরকার তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। কোনো ধরনের চুক্তি হওয়ার আগে ১০ আগস্ট জার্মান যুদ্ধজাহাজ দার্দানেলিসের প্রবেশমুখে পৌঁছে এবং আনোয়ার পাশা তাদের প্রণালীতে প্রবেশের অনুমতি দেন। উজিরে আজম আপত্তি করে বলেন, জার্মান যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি অকালীন এবং বুলগেরিয়ার সঙ্গে প্রয়োজনীয় চুক্তি হওয়ার আগে ত্রিপক্ষীয় জোট অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে। তিনি পুনরায় কল্পিত বিক্রির প্রস্তাব দেন।
ব্রিটিশের চোখে ধূলো দিয়ে ১৯১৪ সালের ১১ আগস্ট এডমিরাল সৌচনের যুদ্ধজাহাজ কন্সটান্টিনোপলে এসে পৌঁছে। উইন্সটন চার্চিল জার্মান যুদ্ধজাহাজ পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে এক বিবৃতিতে বলেন, এডমিরাল সৌচন অনমনীয়তার সঙ্গে গ্রীক দ্বীপপুঞ্জের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। তিনি চেষ্টা করছিলেন যাতে দার্দানেলিসে তাকে ভিড়তে দেয়া হয়। তিনি দিনিউসায় ৩৬ ঘন্টা বিলম্ব করেন এবং কয়েকবার তার একমুখী ওয়ারলেস ব্যবহারে বাধ্য হন।
১৯১৪ সালের ১৬ আগস্ট কামাল পাশা গোয়েবেন এবং ব্রেসলাউয়ের আনুষ্ঠানিক কমিশনিংয়ে সভাপতিত্ব করেন। পুনরায় এ দুটি জার্মান যুদ্ধজাহাজের নামকরণ করা হয় যথাক্রমে ইয়াভুজ সুলতান সেলিম ও মিদিল্লি। জার্মান অফিসার ও নাবিকদের অটোমান নৌবাহিনীতে আত্মীকরণ করা হয়। নাবিকরা তুর্কি ফেজ টুপি পরিধান করে। ব্রিটেন অটোমান ড্রীডনট যুদ্ধজাহাজ আটক করায় অটোমানরা দেশে ব্যাপক প্রচার চালায় যে, তারা জার্মান যুদ্ধজাহাজ ‘ক্রয়’ করেছে। সে সময় অটোমান নৌবাহিনীতে এডমিরাল সৌচনের পদমর্যাদা কি ছিল তা স্পষ্ট নয়। বিদেশি একটি দেশের নৌবাহিনীতে জার্মান কমান্ডার হিসেবে তিনি ছিলেন জার্মান রাষ্ট্রদূত ওয়ানগেনহেইমের কমান্ডে। ১৯১৩ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে তুরস্কে জেনারেল অটো লিমান ভন স্যান্ডার্সের অধীনে একটি জার্মান সামরিক মিশন কাজ করছিল। এডমিরাল সৌচন জার্মান সামরিক মিশনের অংশ না হওয়ায় জেনারেল স্যান্ডার্সের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। এ পর্যায়ে সৈয়দ হালিম পাশা দেখতে পান যে, এডমিরাল সৌচন অথবা তার যুদ্ধাজাহাজ অটোমান নিয়ন্ত্রণে নেই।
১৪ সেপ্টেম্বর আনোয়ার পাশা এডমিরাল সৌচনকে যুদ্ধজাহাজসহ কৃষ্ণসাগরে প্রবেশ এবং যেকোনো রুশ জাহাজে গোলাবর্ষণের নির্দেশ দেন। নৌমন্ত্রী আহমদ কামাল পাশাকে ডিঙ্গিয়ে ভারপ্রাপ্ত সি-ইন-সি আনোয়ার পাশা এ নির্দেশ দিয়েছিলেন। চেইন অব কমান্ডে এডমিরাল সৌচনের অবস্থান ছিল অস্পষ্ট। উজিরে আজম সৈয়দ হালিম পাশা যুদ্ধমন্ত্রী আনোয়ার পাশার নির্দেশ যাচাইয়ে মন্ত্রিসভায় একটি ভোটাভুটির আয়োজন করতে বাধ্য হন। ভোটাভুটিতে আনোয়ার পাশার নির্দেশ বাতিল হয়ে যায়। একই সময় এডমিরাল সৌচন প্রশিক্ষণ মহড়া পরিচালনা করতে চাইছিলেন। তিনি জার্মান রাষ্ট্রদূত ওয়ানগেনহেইমের কাছে অভিযোগ করেন। তিনি তাকে সরাসরি অটোমান সরকারের কাছে প্রস্তাব দেয়ার অনুমতি দেন। ১৮ সেপ্টেম্বর এ জার্মান এডমিরাল ও সৈয়দ হালিম পাশার মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সৈয়দ হালিম পাশা তার অনুরোধে অসন্তুষ্ট হন।
১৫ সেপ্টেম্বর এডমিরাল লিম্পাস ব্রিটিশ নৌমিশন পরিত্যাগ করেন। প্রস্থানকারী ব্রিটিশ এডমিরালের ভূমিকা পালনে এডমিরাল সৌচনকে অনুরোধ করা হয়। সেপ্টেম্বরে দুটি তুর্কি প্রণালীর শক্তিবৃদ্ধি করতে এডমিরাল গাইডো ভন ইউজডোমের নেতৃত্বে ৭ শো নাবিক ও উপকূলীয় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি জার্মান নৌমিশন এসে পৌঁছে। এডমিরাল গাইডো ভন ইউজডোমের নেতৃত্বাধীন নৌমিশনের অনুকরণে এডমিরাল সৌচনকে অটোমান নৌবাহিনীতে এক বছর কমিশন লাভ করতে হয়। এ সময় তিনি কামাল পাশার সরাসরি নির্দেশের আওতায় কাজ করতেন। কৃষ্ণসাগরে জার্মানদের মহড়া না চালাতে নিষেধ করা হয়।
১৯১৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ভাইস এডমিরাল পদমর্যাদায় এডমিরাল সৌচনকে অটোমান নৌবাহিনীতে কমিশন দেয়া হয়। ভাইস এডমিরাল হিসেবে তিনি সরাসরি যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে পারতেন। অন্যদিকে জেনারেল লিমান ভন স্যান্ডার্স কখনো তার মর্যাদায় পৌঁছতে পারেননি। অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতি এডমিরাল সৌচনের আনুগত্য ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তবে তার মাধ্যমে জার্মানি অটোমান সশস্ত্র বাহিনীকে স্বাধীনভাবে ব্যবহারে সক্ষম হয়। এডমিরাল সৌচন ও তার যুদ্ধজাহাজগুলোকে সৈয়দ হালিম পাশা অটোমান নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আনতে সক্ষম হন। অটোমান সাম্রাজ্য ও এডমিরাল সৌচনের মধ্যে একটি অকার্যকর কমান্ডিং সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। নৌমন্ত্রী আহমদ কামাল পাশা যথার্থভাবে তার আত্মজীবনীতে এসব ঘটনা এড়িয়ে গেছেন। তিনি তার আত্মজীবনীতে ১২ থেকে ৩০ অক্টোবরের ঘটনাবলী উল্লেখ করেননি।
কৃষ্ণসাগরে হামলা
১৯১৪ সালের অক্টোবরে অটোমান নৌমন্ত্রী কামাল পাশা উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে প্রেরিত এক নির্দেশে বলেন, এডমিরাল সৌচন নির্দেশ জারির ক্ষমতা রাখেন। কামাল পাশা কেন এ নির্দেশ দিয়েছিলেন তা তিনি তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেননি। অটোমান নৌবাহিনীতে নি?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন