উত্থানের পর পতন। প্রকৃতির এ শাশ্বত নিয়মকে কেউ অতিক্রম করতে পারে না। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী অটোমান সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রেও একথা সত্যি। আধুনিক তুরস্ক ছাড়া অটোমান সাম্রাজ্যের আর কোনো স্মৃতি অবশিষ্ট নেই। ১২৯৯ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত ৬ শো বছরের অধিক এ সাম্রাজ্য এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশের বিস্তীর্ণ ভূখন্ড শাসন করেছে। অমুসলিম ইউরোপে একমাত্র মুসলিম শক্তি হিসেবে টিকে থাকা ছিল অটোমানদের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। আয়তনে এ সাম্রাজ্য ছিল আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের সমকক্ষ এবং মুসলিম বিশ্বের বহু বৈরি অংশ এ সাম্রাজ্যের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয়। এতবড় বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনা করা কঠিন হয়ে ওঠে। প্রশাসনিক চাপে এ সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ে। ষোড়শ শতাব্দীতে অটোমান সাম্রাজ্য অস্তাচলে যাত্রা করে। অটোমান সৈন্যবাহিনীর পরিপূর্ণ পরাজয়ের মধ্য দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। যুদ্ধে পরাজয়ের পরিণামে এ সাম্রাজ্যের ব্যবচ্ছেদ ঘটানো হয়। চার বছরের চরম বিশৃঙ্খলা এবং লড়াইয়ের পর আনাতোলিয়া, থ্রেসের পূর্বাঞ্চলের একটি ক্ষুদ্র ভূখন্ড, উত্তর ইস্তাম্বুল এবং ব্রিটিশ ও ফরাসিদের নিয়ন্ত্রিত পাঁচটি নয়া নির্ধারিত ভূখন্ড নিয়ে আধুনিক তুরস্কের উত্থান ঘটে। ১৯২২ সাল নাগাদ অটোমান সুলতানরা শাসন ক্ষমতায় থাকলেও সীমান্ত রক্ষায় পশ্চিমে হ্যাবসবার্গ এবং পূর্ব দিকে সাফাভি পারস্যের সঙ্গে তাদের লড়াই করতে হয়েছে। এসব লড়াইয়ে অটোমানদের ইউরোপীয় ও আরব প্রদেশগুলো খোয়াতে হয়। ঊনিশ শতকে ফরাসি সৈন্যরা মাগরিব (উত্তর আফ্রিকা) দখল করে নেয় এবং ১৮৩০ সালে গ্রীস স্বাধীনতা অর্জন করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো অটোমান সাম্রাজ্যের অস্তিত্বে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়। রাতারাতি পৃথিবীর দীর্ঘস্থায়ী এ সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যায়নি। শত শত বছরের অবক্ষয় তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। ২০০০ সালের ২৯ জানুয়ারি লন্ডনের দ্য টেলিগ্রাফের একটি রিপোর্টে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের কারণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, কেউ কখনো ভাবতে পারেননি যে, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মাত্র ২০ বছরের মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম চারটি সাম্রাজ্য জার্মান, রুশ, হ্যাবসবার্গ ও অটোমান সাম্রাজ্য বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে। রিপোর্টে এ সাম্রাজ্যের পতনের জন্য অনেকগুলো কারণ উল্লেখ করা হয়। যেসব কারণ অটোমান সাম্রাজ্যের অবনতি ও অবক্ষয় ডেকে এনেছে নিচে সেগুলো একে একে আলোচনা করা হলো:
জার্মানির সঙ্গে জোট গঠন
জার্মানিকে মিত্র হিসেবে বেছে নেয়ায় অটোমান সাম্রাজ্য অর্ধ-শতাব্দী ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অটোমান সরকার শুধুমাত্র জার্মানির সহায়তার ওপর নির্ভর করতে পারতো। জার্মানির বন্ধুত্ব ছিল সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের জন্য ব্রিটিশ ও ফরাসি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে একটি সুবিধাজনক বিকল্প। ১৯০২ সালে জার্মানিকে ৯৯ বছরের জন্য বার্লিন-বাগদাদ রেললাইন নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়। জার্মানি অটোমান অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করে এবং জার্মান অফিসাররা অটোমান সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিতো এবং সৈন্যবাহিনীতে কমান্ড পোস্টে অধিষ্ঠিত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার অব্যবহিত পরে ১৯১৪ সালের ২ আগস্ট অটোমান-জার্মান গোপন চুক্তি অনুমোদন করা হয়। পতনোন্মুখ অটোমান সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী ও আধুনিকীকরণ এবং পার্শ্ববর্তী ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে জার্মানিকে নিরাপদে প্রবেশের সুযোগদানে এ চুক্তি করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে অটোমান সাম্রাজ্যের অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। উপর্যুপরি যুদ্ধে দেশটি ভূখ-ের পর ভূখ- হারায়। অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ে এবং জনগণের মনোবল ভেঙ্গে যায় এবং ক্লান্ত হয়ে পড়ে। অটোমান সাম্রাজ্য এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি এবং সংস্কার চালিয়ে যেতে চাইছিল। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় দেশটি সেই সুযোগ পায়নি। যুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পক্ষে নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব ছিল না। কোনো না কোনো পক্ষের সঙ্গে যোগদান করা ছাড়া তাদের গত্যন্তর ছিল না। কেননা ইতালি-তুর্কি যুদ্ধ এবং বলকান যুদ্ধে দেশটি পুরোপুরি দেউলিয়া হয়ে যায়। তাদের মানসম্পন্ন পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র ও যন্ত্রপাতি ছিল না। নতুন নতুন অস্ত্র ক্রয়ের সামর্থ্য ছিল না। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে জার্মানির সঙ্গে জোট গঠন করা ছিল একমাত্র বিকল্প।
আরব জাতীয়তাবাদ
আরব জাতীয়তাবাদ অটোমান সাম্রাজ্যের ভাঙ্গনের জন্য অনেকাংশে দায়ী। সাম্রাজ্যবাদী গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সম্মিলিত দিকনির্দেশনায় আরব বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। তাদের লক্ষ্য ছিল অটোমান সাম্রাজ্যকে ভেঙ্গে দিয়ে মুসলিম মধ্যপ্রাচ্যকে গ্রাস এবং আরবদের সহায়তায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ। আরব বিদ্রোহ শুরু না হলে অটোমান সৈন্যরা মিসরে সুয়েজ খালে ব্রিটিশদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। সুয়েজ খালে অটোমান হামলার আশঙ্কা দূর করতে চতুর ব্রিটিশ সরকার মরুচারী আরবদের একটি সাম্রাজ্য দানের প্রতিশ্রুতি দেয়। ব্রিটিশ ও ফরাসিরা তাদের লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়। অস্ত্র ও অর্থের যোগান দিয়েছিল ব্রিটেন ও ফ্রান্স। মিসর থেকে ব্রিটিশ সৈন্যরা আরব বিদ্রোহে যোগ দেয়। বানু হাশেম গোত্রের মক্কার শেরিফ হোসেন বিন আলী সাম্রাজ্যবাদীদের বহন হিসেবে কাজ করেন। তার ও তার চার পুত্রের কাঁধে পা রেখে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের নীলনকশা বাস্তবায়ন করে। মুসলিম অটোমানরা হয়ে যায় আরবদের কাছে বিদেশি এবং শত্রু। অন্যদিকে সুদূর ইউরোপের বিধর্মী ব্রিটিশ ও ফরাসিরা হয়ে যায় মুসলিম আরবদের মিত্র। মুসলিম ঐক্যকে বিনষ্ট করার জন্য আরবদের মধ্যে পাশ্চাত্যের ধ্যান ধারণায় লালিত জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করা হয়। বিদেশি আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই জাতীয়তাবাদের মূল বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আরব জাতীয়তাবাদে এ ধরনের উপাদানের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। একটি বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে আরবরা অন্য কয়েকটি বিদেশি শক্তির সহায়তা গ্রহণ করেছে। তারা চিরাচরিত মুসলিম ঐক্যের অবিনাশী আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেয়। কোনো জাতির স্বাধীনতা অর্জনের অধিকারকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু অশুভ বিদেশি শক্তির সহায়তা ও দিকনির্দেশনায় স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যে কোনো গৌরব নেই। বিদেশি শক্তির সহায়তায় স্বাধীনতা অর্জন করলে কখনো মাথা তুলে কথা বলা যায় না। জাতির মানসিকতায় হীনমন্যতার ছাপ পড়ে। সৌদি আরবের আচরণে একথা স্পষ্ট হয়ে যায়। ব্রিটিশরা যে সময় আরবদের স্বাধীনতা অর্জনে আদাজল খেয়ে লেগেছিল, সে সময় ভারতবর্ষসহ পৃথিবীর এক বিরাট অংশ ছিল তাদের ঔপনিবেশ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ
অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধ প্রথমে দায়ী। এ বিধ্বংসী যুদ্ধ না হলে টিম টিম করে হলেও অটোমান সাম্রাজ্য টিকে থাকতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী মিত্রপক্ষ অটোমান সাম্রাজ্য ভাগাভাগি করে। অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা এ সাম্রাজ্যের ভাঙ্গনকে ত্বরান্বিত করে। একইসঙ্গে অটোমান সালতানাতের বিলুপ্তি ঘটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এ অবিস্মরণীয় রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে এবং ১৯১৮ সালের নভেম্বরে ব্রিটিশ, ফরাসি ও ইতালীয় সৈন্যরা কন্সটান্টিনোপল দখল করে নেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে মিত্রশক্তি কয়েকটি চুক্তির মাধ্যমে অটোমান সাম্রাজ্য ভাগাভাগির পরিকল্পনা করে। এসব চুক্তি ও সমঝোতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সাইকস-পিকোট চুক্তি, বেলফোর ঘোষণা, সেভার্স চুক্তি, লাউসেন চুক্তি এবং হোসেন-ম্যাকমোহন পত্রবিনিময়। সাইকস-পিকোট চুক্তির বাইরে ব্রিটেন ও রাশিয়ার মধ্যে আরেকটি চুক্তি হয়। ১৯১৫ সালের মার্চে ব্রিটেন ও রাশিয়া এ গোপন চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী রাশিয়া অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সটান্টিনোপল, ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে কৃষ্ণসাগর সংযোগকারী দার্দানেলিস প্রণালী এবং গ্যালিপলি উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। বিনিময়ে রাশিয়া তেল সমৃদ্ধ মেসোপটেমিয়া অঞ্চলসহ মধ্য পারস্য এবং অটোমান সাম্রাজ্যের বাদবাকি অংশের ওপর ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণ মেনে নিতে সম্মত হয়। রাশিয়ার সঙ্গে ব্রিটেনের গোপন চুক্তি হওয়ার এক বছরের অধিক অতিক্রান্ত হলে সাইকস-পিকোট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। একটি ক্ষুদ্র প্রতিনিধি দলের নেতা পিকোট সিরিয়ায় ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণ কায়েমে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তার অনমনীয়তার জবাবে সাইকস এ অঞ্চলে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় ব্রিটেনের দাবি উত্থাপন করেন। চুক্তিতে ভবিষ্যতে আরব জাতীয়তাবাদের উত্থানকে মূলত উপেক্ষা করা হয়। অথচ সে সময় যুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিজয় লাভে ব্রিটিশ সরকার ও সামরিক বাহিনী আরব জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিচ্ছিল। ১৯২০ সালের ১০ আগস্ট ত্রিপক্ষীয় আঁতাত, সেন্ট্রাল পাওয়ার্স ও অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে স্বাক্ষরিত সেভার্স চুক্তিতে অটোমান সাম্রাজ্যের ভাগাভাগি ও ব্যবচ্ছেদ ঘটানো হয় এবং কার্যত তুরস্কের সার্বভৌমত্ব বিলুপ্ত করা হয়। চুক্তিতে অটোমান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে। ইউরোপের ‘রুগ্ন ব্যক্তি’কে খ- বিখ- করা হয়।
অযোগ্য সুলতান
সোলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্টের রাজত্বকাল অটোমান সাম্রাজ্যের গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। বিংশ শতাব্দীর বহু গবেষক বলছেন যে, ১৫৬৬ সালে সুলতান সোলেমানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অটোমান সাম্রাজ্যের ক্ষয় এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নতুন সম্পদ হস্তগত না হওয়ায় সাম্রাজ্যে অধঃপতন শুরু হয়। সুলতান সোলেমানের আমলেই এ সাম্রাজ্যের অবনতির লক্ষণ ফুটে উঠতে শুরু করে। তিনি বিনা প্রমাণে বিদ্রোহের অভিযোগে জ্যেষ্ঠ পুত্র শাহজাদা মোস্তফা ও চতুর্থ পুত্র শাহজাদা বায়েজীদকে মৃত্যুদ- দেন। তার তৃতীয় পুত্র শাহজাদা মেহমেদও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে মৃত্যুবরণ করেন। তিনজন শাহজাদার অকাল মৃত্যুতে অটোমান সাম্রাজ্য বড় ধরনের একটি ধাক্কা খায়। উচ্ছৃঙ্খল সৈন্যরা নিজেদের খেয়াল খুশি মতো উজিরে আজম নিয়োগ করতো। এমনকি তারা সুলতান প্রথম উসমানকে হত্যা করে। প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, দুর্নীতি ও প্রাদেশিক বিদ্রোহে সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। সুলতানরা ছিলেন দুর্বল ও অধঃপতিত। তারা রাষ্ট্রীয় বিষয়ে উদাসীনতা প্রদর্শন করতেন এবং হেরেমে তাদের সময় কাটাতেন। কোনো সুলতানের মৃত্যু হলে নরকের দ্বার খুলে যেতো এবং সকল রীতি নীতি বিসর্জন দিয়ে একজন শাহজাদা সিংহাসন দখল করতেন। দ্বিতীয় সেলিম সুলতান সোলেমানের উত্তরাধিকার লাভ করেন। তিনি ছিলেন সোলেমানের সর্বশেষ জীবিত একমাত্র পুত্র। দ্বিতীয় সেলিম স্বর্ণ নির্মিত পানপাত্রে মদপান করতেন। ১৫৬৬ সালে সিংহাসনে আরোহণের সময় তার প্রথম কাজ ছিল সাইপ্রাস দখল। তাই সাইপ্রাসের তৈরি মদ তার প্রিয় হয়ে ওঠে। সাইপ্রাস দখলে লিপান্টো যুদ্ধ হয়। দ্বিতীয় সেলিম কুৎসিত ও রুক্ষ মেজাজের ছিলেন। তাকে এক শো বামুনের একটি দেহরক্ষী ঘেরাও করে রাখতো। ক্ষুদে তরবারি সজ্জ্বিত এসব বামুনের পরনে থাকতো সোনালী পোশাক।
দ্বিতীয় সেলিমের পুত্র তৃতীয় মুরাদ রাজনীতিতে তত বেশি আগ্রহী ছিলেন না। তিনি তোপকাপি প্রাসাদের অভ্যন্তরে হেরেমের আয়তন বৃদ্ধিতে তার শক্তি ক্ষয় করেন এবং ইউরোপে তিনি কামুক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন। ১৬৯৫ সালে মৃত্যুর আগে তৃতীয় মুরাদের ২০ পুত্রের মধ্যে ১৯ জনকে হত্যা করা হয়। অবশিষ্ট পুত্র তৃতীয় মেহমেদ ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত ছাড়া সিংহাসনে বসেন। তৃতীয় মেহমেদকে খাৎনা করানো হলে ৫২ দিন পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলে। ১৬৩৩ সালে সুলতান চতুর্থ মুরাদ ধূমপানের জন্য মৃত্যুদ-ের পরিবর্তে ধূমপান বিরোধী প্রচারণা জোরদার করেন। তার পিতা সুলতান প্রথম আহমদ ধূমপানের পাইপ দিয়ে নাক ছিদ্র করে ধূমপায়ীদের শাস্তি দিতেন। চতুর্থ মুরাদ যুদ্ধক্ষেত্রে গোপনে অটোমান সৈন্যদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করতেন এবং ধূমপানের জন্য শিরñেদ, ফাঁসি কিংবা আটক রাখতেন। মনোভাব ভালো থাকলে তিনি হাত-পা ভেঙ্গে অপরাধীদের মুক্তি দিতেন। তার সম্পর্কে প্রজাদের ভাবনা জানার জন্য তিনি ছদ্মবেশে ঘুরতেন। এক হিসাবে বলা হয়, তার আমলে ধূমপান বিরোধী প্রচারণাকালে ২৫ হাজারের বেশি ধূমপায়ীকে হত্যা করা হয়। মৃত্যুদ-ের বিধান থাকায় ধূমপায়ীরা গোপনে ধূমপান করতো। ১৪ বছর পর এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। তৃতীয় সেলিম ফরাসি মডেলে সামরিক স্কুল চালু করেন। তিনি ধারণা করছিলেন যে, এ ধরনের সামরিক স্কুল অটোমানদের ইউরোপীয়দের সমকক্ষ করে তুলবে। কিন্তু তিনি এবং অন্য অটোমান সুলতানরা বুঝতে ব্যর্থ হন যে, ইউরোপীয় সমাজ, বাণিজ্য ও সরকার ব্যবস্থায় আরো গভীরতর পরিবর্তন সংঘটিত হচ্ছে। পাশ্চাত্যে উন্নতমানের ভ্রাম্যমাণ গোলন্দাজ বাহিনী গড়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে অটোমান সাম্রাজ্য বহু পেছনে পড়ে গিয়েছিল। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডস রেকর্ডসে বলা হয়, ১৭৯৮ সালে সুলতান তৃতীয় সেলিম একটি ধনুক থেকে তীর নিক্ষেপ করলে ৯৭২ গজ (প্রায় এক কিলোমিটার) দূরে গিয়ে পতিত হয়। এই রেকর্ড এখনো কেউ ভাঙ্গতে পারেননি।
অটোমান ও ইউরোপ
অটোমানরা একটি শক্তিশালী অবস্থান থেকে বরাবরই ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোকে মোকাবিলা করতো। তাদের সঙ্গে চুক্তিগুলো সুলতানরা অনুমোদন করতেন। চুক্তিতে অটোমান সুলতানরা বার্ষিক রাজস্ব প্রদানের শর্ত জুড়ে দিতেন। কিন্তু অটোমানদের বুঝতে বিলম্ব হয় যে, ইউরোপের অনুকূলে সামরিক ভারসাম্য ঘুরে যাচ্ছে। তারা ইউরোপীয়দের ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুমতি দেন। ইউরোপীয় পণ্যের অনুপ্রবেশে স্থানীয় শিল্প ধ্বংস হয়ে যায় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ভারসাম্য সাম্রাজ্যের স্বার্থের বিপরীতে চলে যায়। অর্থনৈতিক অনুপ্রবেশের পর ইউরোপীয়রা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করে। ১৫৩৬ সালে শক্তির শীর্ষে অবস্থান করার সময় অটোমান সাম্রাজ্য স্বেচ্ছায় ফ্রান্সকে ছাড় মঞ্জুর করে। তবে সে সময় কার্যকর অধীনতামূলক চুক্তিগুলোকে (ক্যাপিচ্যুলেশন সিস্টেম) পরবর্তীকালে অটোমান সাম্রাজ্যের সার্বভৌমত্বের ওপর গুরুত্বপূর্ণ বিধিনিষেধ আরোপে ব্যবহার করা হয়। ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক সুবিধা বৃদ্ধি করা হয় এবং চুক্তির আওতায় বসবাসকারীদের অটোমান আইনের পরিবর্তে সেই দেশের আইনের অধীন করা হয়। এতে মারাত্মকভাবে ন্যায়বিচার লংঘিত হয়। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ৩০ বছর দ্রুত অটোমান সাম্রাজ্যের শক্তির অবক্ষয় দেখা দেয়। ১৫৭১ সালে লিপান্টোর যুদ্ধে স্পেনীয় ও পর্তুগীজ নৌবহরের কাছে অটোমান নৌবহরের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এ অবক্ষয় ধরা পড়ে। কোপরুলু যুগে ভেনিসের কাছ থেকে ক্রীট ও লেমনোস এবং পোল্যান্ড ও রাশিয়ার কাছ থেকে ইউক্রেনের বিরাট অংশ দখল করা হয়। কোপরুলু পরিবার অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে পুনরায় অভিযান শুরু করে এবং ভিয়েনার ১২০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে অটোমান সীমান্ত নিয়ে যান। ১৬৬৪ সালে হ্যাবসবার্গ রাজধানী দখলে ব্যর্থ চেষ্টা চালানো হয়। অটোমান উজিরে আজম আহমদ কোপরুলু ১৯ বছর স্থায়ী চুক্তির বিনিময়ে বিরাট অঙ্কের রাজস্ব আদায় করেন। চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে অটোমান সৈন্যবাহিনী ১৬৮৩ সালের জুলাইয়ে দ্বিতীয়বার ভিয়েনা অবরোধ করে। দুমাস পর পোল্যান্ডের রাজা জান সোবায়েস্কির নেতৃত্বে একটি উদ্ধারকারী বাহিনী ভিয়েনাকে অবরোধমুক্ত করে। ভিয়েনা অবরোধ ছিল ইউরোপে অটোমান সম্প্রসারণের চূড়ান্ত সীমা।
ভিয়েনায় অটোমানদের দ্বিতীয় অভিযানের ফলাফল
১৬৮১ সাল নাগাদ অটোমান সৈন্যবাহিনীকে শক্তিশালী বলে প্রতীয়মান হচ্ছিল। উজিরে আজম মারজিফনলু কারা মোস্তফা পাশা মধ্য ইউরোপের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করার সাহস দেখান এবং ১৬৮৩ সালের জুলাইয়ে দ্বিতীয়বার ভিয়েনা অবরোধ করেন। স্যাভয়ের ইউজিন কাহলেনবার্গে তুর্কিদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত হামলায় নেতৃত্ব দেন। হ্যাবসবার্গকে সহায়তাদানে তিনি মহিলার ছদ্মবেশে পারিসে পালিয়ে যান। তিনি অটোমান সৈন্যবাহিনীকে ধাওয়া করেন এবং বেলগ্রেডের কাছে জিন্টায় তিসা নদী অতিক্রম করার সময় তাদের ওপর হামলা চালান। বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শেষ হয়। ২০ হাজার অটোমান সৈন্য নিহত এবং সরবরাহ ও রসদ বোঝাই ৯ হাজার ঘোড়ার গাড়ি, ৬ হাজার উট এবং নগদ ৩০ লাখ রৌপ্যমুদ্রা ফেলে অবশিষ্টরা পালিয়ে যায়। তুর্কি ঐতিহাসিক এ বিপর্যয়কে একটি দুর্যোগ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। অটোমান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এতবড় বিপর্যয় আর কখনো ঘটেনি। ভিয়েনায় দ্বিতীয় পরাজয় ছিল অটোমান সৈন্যবাহিনীর জন্য একটি নয়া অভিজ্ঞতা। এ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে তাদের দুর্বলতা ও শোচনীয় অবস্থা প্রকাশ হয়ে পড়ে। তারপর একে একে বিপর্যয় ঘটতে থাকে। ইউরোপীয়রা খ্রিস্টান ভূখ- মুক্ত করতে সক্ষম হয় এবং অটোমান ও মুসলিম ভূখ-ে অগ্রযাত্রা করে। রাশিয়া মধ্য এশিয়া দখল করে নেয়। পর্তুগীজরা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে এবং বহু মুসলিম বাণিজ্যিক রুট দখল করে। ভিয়েনায় দ্বিতীয় পরাজয় যুদ্ধের একটি নয়া যুগের সূচনা করে। এ যুদ্ধ ১৬৮৩ থেকে ১৬৯৯ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এ সময়কে বলা হয় ‘গ্রেট রিট্রিট।’ হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্য একটি নিয়মিত সৈন্যবাহিনী গঠন করায় ১৬৯৯ সালের মধ্যে হাঙ্গেরী ও সার্বিয়া থেকে অটোমানদের বিদায় নিতে হয়। হ্যাবসবার্গের নিয়মিত সৈন্যবাহিনী সমান শক্তিতে অটোমানদের মোকাবিলা করে এবং এ সৈন্যবাহিনী হাঙ্গেরী ও পূর্ব ইউরোপে তুর্কিদের কাছে হারানো ভূখ- পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়।
১৬৯৯ সালে স্বাক্ষরিত কার্লোভিজ চুক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় যে, অটোমান সাম্রাজ্য আর কোনো আক্রমণকারী শক্তি নয়। অথচ এ চুক্তির আগ পর্যন্ত এ সাম্রাজ্য তিন শো বছরের অধিক ইউরোপের খ্রিস্টান শক্তিকে ভীতিসন্ত্রস্ত করে রেখেছিল। তখন থেকে অটোমান সাম্রাজ্যকে শক্তিশালী খ্রিস্টান ইউরোপের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়। হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্য ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রধান ইউরোপীয় শত্রু। রুশ জার সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি তুরস্কের বিরুদ্ধে হ্যাবসবার্গের লড়াইয়ে নেতৃত্ব গ্রহণ করে। রুশ জাররা অটোমান রাজধানী কন্সটান্টিনোপলের প্রাচীর কৃষ্ণসাগরে প্রবেশ করতে চাইছিলেন। দুশো বছর লড়াই শেষে রুশ নৌবহর ১৭৭০ সালের জুলাইয়ে চেসমা যুদ্ধে অটোমান নৌবহর ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয় এবং রুশ সৈন্যবাহিনী অটোমান সৈন্যবাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। পরবর্তী দুই শতাব্দী ক্রমান্বয়ে অটোমান সাম্রাজ্যের সীমান্ত সংকুচিত হয়। রাশিয়া নিস্তার নদীর পশ্চিমে তার সীমান্ত সম্প্রসারণ করে।
১৭১৮ সালের মধ্যে অস্ট্রীয়রা হাঙ্গেরী থেকে তুর্কিদের তাড়িয়ে দেয়। কফির বস্তা ফেলে রেখে তুর্কিরা পিছু হটে। অস্ট্রীয়রা আনন্দের সঙ্গে কফি পান করে। তারই সূত্র ধরে বিখ্যাত ভিয়েনা কফি হাউজ গড়ে ওঠে। ভিয়েনা অবরোধ ব্যর্থ হওয়ার পর অটোমান সাম্রাজ্যকে তুলনামূলকভাবে লঘু হুমকি এবং শক্তিশালী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গণ্য করা হয়। তুর্কি প্রভাব ইউরোপীয় ফ্যাশনে রূপান্তরিত হয় এবং হাইডিন, মোর্জাট ও বিটোফেনের মতো অমর সঙ্গীতজ্ঞরা তাদের সঙ্গীতে তুর্কি সুর গ্রহণ করেন।
ভিয়েনায় দ্বিতীয় পরাজয়ের মধ্য দিয়ে তুর্কিদের মধ্যে আত্মজিজ্ঞাসার একটি নয়া যুগের সূচনা হয়। তারা তাদের নিজস্ব বিধি বিধানের যৌক্তিতকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং পাশ্চাত্যের ধ্যান ধারণা ও রীতি নীতির প্রতি আরো আগ্রহ দেখাতে শুরু করে এবং সেসব রীতি নীতি অনুকরণ করতে থাকে। রক্ষণশীলরা এ আন্দোলন প্রতিহত করার চেষ্টা করে। তখন উভয়পক্ষ একমত হয় যে, মূলত প্রযুক্তিতে ইউরোপীয় সংস্কৃতি ধার করা হবে। অটোমানরা রেনেসাঁ ও শিল্প বিপ্লব হাতছাড়া করে এবং প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে পাশ্চাত্যের পেছনে পড়ে যায় এবং গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ লাইনে সমাজ গঠনে ব্যর্থ হয়। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে অটোমান অস্ত্র ও শিল্প কলকারখানা ছিল সেকেলে। অটোমান শহরগুলোতে প্লেগ ও দুর্ভিক্ষ দেখা দিতো। অন্যদিকে ইউরোপীয় শহরগুলোতে পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা ছিল এবং এসব রোগ নির্মূল করা হচ্ছিল। ইউরোপীয়রা তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি করছিল। তারা ব্যবসা ও শিল্প থেকে অর্জিত অর্থ শক্তিশালী সামরিক বাহিনী ও অর্থনীতি গঠনে ব্যবহার করছিল। পক্ষান্তরে অটোমানরা পুরনো ধাঁচের কৃষিভিত্তিক সমাজে বসবাস করছিল। অটোমান সাম্রাজ্য প্রাথমিকভাবে বাষ্পীয় ইঞ্জিন, রেলরোড, টেলিগ্রাফ, কলকারখানা ও মেশিনগান ব্যবহার করতে জানতো না। তবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় অটোমানরা দেখতে পায় যে, তারা অনেক পেছনে পড়ে গেছে। অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণ ও বিজ্ঞান বিষয়ক পরামর্শ দানে ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ দেয়া হয়। জেনিসারি ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা শুরু হয়। সামরিক স্কুলগুলোতে ইউরোপীয় ধাঁচে গণিত, বিজ্ঞান ও ভূগোল শিক্ষাদান করা হয়। ১৭২৮ সালে তুরস্কে প্রথম মুদ্রণ যন্ত্র স্থাপন করা হয়।
ইউরোপে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন
ভিয়েনা অবরোধ ছিল ইউরোপে অটোমান সাম্রাজ্যের ক্ষমতার সর্বোচ্চ চূড়া এবং এ অভিযান ব্যর্থ হলে অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তি পুনরায় হাঙ্গেরী দখলের সুযোগ পায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে অটোমান সাম্রাজ্যকে পারস্য, পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার সঙ্গে অনবরত যুদ্ধ করতে হয়। অবমাননাকর কুচুক-কায়নারজা চুক্তির মধ্য দিয়ে ১৭৬৮-৭৪ সালের রুশো-অটোমান যুদ্ধের অবসান ঘটে। এ চুক্তিতে অটোমান কেন্দ্রীয় সরকারকে ক্রিমিয়ায় তাতার খানাত পরিত্যাগ করতে হয়, দানিয়ুব অঞ্চলের প্রদেশগুলোকে স্বায়ত্তশাসন মঞ্জুর, অটোমান জলসীমায় অবাধে রুশ জাহাজ চলাচলের সুযোগ এবং রাশিয়াকে বিপুল পরিমাণ যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। ১৮৫৩ সালে রাশিয়ার প্রথম জার অটোমান সাম্রাজ্যকে ‘ইউরোপের রুগ্ন ব্যক্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ১৮২১-৩২ সালে গ্রীসের স্বাধীনতা যুদ্ধে ইউরোপ হস্তক্ষেপ করে। ১৮২৭ সালে একটি অ্যাংলো-ফরাসি নৌবহর নাভারিনো যুদ্ধে অটোমান ও মিসরীয় নৌবহরকে ধ্বংস করে দেয়। অন্যদিকে ১৮২৯ সালে যুদ্ধবিরতির আগে রুশ সৈন্যবাহিনী এডিরনি পর্যন্ত এগিয়ে আসে। ইউরোপীয় শক্তিবর্গ গ্রীসের স্বাধীনতা মেনে নিতে অটোমান কেন্দ্রীয় সরকারকে বাধ্য করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে রুশ জার পিটার দ্য গ্রেট রাশিয়ার একটি দীর্ঘস্থায়ী পররাষ্ট্রনীতি ঘোষণা করেন। অটোমান সাম্রাজ্যের ভূখ- গ্রাস করে উষ্ণ পানির বন্দরে পৌঁছানো ছিল তার পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য। পিটার দ্য গ্রেট প্রথমেই কৃষ্ণসাগরের উত্তর উপকূলে অটোমান উপস্থিতি নির্মূলে অগ্রসর হন। প্রথমে কৃষ্ণসাগরের উষ্ণ পানির বন্দরে পৌঁছানো এবং পরে অটোমান নিয়ন্ত্রিত দার্দানেলিস ও বফফোরাস প্রণালীর মধ্য দিয়ে ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ রাশিয়ার মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। অটোমান সাম্রাজ্যের কাছ থেকে ভৌগোলিক সুবিধা আদায় করতে সক্ষম হলেও রাশিয়া এ লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়নি। কৃষ্ণসাগর ‘অটোমান হ্রদ’ হিসেবে বজায় থাকে। এ সাগরে রুশ জাহাজ চলাচল নিষিদ্ধ ছিল। পরবর্তী দুই শতাব্দী রাশিয়া অটোমান শক্তি ধ্বংসে যুদ্ধের পর যুদ্ধ করে। রাশিয়া ও খ্রিস্টান হলি লীগ দীর্ঘ ১৬ বছর যুদ্ধ করে অটোমানদের দানিয়ুবের দক্ষিণে এবং কার্পেথিয়ানের পূর্বদিকে হটিয়ে দেয়। ১৬৯৯ সালে স্বাক্ষরিত কার্লোভিজ চুক্তিতে অটোমানরা প্রথম পরাজয় স্বীকার করে এবং অস্ট্রিয়ার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হাঙ্গেরী, ট্রান্সিলভানিয়া ও ক্রোয়েশিয়া ছেড়ে দেয়। পোল্যান্ড পোডলিয়া ও ডালমাটিয়া পুনরুদ্ধার করে এবং ভেনিসের কাছে মোরিয়া ছেড়ে দেয়া হয়। পরবর্তী বছর অন্য একটি শান্তিচুক্তিতে রাশিয়া আজোভ অঞ্চল লাভ করে। ১৭৭৪ সালে কুচুক-কায়নারজা চুক্তির মাধ্যমে রুশ জাহাজ অটোমান জলসীমার মধ্য দিয়ে চলাচলের অধিকার পায়।
লিপান্টো যুদ্ধ
ষোড়শ শতাব্দীতে পৃথিবীতে পরাশক্তি ছিল দুটি। পশ্চিমে স্পেন এবং প্রাচ্যে অটোমান তুরস্ক। ১৫৭১ সালে লিপান্টো যুদ্ধে এ দুটি পরাশক্তি একে অন্যকে মোকাবিলা করে। যুদ্ধে স্পেনীয় নৌবহর অটোমান নৌবহরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ভেনিস, পোপের রাজ্য ও অস্ট্রিয়ার নৌবহর স্পেনীয় নৌবহরকে সহায়তা করে। ১৫৭০ সালে তুর্কিরা সাইপ্রাস আক্রমণ করলে লিপান্টোর যুদ্ধ হয়। সাইপ্রাস রক্ষায় ভেনিসীয়রা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে অন্যান্য খ্রিস্টান রাষ্ট্রগুলোর সহায়তা কামনা করে। এসব রাষ্ট্র ভেনিসের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও পোপ পঞ্চম পায়াসের উৎসাহে মুসলিম তুর্কিদের বিরুদ্ধে হলি লীগের আওতায় ক্রুসেডে ঐক্যবদ্ধ হয়। লিপান্টো যুদ্ধ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ইতিহাসে বৃহত্তম নৌযুদ্ধ। ১৫৭১ সালের ৭ অক্টোবর আড্রিয়াটিক সাগরে গ্রীসের অদূরে লিপান্টোতে এ যুদ্ধ হয়। সম্মিলিত খ্রিস্টান বাহিনীতে অস্ট্রিয়ার ডন জনের নেতৃত্বে সৈন্য ছিল ৮৪ হাজার, ২ শো গ্যালে, ৬টি গ্যালিউস এবং অসংখ্য ক্ষুদ্র নৌযান। আলী পাশার কমান্ডে তুর্কিদের জাহাজ ছিল ২৯০টি এবং সৈন্য ৮৮ হাজার। অধিকাংশ নৌযান ছিল গ্যালিয়ট। ডন জন ছিলেন স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের জারজ বৈমাত্রেয় ভাই। মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। তিনি অস্ত্রভা-ার থেকে লোহার ভারি চঞ্চু অপসারণ করেন এবং জাহাজের অগ্রভাগে পাঁচটি কামান বসান। অন্যদিকে তুর্কিরা তাদের জাহাজে চঞ্চুগুলো বজায় রাখে এবং তাদের জাহাজের অগ্রভাগে কামান ছিল মাত্র তিনটি। চূড়ান্ত যুদ্ধ মাত্র চার ঘণ্টা স্থায়ী হয়। দুটি নৌবহর অর্ধচন্দ্রাকারে একে অন্যকে মোকাবিলা করে। ইউরোপীয়রা তিনটি গ্যালিউস নিয়ে অগ্রসর হয়। প্রতিটি গ্যালিউস একটি করে স্কোয়াড্রনের নেতৃত্ব দিচ্ছিল। তুর্কি জাহাজগুলো এগিয়ে আসার চেষ্টা করলে উন্নততর ইউরোপীয় কামানের গোলার মুখে পড়ে। তবে তুর্কি জাহাজগুলো ইউরোপীয় জাহাজের কাছাকাছি পৌঁছতে সক্ষম হয়। দুঘণ্টা লড়াইয়ে তুর্কিদের বামপাশ ও মধ্যভাগ ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু লড়াই আরো দুঘণ্টা অব্যাহত থাকে। মাল্টার নাইটরা এডমিরাল সুফি আলী পাশার একটি পতাকা দখল করে। সুলতান দ্বিতীয় সেলিম আলী পাশার হাতে এই বিশাল সবুজ পতাকা তুলে দিয়েছিলেন। কালেমা শাহাদাৎ খচিত এ পতাকায় সোনালী ক্যালিগ্রাফিতে আল্লাহর নাম লেখা ছিল ২৮ হাজার ৯ শো বার। ইসলামের এ সবুজ পতাকা উপহার দেয়া হয় স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপকে। এখনো এ পতাকা ইতালির পিসার একটি গির্জায় প্রদর্শন করা হয়।
লিপান্টো যুুদ্ধের ফলাফল
মোট ১১৭টি তুর্কি জাহাজ আটক এবং আরো ৮০টি জাহাজ ধ্বংস হয়। অন্যদিকে ইউরোপীয়রা হারায় ১২টি জাহাজ এবং সাড়ে ৭ হাজার সৈন্য। অটোমান সৈন্য নিহত হয় ৩০ হাজারের অধিক। তাদের অধিকাংশ নিহত হয় স্পেনীয় মাস্কেটিয়ার ও আর্কুবাশিয়ারদের গুলিতে। অটোমানদের পিছু হটার সময় স্পেনীয় আর্কুবাশিয়াররা তাদের ওপর হামলা চালায়। ১২ হাজারের বেশি খ্রিস্টান দাসকে মুক্ত করা হয়। খ্রিস্টানদের এ বিজয়ে তুর্কি নৌবাহিনী ধ্বংস এবং ইউরোপে অটোমান অগ্রযাত্রা বন্ধ হয়ে যায়। তুর্কিদের অজেয় ভাবমূর্তি ধূলিসাৎ হয়ে যায়। অটোমান দিগি¦জয়ের অবসান ঘটে এবং এ সাম্রাজ্যের সাড়ে তিন শো বছরের দীর্ঘ অবনতির সূচনা হয়। এ যুদ্ধে প্রমাণিত হয় যে, ইউরোপীয় শক্তিগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে সক্ষম। তার আগে বিগত চার শো বছর তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। ক্রীট বিজয় ছিল অটোমানদের শেষ বিজয়। ১৬৩৬ সালে অটোমানদের ইয়েমেন থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। পঞ্চদশ শতাব্দীতে অটোমানরা আর কখনো কোনো নৌযুদ্ধে পরাজিত হয়নি। বিপর্যয়ের জন্য তারা নিজেদের কৃতকর্মকে দায়ী করে। সমসাময়িক ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেন যে, অটোমান শাহী নৌবহর অভিশপ্ত কাফেরদের নৌবহরকে মোকাবিলা করে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্যরকম। হলি লীগ তাদের বিজয়কে কাজে লাগাতে পারেনি। অটোমানদের বিপর্যয়কে একটি ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এতে অটোমানদের ভৌগোলিক সম্প্রসারণে স্থবিরতা নেমে আসে। লিপান্টোতে খ্রিস্টানদের বিজয় কার্যত ভূমধ্যসাগরের বিভক্তিকে নিশ্চিত করে। পূর্বাংশ ছিল অটোমানদের শক্ত নিয়ন্ত্রণে এবং পশ্চিমাংশ হ্যাবসবার্গ ও তাদের ইতালীয় মিত্রদের নিয়ন্ত্রণে। ইতালীয় ভূখ-ে অটোমান অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়। লিপান্টো যুদ্ধের আগে অটোমানরা যেসব ভূখ- দখল করে নিয়েছিল, হলি লীগ সেসব ভূখ- পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। লিপান্টোর যুদ্ধে এ বিজয় ছিল স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এ বিজয় তুর্কিদের স্পেনীয় ভূখ-ে অনুপ্রবেশ করা থেকে বিরত রাখে এবং স্পেন নয়া বিশ্বে (আমেরিকা মহাদেশ) অবাধ লুণ্ঠনের সুযোগ পায়।
অটোমান সাম্রাজ্যকে দুর্বল করার চেষ্টা
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্রিটিশ, ফরাসি ও ইতালীয় সাম্রাজ্যবাদ, গ্রীস ও বলকান জাতীয়তাবাদ, অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার আগ্রাসন, অটোমান সহিষ্ণুতা এবং আধুনিকায়নে তাদের ব্যর্থতায় অটোমান সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে যায়। ১৮৭৮ সালে বার্লিন সম্মেলনে সাবেক অটোমান ভূখ- বুলগেরিয়া, রুমানিয়া ও সার্বিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। একই সময় সাইপ্রাস ও মিসর দখল করে ব্রিটেন এবং আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়া দখল করে ফ্রান্স। ১৮৮২ সালে অটোমান ভূখ- মিসরে ব্রিটিশের দখলদারিত্ব শুরু হয়। ইউরাবি বিদ্রোহ দমনে অটোমন সরকারকে সহায়তাদানের অজুহাতে ব্রিটেন মিসরে সৈন্য পাঠায়। এসব ভূখ- খোয়া যাওয়ায় অটোমান সাম্রাজ্যের আয়তন আরো সংকুচিত হয়। সময়ের পরিক্রমায় স্থানীয় পাশাদের নিয়ন্ত্রিত শরিয়াহ আদালত দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে যায়। ইউরোপীয়রা অটোমান শাসনকে অতিমাত্রায় ইসলামি এবং মুসলমানরা অতি ইউরোপীয় হিসেবে আখ্যায়িত করে। মাদ্রাসা বিদ্রোহ করতে শুরু করে। সামরিক বাহিনী ক্রমশ বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। ইউরোপীয়দের প্রতিযোগিতায় ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামে। বল্গাহীন দুর্নীতি শুরু হয় এবং ধনীরা আরো ধনী এবং দরিদ্ররা আরো দরিদ্র হয়। সুলতানরা আর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না। তার ক্রমশ প্রজাদের সান্নিধ্য থেকে দূরে সরে যান। তাদের সার্মথ্য ও ক্ষমতার ক্রমবর্ধমান ঘাটতি ছিল সাম্রাজ্যের অবনতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সরকার পরিচালনা করতেন মূলত উজিররা। সামরিক বাহিনী ও প্রশাসনে মেধা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে এবং অযোগ্যরা পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন।
সূএঃ ইন্টারনেট