সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২০

মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা

মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত
ইউনিয়নের ভূমিকা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে বিশ্বে স্নায়ুযুদ্ধ বিরাজ করায় সুবিধা যেমন হয়েছিল তেমনি অসুবিধাও হয়েছিল। স্নায়ুুযুদ্ধের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল। পরোক্ষ লড়াইয়ে বিজয়ী হওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল গণতান্ত্রিক বিশ্বের একটি প্রভাব বলয় এবং বিলুপ্ত পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে গঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর আরেকটি পাল্টা প্রভাব বলয়। প্রাথমিকভাবে ভারত ছিল দু’টি প্রভাব বলয়ের বাইরে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট ভারতকে সমাজতান্ত্রিক পরাশক্তি সোভিয়েত প্রভাব বলয়ের দিকে ঠেলে দেয়। পাক-ভারত সংঘাত অনিবার্য বুঝতে পেরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে সহায়তার জন্য হাত বাড়ান।
বিশ্বে নিজ নিজ প্রভাব বলয়ের স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরস্পরবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে। এ দু’টি পরাশক্তির ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এব্যাপারে চৌধুরী এম. শামিমের লেখা ‘দ্য বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশীপ ট্রিটি: অ্যা ক্রিটিক্যাল এনালাইসিস’ শিরোনামে এক নিবন্ধে বলা হয়,
`Bangladesh was a victim of the cold war alliance system. During its war of independence it was a pawn in the chessboard of super power rivalry. The US tilted towards Pakistan while India allied with the Soviet Union.’
  ‘বাংলাদেশ ছিল স্নায়ুুযুদ্ধের শিকার। মুক্তিযুদ্ধকালে দেশটি ছিল পরাশক্তির দাবার ঘুটি। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। অন্যদিকে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে।’ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারত থেকে জাপান পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী একটি প্রভাব বলয় সৃষ্টিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাদানের সিদ্ধান্ত নেয়। মস্কো বিশ্বাস করতো যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে দুর্বল করবে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই এ অঞ্চলের প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নে শ্যেনদৃষ্টি ছিল। এ ব্যাপারে সালাহউদ্দিন আহমদের ‘বাংলাদেশ পাস্ট এন্ড প্রেজেন্ট’ বইয়ের একটি উদ্ধৃতি উল্লেখযোগ্য। তিনি তার বইয়ের ৩৪৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,‘ By the late 1960’s Kremlin seems to have come to the conclusion that the separation of Pakistan’s western and eastern wings would be in Soviet as well as India’s interest.
‘ষাটের দশকের শেষ নাগাদ ক্রেমলিন এই উপসংহারে পৌঁছেছিল যে, পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ থেকে পূর্বাংশের বিচ্ছিন্নতা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের স্বার্থের অনুকূল হবে।’ 
ভারতকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঘাটছড়া বাঁধতে দেখে যুক্তরাষ্ট্র চীনের প্রতি বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. হেনরি কিসিঞ্জারের গোপনে চীন সফরে ভারত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে। পাকিস্তানের দূতিয়ালিতে কিসিঞ্জার ১৯৭১ সালের ৯ জুলাই পিকিং সফর করেন এবং চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। ১৯৭০ সালে ওয়াশিংটন সফরকালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কোন্নয়নে মধ্যস্থতা করার অঙ্গীকার করেন। পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় চীন-মার্কিন যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় এত গোপনীয়তা রক্ষা করা হয় যে, ইসলামাবাদস্থ আমেরিকান দূতাবাস ১৯৭১ সালের মে নাগাদ কিছুই জানতে পারেনি। সোভিয়েত ভীতি যুক্তরাষ্ট্রকে বিপরীত মেরুর শক্তি চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার প্রয়াস চালাতে বাধ্য করে। চীন ছিল পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। চীনের সঙ্গে দেশটির বন্ধুত্ব পিকিংয়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সহায়ক বলে বিবেচিত হয়। ভারতকে মোকাবিলা করার কৌশলগত প্রয়োজনেই পাকিস্তান মুসলিম দেশ হয়েও বস্তুবাদে বিশ্বাসী চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষ বেধে যাওয়ায় ষাটের দশকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। তবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালে মস্কোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক চূড়ান্ত পর্বে উন্নীত হয়।
কিসিঞ্জারের চীন সফর শুরু হওয়ার ঠিক এক মাস পর ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট সোভিয়েত-ভারত ২০ বছর মেয়াদী মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে ভারতের মনোবল বৃদ্ধি পায়। চুক্তিতে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা জোরদার, অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের অবসান, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রতি ভারতের অঙ্গীকারের কথা বলা হলেও আসলে এটি ছিল নির্দিষ্টভাবে চীন ও পাকিস্তানকে মোকাবিলা এবং বিশেষভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিহত করার একটি সামরিক চুক্তি। চুক্তির ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ তার প্রমাণ। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো কোনো পক্ষের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িত তৃতীয় কোনো পক্ষকে কোনো ধরনের সহায়তা প্রদানে বিরত থাকবে। চুক্তিতে স্বাক্ষরদানকারী কোনো পক্ষ আক্রান্ত হলে অথবা হুমকির মখোমুখি হলে পক্ষগুলো তাদের নিজ নিজ দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে এ ধরনের হুমকি দূর করতে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে অবিলম্বে পারস্পরিক আলোচনায় মিলিত হবে।’ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের প্রতিরক্ষা সামর্থ্য শক্তিশালী করতে শুরু করে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বেধে গেলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে বৈষয়িক ও কূটনৈতিক সমর্থন প্রদান করে। দেশটি ভারতে সামরিক সহায়তা প্রেরণ এবং জাতিসংঘে ভারতকে কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে পাকিস্তানের ব্যবচ্ছেদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে চীনের সমর্থনপুষ্ট যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করে। যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রস্তাবে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যাহার এবং পাক-ভারত সীমান্তে পর্যবেক্ষক মোতায়েনের আহ্বান জানানো হয়। বিপরীতক্রমে ভারতের অবস্থানের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথমে পূর্ব পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তি এবং পরে যুদ্ধবিরতির দাবি জানায়। অন্যদিকে ৫ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে দেয়া সব ধরনের অর্থনৈতিক সাহায্য প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেয়। ৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট আরেকটি প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করে। এ প্রস্তাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক নিষ্পত্তির যে আহ্বান জানিয়েছিল, তার উল্লেখ ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়ন অন্য ৮টি সমাজতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে আর্জেন্টিনার উত্থাপিত অন্য একটি প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করে। আর্জেন্টিনার প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতি এবং এক দেশ থেকে অন্য দেশের সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছিল। ১৩ ডিসেম্বর অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উত্থাপিত তৃতীয় একটি প্রস্তাবেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো দেয়। তবে দেশটি পোল্যান্ডের একটি প্রস্তাব সমর্থন করে। 
যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭১ সালের সংকটকে স্নায়ুযুদ্ধের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করতো এবং মনে করতো, সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোকে দুর্বল করতে চাইছে। এ হিসাব থেকে দেশটি ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানকে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে সমর্থন দান করে। তবে দেশটি পাকিস্তানকে একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হিসাবে টিকিয়ে রাখতে মোটেও আগ্রহী ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ থেমে গেলে পশ্চিম পাকিস্তান ভাঙ্গার এবং আজাদ কাশ্মীর দখলে ভারতকে যে কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখতে চাইছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. হেনরি কিসিঞ্জার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সোভিয়েত সম্প্রসারণে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন। সোভিয়েত হুমকি মোকাবিলায় প্রেসিডেন্ট নিক্সন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় যোগাযোগ করছিলেন। ১৯৭২ সালে তিনি চীন সফরে আগ্রহী ছিলেন। চীনের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তান ছিল একটি মাধ্যম। তাই নিক্সন প্রশাসনের কাছে পাকিস্তান বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের পতন কাম্য ছিল না। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে মোটেও পছন্দ করতেন না। ১৯৭১ সালের নভেম্বরে ইন্দিরা গান্ধীর যুক্তরাষ্ট্র সফরে তার এ মনোভাবের প্রতিফলন ঘটে। ৪/৫ নভেম্বর দু’দিনব্যাপী সফরকালে ইন্দিরা প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তবে প্রথমদিনের সাক্ষাৎকার ছিল তার কাছে অত্যন্ত বিব্রতকর। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কর্মকর্তা স্যামুয়েল হসকিনসন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাকে সঙ্গে নিয়ে হোয়াইট হাউসের কূটনৈতিক প্রবেশদ্বার অতিক্রম করে বিশেষ একটি অভ্যর্থনা এলাকায় গিয়ে পৌঁছান। সেখানে পৌঁছে তিনি একটি টেলিফোন উঠিয়ে নিক্সনের সচিব রোজ ম্যারি উডসকে জানান, ‘মিসেস ইন্দিরা এখানে অপেক্ষা করছেন। অনুগ্রহ করে প্রেসিডেন্টকে জানান।’ ইন্দিরা নিজেও বললেন, তিনি এখানেই প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান। কিন্তু প্রেসিডেন্টের দেখা নেই। আধাঘন্টা কেটে যায়। মিসেস গান্ধী অস্থির হয়ে উঠেন। দৃশ্যত তাকে বিরক্ত বলে মনে হলো। হসকিনসন আবার রোজ ম্যারিকে টেলিফোন করেন। কিছুক্ষণ পর রোজ ম্যারি মিসেস গান্ধীকে রুজভেল্ট রুমে নিয়ে যেতে বলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টগণ সাধারণত বিদেশী রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সঙ্গে হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে দেখা করেন। ইন্দিরার ক্ষেত্র তার ব্যতিক্রম করা হয়। হসকিনসন ইন্দিরাকে নিয়ে রুজভেল্ট রুমে যান। আবার শুরু হয় প্রতীক্ষার পালা। তবে দীর্ঘক্ষণ নয়। তবু যতক্ষণ বিলম্ব ঘটে তা ছিল মিসেস ইন্দিরার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাবার জন্য যথেষ্ট। হঠাৎ রুজভেল্ট রুমের দরজা খুলে যায়। প্রেসিডেন্ট নিক্সন দু’হাত প্রসারিত করে প্রশস্ত হাসি দিয়ে বললেন, ‘মিসেস গান্ধী, আপনি এখানে? কই, কেউ তো আমাকে বলেনি যে, আপনি এখানে?’ ইন্দিরা ফিরতি হাসি দেন। তবে অনেক কষ্টে। বৈঠকে প্রেসিডেন্ট নিক্সন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাকে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানিয়ে দেন, পাকিস্তানের ভাঙ্গনে কোনো স্বার্থ হাসিল হবে না। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ভারত সংঘাতের সূচনা ঘটালে বৃহৎ শক্তিগুলো কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে তা নির্ভুলভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়। 
     ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ছিল প্রেসিডেন্ট নিক্সনের গভীর আবেগময় সম্পর্ক। প্রেসিডেন্ট নিক্সন মনে করছিলেন, ভারতীয় হামলায় পশ্চিম পাকিস্তানের পতন ঘটলে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে এবং এ অঞ্চলে সোভিয়েত ইউনিয়নের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম হবে। তাতে বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার সম্ভাব্য নয়া মিত্র চীনের অবস্থান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাকিস্তানের উপর মার্কিন কংগ্রেসের নিষেধাজ্ঞা সরাসরি লংঘন করে চীনের কাছে মিত্র হিসাবে নিজের আন্তরিকতার প্রমাণ দিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সন জর্দান ও ইরানের মাধমে পাকিস্তানে সামরিক সরবরাহ পাঠান। একইসঙ্গে পাকিস্তানে সমরাস্ত্র সরবরাহ বৃদ্ধি করতে চীনকে উৎসাহিত করা হয়।
পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার বিবরণ দিয়ে ঢাকাস্থ মার্কিন কূটনীতিক আর্চার্ড ব্লাড ওয়াশিংটনে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন। এ বার্তা ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ নামে পরিচিত। কিন্তু নিক্সন প্রশাসন এ বার্তা উপেক্ষা করে। ১৯৭১ সালের মার্চে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এক আলোচনায় প্রেসিডেন্ট নিক্সন ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্র“য়ারি কংগ্রেসের কাছে স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ড রিপোর্টে ইঙ্গিত দেন যে, যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযানে সমর্থন দেয়নি। আবার নিন্দাও করেনি। য্ক্তুরাষ্ট্র গণহত্যা বন্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুরতার নিন্দা করে কখনো কোনো প্রকাশ্য বিবৃতি দেয়নি বরং নীরব কূটনীতির মাধ্যমে নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানিদের সবুজ সংকেত দিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নিক্সন একটি পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের কাছে বলেছিলেন, ‘ইয়াহিয়া যুক্তরাষ্ট্রের একজন ভালো বন্ধু।’ নৃশংস সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করার পরিবর্তে তিনি আরো বলেছিলেন, ইয়াহিয়া যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তিনি সেগুলোর যৌক্তিকতা উপলদ্ধি করতে পারছেন। ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল তিনি এক নির্দেশে বলেন,To all hands. Don’t squeeze Yahya at this time- RMN.’
সবার প্রতি প্রযোজ্য। এ মুহূর্তে ইয়াহিয়াকে ঘাটাবে না- আরএমএন।’ ১৯৭১ সালে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলে কর্মরত স্যামুয়েল হসকিনসন ১৯৭১ সালে দক্ষিণ এশিয়ার সংকটকে বৃহৎ শক্তির একটি দাবা খেলা হিসাবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, ‘আমরা ইয়াহিয়াকে পছন্দ করতাম। তিনি ছিলেন সামরিক বাহিনীর লোক। তার সম্পর্কে আমরা ভালো রিপোর্ট পাচ্ছিলাম। তবে তিনি ইন্দিরার মতো রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন না। একজন সাধারণ সৈনিক যা করে সংকটে তিনি তাই করেছেন। সৈনিক বলেই তিনি যুদ্ধে গিয়েছেন। হোয়াইট হাউস বিশ্বাস করতো, মিসেস গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত প্রতিবেশী পাকিস্তানের ধ্বংস সাধনে বদ্ধপরিকর। ২৫ মার্চের পর ইসলামাবাদে মার্কিন দূতাবাসের দ্বিতীয় কর্তাব্যক্তি সিডনি সোবার ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বহুবার বৈঠকে মিলিত হন। এসব বৈঠকে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুদন্ড কার্যকর না করতে তার উপর চাপ প্রয়োগ করেন। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে তিনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে একটি বৈঠকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে য্ক্তুরাষ্ট্রের একটি পরিকল্পনা পেশ করেন। ইয়াহিয়া খান যুক্তরাষ্ট্রের এ পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও ভারত প্রত্যাখ্যান করে। তিনি আরো বলেন, শেষদিন পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান বিশ্বাস করতেন, সংকটের একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তি খুঁজে বের করা এবং পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ রাখা সম্ভব। ইয়াহিয়া আমেরিকানদের জানিয়েছিলেন, তিনি ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর বিচারপতি এআর কর্নেলিয়াস প্রণীত একটি খসড়া সংবিধান ঘোষণা করার এবং ২৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের পরিকল্পনা করছেন। 
চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতা স্থাপনে ইয়াহিয়ার গুরুত্ব এবং নিক্সন ও কিসিঞ্জারের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব থাকায় নিক্সন ঘোষণা করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র এমন কিছু করবে না যাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের জন্য পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে অথবা তিনি বিব্রতবোধ করতে পারেন। আমেরিকার স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকায় ওয়াশিংটন প্রকাশ্যে পাকিস্তানের সমালোচনা করেনি। উপমহাদেশে সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করলে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। তবে একই সঙ্গে নিক্সন প্রশাসন এ দাবি করেছে যে, তারা কোনো ভারতবিরোধী নীতি অনুসরণ করেনি। প্রকাশিত দলিলপত্রে দেখা গেছে, প্রকাশ্য বিবৃতিতে পাকিস্তানের প্রতি ঝুঁকে পড়া ছাড়াও চীনের সঙ্গে আলোচনা এবং যুদ্ধ সংক্রান্ত প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে পাকিস্তানপন্থী একটি অবস্থান গ্রহণ করে। পাকিস্তানের দূতিয়ালিতে ড. হেনরি কিসিঞ্জার অত্যন্ত গোপনে চীন সফর করেন। নয়াদিল্লি সফর শেষ করে ইসলামাবাদ এসে তিনি চীনের উদ্দেশে রওনা দেন। নয়াদিল্লিকে ফাঁকি দেয়ার জন্য একটি কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়। কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয় এজন্য যাতে ভারত এই ধারণা পোষণ না করে যে, তাদের গুরুত্বকে খাটো করে দেখা হচ্ছে। পরিকল্পনা করা হয়েছিল যে, কিসিঞ্জার নয়াদিল্লি থেকে ইসলামাবাদ এসে পৌঁছানোর পর ঘোষণা করা হবে, তিনি দীর্ঘ সফর ও উষ্ণ আবহাওয়ায় ক্লান্ত। তাই তার কয়েকদিন বিশ্রামের প্রয়োজন। কিন্তু দিল্লি থেকে ফিরে আসার পর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়, দিল্লিতে অবস্থানকালে তিনি জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন এবং খাবার গ্রহণে তার বদহজম হয়েছে। তাতে তার রাতে ভালো ঘুম হয়নি। অতএব তিনি বিশ্রাম নেবেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তার একান্ত বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে তারা নৈশভোজে মিলিত হন। এসময় উভয়ে ছিলেন অত্যন্ত ফুরফুরে মেজাজে। ইয়াহিয়া খানকে তিনি ঠাট্টা করে বলেন, ‘মি. প্রেসিডেন্ট, আপনি একজন নির্বাচিত একনায়কের মতো একটি বিশৃঙ্খলাপূর্ণ নির্বাচন করেছেন।’ 
কিসিঞ্জার পাকিস্তানিদের সঙ্গে বৈঠককালে জানতে চান পান উৎসবে কিভাবে চীনাদের সঙ্গে কথা বলবেন, কিভাবে তাদের কথার জবাব দেবেন। চীনের সঙ্গে দীর্ঘ দু’দশক যোগাযোগ না থাকায় তাদের আচার আচরণ সম্পর্কে মার্কিনীদের কোনো ধারণা ছিল না। তাই কিসিঞ্জারের জন্য তাদের ব্যাপারে ধারণা লাভ করা ছিল জরুরি। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে কিসিঞ্জার বেইজিংয়ে পৌঁছান। বেইজিং সফরকালে তিনি চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে কয়েকবার বৈঠকে মিলিত হন। কোনো কোনো সময় তিনি তার সহকারীদের সঙ্গেও বৈঠকে মিলিত হতেন। চীনে দু’দিন অবস্থান শেষে ১১ আগস্ট তিনি ইসলামাবাদ ফিরে আসেন। তাকে বহনকারী বিমান কোথায় অবতরণ করবে সে সংকেতের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও পাকিস্তানি কর্মকর্তারা অপেক্ষা করতে থাকেন। যথাসময়ে সংকেত দেয়া হয়। বার্তা পেয়ে পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বিমান বন্দরে ছুটে যান। কিসিঞ্জারকে বহনকারী বিমানটি বেইজিং থেকে দিনের বেলা ফিরে আসে। কিন্তু বিমানটি অবতরণ করে বিমান বন্দরে বিমান বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত অংশে। বিমান বন্দরে কর্মরত লোকজন বিস্মিত হয়। তারা বুঝতে পারছিল না বিমানটি কেন বিমান বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত অংশে অবতরণ করেছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব কিসিঞ্জারকে বিমান বন্দর থেকে তার হোটেল স্যুটে নিয়ে আসেন। কিসিঞ্জার খুবই উল্লসিত। চৌ এন লাইকে তিনি একজন মহান রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে আখ্যায়িত করেন এবং তার আতিথেয়তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। বেইজিংয়ে কিসিঞ্জার একটি অতিথিশালায় অবস্থান করেন। সেখানে একটি ক্ষুদ্র সেতু ছিল। অতিথিশালায় ছিল ১২টি কক্ষ। প্রতিটি কক্ষ ছিল একটি থেকে আরেকটি বিচ্ছিন্ন। পৃৃথক হওয়ায় এক কক্ষের অতিথিরা জানতো না অন্য কক্ষের অতিথি কে বা কারা। অতিথিশালায় সর্বত্র ছিল সতর্ক চীনা প্রহরী। কিসিঞ্জার সেতু অতিক্রম করে অন্য কক্ষে যাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু চীনা প্রহরীরা তাকে থামিয়ে দেয়। কিভাবে জানি চৌ এন লাই ঘটনাটি জানতে পারেন। তিনি সেখানে ছুটে আসেন এবং তার হাত ধরে সেতু অতিক্রম করেন। এসময় প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই মন্তব্য করেন, ‘আমরা যেন এ সেতুটির কথা বিস্মৃত না হই। এ সেতুর জন্য আমাদের মধ্যে সাক্ষাৎ সম্ভব হয়েছে।’ 
১৯৭১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট নিক্সন সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকোর সঙ্গে বৈঠকে তাকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়তে ভারতকে নিরুৎসাহিত করার অনুরোধ জানান। ২১ নভেম্বর ভারতীয় সৈন্যরা মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা প্রদানে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত অতিক্রম করে সামরিক তৎপরতায় জড়িত হয়ে পড়লে কিসিঞ্জার উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন। তিনি ভারতের আচরণকে পাক-ভারত যুদ্ধের সূচনা হিসাবে উল্লেখ করেন। ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ বেধে যাবার দিন তিনি পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও সিআইএ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে যুদ্ধ শুরু করার জন্য ভারতকে অভিযুক্ত করেন। ৮ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা কিসিঞ্জারের সঙ্গে টেলিফোনে পাক-ভারত যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনাকালে নিক্সন পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ এস. ফারল্যান্ডের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, তিনি সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট লিওনিদ ব্রেঝনেভকে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কাউকে আগ্রাসন চালানোর অনুমতি দেবে না।
প্রেসিডেন্টের উদ্বেগের প্রেক্ষিতে ১০ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে সিআইএ’র একটি সুরক্ষিত কক্ষে কিসিঞ্জার জাতিসংঘে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত হুয়াং হুয়ার সঙ্গে গোপন আলোচনায় মিলিত হন এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগর অভিমুখে কয়েকটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজের অগ্রসর হওয়ার ছবি এবং অতি গোপনীয় তথ্য তার কাছে হস্তান্তর করেন। তিনি চীনা রাষ্ট্রদূতকে জানান, আমরা এই মর্মে একটি গোয়েন্দা রিপোর্ট পেয়েছি যে, মিসেস গান্ধী পাকিস্তানের সেনা ও বিমান বাহিনীকে ধ্বংস করতে এবং আজাদ কাশ্মীরের দক্ষিণাংশকে তার দেশের সঙ্গে অঙ্গীভূত করতে চান। যুদ্ধে এতটুকু অগ্রগতি অর্জিত হলে তিনি যুদ্ধবিরতিতে রাজি হবেন। আমাদেরকে অবশ্যই তার এ অভিপ্রায় রুখে দিতে হবে এবং এজন্যই আপনার সঙ্গে বৈঠকের আয়োজন করেছি। কিসিঞ্জার ভারতের বিরুদ্ধে সৈন্য মোতায়েনের উদ্যোগ গ্রহণে চীনের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি চীনা রাষ্ট্রদূতকে প্রতিশ্র“তি দেন যে, এ উদ্যোগ গ্রহণ করতে গিয়ে অন্য পক্ষ চীনে হামলা চালালে যুক্তরাষ্ট্র বেইজিংয়ের সহায়তায় এগিয়ে যাবে। চীনা রাষ্ট্রদূত হুয়াং হুয়া জোর দিয়ে বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত উপমহাদেশে একটি বিপজ্জ্বনক পথে অগ্রসর হচ্ছে এবং চীনকে ঘেরাও করে ফেলতে চাইছে। চীনা রাষ্ট্রদূতের উদ্বেগ লক্ষ্য করে কিসিঞ্জার স্পষ্টাক্ষরে তাকে জানান, আমরা উভয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের উপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখবো। ১২ ডিসেম্বর চীন হোয়াইট হাউসের কাছে একটি জরুরি বার্তা পাঠায়। বার্তায় নিউইয়র্কে একটি মার্কিন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার প্রস্তাব দেয়া হয়। বার্তা পেয়ে কিসিঞ্জারের সহকারী জেনারেল আলেকান্ডার হেইগ নিউইয়র্কে ছুটে যান। তিনি ভাবছিলেন চীনারা হয়তো তাকে সিকিম অথবা নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ারে (অরুণাচল) তাদের সৈন্য সমাবেশ সম্পর্কে অবহিত করতে চায়। কিন্তু চীনা রাষ্ট্রদূত হুয়াং হুয়া বিশ্ব সংস্থায় তার সরকারের পরবর্তী অবস্থান তুলে ধরা ছাড়া আর কোনো সুসংবাদ দিতে পারেননি।
পাক-ভারত যুদ্ধে চীনের সহায়তা কামনা করার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নকে এমন ইঙ্গিতও দিয়েছিল যে, ক্রেমলিন ভারতকে সংযত না করলে বড় ধরনের সংঘাত বেধে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র অভিমত প্রকাশ করেছিল যে, যুদ্ধে চীনের ভূমিকা চূড়ান্ত নিষ্পত্তিকারী হতে পারে। কিন্তু চীন ছিল অত্যন্ত হুঁশিয়ার। ভারত সীমান্তে দেশটি সৈন্য মোতায়েন করেছিল। তবে চীন ভারতে হামলা চালানোর ঝুঁকি নেয়নি। ভারতে হামলা চালালে সোভিয়েত ইউনিয়ন চীনে পাল্টা হামলা চালিয়ে বসতে পারতো। পরিস্থিতি যদি সত্যি সে রকম হতো তাহলে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত যুদ্ধে জড়িয়ে যেতো। ১৯৭১ সালে পাক-ভারত যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাবার সকল সম্ভাবনা বিরাজ করছিল। চীনের ভূমিকার উপর নির্ভর করছিল সম্ভাব্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভবিষ্যৎ। কিন্তু দেশটি ভারতে হামলা না চালিয়ে নিজেকে এবং বিশ্বকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে রক্ষা করেছে। ২০০২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ৩১তম বিজয় দিবসে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা মোহাফেজখানা থেকে প্রকাশিত গোপন দলিলে বলা হয়, `With the Indian army and armed Bengali separatists winning, the US on 10 December 1971 urged Beijing to mobilise troops towards India, saying the US would back it if the Soviet Union became involved. China declined and on 16 December the war ended with the Indian army and Bengali separatists taking Dhaka.'
‘ ভারতীয় সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বিজয়ী হওয়ার মুহূর্তে ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটানোর জন্য বেইজিংয়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধে সম্পৃক্ত হলে যুক্তরাষ্ট্র চীনের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু চীন যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানে সাড়াদানে অস্বীকৃতি জানায় এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঢাকা দখল করার মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়।’
৯ ডিসেম্বর সিআইএ ডিরেক্টর রিচার্ড হোমস প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে সতর্ক করে দেন যে, যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বিপর্যয় ঘটতে যাচ্ছে। পূর্ব রণাঙ্গনে যুদ্ধ থেমে গেলে এখান থেকে অতিরিক্ত ভারতীয় সৈন্য পশ্চিম রণাঙ্গনে ছুটে যাবে। তখন পশ্চিম পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। সিআইএ ডিরেক্টরের কাছ থেকে এ বার্তা পেয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সন বঙ্গোপসাগরে পরমাণু শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরী ‘ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ’ পাঠানোর নির্দেশ দেন এবং নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পাকিস্তানে সামরিক সরবরাহ প্রেরণ করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন এ সংবাদ পেয়ে তাদের নৌবহরকে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেয়। ১০ ডিসেম্বর দক্ষিণ ভিয়েতনামের অদূরে টঙ্কিন উপসাগরে ইয়াঙ্কি স্টেশন থেকে ১০টি যুদ্ধজাহাজের প্রহরায় মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ‘ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ’ সিঙ্গাপুর অভিমুখে ধেয়ে আসতে থাকে। ১২ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে রওনা হয়। চারটি রাডার সজ্জিত এন্টারপ্রাইজে ছিল ৯০টি জঙ্গি ও বোমারু বিমান। এটি ছিল প্রশান্ত মহাসাগরে মোতায়েন মার্কিন সপ্তম নৌবহরের অংশ। মার্কিন নৌবাহিনীর বৃহত্তম এ বিমানবাহী রণতরীর ঘণ্টায় গতিবেগ ছিল ৩৩ দশমিক ৮ নটিক্যাল মাইল এবং দৈর্ঘ্য ছিল এক হাজার ১২৩ ফুট এবং প্রস্থ ১৩২ দশমিক ৮ ফুট। এন্টারপ্রাইজের নেতৃত্বে ‘টাস্কফোর্স-৭৪’ গঠন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এ উদ্যোগ ছিল একটি পরমাণু হুমকি। বিমানবাহী রণতরী এন্টারপ্রাইজ ছাড়াও ‘টাস্কফোর্স-৭৪’ এ ছিল উভচর যুদ্ধজাহাজ ‘ইউএসএস ত্রিপোলী’, নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র সজ্জিত তিনটি প্রহরাদানকারী যুদ্ধজাহাজ ‘ইউএসএস কিং’, ‘ডেকাটার’ ও ‘পিয়ারসন্স’, চারটি ডেস্ট্রয়ার ‘ইউএসএস বাউসেল’, ‘অরলেক’, ‘ম্যাককীন’ ও ‘এন্ডারসন’ এবং একটি পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন। সহায়তাদানকারী যুদ্ধজাহাজগুলোর পুনরায় জ্বালানি গ্রহণের জন্য টাস্কফোর্সের অগ্রযাত্রায় বিলম্ব ঘটে। ফলে টাস্কফোর্স-৭৪ কে সিঙ্গাপুরের পূর্বদিকে যাত্রাবিরতি করতে হয়। ১৩-১৪ ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী রাতে টাস্কফোর্স-৭৪ মালাক্কা প্রণালী অতিক্রম করে এবং ১৫ ডিসেম্বর সকালে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে। উভচর যুদ্ধজাহাজ ‘ইউএসএস ত্রিপোলী’তে ছিল ২৫ টি অ্যাসল্ট হেলিকপ্টার এবং ২ শো মেরিন সেনার একটি ব্যাটালিয়ন।
     ১২ ডিসেম্বর সাবেক দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গন থেকে নিউইয়র্ক টাইমসের এক রিপোর্টে বলা হয়, মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ‘এন্টারপ্রাইজ’ ও কয়েকটি প্রহরাদানকারী যুদ্ধজাহাজ মালাক্কা প্রণালীর উদ্দেশে ভিয়েতনামের জলসীমা অতিক্রম করেছে এবং বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের জন্য নির্দেশের অপেক্ষা করছে। ভারত সরকার নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এ সংবাদ থেকে মার্কিন টাস্কফোর্সের এগিয়ে আসার সংবাদ জানতে পারে। তবে ভারত টাস্কফোর্সের লক্ষ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি। এ নিয়ে ভারতীয় কর্মকর্তারা ৪ দিন পর্যন্ত মাথা ঘামান। ভারত সরকার টাস্কফোর্সের সম্ভাব্য হুমকির বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মেলভিন লেয়ার্ড বঙ্গোপসাগরে বিমানবাহী রণতরীর উপস্থিতি সম্পর্কে একটি ব্যাখ্যা দেন। তিনি তার ব্যাখ্যায় বলেন, ১২ ডিসেম্বর ব্রিটিশ বিমান বাহিনী ঢাকা থেকে ১২৪ জন আমেরিকানকে সরিয়ে নিয়েছে। তবে সেখানে এখনো ৪৭ জন আমেরিকান স্বেচ্ছায় অবস্থান করছে। তাদের অপসারণে জরুরি পরিকল্পনার অংশ হিসাবে টাস্কফোর্স পাঠানো হচ্ছে। ভারত মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এ ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করে। মুষ্টিমেয় আমেরিকানকে অপসারণে পরমাণু শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরীর নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্স পাঠানোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভারত সন্দেহ প্রকাশ করে। কেউ কেউ ধারণা করছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের চারপাশে ভারতীয় অবরোধ ভেঙ্গে মার্কিন মেরিনদের সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যদের সংযোগ সাধনে এ টাস্কফোর্স পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু ভারত এ ধারণা বাতিল করে দেয়। দিল্লি বিশ্বাস করতো যে, অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে মার্কিন মেরিনদের সংযোগ সাধন করতে হলে বঙ্গোপসাগরে সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে হবে। ভারতীয় কর্মকর্তারা ধারণা করছিলেন যে, ঢাকার পতন ঘটলে পাকিস্তানি সৈন্যদের পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নেয়া হবে। মার্কিন উভচর অ্যাসল্ট যুদ্ধজাহাজ ‘ত্রিপোলী’র উপস্থিতি থেকে তারা এ ধারণা করছিলেন। অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সৈন্যদের অপসারণে ত্রিপোলী’তে এসব জঙ্গি হেলিকপ্টার ও মেরিন ব্যাটালিয়ন মজুদ করে রাখা হয়েছে বলে ধারণা করা হতে থাকে।
মার্কিন ৭ম নৌবহর এগিয়ে আসার সংবাদ পেয়ে ১০ ডিসেম্বর ভারতীয় নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এস এম নন্দ বিচলিত হয়ে পড়েন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে যুুদ্ধের পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিফিংদানকালে তার এ বিচলিত অবস্থা ধরা পড়ে। ব্রিফিংয়ের সময় একটি বিরাট টেবিলের একপাশে বসেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা এবং অন্য পাশে বসেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এসএইচএফজি মানেকশ, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল পি সি লাল ও নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল নন্দ। ব্রিফিংয়ে ব্যাঘাত ঘটিয়ে এডমিরাল নন্দ ইন্দিরার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘ম্যাডাম মার্কিন ৭ম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে এগিয়ে আসছে।’ ইন্দিরা নিরুত্তর। ব্রিফিং চলতে থাকে। কিছুক্ষণ পর এডমিরাল নন্দ আবার প্রধানমন্ত্রীর মনোযোগ আকর্ষণ করে বলেন, ‘ম্যাডাম আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, মার্কিন ৭ম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে রওনা হয়েছে।’ ইন্দিরা তাকে তৎক্ষণাৎ থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এডমিরাল আপনার কথা আমি প্রথমবারই শুনতে পেয়েছি। চলুন আমরা ব্রিফিংয়ে মনোযোগ দেই।
ইন্দিরা উড়িয়ে দেয়া সত্ত্বেও এডমিরাল নন্দর মন খচখচ করছিল। তিনি অরোরার চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকবের কাছে টেলিফোন করেন। জ্যাকব তাকে অভয় দিয়ে বলেন, ভারতীয়দের সামান্য ভয় দেখানোর জন্য টাস্কফোর্স পাঠানো হয়েছে। অন্য কোনো কিছুর জন্য নয়। টাস্কাফোর্স এত দূরে যে, সময়মতো এটি বঙ্গোপসাগরে এসে পৌঁছতে পারবে না। তিনি তাকে আরো আশ্বস্ত করেন যে, পাকিস্তানি ডলফিন শ্রেণীর সাবমেরিন পারস্য উপসাগরে ঘোরাফেরা করছে। এ সাবমেরিন বিশাল বিস্তৃতি কভার করতে পারবে না। তারপরও এডমিরাল নন্দ বিশ্বাস করছিলেন, সমুদ্রের মধ্যে কোথাও রিফুয়েলিংয়ের ব্যবস্থা থাকা অসম্ভব নয়। 
নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল নন্দ বারবার তাগিদ দেয়ায় ভারতের টনক ন?

কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে স্বাধীনতার ঘোষণা

কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে স্বাধীনতার ঘোষণা  

লেখকঃ সাহাদত হোসেন খান

চট্টগ্রামে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। এ বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা প্রচারিত হওয়া মাত্র যুদ্ধের সংবাদ বিশ্বের জনগণের কাছে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের নাম চারদিকে চারদিকে ছড়িয়ে যায়। কালুরঘাটের অদূরে মদুনাঘাটে এ বেতার কেন্দ্রের তিনটি পর্যায় ছিল। 
চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের প্রথম ঘোষণা ভেসে এসেছিল ২৭ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটে গ্রীনিচ সময় ১৯.৪৫ টায়। চট্টগ্রাম বেতারের ৮ জন ও বহিরাগত ২ জন নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর ঐতিহাসিক ভূমিকায় প্রথম ঘোষণা দেয়া সম্ভব হয়েছিল। তারা হলেন বেলাল মোহাম্মদ (নিজস্ব শিল্পী), আবুল কাশেম সন্দীপ (চট্টগ্রাম ফটিকছড়ি কলেজের তৎকালীন ভাইস প্রিন্সিপাল), সৈয়দ আবদুস শাকের (বেতার প্রকৌশলী), আবদুল্লাহ আল ফারুক (অনুষ্ঠান প্রযোজক), মোস্তফা আনোয়ার (অনুষ্ঠান প্রযোজক), রাশেদুল হাসান (টেকনিক্যাল এসিসট্যান্ট), আমিনুর রহমান (টেকনিক্যাল এসিসট্যান্ট), এ এম শরফুজ্জামান (টেকনিক্যাল অপারেটর), রেজাউল করিম চৌধুরী (টেকনিক্যাল অপারেটর) ও কাজী হাবিবউদ্দিন আহমেদ মনি, রশীদুল হোসেন ও মোস্তফা মনোয়ার। তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ।
গ্রেফতার হওয়ার আগ মুহূর্তে ২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১২টা ২০ মিনিটে  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং শত্র“দের প্রতিহত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে ড. মযহারুল ইসলাম তার ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা’ শিরোনামে বইয়ের ৩৯ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথাগুলো জেনারেল ওসমানী তার ৩২ নম্বর বাড়ির একটি নিভৃত কক্ষে ইংরেজিতে লিখেন। সেখানে তাজউদ্দিন ও আমি উপস্থিত ছিলাম। বঙ্গবন্ধু নিজেই ওসমানীর হাতে কাগজ-কলম তুলে দেন। ডিক্টেশন দেন তিনি নিজেই। তাজউদ্দিন ও আমি শ্রোতা এবং দু’একটি ইংরেজি শব্দের সাহায্যকারী। ২৫ মার্চ দিবাগত রাত সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে কোনো একসময় ঘোষণাটি সম্পূর্ণভাবে বঙ্গবন্ধুর মুসাবিদায় তৈরি ও লিখিত হয়। বঙ্গবন্ধু জেনারেল ওসমানীর হস্তলিখিত ঘোষণাটি রাত ১২টার পরে ওয়ারলেসে চট্টগ্রামে প্রেরণ করেন।’
এক নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকের আলোচিত বই ‘এ টেল অব মিলিয়ন্স’-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ২৫/২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দু’টি ঘোষণা দেন। প্রথম ঘোষণায় তিনি বলেন, `This may be my last message; from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh. Final victory is ours. Joy Bangla.’ এটা আমার শেষ বার্তা হতে পারে। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ যেখানে যে অবস্থায় রয়েছে এবং যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে দখলদার বাহিনীকে শেষ শক্তি দিয়ে মোকাবিলা করার জন্য আমি তাদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটি বিতাড়িত হওয়া নাগাদ আপনারা লড়াই চালিয়ে যান। আমাদের চূড়ান্ত বিজয় হবেই। জয় বাংলা।’ 
দ্বিতীয় ঘোষণায় তিনি বলেন, Today Bangladesh is a sovereign and independent country. On Thursday night, West Pakistani armed forces suddenly attacked the police barracks of Razarbagh and the EPR headquarters at Pilkhana in Dhaka. Many innocent and unarmed have been killed in Dhaka city and other places of Bangladesh.Violent clashes between EPR and Police on the one hand and armed forces of Pakistan on the other, are going on. The Bengalis are fighting the enemy with great courage for an independent Bangladesh. May Allah aid us in our fight for freedom. Joy Bangla.' আজ বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম ও স্বাধীন রাষ্ট্র। বৃহস্পতিবার রাতে পশ্চিম পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী আকস্মিকভাবে রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক এবং ঢাকার পিলখানায় ইপিআর সদরদপ্তরে আক্রমণ চালায়। ঢাকা মহানগরী এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বহু নির্দোষ ও নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে ইপিআর ও পুলিশের তীব্র সংঘর্ষ চলছে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য বাঙালিরা শত্র“র সঙ্গে বীরবিক্রমে লড়াই করছে। আল্লাহ আমাদের সংগ্রামে সহায়তা করুন। জয় বাংলা।’
    বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ কৌশল বিভাগের অধ্যাপক নূরুল্লাহ তৎকালীন বুয়েট ছাত্রনেতা স্থপতি ড. রাশিদুল হাসান খানের সহায়তায় মুজিবের অনুমতিক্রমে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে তার বাসভবনের ছাদে ট্রান্সমিটার স্থাপন করেন। কিন্তু ট্রান্সমিটার বসাবার পর বিকল হয়ে পড়ে। পরে এ বেতার যন্ত্র সচল করা হয়। ২৬ মার্চ এ ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করা হতে থাকে। শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসভবনে পৌঁছে। ২৬ মার্চ তার স্ত্রী ডা. নূরুন্নাহার ঘোষণাটি লিপিবদ্ধ করে তা চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ অফিসে এবং চট্টগ্রামের সলিমপুর ইপিআর ক্যাম্পের নিকটস্থ ওয়ারলেস স্টেশনে পাঠান। ওয়ারলেসের টিটিআর জালাল আহমেদ তা লিখে রাখেন। সহকারি প্রকৌশলী একেএমএস আব্দুল হাকিম মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণা সলিমপুর ওয়ারলেস স্টেশনের কর্মচারি জালাল আহমদ, জুলহাস উদ্দিন টিটিআর, এমডি শফিকুল ইসলাম ইএসডব্লিউ, আবুল কাশেম খান টিটিআর এবং আবুল ফজল ক্যাশিয়ারের সাহায্যে দেশ বিদেশে প্রেরণ করেন। সলিমপুর স্টেশনের দু’টি ভিন্ন চ্যানেল ছিল। একটি ছিল আন্তর্জাতিক মেরিটাইম বিভাগের কোস্টাল অপারেশনাল স্টেশন। এ স্টেশন থেকে সমুদ্রে যে কোন স্থানে জাহাজে বার্তা প্রেরণ করা যেতো। অপরটি ছিল ভিএইচএফ ওয়ারলেস স্টেশন। নিকটে ছিল পাহাড়তলী ইপিআর ক্যাম্প। এ জন্য অনেক সময় সলিমপুর স্টেশনকে ইপিআর স্টেশন বলা হতো। চট্টগ্রামের সলিমপুর স্টেশন থেকে প্রেরিত স্বাধীনতা ঘোষণা ভারত, ব্রিটেন, জাপান, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশে পৌঁছে। ঢাকার মগবাজার ভিএইচএফ ওয়ারলেসের সুপারভাইজার মেজবাহউদ্দিন ২৬ মার্চ রাতে মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা সলিমপুর স্টেশনের কর্মচারি মাহফুজ আলীর নিকট পাঠান। তিনি তা লিখে রাখেন এবং প্রচার করেন। চট্টগ্রাম ফৌজদারহাট ওয়ারলেসের অপারেটর মাহতাবউদ্দিন ও সুপারভাইজার নূরুল আমিন ঢাকার মগবাজার ওয়ারলেস অফিস থেকে মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা  “This may be my last message” পান। তারা সে বার্তা চট্টগ্রাম সংগ্রাম অফিসসহ সকল জেলায় প্রেরণ করেন। রেডিও পাকিস্তান ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হচ্ছিল, শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যদিকে কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পাল্টা ঘোষণায় বলা হচ্ছিল, তিনি সুস্থ আছেন এবং যথাসময়ে তার কণ্ঠ শোনা যাবে। বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের এ ঘোষণা সঠিক ছিল না। তবে জাতির মনোবল অক্ষ্ণুœ রাখতে এতটুকু মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়েছিল। 
     ২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১টা ৩০ মিনিটে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে দৈনিক আজাদী অফিসে মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার টেলেক্স মেসেজ আসে। ২৬ মার্চ সকাল থেকে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ অফিস মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণা শহরে মাইকে প্রচার করে। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা প্রচারের জন্য কাস্টমস কর্মকর্তা এমএ হালিম, প্রকৌশলী মির্জা নাসিরউদ্দিন, আব্দুস সোবহান, দেলোয়ার হোসেন, রাখাল চন্দ্র বণিক, এমএনএ আতাউর রহমান কায়সার, এসপিএ মোশাররফ প্রমুখের সহায়তায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করেন।
    ২৬ মার্চ দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে এম এ হান্নান মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করেন। তিনি সান্ধ্য অধিবেশনেও স্বাধীনতা ঘোষণা প্রচার করেন। ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় ওয়াপদার প্রকৌশলী আশিকুল ইসলাম কালুরঘাট বা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ইংরেজিতে এবং পরে আবুল কাশেম সন্দ্বীপ বাংলায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। ইংরেজি থেকে বার্তাটি বাংলায় অনুবাদ করেন ড. মঞ্জুলে মাওলা। ছাত্ররা নবনির্মিত আগ্রাবাদ রেডিও স্টেশন থেকে বার্তাটি প্রচারে কর্তৃপক্ষের অনুমতি পায়নি। এসময় তারা কালুরঘাট ব্রিজ অতিক্রম করে এবং মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব্ েঅষ্টম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রবেশ করে। বাঙালি সৈন্যরা কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে প্রহরা দিচ্ছিল। চট্টগ্রামে ইপিআরে কর্মরত সিনিয়র বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করার অনুরোধ জানালে তিনি সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে মোতায়েন অষ্টম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের টু-আই-সি মেজর জিয়াউর রহমানকে খুঁজে বের করার পরামর্শ দেন। জিয়া বাঙালি সামরিক অফিসারদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র হওয়ায় তিনি এ পরামর্শ দিয়েছিলেন। যথাসময়ে মেজর জিয়াকে ষোলশহরে খুঁজে পাওয়া যায়। তাকে অনুরোধ করা মাত্র তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানে রাজি হন।
   বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে কোনো কোনো লেখক ও গবেষক প্রশ্ন তুলেছেন। এ প্রসঙ্গে ছদরুদ্দীনের ‘মুক্তিযুুদ্ধ: বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে’ নামে বইয়ের ৫১ পৃষ্ঠার একটি উক্তি উল্লেখ করার মতো। তিনি লিখেছেন, ‘২৭ মার্চ লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের বাণী নামে একটি গোপন বেতার কেন্দ্র থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। শেখ মুজিব নিজে এ বেতার বার্তা ঘোষণা করেননি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে বিশ্বাসঘাতক হিসাবে অভিযুক্ত করার কিছুক্ষণ পরেই শেখ মুজিবের এ ঘোষণা শোনা যায়। যেহেতু ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ প্রচার করা হয় ২৬ মার্চ রাত ৮টায় কাজেই এ সংবাদ অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয় ২৬ মার্চ শুক্রবার রাত ৮টার পর।
   ২৮ মার্চের অবজারভারে বলা হয়, ‘গতকাল পাকিস্তান থেকে বাঙালি বিদ্রোহের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বর্তমান ঠিকানা সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী সংবাদ পাওয়া গেছে। সরকারি পাকিস্তান রেডিওর ঘোষণা অনুযায়ী শহরে তিনি তার বাড়ি থেকে ধৃত ও বন্দি হয়েছেন। তারপর ভারতে শেখ মুজিবের নামে প্রচারিত একটি বেতার বার্তা ধরা পড়ে। এতে বলা হয়েছে, ‘আমি চট্টগ্রামে আছি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মতোই স্বাধীন। গত শুক্রবারের ঘোষণায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের নতুন নামকরণ করেছেন বাংলাদেশ।’ এই সংবাদে শুক্রবার পূর্ব পাকিস্তানের নয়া নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ অর্থাৎ ২৬ মার্চ শুক্রবার বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়।
     শুধু একটি বিষয় ছাড়া অন্যান্য সংবাদ যে পরস্পরবিরোধী ও বিভ্রান্তিকর তাতে কোনো সন্দেহ নেই। উপরোক্ত ২৭ ও ২৮ মার্চের সংবাদ থেকে আমরা জানতে পারি (ক) ২৬ মার্চ শুক্রবার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঘোষণার ‘কিছুক্ষণ পরেই’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। (খ) শেখ মুজিব নিজে স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। (গ) তিনি চট্টগ্রামে বহাল তবিয়তে ছিলেন এবং (ঘ) পূর্ব পাকিস্তানের নয়া নামকরণ করেছেন ‘বাংলাদেশ।’
২৫ মার্চ দিবাগত রাত দেড়টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় তার নিজের বাড়িতেই গ্রেফতার হন। কাজেই তার পক্ষে ২৬ মার্চ দিবাগত রাত ৮টায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঘোষণার ‘কিছুক্ষণ পরে’ চট্টগ্রামে বহাল তবিয়তে থাকা বা চট্টগ্রাম থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করা সম্ভব নয়। অগত্যা ধরে নিতে হয় যে, অন্য কেউ মুজিবের হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু ঘোষক তার হয়ে এ অভিনয় করলেন কেন? তার পরিচয়ই বা কি? এ প্রশ্ন অত্যন্ত স্বাভাবিক। অভিনয়ের কারণ অত্যন্ত স্পষ্ট। ২৫/২৬ মার্চ রাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে বা পরে স্বয়ং শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা না করলেও তিনিই যে পহেলা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাঙালিদের মুক্তি ও স্বাধীনতার বাণী শুনিয়েছেন এবং স্বাধীনতার পথে তাদের উদ্ধুদ্ধ করেছেন সে সম্পর্কে কারো দ্বিমত নেই। এসময় তিনিই ছিলেন একমাত্র বাঙালি নেতা যার সম্মোহনী নেতৃত্ব ও ভাবমূর্তি সমগ্র দেশকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল। এজন্য ২৫ মার্চের কালরাত্রির পর থেকে জাতির মনোবল অক্ষুণœ রাখার জন্য বেতার প্রচারণায় এবং নেতা উপনেতাদের ভাষণে তার নাম কারণে অকারণে বীজমন্ত্ররূপে পুনঃপুনঃ উচ্চারিত হয়েছে। এমনকি স্বাধীনতা ঘোষণার অর্ডারেও। তার নাম ভাঙিয়ে গণহত্যার বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও সংহত করতে হয়েছে। এ ছাড়া উপায় ছিল না।’ বইটির ৬২/৬৩ নম্বর পৃষ্ঠায় তার আরেকটি একটি বিশ্লেষণও উল্লেখ করার মতো। তিনি লিখেছেন, ‘মুজিব নিজেই যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন তাহলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ২৭ মার্চের ভাষণে তার বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণার অভিযোগ আনতেন। এ ভাষণে তিনি মুজিবের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ আনলেও স্বাধীনতা ঘোষণার অভিযোগ আনেননি। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই, শেখ মুজিব ২৫/২৬ তারিখ রাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে স্বাধীনতা বা যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, তাহলে এ সত্য মেনে নিতে হয় যে, তিনি নিজে স্বাধীনতা বা য্দ্ধু ঘোষণা করে শত্র“র হাতে ধরা দেয়ার জন্য হাত পা গুটিয়ে তার ধানমন্ডির বাড়িতে অবস্থান করছিলেন! এ যেমন অস্বাভাবিক, তেমনি অবিশ্বাস্য। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র অতি স্পষ্টভাবে বলেছেন, আমরা জগদ্বাসীকে জানাতে চাই যে, শেখ মুজিবুর রহমান যদি সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা গ্রহণ করতেন তাহলে যে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে তার নিজের সৈন্যদল যুদ্ধ করবে তাদের হাতে বন্দি হওয়ার সম্ভাবনা এড়িয়ে চলতেন।’ 
স্বাধীনতার ঘোষণা: স্মারক গ্রন্থ নামে একটি বইয়েও অনুরূপ প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বইটির ৫৪ পৃষ্ঠায় খোন্দকার আলী আশরাফের ‘স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছিলেন’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলার স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায় প্রকাশিত ড. সৈয়দ আনোয়ার আলীর নিবন্ধের একটি অংশ উল্লেখ করা হয়। উল্লেখিত নিবন্ধে ড. আনোয়ার বলেছেন, ‘চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ রোডে একজন লোক টেলিগ্রাম বলে চেঁচাচ্ছিল আর একটা ছোট কাগজ বিলি করছিল। গাড়ি থামিয়ে আমি একটি কাগজ সংগ্রহ করি। কাগজটা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচারিত একটি বাণী। তিনি তাতে ২৫ মার্চ ঢাকার ঘটনাবলী উল্লেখ করে বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্যের এবং দেশবাসীর প্রতি প্রতিরোধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। টেলিগ্রামের কাগজটা আমার স্ত্রী মঞ্জুলা আনোয়ারের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। দেখে প্রথমে তিনি উল্লসিত হয়েছিলেন। কিন্তু একটু পরেই নিরাশ হয়ে বললেন, এরকম একটা বাণী আমাদের কতটা অনুপ্রাণিত করবে সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। কেননা এতে স্বাধীনতার উল্লেখ নেই। যাই হোক, তিনি নিজেই উদ্যোগ নিয়ে ব্যাপক প্রচারের জন্য এই আবেদন বাংলায় অনুবাদ করে পাড়ার কিছু ছেলেমেয়েদের দিয়ে কার্বন কপি করাতে শুরু করেন। বাংলা অনুবাদে তিনি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কয়েকটি পরিবর্তন সাধন করেছিলেন আমার সঙ্গে আলাপ করে। আমার স্ত্রী এতে একটি ছোট অথচ আকাঙ্খিত শব্দ যোগ করেছিলেন। শব্দটি ছিল ‘স্বাধীনতা’। কোরআন তেলাওয়াতের পর আমার স্ত্রী মঞ্জুলার পরিবর্তিত বার্তাটি পাঠ করেন আবুল কাশেম সন্দীপ। ইংরেজি বার্তাটি পাঠ করেন ইঞ্জিনিয়ার আশিকুল ইসলাম। ফেরার পথে শুধু দেখছিলাম আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান ছোট একটি কামরায় নীরবে কী যেন লিখছেন। আমি তাকে বললাম, আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু করেছি। শিগগির কিছু বলুন, দেশবাসীকে অনুপ্রাণিত করুন। উনি বললেন, ‘আমি তাই লিখছি।’ আমি তাকে বলছিলাম, এখন লেখার সময় নয়। যা মুখে আসে তাই বলুন।’
খোন্দকার আলী আশরাফ তার আলোচিত নিবন্ধের ৫৭ নম্বর পৃৃষ্ঠায় আরো লিখেছেন, ‘ড. আনোয়ার টেলিগ্রাম বলে কথিত স্বাধীনতার ঘোষণাবিহীন যে চিরকুটটি পেয়েছিলেন তা আদৌ কোনো টেলিগ্রাম কপি ছিল কিনা আর হলেও তার উৎস কি? কে কোথা থেকে তা পাঠিয়েছিল তার প্রমাণ কি? তাতে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম থাকলেও তিনিই যে তা পাঠিয়েছিলেন তারই বা প্রমাণ কি? সেই তথাকথিত টেলিগ্রামও যে ড. আনোয়ার ও তার পত্মী মিসেস মঞ্জুলার মতো চট্টগ্রামের কোনো দেশপ্রেমিক বা দেশপ্রেমিকাদের কাজ নয় একথা কে বলতে পারে? ঐ আবেদন শেখ সাহেবের ছাড়া অন্য কারো নামে করা হলে তা যে মূল্যহীন হতো একথা কে না বুঝে? শেখ মুজিবুর রহমান আদৌ চট্টগ্রামে কোনো স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন কিনা কিংবা বিরাজমান পরিস্থিতিতে টেলিগ্রাম বা ওয়ারলেস বা অন্য কোনো বার্তা পাঠানো তার পক্ষে সম্ভব ছিল কিনা তাও ভেবে দেখতে হবে। মহাখালীর ওয়ারলেস কেন্দ্র ছিল সন্ধ্যার পর থেকে হানাদারদের নিয়ন্ত্রণে। রাত ১১টার পর থেকে রাজধানীর সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই অবস্থায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে স্বাধীনতার ঘোষণা একমাত্র টেলিপ্যাথি ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে পাঠানো সম্ভব ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমান যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েই থাকবেন তাহলে চট্টগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হোক বা না-ই হোক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আট মাসে তা একবারও প্রচার করা হলো না কেন? আমাদের তো মনে হয় তেমন কোনো ঘোষণা থাকলে তা প্রতিটি অধিবেশনে ‘বজ্রকণ্ঠ’-এর মতো প্রচার করা হতো। কেননা সেই দুর্যোগময় দিনে জাতিকে অনুপ্রাণিত করতে তার বাণীর চাইতে শক্তিশালী আর কোনো অস্ত্র ছিল না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এ নীরবতা থেকে কি শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টি হয় না? জেনারেল ওসমানী বলেছেন, তিনি রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত শেষ ব্যক্তি হিসাবে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ছিলেন। তার কাছে মুজিব বলেছিলেন, পাকিস্তানিরা শক্তিপ্রয়োগ করলে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। ঘোষণা তিনি প্রস্তুত করে রেখেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, শেখ মুজিবের বার্তায় রাজারবাগ ও পিলখানায় পাকিস্তানি সৈন্যদের হামলার কথা স্থান পেয়েছে। রাজারবাগ ও পিলখানায় হামলা হয়েছে রাত সাড়ে ১০টায়। রাত সাড়ে ১০টার ঘটনা তিনি রাত সাড়ে ৯টার আগে লিখলেন কিভাবে? পাকিস্তানি মেজর সিদ্দিক সালিক বলেছেন, তিনি রাত ১২টায় ক্ষীণস্বরে রেডিও ওয়েভে মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণা শুনতে পেয়েছেন। একই যুক্তিতে তার বর্ণনাও বাতিল হয়ে যায়।’ 
২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান সৈন্যদের নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ১৫ মাইল দূরে পটিয়া থানার করইল গ্রামে অবস্থান করছিলেন। চট্টগ্রাম বেতারের কর্মকর্তা বেলাল মোহাম্মদ সেদিন সন্ধ্যায় তাকে পটিয়া থেকে কালুরঘাটে নিয়ে আসেন। বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা জিয়াকে পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠে। ২৭ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টা। কিন্তু কি বলবেন তিনি? একটি করে বিবৃতি লেখেন আর ছিঁড়ে ফেলেন। বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা বারবার ঘোষণা করছিল আর মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে মেজর জিয়া ভাষণ দেবেন। ১৫ মিনিট পার হয়ে যায়। মেজর জিয়া মাত্র তিন লাইন লিখতে পেরেছেন। এ ব্যাপারে জিয়াউর রহমান তার ডায়েরীতে লিখেছেন, ‘২৭ মার্চ শহরের চারদিকে তখনো বিক্ষিপ্ত লড়াই চলছিল। সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায় রেডিও স্টেশনে এলাম। এক টুকরো কাগজ খুঁজছিলাম। হাতের কাছে একটি এক্সারসাইজ খাতা পাওয়া গেল। তার একটি পৃষ্ঠায় দ্রুত হাতে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম ঘোষণার কথা লিখলাম। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বভার নিয়েছি সে কথাও লেখা হলো সেই প্রথম ঘোষণায়। কিছুক্ষণের মধ্যে সে ঘোষণা বেতারে প্রচার করলাম। ২৮ মার্চ সকাল থেকে পনেরো মিনিট পর পর ঘোষণাটি প্রচার করা হলো কালুরঘাট রেডিও স্টেশন থেকে। ৩০ মার্চ দ্বিতীয় ঘোষণাটি প্রচার করা হলো রাজনৈতিক নেতাদের অনুরোধক্রমে।’ 
স্বাধীনতা ঘোষণার বিবৃতি লেখার অনেক ঝুঁকি ছিল। জিয়াউর রহমানকে শব্দচয়ন, বক্তব্য পেশ ইত্যাদি নিয়ে ভাবতে হচ্ছিল। প্রায় দেড় ঘণ্টা মুসাবিদার পর তিনি তার সেই ঐতিহাসিক ভাষণ তৈরি করেন। নিজেই তিনি বাংলা ও ইংরেজিতে এ ভাষণ পাঠ করেন। জিয়ার প্রথম ঘোষণা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের তৃতীয় খন্ডে সংযোজন করা হয়েছে। তবে এ সংযোজিত ভাষণে তার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি নেই। যেমন- তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মেজর জিয়া বলছি,’ ‘আমি বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি।’ এমনকি তার ভাষণে ইংরেজি ‘আই’ শব্দটিও নেই। এ অসম্পূর্ণতা চাপা দিতে গিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের তৃতীয় খন্ডের পাদটীকায় এক ব্যাখ্যায় বলা হয়, নিরাপত্তার কারণে জিয়ার প্রথম ভাষণের মূল কপি নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। এ দলিলপত্রে জিয়ার প্রথম ঘোষণা হিসাবে যা মুদ্রিত হয়েছে তা তার দ্বিতীয় ঘোষণার কাছাকাছি। স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের তৃতীয় খণ্ডে উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী জিয়ার প্রথম ভাষণ হলো এরকম। Major Zia, Provisional Commander-in-Chief of the Bangladesh Liberation Army, hereby proclaims, on behalf of Sheikh Mujibur Rahman, the independence of Bangladesh. 
I, also declare, we have already framed a sovereign, legal government under Skeikh Mujibur Rahman which pledges to function as per law and and the constition. The new democratic Government is committed to a policy of non-alignment in international relations. It will seek friendship with all nations and strive for international peace. I appeal to all government to mobilize opinion in their respective countries against the brutal genocide in Bangladesh.The Government under Sheikh Mujibur Rahman is sovereign and legal Government of Bangladesh and is entitled to recognition from all democratic nation of the world.’  মেজর জিয়া, বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির অস্থায়ী কমান্ডার, এতদ্বারা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।
আমি আরো ঘোষণ করছি, আমরা ইতিমধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি সার্বভৌম ও আইনানুগ সরকার গঠন করেছি। এ সরকার আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনার প্রতিশ্র“তি দিচ্ছে। নয়া গণতান্ত্রিক সরকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কে জোট নিরপেক্ষ নীতির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা সকল জাতির বন্ধুত্ব কামনা করছি এবং আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য প্রচেষ্টা চালাবো। আমরা বাংলাদেশে বর্বর গণহত্যার বিরুদ্ধে নিজ নিজ দেশে জনমত তৈরিতে সকল সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশের সার্বভৌম ও আইনানুগ সরকার এবং বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক দেশের স্বীকৃতির দাবিদার।’ 
নিজের নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ায় মরহুম শিল্পপতি একে খানসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ তাকে মৃদু ভর্ৎসনা করেন। তাদের আপত্তির মুখে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আবার বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এ ব্যাপারে কাদের সিদ্দিকী তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘স্বাধীনতা ‘৭১’-এর ৪১৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘তার বক্তৃতা রেকর্ড করার জন্য একটি টেপ রেকর্ডার আনা হলো। এখানে তিনি প্রথম নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে ঘোষণা করে বক্তব্য রাখেন। তার ঘোষণার শুরুটা ছিল এরকম। ‘আমি মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’ রেডিও সেন্টারে সম্প্রচার শুরু হলে ক্রটি ধরা পড়ে। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ জিজ্ঞেস করলে জিয়া সাহেব বলেন, ‘আমি ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। আপনারা একটা খসড়া করে দিন।’ এবার সংগ্রাম পরিষদের নেতারা চিন্তাভাবনা করে ৫/৬ লাইনের একটি খসড়া বক্তৃতা লিখে দেন।’
ওয়েবসাইট ‘দ্য উইকিপিডিয়া: দ্য ফ্রি এনসাইক্লোপিডিয়া’র বর্ণনা অনুযায়ী এই খসড়ার ভিত্তিতে তিনদিন পর ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় বেলাল মোহাম্মদ, ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়া প্রমুখের উপস্থিতিতে মেজর জিয়া তার দ্বিতীয়  ঘোষণায় বলেন, This is Shadhin Bangla Betar Kendra. I, Major Ziaur Rahman at the direction of our great national leader Bangobandhu Sheikh Mujibur Rahman, hereby declare that the independent People's Republic of Bangladesh has been established. At his direction, I have taken the command as the temporary Head of Republic. In the name of Sheikh Mujibur Rahman, I call upon all Bengalis to rise against the attack by the West Pakistani Army. We shall fight to the last to free our Motherland. By the grace of Allah, victory is ours. Joy Bangla. ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি। আমি মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ঘোষণা করছি যে, স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তার নির্দেশে আমি প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। আমি শেখ মুজিবুর রহমানের নামে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ রুখে দাঁড়ানোর জন্য সকল বাঙালির প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা আমাদের মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে লড়াই করবো। ইনশাল্লাহ আমরাই বিজয়ী হবো। জয় বাংলা।’
     বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের তৃতীয় খণ্ডে জিয়াউর রহমানের দ্বিতীয় ঘোষণাও উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এতে তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ৩১ মার্চ। এখানেও একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। ব্যাখ্যায় বলা হয়, জিয়াউর রহমান ভুল করে ৩০ তারিখের স্থলে ৩১ মার্চ লিখেছেন। উল্লেখিত বর্ণনা অনুযায়ী জিয়ার দ্বিতীয় ঘোষণা হলো এরকম। 

From Major Zia
Declaration:
Punjabis have been used 3rd Commando Battalion in Chittagong city area to subdue the valliant freedom fighters of Sadhin Bangla. But they have been thrown back and many of them have been killed.
The Punjabis have been extensivly using F-86 aircrafts to kill the civilians strongholds and vital points. They are killing the civilians, men, women and children brutally. So far at least---thousands of Bengali civilians have been killed in Chittagong area alone. 
The Sadhin Bangla Liberation Army is pushing the Punjabis--- from one place to other. At present Punjabis have utilized at least two Brigades of Army, Navy and Air force. It is in fact a combined operation.
I once again request the United Nations and the big powers to intervene and physically come to our aid. Delay will mean massacre of additional millions.’ 
                                          Signature
                            Major Ziaur Rahman
                             31.3.71
 
মেজর জিয়ার পক্ষ থেকে  
         ঘোষণা
পাঞ্জাবীরা স্বাধীন বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দমন করতে চট্টগ্রাম এলাকায় তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়ন ব্যবহার করছে। কিন্তু তাদেরকে বিতাড়িত করা হয়েছে এবং তাদের অনেকে নিহত হয়েছে। 
পাঞ্জাবীরা বেসামরিক লোকজনকে হত্যা এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংসে ব্যাপকভাবে এফ-৮৬ জঙ্গিবিমান ব্যবহার করছে। তারা বেসামরিক নর, নারী ও র্শিশুদের হত্যা করছে। এ পর্যন্ত শুধুমাত্র চট্টগ্রাম এলাকায় কমপক্ষে কয়েক হাজার বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলা মুক্তি ফৌজ পাঞ্জাবীদের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। বর্তমানে পাঞ্জাবীরা সেনাবাহিনীর অন্তত দু’টি ব্রিগেড, নৌ ও বিমান বাহিনী ব্যবহার করছে। বস্তুত এটি হচ্ছে একটি যৌথ অভিযান। 
   আমি আবারো আমাদের সহায়তায় বৈষয়িকভাবে এগিয়ে আসতে এবং হস্তক্ষেপ করার জন্য জাতিসংঘ ও বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। বিলম্ব ঘটার মানে হলো আরো কয়েক লাখ লোকের মৃত্যু।
                                          স্বাক্ষর 
                               মেজর জিয়াউর রহমান
                                  ৩১.৩.৭১    
লে. শমসের মোবিন চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘২৭ মার্চ সন্ধ্যায় মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে আসেন এবং ভাষণ দেন। ২৮ মার্চ সারাদিন আমি বেতার কেন্দ্র থেকে এ ভাষণ পাঠ করি।’ ক্যাপ্টেন এমএসএ ভূঁইয়া লিখেছেন, ‘সেখানে অষ্টম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের লে. শমসেরের সঙ্গে আমার দেখা হয়। লে. শমসের সে সময় বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের লিখিত ভাষণ বারবার প্রচার করছিলেন।’ অন্যদিকে মাহবুব-উল-আলম তার ‘রক্ত-আগুন-অশ্র“সজল-স্বাধীনতা’ নামে গ্রন্থের ৯২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,‘ আওয়ামী লীগ নেতা ডাক্তার আবু জাফর ছাড়াও চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হান্নানের দেখা হলো দলের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে। তখন তারা বেতার কেন্দ্র দখল করে সেখান থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা ব্যাপকভাবে জনগণের মধ্যে প্রচারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সে অনুযায়ী ডাক্তার আবু জাফর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করেন। এ ঘোষণাপত্র কিঞ্চিত সংশোধন করে সেদিন দুপুর আড়াইটায় তা চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটিং সেন্টার থেকে প্রচার করা হয়। হান্নান সর্বপ্রথম সে ঘোষণা করলেন। সেদিন চট্টগ্রাম থেকে প্রচারিত এই একটি ঘোষণা সারা বাংলার বুকে যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল আজো তা ভাবতে গেলে অবাক হতে হয়।’
বাংলাদেশের জনগণের উপর জিয়ার ঘোষণার প্রভাব সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের পঞ্চদশ খন্ডে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম তার দীর্ঘ নিবন্ধের ৯৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘স্নান করে খেতে যাব। হঠাৎ স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান কানে ভেসে এলো। ঘোষক বেতারে বলছেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে হাজির হতে বেতারে নির্দেশ দেয়া হলো। প্রথমে এদের নামধাম কিছুই বুঝা গেল না। ঠাওর করে উঠতে পারলাম না, কারা কোত্থেকে এই বেতার চালাচ্ছে। পরে বেতারে মেজর জিয়ার কন্ঠ শোনা গেল। তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। মেজর জিয়ার আহ্বান বেসামরিক ও সামরিক তথা বাংলার সর্বশ্রেণীর মানুষকে সংগ্রামে উজ্জীবিত করে।’ 
মেজর (অব:) রফিকুল ইসলাম পিএসসি তার ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার প্রথম প্রহর’ গ্রন্থের ৩২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘স্বাধীনতা ঘোষণার বিতর্কে না গিয়েও একটি কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বর এবং তার আহ্বানই সামরিক ও আধা সামরিক তথা গোটা বাঙালি জাতিকে নতুন আশার পথ দেখিয়েছে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সেদিন সত্যিই মেজর জিয়ার আহ্বানই সবার প্রাণে সাড়া জাগিয়েছিল। অন্ধকারে জনতা পেয়েছিল আশার সন্ধান।’ 
জিয়ার কোর্সমেট অবসরপ্রাপ্ত মরহুম লে. কর্নেল এমএ হামিদের একটি উক্তিও উল্লেখের দাবি রাখে। তিনি তার ‘একাত্তরের জয়পরাজয়: মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের দৃশ্যপট’ বইয়ের ৬৭ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘২৭ তারিখ মেজর জিয়া চট্টগ্রাম রেডিও স্টেশন থেকে স্বাধীনতার সপক্ষে তার বিখ্যাত বেতার ঘোষণা দেন যা দেশের সর্বত্র জনগণের কানে পৌঁছে গিয়ে এক অপূর্ব উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। অবশ্য তার আগের দিন ২৬ তারিখ আওয়ামী লীগ নেতা জনাব হান্নান জাতির নেতার পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেন। কিন্তু দুর্বল ট্রান্সমিটারের জন্য তা সবাই শুনতে পায়নি।’
কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার করার সামর্থ্য ছিল সীমিত। বঙ্গোপসাগরে একটি জাপানি জাহাজে এ বার্তা ধরা পড়ে। পরে এ বার্তা রেডিও অস্ট্রেলিয়া ও বিবিসি পুনঃপুন প্রচার করে। মেজর জিয়ার সেদিনের সে ঐতিহাসিক ঘোষণা শুনে দিশেহারা সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। শুরু হয় সর্বাত্মক সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ। দু’দিন পর এই বেতার কেন্দ্রের নাম থেকে বিপ্লবী শব্দটি বাদ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এই বেতার কেন্দ্রের প্রচার কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্নভাবে অগ্রসর হতে পারেনি। প্রচণ্ড বাধা আসে ৪ দিনের মধ্যে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল মেজর জেনারেল মিঠঠা কালুরঘ

মানবতার বিরুদ্ধে এসব অপরাধের দায় কার?

মানবতার বিরুদ্ধে এসব 
 অপরাধের দায় কার?
লেখকঃ সাহাদত হোসেন খান
আপনি কান পাতলে শুধু শুনবেন ‘ইসলামী জঙ্গি’, আর ‘ইসলামী জঙ্গি।’ হ্যাঁ, কিছু জঙ্গি কিছু সন্ত্রাসী তো থাকতেই পারে। কিন্তু তাদেরকে জঙ্গি বানিয়েছে কে? যাদেরকে জঙ্গি বলে সাব্যস্ত করা হচ্ছে তাদের সবাই মুসলমান। মুসলমানদের ভূখন্ড কেড়ে নিয়ে আপনি হবেন সাধু আর জুলুমের শিকার মুসলমানরা হবে জঙ্গি, সন্ত্রাসী তাই না? বিশ্বের এ অন্যায় মানি না। কয়েক বছর ধরে জঙ্গি বলতে একটি শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু তার আগে এবং পরে কারা বিশ্ববাসীর শান্তি কেড়ে নিয়েছিল? নিশ্চয়ই কথিত জঙ্গিরা নয়। এসব অপরাধীর নাম কেউ উচ্চারণ করে না। কিন্তু ইতিহাস থেকে তাদের অপরাধের চিত্র মুছে দেয়া সম্ভব নয়। ইতিহাসের পাতায় পাতায় তাদের অপরাধের স্বাক্ষর খুঁজে পাওয়া যায়। তাদের কার্যকলাপ মানবতার বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ। এসব অপরাধী হলো সাম্রাজ্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী, আধিপত্যবাদী ও কমিউনিস্ট। তাদের কেউ কথিত ইসলামী জঙ্গি নয়।

হিরোশিমায় আণবিক বোমা নিক্ষেপ
প্রথমেই সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যাক হিরোশিমায় বিশ্বের প্রথম আণবিক বোমা নিক্ষেপের উপাখ্যান নিয়ে। কে হিরোশিমায় আণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছিল, ইসলামী জঙ্গির? না, বহুল কথিত ইসলামী জঙ্গিরা নয়, আণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছিল সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা। অক্ষশক্তির গুরুত্বপূর্ণ শরীক জাপানকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে মার্কিন সামরিক বাহিনী ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোশিমায় বিশ্বের প্রথম আণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। প্রথম আণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তা বিদ্যমান থাকা অবস্থায় তিন দিন পর ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে বিশ্বের দ্বিতীয় আণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়। জাপানে আণবিক বোমা নিক্ষেপের আগে বিশ্বে আর কখনো, কোথাও এ বিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সাড়ে তিন বছরে প্রায় ৩ লাখ লোক নিহত হয়। অর্ধেক লোক নিহত হয় জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে। ধ্বংস এবং আরো ধ্বংসের ভীতি সৃষ্টি করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্রুত নিষ্পত্তি টানাই ছিল আণবিক বোমা নিক্ষেপে নির্দেশ দানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যানের আনুষ্ঠানিক যুক্তি। আণবিক বোমা নিক্ষেপে তাৎক্ষণিক নিহত হয় এক লাখ ২০ হাজার লোক এবং পরে প্রাণ হারায় তার দ্বিগুণ। আণবিক বোমা নিক্ষেপের পর ১৫ আগস্ট জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করে। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা নিক্ষেপের ঘটনা এ বোমা ব্যবহারে ইতিহাসের প্রথম ও একমাত্র ঘটনা। প্রতি বছর ৬ আগস্ট হিরোশিমা এবং ৯ আগস্ট নাগাসাকি দিবস পালিত হয়। ৬ আগস্ট সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে হিরোশিমায় পৃথিবীর প্রথম আণবিক বোমা নিক্ষিপ্ত হয়। মহাপ্রলয় থেকে একটি ঘড়ি রক্ষা পায়। সে ঘড়ির কাটা চিরদিনের জন্য ৮ টা ১৫ মিনিটে এসে থেমে আছে।

নাগাসাকিতে দ্বিতীয় আণবিক বোমাবর্ষণ
১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র জাপানের নাগাসাকিতে ১৯-২৩ কিলোটন শক্তিসম্পন্ন আণবিক বোমাবর্ষণ করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দ্রুত সমাপ্তির পথে অগ্রসর হয়। আণবিক বোমা নিক্ষেপে তৎক্ষণাৎ ৭০ হাজার লোক নিহত এবং পরে বোমার প্রতিক্রিয়ায় তার চেয়ে বেশি লোকের মৃত্যু হয়। নাগাসাকি ছিল দক্ষিণাঞ্চলীয় জাপানের অন্যতম বৃহৎ সমুদ্র বন্দর। যুদ্ধকালে অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধজাহাজ, সামরিক সাজসরঞ্জাম ও অন্যান্য রণসম্ভার তৈরি হওয়ায় শহরটির সামরিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। হুঁশিয়ারি ছাড়াই নাগাসাকিতে মানববিধ্বংসী মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়। ৮ আগস্ট লিফলেট ফেলা হলেও সেগুলো ১০ আগস্টের আগে পাওয়া যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির সিদ্ধান্ত ছিল যে, আমরা জাপানিদের কোনো হুঁশিয়ারি দিতে পারি না। এ সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও রেডিও সাইপেনের মাধ্যমে জাপানকে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছিল।

জাপানি মহিলাদের গণধর্ষণ
এশিয়ায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাব তুঙ্গে থাকায় প্রথমদিকে যুদ্ধে সাফল্য অর্জন করলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে জাপান পরাজিত হয়। ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জাপান মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। যুদ্ধকালে মার্কিন সৈন্যরা জাপানে গণধর্ষণে মেতে উঠে। এত বছর পর আজো ওকিনাওয়ায় ধর্ষিতাদের আর্তচিৎকার শোনা যায়। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুদ্ধের শেষ মাসগুলোয় ওকিনাওয়া যুদ্ধ এবং জাপানে দখলদারিত্বকালে মিত্র সৈন্যরা অসংখ্য ধর্ষণে লিপ্ত হয়। ১৯৫২ সাল নাগাদ জাপানে মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত ছিল। ওকিনাওয়ায় মিত্রবাহিনী বিশেষ করে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ স্থায়ী হয়েছিল আরো দু’দশক। সানফ্রান্সিসকো চুক্তি বলবৎ হলে ১৯৫২ সালের ২৮ এপ্রিল জাপানের অধিকাংশ ভূখ- মিত্রবাহিনীর দখলমুক্ত হয়। ওকিনাওয়ায় দখলদারিত্ব শেষ হয় ১৯৭২ সালের ১৫ মে। ১৯৪৫ সালের মধ্যে মার্কিন সৈন্যরা জাপানের ভূখ-ে প্রবেশ এবং দখল করতে শুরু করে। ১৯৪৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মার্কিন সৈন্যরা আইয়োজিমায় অবতরণ করে এবং পহেলা এপ্রিল অবতরণ করে ওকিনাওয়ায়। ১৯৪৫ সালে জাপান আত্মসমর্পণ করলে মিত্রবাহিনী দেশটির মূল ভূখ-ে ঢুকে পড়ে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে জাপানে দখলদারিত্ব কায়েম করে। ২০০০ সালের পহেলা জুন ক্যালভিন সিমস নিউইয়র্ক টাইমসে ‘থ্রি ডেড মেরিন্স এন্ড অ্যা সিক্রেট অব ওয়ারটাইম ওকিনাওয়া’ শিরোনামে এক রিপোর্টে লিখেছেন: ‘এ ভয়ংকর যুদ্ধে আমেরিকান ও জাপানি উভয়ের হাতে নৃশংস দুর্ভোগ নিয়ে বহু লেখালেখি ও বিতর্ক হয়েছে। এ যুদ্ধে ২ লাখের বেশি সৈন্য ও বেসামরিক লোক নিহত হয়। নিহত বেসামরিক লোকের এক-তৃতীয়াংশ ছিল ওকিনাওয়ার।’ জাপানি রাজকীয় সৈন্যদের ধর্ষণ নিয়ে ইউকি তানাকা ‘জাপান‘স কম্ফোর্ট উইমেন: সেক্সুয়াল সেøভারি এন্ড প্রসটিটিউশন ডিউরিং ওয়ার্ল্ড ওয়ার সেকেন্ড’ শিরোনামে একটি বিখ্যাত বই লিখেছেন। তার বইয়ে উল্লেখিত ধর্ষিতাদের সংখ্যা হচ্ছে জাপানি সূত্র থেকে প্রাপ্ত।

ভিয়েতনামে সামরিক হস্তক্ষেপ
ভিয়েতনামের নাম এখন কারো মুখে উচ্চারিত না হলেও কয়েক দশক আগে বিশ্বের সব নিপীড়িত ও সংগ্রামী জনতা তাদের নামে শ্লোগান দিতো। ভিয়েতনাম সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি প্রতীকে পরিণত হয়। আজও কোথাও কোনো জাতি মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লে ভিয়েতনামের মুক্তিসংগ্রামের অবিস্মরণীয় ইতিহাস গর্বের সঙ্গে স্মরণ করে। এ আত্মবিশ্বাস জেগে ওঠে যে, মুক্তিসংগ্রাম কখনো পরাজিত হয় না। বৈদেশিক ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেই ভিয়েতনামীরা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অন্তরে শ্রদ্ধার আসনে ঠাঁই নিয়েছে। ১৯৭৩ সালে প্যারিস শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেমে গেছে, এ কথা সত্যি। কিন্তু এ যুদ্ধের স্মৃতি এখনো সাম্রাজ্যবাদীদের তাড়া করে ফিরে। কোথাও সামরিক আগ্রাসন চালাতে গেলেই ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি তাদের মনে পড়ে। ভয় পায় না জানি আরেকটি ভিয়েতনাম সৃষ্টি হয়। ভিয়েতনামীরা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, একটি জাতির সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম কখনো পাশবিক শক্তি প্রয়োগে দমন করে রাখা যায় না। প্রায় এক শো বছর দুটি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে তারা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ বন্দি মার্কিনীদের মধ্যে ছিলেন চার তারকা জেনারেলের পুত্র নেভি পাইলট আরিজোনার রিপাবলিকান সিনেটর জন ম্যাককেইন ও স্বনামধন্য মার্কিন চিত্রপরিচালক অলিভার স্টোন।

ভিয়েতনামের মাই লাইয়ে গণহত্যা
মাই লাইয়ের নাম এ প্রজন্মের অনেকেই জানে না। পৃথিবীর ইতিহাসে আজ পর্যন্ত যতগুলো গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে ভিয়েতনামের মাই লাই গণহত্যার স্থান শীর্ষে। আজকের প্রজন্ম হয়তো মাই লাইয়ের নামই জানে না। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকগুলোতে মাই লাই নামটি প্রায় সবার মুখে উচ্চারিত হতো। বিশ্ব মানবতা যে ক’টি অপরাধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে ঘৃণা করে তার মধ্যে এ গণহত্যা হচ্ছে অন্যতম। মাই লাই গণহত্যা হচ্ছে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সবচেয়ে মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি। মাই লাই ছিল একটি ক্ষুদ্র পল্লীর সাংকেতিক নাম। মার্কিন সামরিক বাহিনী চারটি ক্ষুদ্র পল্লীকে তাদের মানচিত্রে মাই লাই নামকরণ করে। চতুর্থ বা চার নম্বর মাই লাইয়ে সংঘটিত হয় গণহত্যা। ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামে সামরিক হস্তক্ষেপ করে। ভিয়েতনাম ছিল তখন দু’ভাগে বিভক্ত। একটি উত্তর এবং আরেকটি দক্ষিণ। মার্কিন সৈন্যরা অবস্থান করতো দক্ষিণ ভিয়েতনামে। শুধু উত্তর ভিয়েতনামী কমিউনিস্ট গেরিলারা নয়, দক্ষিণ ভিয়েতনামের গেরিলারাও মার্কিন সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। দক্ষিণ ভিয়েতনামী গেরিলাদের বলা হতো ‘এনএলএফ’ বা ভিয়েতকং গেরিলা। এ গেরিলাদের বিরুদ্ধে মার্কিন সৈন্যদের অপারেশনকালে ঘটে মাই লাই ট্র্যাজেডি। এতগুলো নিরস্ত্র ও নির্দোষ বেসামরিক লোক নিহত হলেও যুক্তরাষ্ট্র আজ পর্যন্ত ভিয়েতনামীদের কাছে ক্ষমা চায়নি। আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখও প্রকাশ করেনি।

ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত
ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুতা নতুন নয়। উপসাগরীয় দেশটিকে ওয়াশিংটন বরাবরই নিজের পক্ষপুটে রাখতে চেয়েছে। এ অভিসন্ধি থেকে ১৯৫৩ সালে ইরানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে ক্যু করে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।  ১৯৫৩ সালে সংঘটিত ইরানের অভ্যুত্থান ‘২৮ মোরদাদ অভ্যুত্থান’ হিসেবে পরিচিত। ১৯৫৩ সালের ১৯ আগস্ট অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ড. মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তাকে অপসারণে অভ্যুত্থান ঘটানো হয় দুবার। প্রথমবার ঘটানো হয় ১৯৫৩ সালের ১৫ আগস্ট এবং দ্বিতীয় বার ১৯ আগস্ট। প্রথমবারের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে দ্বিতীয়বার উদ্যোগ নেয়া হয়। তাকে অপসারণে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যথাক্রমে ‘অপারেশন অ্যাজাক্স’ এবং ‘অপারেশন বুট’ সাংকেতিক নামে অভিযান পরিচালনা করে। আইসেনহাওয়ার প্রশাসন ‘অপারেশন অ্যাজাক্স’কে একটি সুদূরপ্রসারী সাফল্য হিসেবে দেখতে পায়। রাতারাতি সিআইএ মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রীয় অংশে পরিণত হয় এবং বিশ্বের ঘটনাবলীর গতিধারা নিয়ন্ত্রণে গোয়েন্দা তৎপরতা অত্যন্ত সহজ ও কার্যকর উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেক অ্যাংলো-আমেরিকান তেল কোম্পানির (এআইওসি) হিসাবপত্র পরীক্ষা এবং ইরানি তেল মজুদে কোম্পানির প্রবেশে শর্ত পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। এ অপরাধে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
গুয়াতেমালায় অভ্যুত্থান
পশ্চিম গোলার্ধে কমিউনিজমের প্রসার রোধে যুক্তরাষ্ট্র ল্যাটিন আমেরিকান দেশ গুয়াতেমালায় অভ্যুত্থান ঘটায়। ইতিমধ্যে কিউবায় সমাজতন্ত্র কায়েম এবং দেশটি সোভিয়েত বলয়ভুক্ত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল। ১৯৫৪ সালে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) গোপন তৎপরতায় গুয়াতেমালার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জ্যাকব আরবানেজ গুজম্যান ক্ষমতাচ্যুত হন এবং গুয়াতেমালা বিপ্লবের অবসান ঘটে। ‘অপারেশন পিবিসাকসেস’ সাংকেতিক নামে এ অপারেশনে কর্নেল কার্লোস কাস্টিলো আরমাসের সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ অভ্যুত্থান ছিল সে দেশে সংঘটিত উপর্যুপরি সামরিক অভ্যুত্থানের অন্যতম। অপারেশন পিবিসাকসেসের আগে পরিচালনা করা হয়েছিল ‘অপারেশন পিবিফরচুন।’ এ অপারেশন ব্যর্থ হওয়ার পর গ্রহণ করা হয় ‘অপারেশন পিবিসাকসেস।’ নিছক একটি সন্দেহ থেকে গুয়াতেমালার সংস্কারবাদী প্রেসিডেন্ট আরবানেজ গুজম্যানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। কমিউনিস্ট না হলেও সিআইএ সন্দেহ করতো যে, তিনি কমিউনিস্ট ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রীড়নক এবং পশ্চিম গোলার্ধে কমিউনিজম আমদানি করছেন। আরবানেজ সরকার গুয়াতেমালা শ্রমিক দলকে বৈধ রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ৫৮-আসনের সিনেটে তাদের আসন ছিল মাত্র চারটি। সোভিয়েত ইউনিয়ন অথবা কমিউনিজমের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। তার অপসারণ রোধে সোভিয়েত ইউনিয়ন কোনো উদ্যোগও নেয়নি। আমেরিকার কফি উৎপাদনকারী ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির (ইউএফসি) অবৈধ ভোগ দখল থেকে গুয়াতেমালার উর্বর ভূমি কেড়ে নেয়ায় আরবানেজকে চরম মূল্য দিতে হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে গুয়াতেমালার অধিগ্রহণকৃত এসব জমির প্রকৃত মূূল্য বাবদ এক কোটি ৫৮ লাখ ৫৪ হাজার ৮৫৯ ডলার পরিশোধে আরবানেজ সরকারের কাছে দাবি জানায়। আরবানেজ সরকার এ দাবিকে জাতীয় সার্বভৌমত্বের লংঘন হিসেবে নাকচ করে দেয়।
হাঙ্গেরীতে সোভিয়েত সামরিক অভিযান
পূর্ব ইউরোপের সাবেক কমিউনিস্ট দেশ হাঙ্গেরী সোভিয়েত ব্লকভুক্ত হলেও গণঅভ্যুত্থান নস্যাতে লাল ফৌজ দেশটিতে পর পর দুবার সামরিক অভিযান চালায়। ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরীর এ গণঅভ্যুত্থান ‘হাঙ্গেরী বিপ্লব’ নামেও পরিচিত। হাঙ্গেরী রিপাবলিক সরকার এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের চাপিয়ে দেয়া নীতিমালার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ বিপ্লব ঘটে। ১৯৫৬ সালের ২৩ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বিপ্লব স্থায়ী হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে নাৎসি বাহিনীকে বিতাড়িত এবং পূর্ব ইউরোপকে পদানত করার পর এটা ছিল সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে বৃহত্তম হুমকি। নেতৃত্বহীন অবস্থায় অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল। ব্যর্থ হলেও হাঙ্গেরীর অভ্যুত্থান ছিল অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং কয়েক দশক পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

কঙ্গোর প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিস লুমুম্বা হত্যাকান্ড
মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইয়ের চক্রান্তে কঙ্গোর প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিস লুমুম্বা হত্যাকা-ের শিকার হন। লুমুম্বা সামনের দরজা দিয়ে ইতিহাসে প্রবেশ করেন। কিউবার জন্য ফিদেল ক্যাস্ট্রো, মিসরের জন্য জামাল আবদেল নাসের, ঘানার জন্য নক্রুমা, চীনের জন্য চেয়ারম্যান মাও সে তুং এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য ভøাদিমির লেনিন ছিলেন যা, কঙ্গোর জন্য লুমুম্বা ছিলেন তাই।  ১৯৬১ সালের ১৭ জানুয়ারি কঙ্গোর (বর্তমান নাম ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো) গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিস ইমেরি লুমুম্বা ফায়ারিং স্কোয়াডে প্রাণ হারান। তার হত্যাকাণ্ডকে বিংশ শতাব্দীতে আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করা হয়। লুমুম্বা ১৯৬০ সালের ২৩ জুন থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮১ দিন কঙ্গোর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ঐক্যবদ্ধ কঙ্গোর সমর্থক ছিলেন এবং জাতিগত ও আঞ্চলিক ধারায় দেশ বিভক্তির বিরোধিতা করেন। দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা করতে গিয়ে তিনি দেশি ও বিদেশি চক্রান্তে প্রাণ দিয়েছেন। তার হত্যা চক্রান্তে আমেরিকার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ও ব্রিটিশ সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-৬ এবং কঙ্গোর ঔপনিবেশিক প্রভু বেলজিয়াম প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। মুভমেন্ট ন্যাশনাল কঙ্গোলিজের (এমএনসি) সম্মোহনী নেতা ও প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে লুমুম্বা ১৯৬০ সালে বেলজিয়ামের কাছ থেকে কঙ্গোর স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব দেন। কঙ্গো সংকটে এক অভ্যুত্থানে মাত্র ১২ সপ্তাহের মধ্যে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। বেলজিয়ামের সমর্থনপুষ্ট খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ কাতাঙ্গা প্রদেশের বিচ্ছিন্নতার বিরোধিতা করায় তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
কিউবায় সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন
১৯৬২ সালে কিউবায় সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়ন নিয়ে দুই পরাশক্তি পরমাণু যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল এবং ১৩ দিন পৃথিবী পরমাণু যুদ্ধের জন্য প্রহর গুনছিল। ১৯৬১ সালে কিউবায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘বে অব পিগস’ সাংকেতিক নামে একটি অভিযান এবং তুরস্ক ও ইতালিতে আমেরিকার তৈরি মাঝারি পাল্লার জুপিটার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের জবাবে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ ভবিষ্যতে যেকোনো আগ্রাসন মোকাবিলায় এ দ্বীপে পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনে কিউবার অনুরোধে একমত হন। ১৯৬২ সালের জুলাইয়ে সোভিয়েত নেতা  ক্রুশ্চেভ ও কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মধ্যে একটি গোপন বৈঠকে এ বিষয়ে ঐকমত্য হয় এবং একই বছর গ্রীষ্মের শেষদিকে কিউবায় বেশ কয়েকটি পরমাণু নিক্ষেপকারী স্থাপনা তৈরির কাজ শুরু হয়।

চেকশ্লোভাকিয়ায় সামরিক অভিযান
চেকশ্লোভাকিয়া ছিল পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘনিষ্ঠ মিত্র। তাদের কৌশলগত মিত্রতায় কখনো কখনো ফাটল দেখা দেয়। এ ফাটল রোধে সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশটিতে দুবার সামরিক অভিযান চালায়। একবার ১৯৫৬ সালে এবং আবার ১৯৬৮ সালে। চেকশ্লোভাকিয়া বলতে আজ আর কোনো দেশ নেই। দেশটি শান্তিপূর্ণভাবে ১৯৯২ সালে দুটি দেশে পরিণত হয়েছে। একটি দেশের নাম চেক প্রজাতন্ত্র এবং আরেকটির নাম সে­াভাকিয়া। সোভিয়েত হস্তক্ষেপকালে দেশ হিসেবে সে­াভাকিয়ার অস্তিত্ব না থাকলেও জাতি হিসেবে সে­াভাকদের অস্তিত্ব ছিল। চেকশ্লোভাক সংকটের মূল নায়ক আলেক্সান্ডার ডুবেক ছিলেন সে­াভাক। চেকশ্লোভাকিয়া সোভিয়েত জোটভুক্ত হলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন এ দেশে ১৯৬৮ সালে সামরিক অভিযান চালিয়েছিল।

অভ্যুত্থানে চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দে নিহত
তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে কোনো না কোনো পরাশক্তির আশীর্বাদ থাকতো। পরাশক্তির সমর্থন ছাড়া কোথাও সামরিক অভ্যুত্থান ঘটার নজির নেই। ১৯৭৩ সালে চিলিতে সংঘটিত অভ্যুত্থান হচ্ছে তার দৃষ্টান্ত এবং এ অভ্যুত্থান চিলির ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। রক্ষণশীল নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেস এবং সমাজবাদী প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দের মধ্যকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংঘাত এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের নির্দেশিত অর্থনৈতিক যুদ্ধের পরিণামে সশস্ত্র বাহিনী ও জাতীয় পুলিশ আলেন্দেকে ক্ষমতাচ্যুত করে। আলেন্দে ক্ষমতাচ্যুত হলে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল অগাস্টো পিনোশে ক্ষমতা দখল করেন। সামরিক জান্তা ১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চিলি শাসন করে। ক্ষমতা দখলকারী জান্তা চিলির কংগ্রেস ভেঙ্গে দেয় এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর কঠোর নির্যাতন চালায়। আলেন্দের হাজার হাজার সমর্থককে হত্যা করা হয়। পিনোশের স্বৈরশাসনের আগে কয়েক দশক পর্যন্ত চিলিকে গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার একটি আলোকবর্তিকা হিসেবে প্রশংসা করা হতো। চিলির অভ্যন্তরে আলেন্দে সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীলরা পিনোশে সরকারের বিরুদ্ধে একটি দুর্বল প্রতিরোধ অব্যাহত রাখে। ১৯৮৮ সালে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি গণভোটে পিনোশে অপসারিত হন।

আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসন
আফগানিস্তান পৃথিবীর এক হতভাগ্য দেশ। অতীতকাল থেকে দেশটি বাইরের শক্তির লক্ষ্যবস্তু। প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশটিতে সামরিক অভিযান চালায়। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র। যেন সে দেশে পালাক্রমে বাইরের দেশের হস্তক্ষেপ চলছে। ১৯৭৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর খ্রিস্টানদের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব বড়দিনে আফগানিস্তানে সোভিয়েত সামরিক আগ্রাসন ঘটে। এ দেশটিতে যতবার বিদেশিরা আগ্রাসন চালিয়েছে ততবার আর কোনো দেশে আগ্রাসন ঘটার নজির নেই। দৃশ্যত মনে হতো আফগান মুজাহিদরা সোভিয়েত সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। কিন্তু আফগান প্রতিরোধ আন্দোলনের চালিকা শক্তি ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে পরোক্ষ লড়াইয়ে জড়িত হয়ে পড়ে। দুর্দিনে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পাশ্চাত্যের মিত্রদের কাছে আফগান মুজাহিদরা জঙ্গি, মৌলবাদী, সন্ত্রাসী অথবা গোঁড়া বলে বিবেচিত হয়নি। অনেকের চোখ কপালেও উঠলেও একথা দিবালোকের মতো সত্য যে, মুজাহিদরা হোয়াইট হাউজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হয়। সোফায় বসে তাদের খোশগল্প করার দৃশ্য এখনো ক্যামেরাবন্দি হয়ে আছে। হোয়াইট হাউজে আফগান মুজাহিদ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট রিগ্যান বলেছিলেন: ‘হাতে বহনযোগ্য অস্ত্র নিয়ে আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে আফগান মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।’

১৯৯০ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ
১৯৯০ সালে ইরাক নিকট প্রতিবেশি কুয়েত দখল করে নিলে উপসাগরীয় সংকটের সৃষ্টি হয়। ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট থেকে ১৯৯১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ সংকট বিরাজ করে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম’ পরিচালনা করা হলে কুয়েতে ইরাকি দখলদারিত্বের অবসান ঘটে। উপসাগরীয় যুদ্ধ ছিল আসলে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সর্বাধুনিক অস্ত্রের একটি প্রদর্শনী। এ যুদ্ধে অত্যাধুনিক মার্কিন জঙ্গিবিমান এফ-১৬, এফ-১৫ ও এফ-১৮ হর্নেট এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে ব্যবহৃত ভয়াল বোমারু বিমান বি-৫২ অংশগ্রহণ করে। এছাড়া এম-১-এ-১ অ্যাবরামস ট্যাঙ্ক এবং ব্র্যাডলি সাঁজোয়া যান ব্যবহার করা হয়। সৌদি আরবে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য মোতায়েন ও সমরসজ্জার সাংকেতিক নাম ‘অপারেশন ডেজার্ট শিল্ড।’ যুদ্ধে ইরাক পরাজিত হয় এবং কুয়েতে মোতায়েন ইরাকি সৈন্যরা হয়তো আত্মসমর্পণ করে নয়তো পালিয়ে যায়। দক্ষিণাঞ্চলে শিয়া এবং উত্তরাঞ্চলে কুর্দিরা বিদ্রোহ করে। ইরাক পরাজিত হলেও প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের পতন ঘটেনি। সাদ্দাম হোসেনকে অপসারণে ২০০৩ সালের মার্চে পুনরায় দেশটিতে আগ্রাসন চালানো হয়। অতি উৎসাহী হয়ে অনেকে ভেবেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাবে। কিন্তু ¯œায়ুুযুদ্ধ বলবৎ থাকা সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়ন তার ঘনিষ্ঠ মিত্র ইরাককে রক্ষায় এগিয়ে আসেনি।

২০০৩ সালে ইরাকে আগ্রাসন
কথিত নিষিদ্ধ অস্ত্র তৈরির অভিযোগে আন্তর্জাতিক জনমত উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্র ২০০৩ সালে ইরাকে সামরিক আগ্রাসন চালায়। তার আগে আগ্রাসন চালানো হয়েছিল ১৯৯১ সালে। ১৯৯১ সালে ইরাকে সামরিক অভিযান চালানোর একটি যুক্তি ছিল। অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য যাই থাকুক, দৃশ্যত উদ্দেশ্য ছিল ইরাককে কুয়েত থেকে বিতাড়ন। কিন্তু ২০০৩ সালে দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধের কোনো যুক্তি ছিল না। আন্তর্জাতিক আইনে এ যুদ্ধ ছিল অবৈধ। জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব পরলোকগত কফি আনান ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি আভাস দিয়েছি যে, এ যুদ্ধ জাতিসংঘ সনদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং জাতিসংঘ সনদের আলোকে এ যুদ্ধ অবৈধ। তিনি দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে ইরাকের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যুদ্ধকে অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করেন।

২০০১ সালে আফগানিস্তানে হামলা
আফগানিস্তানই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে পৃথিবীর দুটি পরাশক্তি মাত্র ২২ বছরের ব্যবধানে দুবার সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে যে, আফগানিস্তানে কখনো কোনো বিদেশি দখলদার শক্তি বিজয়ী হতে পারেনি। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইর্য়কে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিশোধ গ্রহণে একই বছরের ৭ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র মিত্রদের সহায়তায় আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসন চালায়। মার্কিন সামরিক আগ্রাসনে তালেবান সরকারের পতন ঘটে এবং শীর্ষ তালেবান নেতা মোল্লা ওমর ও আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন পালিয়ে যান। যুদ্ধে মার্কিন বাহিনী নিষিদ্ধ গুচ্ছ বোমা এবং দুর্ধর্ষ কমান্ডো নেভি সীল ও গ্রীন ব্যারেট ব্যবহার করে। গুচ্ছ বোমা ব্যবহার করে শুধু প্রতিপক্ষ তালেবান নয়, পাহাড় পর্বতও ঝাঝরা করে দেয়া হয়। এ যুদ্ধ ‘আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ’ হিসেবে পরিচিত। আল-কায়েদাকে ধ্বংস এবং তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করার মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানে আল-কায়েদাকে নিরাপদে তৎপরতা চালানোর সুযোগ না দেয়া ছিল যুদ্ধের ঘোষিত লক্ষ্য। এ যুদ্ধে যুক্তরাজ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। দেশটি যুদ্ধের শুরু থেকে সামরিক তৎপরতায় সহায়তা দেয়। আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে ব্রিটেনের আচরণ কোনো মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্রের মতো মনে হয়নি। মনে হয়েছে দেশটি যেন যুক্তরাষ্ট্রের জমজ ভাই। ডাক দেয়ার আগেই হাজির। সাম্রাজ্যবাদীদের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে মুসলিম শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সত্যি। তবে একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক দেশের দাবিদার এসব দেশের মুসলিম বিদ্বেষী চেহারাও স্পষ্ট হয়ে গেছে।

কাশ্মীর গ্রাস
ব্রিটিশ ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলো শান্তিপূর্ণভাবে হয়তো পাকিস্তানে নয়তো ভারতে যোগদান করে। যেসব রাজ্যের রাজা ও প্রজার ধর্ম ছিল বিপরীত সেসব রাজ্যে গোলমাল দেখা দেয়। এসব রাজ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জুনাগড়, হায়দরাবাদ ও কাশ্মীর। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ছিল দেশীয় রাজ্যগুলোর ভারত অথবা পাকিস্তানে যোগদানের শেষদিন। ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন কাশ্মীরের মহারাজা হরিসিংকে ১৫ আগস্টের মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আহ্বান জানান। মহারাজা সিদ্ধান্ত গ্রহণে আরো সময় চান। এসময় তিনি কাশ্মীরে স্থিতাবস্থা চুক্তি স্বাক্ষরে পাকি কাশ্মীরের স্থানীয় বাহিনীকে বলা হতো স্টেট ফোর্স। মেজর জেনারেল স্কটের নেতৃত্বে এ স্টেট ফোর্সে ছিল চারটি ব্রিগেড ও আর্মি হেডকোয়ার্টার। ব্রিগেডগুলো হলো জম্মু ব্রিগেড, কাশ্মীর ব্রিগেড, মিরপুর ব্রিগেড ও পুঞ্জ ব্রিগেড। এসব ব্রিগেডে সৈন্য ছিল মাত্র ৮ ব্যাটালিয়ন। স্টেট ফোর্সে কোনো গোলন্দাজ ও সাঁজোয়া যান ছিল না। এ ক্ষুদ্র বাহিনী গিলগিট থেকে সুচেতগড় পর্যন্ত ৫ শো কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত ছিল। পাকিস্তানি উপজাতীয় গেরিলাদের অগ্রাভিযানে কাশ্মীরের এ রাজ্য বাহিনী পলায়ন করে। ১৯৪৭ সালের ২৪ অক্টোবর ভারত সরকার কাশ্মীরে পাকিস্তানিদের অভিযানের কথা জানতে পারে। ততক্ষণে ডোমেল ও মোজাফফরাবাদের পতন ঘটেছিল। পাকিস্তানিরা শ্রীনগরের দিকে ধেয়ে আসছিল। ২৪ অক্টোবর রাতে কাশ্মীরের মহারাজা হরিসিং ভারতের কাছে এসওএস সংকেত পাঠান। সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, জম্মু ও কাশ্মীর আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতে যোগদানের আগে ভারত সৈন্য পাঠাতে পারে না। তখনি মহারাজার ভারতে যোগদানের একটি চিঠি ইস্যু করা হয়। কাশ্মীরে সৈন্য প্রেরণে ভারত শুরুতেই কতগুলো প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়। শ্রীনগর ছিল ভারত সীমান্তের যে কোনো জায়গা থেকে ৪৮০ কিলোমিটার দূরে। পূর্ব পাঞ্জাবে মোতায়েন ভারতীয় সৈন্যরা ছিল শরণার্থীদের পুনর্বাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত। বিমান যোগে সৈন্য প্রেরণই ছিল একমাত্র বিকল্প। তবে শ্রীনগর বিমান বন্দর ছিল পুরোপুরি বোঝাই পরিবহন বিমান অবতরণের জন্য অযোগ্য। এ প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠার উপায় বের করা হয়। অপারেশনের সাংকেতিক নাম দেয়া হয় অপারেশন জ্যাক। ঐ সময় গোরগাঁওয়ে অবস্থানকারী লে. কর্নেল ডিআর রায়ের নেতৃত্বাধীন ফার্স্ট শিখ ব্যাটালিয়নকে সর্বপ্রথম পাঠানো হয়। ২৭ অক্টোবর দিল্লি থেকে চারটি ডাকোটা বিমান উড্ডয়ন করে এবং একইদিন ভোরে শ্রীনগরে গিয়ে পৌঁছে। ২৮ অক্টোবর প্রথম সংঘর্ষ বাধে। যুদ্ধে ভারতের পক্ষে প্রথম প্রাণ হারান লে. কর্নেল রায়।

হায়দরাবাদ গ্রাস
ব্রটিশ ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশীয় রাজ্য হায়দরাবাদের সঙ্গে স্থিতাবস্থা চুক্তি বলবৎ থাকা সত্ত্বেও ভারত ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বরে এ স্বাধীন দেশটি কেড়ে নেয়। আগ্রাসন চালানোর অজুহাত হিসাবে বলা হয়েছিল, নিজাম চুক্তি ভঙ্গ করেছেন। স্বাধীনতা রক্ষায় নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবকদের চিহ্নিত করা হয় ‘বর্বর’ হিসাবে। তাদেরকে বর্বর হিসাবে চিহ্নিত করা ছিল ভারতীয় প্রচারণার অংশ। তাদেরকে নির্দোষ হিন্দুদের হত্যা, হিন্দু মহিলাদের ধর্ষণ এবং হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুণ্ঠনের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। সমসাময়িক লেখকগণ স্বীকার করেছেন, কয়েকটি এলাকায় স্বেচ্ছাসেবকরা হিন্দুদের ওপর সহিংসতা চালিয়েছিল। তবে এ সহিংসতা ব্যাপক ছিল না। স্বেচ্ছাসেবকদের সহিংসতার অধিকাংশ ঘটনা ছিল অসত্য ও অতিরঞ্জিত।
১৩ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে উভয়পক্ষের মধ্যে বিক্ষিপ্ত লড়াই চলছিল। ৬ সেপ্টেম্বর চিলাকালু গ্রামের কাছে একটি ভারতীয় চৌকিতে স্বেচ্ছাসেবক ইউনিট ভারি গোলাবর্ষণ করে। এ হামলার জবাব দানে ভারতীয় সেনাবাহিনী আবি সিংয়ের নেতৃত্বে পুনা হর্সের এক স্কোয়াড্রন ট্যাঙ্ক এবং ২/৫ গুর্খা রাইফেলসকে পাঠায়। পুনা হর্সের ট্যাঙ্ক স্কোয়াড্রন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে হায়দরাবাদ ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে কোডরে পিছু হটিয়ে দেয়। কোডরে হায়দরাবাদ সেনাবাহিনীর প্রথম ল্যান্সারের সাঁজোয়া বহর পুনা হর্সের গতিরোধ করে। এক সংক্ষিপ্ত সংঘর্ষে পুনা হর্স হায়দরাবাদ ল্যান্সারের একটি সাঁজোয়া যান ধ্বংস করে এবং কোডরে হায়দরাবাদ রাজ্যের গ্যারিসনকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। হায়দরাবাদ দখল এবং একীভূতকরণে ভারত সরকারের নির্দেশ লাভের পর ভারতীয় সেনাবাহিনী ‘গোডার্ড পরিকল্পনা’ বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার-ইন-চিফ লে. জেনারেল গোডার্ড এ পরিকল্পনা প্রণয়ন করায় তার নামে অভিযানের নামকরণ করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী হায়দরাবাদ রাজ্যের রাজধানী আওরঙ্গাবাদের দু’দিক থেকে মূল অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পূর্বদিকে বিজয়বাড়া থেকে একটি এবং পশ্চিমদিকে শোলাপুর থেকে আরেকটি বাহিনীকে হায়দরাবাদ অভিমুখে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়। সার্বিক কমান্ড ন্যস্ত করা হয় ডিএসও লে. জেনারেল রাজেন্দ্র সিংয়ের হাতে। মেজর জেনারেল জেএন চৌধুরীর নেতৃত্বে শোলাপুর থেকে একটি বাহিনী এগিয়ে আসে। তার অধীনস্থ বাহিনীতে ছিল চারটি টাস্ক ফোর্স।
জুনাগড় গ্রাস
আরব সাগরের কূল ঘেষা জুনাগড় ছিল গুজরাটে ব্রিটিশ ভারতের একটি দেশীয় রাজ্য। তার চারদিকে ভারত। বেরাবাল বন্দরের একটি সংযোগ পথে আরব সাগরের সঙ্গে তার যোগাযোগ। জুনাগড়ের আয়তন ৩ হাজার ৩৩৭ বর্গমাইল এবং ১৯৪১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী লোকসংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৭০ হাজার ৭১৯ জন। এ রাজ্য তার ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নিয়েও টিকে থাকতে পারেনি। ভারতের সামরিক শক্তির কাছে তাকে হার মানতে হয়। আজ এ রাজ্য ভারতের গুজরাট রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। স্বকীয়তা হারিয়ে যাওয়ায় অনেকে জুনাগড়ের নামও ভুলে গেছে। কিন্তু ইতিহাসে এ রাজ্যের করুণ উপাখ্যান এখনো উজ্জ্বল। জুনাগড় রা?

আব্বাসীয় খেলাফতের পতন

৬৫৫ হিজরী রমজান মাস মোতাবেক ১২৫৭ সালে মোঙ্গল নেতা হালাগু খান আব্বাসীয় খলিফার নিকট দূত প্রেরণ করে। উদ্দেশ্য মূলতঃ মঙ্গু খানের নির্দেশ অনুযায়ী বাগদাদ দখল এবং খেলাফত ব্যবস্থা ধ্বংস করা। সুতরাং দূত যে পত্র নিয়ে যায় তাতে শব্দের তুলনায় হুমকি-ধমকি ছিলো বেশী৷ তাতে খিলাফত ছেড়ে দিয়ে তার পুত্রকে খলিফা ঘোষণা করা, বাগদাদকে মোঙ্গলদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া, এবং খলিফাকে একজন সাধারণ মানুষের মতো তার নিকট উপস্থিত হতে বলা হয়।
পত্র পাওয়ার পর খলিফা ঘৃণা ভরে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং উল্টো হালাগু খানকে ধ্বংস করে দেয়ার হুমকি দেন। এবং মোঙ্গল দূতকে অপমানিত হয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। খলিফার এমব ঔদ্ধত্যপূর্ণ জবাব দূতের অপমান বাগদাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয় এবং খিলাফত ধ্বংসের সীল মেরে দেয়া হয়। 

হালাগু খান এবার জ্যোতিষবিদদের সাথে পরামর্শ করে আক্রমনের জন্য শুভ দিন নির্ধারণ করার হুকুম দেন। তার দলে মোঙ্গল সম্রাট মঙ্গু খানের সময়কার একজন জ্যোতির্বিদ ছিলেন, তার নাম ছিলো হুসামুদ্দীন। পেশায় জ্যোতির্বিদ হলেও ধর্মের দিক দিয়ে মুসলিম ছিলেন। তিনি খেলাফত রক্ষার জন্য বারবার হালাগু খানকে ভুল ভবিষ্যদ্বানী করে আক্রমণ থেকে বিরত থাকার জন্য চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু অপরাপর জ্যোতির্বিদরা বললেন আক্রমণ শুভ এবং হালাগু খানের বিজয় নিশ্চিত। এমন দ্বিধাদ্বন্দের কারণে হালাগু খান নাসিরুদ্দিন তুসীকে ডেকে পরামর্শ চায়। এই লোক ছিলো আব্বাসীয় খিলাফতের ঘোর বিরোধী, সে এসেই তাকে সম্ভাব্য রকম উপায়ে বাগদাদ আক্রমণের জন্য প্ররোচনা করতে থাকে। 

অতঃপর ৬২৫ হিজরী মোতাবেক ১২৫৭ সালে হালাগু খান ইরানের ভিতর দিয়ে বাগদাদের দিকে অভিযান শুরু করে। এ সময় সে ইরাক সীমন্তবর্তী গোত্রগুলোকে অর্থের বিনিময়ে সৈন্যদলো যোগ করে, এবং মসুল ও পারস্য শাসকের সহোযোগিতাও লাভ করে। 

যখন খলিফা বুঝলেন আগুন ধরে গেছে তখন তিনি কুটনৈতিক পন্থায় এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালান। কোনভাবেই হালাগু খানকে তার সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে না পেরে খলিফা মুতাসিম বিল্লাহ তার বন্ধু মুআইয়িদুদ্দীন আলকামির শরণাপন্ন হন। তার কাছে সমাধান চান। এই আলকামি তাকে বুদ্ধি দেয় আপনি নিজে একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে সম্রাটের সাথে সাক্ষাৎ করুন, তবেই সমস্যার সমাধান হবে। সুতরাং সেই অনুযায়ী খলিফা হালাগু খানের নিকট দূত পাঠিয়ে নিজের ইচ্ছে ব্যক্ত করেন। তবে শর্ত দেয়, খলিফা একা আসতে পারবে না সাথে তার মন্ত্রী সভা এবং নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদেরও নিয়ে আসতে হবে। 

অতঃপর ৯০০ প্রতিনিধি দল নিয়ে খলিফা দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে হালাগু খানের তাবুতে উপস্থিত হন। তাবুটি একদম বাগদাদ প্রাচীর লাগোয়া অবস্থান করছিলো। এই দলের সাথে সেই আলকামিও ছিলো। তাবুর নিকটে যাওয়ার সাথে সাথেই প্রহরীরা প্রবেশে বাধা দেয় এবং খলিফাসহ মাত্র ১৭জনকে তাবুর ভিতরে যাওয়ার অনুমতি দেয়। এরফলে ঐ ১৭জন ছাড়া বাকী ৮৮৩ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। 

হালাগু খানের নির্দেশানুসারে-খলিফাকে ডান্ডা বেড়ী পরিয়ে বন্দী করা হয়। রাজকুমারদের হত্য করা হয়। রাজকুমারীদের বন্দী করা হয়।বায়তুল মালের সমস্ত সম্পদ দখল করা হয়। এবং বিশ্বাসঘাতক আলকামিকে দিয়ে বাগদাদ বাসীর নিকট পত্র পাঠিয়ে শহরের বাইরে ডেকে পাঠানো হয়। শহরের প্রতিটি নারী, শিশু, বৃদ্ধ, এবং আলেমদের হত্যা করা হয়। বিশেষ করে সুন্নী মতার্দর্শী আলেমদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করা হয়। এসময় খলিফা ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ অবলোকন করেন এবং বুঝতে পারেন আলকামির মতো বিশ্বাসঘাতকের কারণেই আজকের এই দশা। 

টানা ৪০দিন ব্যাপী শহরটাকে ধ্বংস করে একে শ্মশানে পরিণত করা হয়। ৫০০ বছর ধরে তিলে তিলে গড়া সভ্যাতার অপার নিদর্শন বাগদাদ নগরী নিমিষেই শেষ হয়ে যায়।

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ

৩ ডিসেম্বর পাক-ভারত সর্বাত্মক যুদ্ধ বেধে গেলে পাকিস্তানি সৈন্যরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ৭ ডিসেম্বর ষোড়শ ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ এবং ৯ ডিসেম্বর ৩৯তম এডহক ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল আবদুর রহিম খান আক্রান্ত হন। অলৌকিকভবে জেনারেল নজর রক্ষা পান। মিত্রবাহিনী নিকটবর্তী প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেঙ্গে ফেললে জেনারেল রহিম তার সদরদপ্তর নিয়ে চাঁদপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। পিছু হটার সময় তার কয়েকটি ফেরি চরায় আটকা পড়ে। তার পশ্চাদপসরণ বিলম্বিত হয়। নারায়ণগঞ্জের দিকে পিছু হটার সময় তার উপর ভারতীয় বিমান হামলা হয়। জেনারেল রহিমের সদরদপ্তর সম্বলিত নৌযান নিমজ্জিত হয়। ভারতীয় বিমান হামলায় কয়েক শো পাকিস্তানি সৈন্য ও অফিসার নিহত হয়। ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে অভিযানে অংশগ্রহণকারী মেজর বিলাল এখানেই প্রাণ হারান। জেনারেল রহিমও আহত হন। ১৩ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে উত্তপ্ত আলোচনা শুরু হয়। আমেরিকানরা যুদ্ধবিরতি এবং তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এ প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করে। তবে রুশরা ভারতকে জানিয়ে দেয় যে, তারা আর কোনো ভেটো প্রয়োগ করবে না। রাশিয়ার এ ইঙ্গিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাইকমান্ড উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে। পূর্ব পাকিস্তানের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ভারতীয়দের হাতে সময় ছিল খুব সামান্য। ভারতীয় হাইকমান্ডের পরিকল্পনা ছিল প্রথমে খুলনা ও চট্টগ্রাম বন্দরের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। সে লক্ষ্যে ভারতীয় সেনাসদর দপ্তর থেকে চট্টগ্রাম ও খুলনা বন্দর দখলের নির্দেশ দেয়া হয়। ১৪ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ নিঃশর্তে আত্মসমর্পণের জন্য বেতারযোগে চরমপত্র দেন। তবে তিনি এ চরমপত্র দিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে লক্ষ্য করে। বিবিসির একটি ভুল সংবাদের ভিত্তিতে তিনি এ ভুল করেন। বিবিসির সংবাদে বলা হয়েছিল যে, জেনারেল নিয়াজি পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে গেছেন এবং ফরমান আলী দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তাই তিনি তার উদ্দেশ্যে প্রেরিত বেতার বার্তায় বলেন, ‘রাও ফরমান আলী কা পয়গাম হে। হাতিয়ার ঢাল দো।’ ঢাকার আকাশে বিমান থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করার জন্য লাখ লাখ প্রচারপত্র নিক্ষেপ করা হয়। জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণে রাজি ছিলেন না। ১৫ ডিসেম্বর মধ্যরাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সম্মতিতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধানের শর্তে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে জেনারেল নিয়াজির কাছে একটি বার্তা পাঠান। 
    ১৪ ডিসেম্বর ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সৈন্যরা টঙ্গী এবং ১৬ ডিসেম্বর সকালে সাভারে এসে পৌঁছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল নাগরা মিরপুর ব্রীজে এসে পৌঁছে নিয়াজিকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানিয়ে তার কাছে একটি চিরকুট পাঠান। এ চিরকুট পেয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩৬তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল জামশেদ তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে আসেন। মেজর জেনারেল নাগরার সঙ্গে ছিলেন কাদের সিদ্দিকী। নিয়াজি ও নাগরা উভয়ে ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একই ব্যাচের অফিসার। পাকিস্তান বাহিনীতে নিয়াজি লে. জেনারেল র‌্যাঙ্কে উন্নীত হলেও নাগরা ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল র‌্যাঙ্কের অফিসার। নিয়াজির সদরদপ্তরে উভয়ে পাশাপাশি বসেন। নিয়াজি তাকে জিজ্ঞেস করেন তিনি উর্দু কবিতা বুঝেন কিনা। জবাবে নাগরা জানান, তিনি লাহোর সরকারি কলেজ থেকে ফার্সীতে এমএ পাস করেছেন। নাগরা নিয়াজির চেয়ে বেশি শিক্ষিত হওয়ায় তিনি তার সঙ্গে পাঞ্জাবী ভাষায় রসিকতা করতে শুরু করেন। জেনারেল নাগরা নিয়াজির কাছ থেকে বিদায় নেয়ার আগেই বেলা ১টায় জেনারেল জ্যাকব হেলিকপ্টারে চড়ে ঢাকায় আসেন। কুর্মিটোলা বিমান বন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানান জেনারেল নিয়াজির চীফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকী। বাকির সিদ্দিকীর সঙ্গে তার আলোচনা হয়। আত্মসমর্পণের শর্ত নিয়ে তার সঙ্গে ঐকমত্য না হওয়ায় তিনি জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন। নিয়াজি প্রকাশ্যে আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জানান। তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে তার অফিসে আত্মসমর্পণের আয়োজন করার জন্য পীড়াপীড়ি করেন। জেনারেল জ্যাকব তার প্রস্তাব নাকচ করে দেন। নিয়াজি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পরিবর্তে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করতে চাইছিলেন। জ্যাকব তাও নাকচ করে দেন। তিনি নিয়াজিকে ভেবে দেখার জন্য ৩০ মিনিট সময় দিয়ে বাইরে বের হয়ে যান। ফিরে এসে তিনি তার টেবিলে আত্মসমর্পণের দলিলটি পেশ করেন। তিন মিনিট কোনো জবাব না দেয়ায় জ্যাকব তার হাত থেকে দলিলটি নিয়ে বলেন, আমি ভারতীয় হাইকমান্ডকে বলবো, আপনি দলিলটি পাঠ করেছেন এবং তাতে স্বাক্ষর দানে সম্মতি দিয়েছেন। জ্যাকবের চাপে নিয়াজি তার শর্তেই আত্মসমর্পণে রাজি হন।
 পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতীয় বিমান ঘাঁটিগুলোতে সফল বোমাবর্ষণের সংবাদ পেয়ে ৪ ডিসেম্বর ইস্টার্ন কমান্ডের পাকিস্তানি সৈন্যরা উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। তারা ভাবছিল অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে তাদের পরিত্রাণ ঘটবে। কিন্তু সেদিন খুব সৈন্যই ভাবতে পেরেছিল যে, তাদের সামনে চরম দুঃসময় অপেক্ষা করছে। তাদেরকে জানানো হয়েছিল, পশ্চিম রণাঙ্গনে চাম্ব ও অমৃতসর দখল করে নেয়া হয়েছে। কিন্তু একসময় তাদের কাছে এ নিষ্ঠুর পরিহাস ধরা পড়ে। ৭ ডিসেম্বর যশোরের পতন ঘটলে তাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তান বিপন্ন হওয়ার সংবাদ পেয়ে পূর্ব রণাঙ্গনে তারা নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করে।   

আত্মসমর্পণের দলিল 
আত্মসমর্পণ দলিলে বল হয়ঃ
`The Pakistan Eastern Command agrees to surrender all Pakistan Armed Forces in Bangladesh to Lieutenant General Jagjit Sing Aurora, General Officer Commanding-in-Chief of the Indian and Bangladesh forces in the Eastern Theatre. This surrender includes all Pakistanland, air and naval forces as also para-military forces and civil armed forces. The forces will lay down their arms and surrender at the places where they are currently located to the nearest regular troops under the command of Lieutenant General Jagjit Singh Aurora.
The Pakistan Eastern Command shall come under the orders of Lieutenant General Jagjit Singh Aurora as soon as the Instrument has been signed. Disobedience of orders will be regarded as a breach of surrender terms and will be dealt with in accordance with the accepted laws and usages of war. The decision of Lieutenant General Jagjit Sing Aurora will be final, should any doubt arise as to the meaning or interpretation of the surrender terms.
Lieutenant General Jagjit Singh Aurora gives a solemn assurance that personnel who surrender shall be treated with the provision of Geneva Convention and guarantees safety and well-being of all Pakistanmilitary and para-military forces who surrender. Protection will be provided to foreign nationals, ethnic minorities and personnel of West  Pakistan origin by the forces under the Command of Lieutenant General Jagjit Singh Aurora.'
(Signatories)
1. Jagjit Singh Aurora
Lieutenant General
General Officer Commanding in-Chief
Indian and BangladeshForces in the Eastern Theatre
2. Amir Abdullah Khan Niazi
Lieutenant General
Martial Law Administrator
Zone `B' and Commander Eastern Command (Pakistan)

‘বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণে সম্মত হচ্ছে। পাকিস্তানের সকল স্থল, বিমান ও নৌ বাহিনী এবং সকল আধাসামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী এই আত্মসমর্পণের আওতায় পড়বে। বর্তমানে এ বাহিনীর যে যেখানে অবস্থান করছে সেখানে তারা লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কমান্ডের আওতায় নিকটবর্তী নিয়মিত সৈন্যদের কাছে তাদের অস্ত্র সমর্পণ এবং আত্মসমর্পণ করবে। আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ড লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নির্দেশের আওতায় চলে আসবে। নির্দেশ অমান্যকে আত্মসমর্পণের শর্ত ভঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করা হবে এবং অনুমোদিত আইন ও যুদ্ধের রীতিনীতি অনুযায়ী কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হবে। আত্মসমর্পণের শর্তাবলী ও ব্যাখ্যা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ দেখা দিলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার সিদ্ধান্ত হবে চূড়ান্ত। 
লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা যেসব সৈন্য আত্মসমর্পণ করবে জেনেভা কনভেনশনের ধারা অনুযায়ী সৈন্য হিসাবে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান এবং পাকিস্তান সশস্ত্র ও আধাসামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণকারী সকল সদস্যের নিরাপত্তা ও কল্যাণের নিশ্চয়তা প্রদানের দৃঢ় আশ্বাস দিচ্ছেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার অধীন সৈন্যরা বিদেশী নাগরিক, জাতিগত সংখ্যালঘু ও পশ্চিম পাকিস্তান বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের নিরাপত্তা প্রদান করবে।’
(স্বাক্ষরকারীদ্বয়) 
১. জগজিৎ সিং অরোরা 
লেফটেন্যান্ট জেনারেল
 পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়ক
 ২. আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি
লেফটেন্যান্ট জেনারেল
সামরিক আইন প্রশাসক
জোন ‘বি’ এবং ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার (পাকিস্তান) 
১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯ টায় বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করার কথা ছিল। জেনারেল জ্যাকবের সঙ্গে আলোচনা করেই সময় ৬ ঘণ্টা বৃদ্ধি করা হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা কোথায়, কিভাবে এবং কখন আত্মসমর্পণ করবে সে পরিকল্পনা জ্যাকবই করেছিলেন। বেলা ২টা ৪৫ মিনিটে জেনারেল নিয়াজি অনুস্বাক্ষর করলে আত্মসমর্পণ দলিলে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরের সময়সূচি নির্ধারণ করা হয় বিকাল ৪ টা ৩০মিনিটে। ব্রিগেডিয়ার সাহবেগ সিং ও তার সাতজন সহযোগী আত্মসমর্পণের মঞ্চ প্রস্তুত করেন। জ্যাকবের সঙ্গে ছিলেন ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল অরোরা। অরোরার সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী ভান্তি কাউর। বিমান বন্দরে ভারতীয় ও পাকিস্তানি সৈন্যরা অরোরাকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। একটি সামরিক জীপ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি ও তার সহযোগীদের নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে এসে থামে। সামরিক জীপ দেখে জেনারেল অরোরা ও তার লোকজন উড়ে দাঁড়ান। চোস্ত সামরিক কায়দায় দু’জেনারেল একে অন্যকে স্যালুট করেন। বিশাল বটগাছের নিচে একটি টেবিলের পাশে দু’টি চেয়ার পাতা। একটিতে বসেন অরোরা এবং অন্যটিতে নিয়াজি। একজন ভারতীয় সেনা অফিসার টেবিলের উপর আত্মসমর্পণের দলিল পেশ করেন। তাতে প্রথমে স্বাক্ষর করেন নিয়াজি এবং পরে অরোরা। সময় ছিল তখন বিকাল ৪টা ৩১ মিনিট। এরপর হোলস্টার থেকে নিয়াজি তার পিস্তল বের করে টেবিলের উপর রাখেন। তিনি আত্মসমর্পণের প্রতীক হিসাবে অরোরার কাছে ৩৮ নম্বর খচিত পয়েন্ট থ্রি এইট ক্যালিবারের নিজের পিস্তল তুলে দেন এবং ব্যাজ ও বেল্ট খুলে ফেলেন। দু’জেনারেল করমর্দন করেন এবং একে অন্যের সঙ্গে আলিঙ্গন করেন। এসময় তাদের উভয়ের চোখ ছিল অশ্র“সজল। উভয় জেনারেল আবার উড়ে দাঁড়ান এবং একে অন্যকে স্যালুট করেন। 
আত্মসমর্পণ দলিল স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ থেমে যায় এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসাবে স্বাধীন বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করে। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ভারতের পক্ষে অরোরা ছাড়া আরো উপস্থিত ছিলেন পূর্বাঞ্চলীয় নৌ কমান্ডের কমান্ডার ভাইস এডমিরাল এন. কৃষ্ণ, অষ্টম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল কে. ভি. কৃষ্ণ রাও (পরবর্তীতে ভারতের সেনাপ্রধান), পূর্বাঞ্চলীয় এয়ার কমান্ডের প্রধান এইচসি দেওয়ান, চতুর্থ কোর কমান্ডার লে. জেনারেল সগৎ সিং, ইস্টার্ন কমান্ডের চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জেএফআর জ্যাকব এবং ১০১তম কমিউনিকেশন জোনের কমান্ডার মেজর জেনারেল গন্ধর্ব নাগরা। বাংলাদেশ পক্ষে উপস্থিত ছিলেন গ্র“প ক্যাপ্টেন একে খন্দকার, ৩ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর সফিউল্লাহ, ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এটিএম হায়দার, বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী প্রমুখ। পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করায় হাজার হাজার মানুষ আনন্দে ফেটে পড়ে। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির মধ্য দিয়ে সৈন্যরা অরোরাকে কাঁধে তুলে নেয়। জনতার ভয়ে নিয়াজি দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের পর ৯৩ হাজারের বেশি পাকিস্তানিকে বন্দি করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার অরোরাকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করে। 
ঢাকার বাইরে অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সৈন্যরা নিকটবর্তী ভারতীয় সেনা কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ঝিনাইদহে পাকিস্তানের নবম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল এমএইচ আনসারী আত্মসমপর্ণ করেন ভারতের চতুর্থ মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল এমএস ব্রার কাছে, নাটোরে ষোড়শ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ আত্মসমর্পণ করেন ২০তম মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল লক্ষèণ সিংয়ের কাছে এবং চতুর্দশ ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল কাজী আবদুল মজিদ ভারতের ৫৭তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল বিএস গঞ্জালভেসের কাছে পিস্তল হস্তান্তর করে আত্মসমর্পণ করেন। 
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করলেও শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন প্রহরায় নিয়োজিত সৈন্যরা নিয়াজির নির্দেশ পালনে অস্বীকৃতি জানায়। ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর দু’জন ব্রিগেডিয়ার, ৪/৫ জন মেজর ও প্রায় দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্যের ঘেরাওয়ের মধ্যে তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। মিরপুরের সশস্ত্র অবাঙালি মিলিশিয়ারাও অস্ত্র সমর্পণ করতে রাজি হয়নি। তাদেরকে নিরস্ত্র করতে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মেজর মইনুল হোসেনের নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টকে মিরপুরে পাঠানো হয়। বিদ্রোহী বিহারীদের সঙ্গে ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের ভয়াবহ লড়াইয়ে ৩৯ জন সৈন্য নিহত হয়। কোনো একক লড়াইয়ে আর কখনো বাংলাদেশকে এত সৈন্য হারাতে হয়নি। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের কোম্পানি কমান্ডার লে. হেলাল মোর্শেদ খান আহত হন। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব জহির রায়হান রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যান। তিনি তার সহোদর শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজে বের করতে গিয়েছিলেন। কয়েকদিন পর কয়েকজন ভারতীয় সৈন্যের সঙ্গে জহির রায়হানের লাশ পাওয়া যায়। মতাদর্শগতভাবে তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট। কলকাতায় অবস্থানকালে জহির রায়হান আওয়ামী লীগ নেতাদের কর্মকান্ডের বেশ কিছু বিতর্কিত ছবি তুলেছিলেন। এসব ছবি নিয়ে তিনি ‘স্টপ জেনোসাইড’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন। এ চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়াই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ১৬ ডিসেম্বরের পরবর্তী দু’দিন পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্যরা নিজ নিজ অস্ত্র বহন করার সুযোগ পেয়েছিল। ভারতীয়রা তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছিল। তবে ধীরে ধীরে তাদের আচরণ রুক্ষ হতে থাকে। 
বাংলাদেশী ও ভারতীয় সূত্রের হিসাব অনুযায়ী পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের সহযোগীসহ ৯৩ হাজার লোক ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করে। বন্দিদের মধ্যে ৭৯ হাজার ৬৭৬ জন ছিল ইউনিফর্মধারী। ইউনির্ফমধারীদের মধ্যে ৫৫ হাজার ৬৯২ জন ছিল সেনাবাহিনীর সদস্য, ১৬ হাজার ৩৫৪ জন আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য, ৫ হাজার ২৯৬ জন ছিল পুলিশ বাহিনীর সদস্য, এক হাজার ছিল নৌসেনা এবং ৮ শো ছিল বিমান বাহিনীর সদস্য। বাদবাকি বন্দিরা ছিল হয়তো পাকিস্তানি সৈন্যদের পরিবারের সদস্য নয়তো সহযোগী। হামুদুর রহমান কমিশনের তালিকা অনুযায়ী বন্দিদের সংখ্যা ছিল নিম্নরূপ:
শাখাবন্দির সংখ্যা
সেনাবাহিনী                          ৫৪ হাজার ১৫৪
নৌবাহিনী                             ১ হাজার ৩৮১
বিমান বাহিনী                                  ৮৩৩
পুলিশসহ আধাসামরিক বাহিনী     ২২ হাজার
বেসামরিক লোক                     ১২ হাজার

পূর্ব রণাঙ্গনে ৮ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়। পাকিস্তানি হিসাবে ১১৫ জন অফিসার, ৪০ জন জেসিও এবং অন্যান্য র‌্যাঙ্কের ১ হাজার ১৮২ জন সৈন্য নিহত হয়। ভারতের হিসাব অনুযায়ী সাড়ে চার হাজার পাকিস্তানি সৈন্য নিহত এবং আরো চার হাজার সৈন্য আহত হয়। ভারতের পক্ষে নিহত হয় ১ হাজার ৪২১ জন, আহত হয় ৪ হাজার ৫৮ জন এবং নিখোঁজ হয় ১৫৬ জন। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে নিহত হয় ২ হাজার ৮৪৩ জন। ২০ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজি ও তার উর্ধ্বতন কমান্ডারদের বিমানে করে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিখা অনির্বাণ প্রজ্জ্বলন করা হয়। ভারতে দিবসটিকে ইস্টার্ন কমান্ড দিবস হিসাবে পালন করা হয়।

ঢাকায় ভারতীয় সৈন্য
১৬ ডিসেম্বরের পর রাজধানী ঢাকাসহ সর্বত্র ছিল শুধু ভারতীয় সৈন্য। বাংলাদেশ ভারতীয় সৈন্যরা দখল করে নিয়েছে কিনা এমন কথা বলাবলি শুরু হয়। প্রথমেই মেজর জেনারেল নাগরার নেতৃত্বে এক ডিভিশন ভারতীয় সৈন্য ঢাকায় প্রবেশ করে। তারপর ভারতের ৫৭তম মাউন্টেন ব্রিগেড অবস্থান গ্রহণ করে জাতীয় সংসদ ভবনের উল্টোদিকে মনিপুরী পাড়ায়। এভাবে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশ ভারতীয় সৈন্যে ছেয়ে যায়।। বাংলাদেশ-ভারত ২৫ বছর মেয়াদী মৈত্রী চুক্তির আওতায় ১৯৭২ সালের ১৩ মার্চ বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়।
মিত্রবাহিনীর ছদ্মাবরণে ভারতীয় সৈন্যরা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অবস্থানকালে অবাধে লুণ্ঠন চালায়। পাকিস্তানি সৈন্যদের সমর্পিত সকল সমরাস্ত্র তারা সীমান্তের বাইরে পাচার করে। নিঃসন্দেহে এসব অস্ত্র ছিল বাংলাদেশের প্রাপ্য। পাকিস্তানি সৈন্যদের সমর্পিত অস্ত্র ভারতে পাচারের বিরুদ্ধে মেজর জলিল ছাড়া আর কোনো মুক্তিযোদ্ধা রুখে দাঁড়াননি। কেউ প্রতিবাদ করেননি। ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো সরকার পাকিস্তানি সৈন্যদের ফেলে যাওয়া সমরাস্ত্র ফেরত দেয়ার জন্য ভারতের কাছে দাবি করেনি। ভারতীয়রা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের প্রতীক জেনারেল নিয়াজির সামান্য বেল্ট, ব্যাজ, পিস্তল ও মার্সিডিজ গাড়ি তুলে নেয়ার লোভ সংবরণ করতে পারেনি। আত্মসমর্পণ করার সময় শুধুমাত্র ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের অক্ষত ট্যাংক ছিল ৫০টি এবং কামান ছিল ৭ শো। এসব ভারি অস্ত্রের কোনোটাই ভারতীয়রা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেনি। সর্বাত্মক যুদ্ধকালে বাংলাদেশের সীমান্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এ সুযোগে টয়লেট সামগ্রী থেকে শুরু করে সবই লুণ্ঠন করে তারা নিজ দেশে নিয়ে যায়। ভারতে বিদেশী সামগ্রী আমদানির সুযোগ সীমিত থাকায় ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশ থেকে বিদেশী সামগ্রী নিজ দেশে নিয়ে যেতে প্রলুদ্ধ হয়। কী পরিমাণ সম্পদ তারা লুণ্ঠন করেছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান বের করা কঠিন। অটল জীপ ও শক্তিমান ট্রাকে করে লুণ্ঠিত মালামাল ভারতে পাচার করা হয়। ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল বাধা দেয়ায় তাকে গ্রেফতার করে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্যদের লুণ্ঠনের ব্যাপারে ‘বাংলাদেশ পাস্ট এন্ড প্রেজেন্ট’ পুস্তকে সালাহউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, After the war was over, India was criticised for overstaying in the Chittagong Hill Tracts. It was also alleged that the Indian army removed by convey of trucks large amounts of arms, ammunitions and machinery from Bangladesh. As a result, tension and suspicion grew up against India’s policy towards Bangladesh, apprehending that Indiawanted to turn Bangladeshinto a client state and not a self-respecting independent state.’
‘যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর ভারতীয় সৈন্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিক সময় অবস্থান করতে থাকায় ভারত সমালোচিত হতে থাকে। অভিযোগ উঠে যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী ট্রাক বহরে করে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও সাজসরঞ্জাম সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার ফলে বাংলাদেশকে আত্মমর্যাদাশালী রাষ্ট্রের পরিবর্তে ভারত একটি তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায় এমন একটি আশংকা দেখা দেয়। তাতে ভারতীয় নীতির বিরুদ্ধে উত্তেজনা ও সংশয় সৃষ্টি হয়।’  
    মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক জনাব জয়নাল আবেদীনের ‘র’ এন্ড বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি বইয়েও বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্যদের লুন্ঠনের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। বইটিতে তিনি লিখেছেন, The real Indian face lay bare after the surrender of Pakistani forces, when I saw the large scale loot and plunder by the Indian Army personnel. The soldiers swooped on everything they found and carried them away to India. Curfew was imposed on our towns, industrial bases, ports, cantonments, commercial centres and even residential areas to make the looting easier.They lifted everything from ceiling fans to military equipment, utensils to water taps. Thousands of Army vehicles were used to carry looted goods to India.
‘‘পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের পর ভারতীয় সৈন্যদের ব্যাপক লুটতরাজ দেখতে পেয়ে ভারতের প্রকৃত চেহারা আমার কাছে নগ্নভাবে ফুটে উঠে। ভারতীয় সৈন্যরা যা কিছু দেখতে পেতো তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তো এবং সেগুলো ভারতে বহন করে নিয়ে যেতো। লুটতরাজ সহজতর করার জন্য তারা আমাদের শহর, শিল্প স্থাপনা, বন্দর, সেনানিবাস, বাণিজ্যিক কেন্দ্র এমনকি আবাসিক এলাকায় কারফিউ জারি করে। তারা সিলিং ফ্যান থেকে শুরু করে সামরিক সাজসরঞ্জাম, তৈজষপত্র ও পানির টেপ পর্যন্ত উঠিয়ে নিয়ে যায়। লুণ্ঠিত মালামাল ভারতে পরিবহনের জন্য হাজার হাজার সামরিক যান ব্যবহার করা হয়।’ বইটির আরেকটি অংশে তিনি লিখেছেন, Through the independence war of Bangladesh India was immensely benefited economically, militarily, strategically and internationally. So India involved in our war of liberation for its own interest, not for us
 ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভারত অর্থনৈতিক, সামরিক, কৌশলগত ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক লাভবান হয়েছে। এ কারণে দেশটি তার নিজের স্বার্থে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে স¤পৃক্ত হয়, আমাদের স্বার্থে নয়।’ 
    সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে ভারতে সম্পদ পাচার সম্পর্কে আট নম্বর সেক্টরে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসাবে অংশগ্রহণকারী মেজর জেনারেল খোন্দকার মো: নূরন্নবী (অব:) তার ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে সেক্টর আট নামে বইয়ের ১৬৪/১৬৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘সীমান্ত খোলা পেয়ে ভারতীয় মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন এলাকায় ঢুকে পড়ে এবং স্থানীয় বাজার ও দোকানপাট থেকে সব বিদেশী মালামাল বিশেষ করে রেডিও, টেলিভিশন, খুচরা যন্ত্রাংশ, বিদেশী ওষুধপত্র অর্থাৎ যা কিছু বিদেশী সব কিনে নিচ্ছিল। এমনকি পাকিস্তানি ধাতবমুদ্রাও। এটা আমাদের জন্য একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এসময় সেক্টর কমান্ডার মেজর এমএ মঞ্জুর আমাদের এলাকায় এলেন। আমরা তাকে এ বিষয়ে অবহিত করলাম। তিনি জানালেন যশোরেও একই অবস্থা। সেক্টর কমান্ডার মাড়োয়ারীদের এ ব্যবসার ব্যাপারে ভারতের চতুর্থ মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল ব্রার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জেনারেল ব্রার সেক্টর কমান্ডারকে জানান যে, এদের নিয়ে সবাই অতিষ্ঠ।’
    বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্যদের লুন্ঠনের ব্যাপারে কানাডা প্রবাসী আজিজুল করিম ‘হোয়াই সাচ এন্টি-ইন্ডিয়ান ফিলিংস এমং বাংলাদেশী?’ শিরোনামে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে ‘অনিক’-এর রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, ‘ভারতীয় সৈন্যদের লুণ্ঠিত মালামালের মূল্য ছিল প্রায় ১ শো কোটি মার্কিন ডলার।’ বিএনপি সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী ড. কামাল সিদ্দিকী ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭২ সালে তিনি খুলনার ডিসি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সে সময় তিনি বাংলাদেশ ও ভারত উভয় সরকারের কাছে লিখিত পত্রে বলেন, ভারতীয় সৈন্যরা তার জেলা থেকে কোটি কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতি, যানবাহন ও সাজসরঞ্জাম স্থানান্তর করে ফেলেছে। মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী অভিযোগ করেছিলেন, ভারতীয় সৈন্য ও চোরাচালানীরা বাংলাদেশ থেকে ৬ হাজার কোটি রুপি মূল্যের সামগ্রী ভারতে পাচার করেছে। অরোরার পদোন্নতি না ঘটা হচ্ছে বাংলাদেশে ভারতীয় সৈনদের লুণ্ঠনের আরেকটি বড় প্রমাণ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের পহেলা জানুয়ারি ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশকে ফিল্ড মার্শাল পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। যে যুক্তিতে মানেকশর পদোন্নতি ঘটেছিল একই যুক্তিতে অরোরারও পদোন্নতি ঘটার কথা ছিল। পদোন্নতি ঘটলে মানেকশর পরে তিনি হতেন ভারতের পরবর্তী সেনাপ্রধান। কিন্তু তার কপালে পদোন্নতি ঘটেনি। মানেকশ অবসরে যাবার পর লে. জেনারেল জি. জি. বেবুর ভারতের সেনাপ্রধান হিসাবে নিযুক্তি পান। বাংলাদেশ যুদ্ধে বিজয়ী মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক অরোরাকে লে. জেনারেল র‌্যাঙ্ক থেকেই বিদায় নিতে হয়। বাংলাদেশে অবস্থানকালে তিনি সৈন্যদের মধ্যে শৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ায় তার পদোন্নতি ঘটেনি। অরোরার প্রতি অবিচার করার সত্যতা মানেকশ নিজেও স্বীকার করেছেন। একবার তিনি মন্তব্য করেছিলেন, Jaggi did the work, but I got the baton ‘বাংলাদেশ যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার কাজটি করেছেন জগি বা জগজিৎ। কিন্তু ফিল্ড মার্শালের ব্যাটন পেলাম আমি।’ 
ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল অরোরা ও তার সহযোগী মেজর জেনারেল জ্যাকবের সঙ্গে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশর কথাবার্তায়ও বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনীর লুটপাটের প্রমাণ পাওয়া যায়। এব্যাপারে জ্যাকব তার ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা: বার্থ অব অ্যা নেশন’-এ (বাংলা অনূদিত গ্রন্থের ১২৮ পৃষ্ঠা) লিখেছেন, ‘আমি মানেকশ বললাম, আমাদের সৈন্যরা যত তাড়াতাড়ি বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাবর্তন করবে ততই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক। কারণ ইতিমধ্যে তাদের কার্যকলাপ নিয়ে অভিযোগ আসতে শুরু করেছে। তার কয়েকদিন পর সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ আমাকে টেলিফোনে প্রশ্ন করেন, আপনি কি পাকিস্তানি সৈন্যদের রসদ লুট হওয়ার গুজব শুনতে পেয়েছেন? আমি বললাম, এটা গুজব। আর কিছু নয়। তিনি জানতে চাইলেন, তাহলে আমি কী শুনেছি? আমি বললাম, আমি গুজব ছড়াই না। তারপর তিনি অরোরার সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেন। পরদিন জেনারেল মানেকশ লুটপাটের গুজব তদন্ত করতে আমাকে ঢাকা যাবার নির্দেশ দেন। সেদিনই আমি ঢাকা গিয়ে কমান্ডার ও স্টাফ সদস্যদের সঙ্গে কলকাতা ও দিল্লিতে লুটপাটের যে গুজব পৌঁছেছে সে সম্পর্কে জানতে চাই। তবে এসব অভিযোগ তারা অস্বীকার করেন।’ 
মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান অস্বীকার 
পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমপর্ণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানীকে যোগদান করার সুযোগ না দিয়ে ভারতীয়রা মুক্তিযুদ্ধের পুরো কৃতিত্ব কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে। আত্মসমর্পণ দলিলে একদিকে স্বাক্ষর করেছেন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল নিয়াজি এবং অন্যদিকে স্বাক্ষর করেছেন ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল অরোরা। বাংলাদেশ যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ হওয়া সত্ত্বেও দেশটি এ দলিলের স্বাক্ষরদাতা নয়। বাংলাদেশকে এ ঐতিহাসিক দলিলে স্বাক্ষর দানের সুযোগ না দিয়ে ভারত ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধ হিসাবে চিহ্নিত করার অশুভ প্রয়াস চালিয়েছে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক কর্মকর্তা বি রমনের বইয়ের একটি উক্তি তার প্রমাণ। সাংবাদিক মাসুমুর রহমান খলিলী ও একরামুল্লাহিল কাফির যৌথ উদ্যোগে ‘র’ এর কাওবয়েরা’ নামে তার বইয়ের বাংলা অনুবাদের ১৪ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘ফিল্ড মার্শাল এসএইচএফজে মানেকশর নেতৃত্বে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী এবং পরলোকগত কে. এফ. রুস্তমজীর নেতৃত্বে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফ’র প্রকাশ্য এবং ‘র’ ও ইন্টেলিজেন্স বুুু্যুরোর গোপন কর্মকান্ড বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। তবে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যে নেতৃত্ব দিয়েছেন তা না হলে এ প্রচেষ্টায় সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হতো না।’ 
ভারত সরকার নিজেও ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে তাদের নিজস্ব যুদ্ধ হিসাবে বিবেচনা করে এবং যুদ্ধে বিজয় লাভের জন্য গৌরবান্বিত বোধ করে। এ যুদ্ধ সম্পর্কে ভারতের সংরক্ষিত সরকারি দলিলের ভূমিকায় ড. এস এন প্রসাদ লিখেছেন, India won a glorious victory against Pakistan in 1971 war. It was the first decisive victory in a major war in centuries. And it was won singlehandedly in the face of opposition and threats from a majority of the UN member states, including a super power. Every Indian felt proud of this glittering chapter in the nation’s history.

‘ভারত ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গৌরবময় বিজয় অর্জন করে। কয়েক শতাব্দীর মধ্যে এটা ছিল প্রথম চূড়ান্ত নিষ্পত্তিকারী বিজয়। একটি পরাশক্তিসহ জাতিসংঘের অধিকাংশ সদস্য দেশের বিরোধিতা ও হুমকির মুখে এককভাবে এ বিজয় অর্জিত হয়। জাতির ইতিহাসের এ উজ্জ্বল অধ্যায়ের জন্য প্রতিটি ভারতীয় গৌরব বোধ করে।’ ভারতীয় লেখক ড. সুভাষ কাপিলা তার ‘দ্য বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশীপ ট্রিটি’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে লিখেছেন, In India’s post-independence political and military history, December 16, 1971 was India’s finest hour. ‘স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ও সামরিক ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর হচ্ছে ভারতের উজ্জ্বলতম মুহূর্ত।’ লে. জেনারেল জ্যাকব তার ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা: বার্থ অব অ্যা নেশন’-এ (বাংলা অনুবাদ ১৩৪ পৃষ্ঠা) মন্তব্য করেছেন,‘ ইন্দিরা গান্ধী জাতিকে এক মহান সামরিক বিজয় এনে দিয়েছেন যা আমাদের সম্মান পুনরুদ্ধার করে এবং ভারতকে আঞ্চলিক পরাশক্তির মর্যাদা এনে দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইন্দিরা গান্ধীর শ্রেষ্ঠ কীর্তি।’  
    মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের প্রতি ভারতীয়রা অবজ্ঞা প্রদর্শন করায় মুক্তিযোদ্ধারাও ব্যথিত। এ ব্যাপারে ৩ নম্বর সেক্টরে এস ফোর্সের সাবেক কোম্পানি কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব:) সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম বীর প্রতীকের একটি উক্তি উল্লেখ করার দাবি রাখে। তিনি প্রোবনিউজে ৩৯তম বিজয় দিবস সংখ্যায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন, There is no mention of the Mukti Bahini in the surrender document and there is only little or marginalized mention of the contribution of Mukti Bahini in the dozens of books written by Indian authors, It is a pity.’ ‘আত্মসমর্পণ দলিলে মুক্তিবাহিনীর অবদানের কোনো উল্লেখ নেই এবং ভারতীয় লেখকদের ডজন ডজন বইয়ে মুক্তিবাহিনীর অবদান স্থান পেয়েছে খুব সামান্য।  নয়তো নামমাত্র। তা অত্যন্ত দুঃখজনক।’ 

প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অনুপস্থিতি
পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমপর্ণ অনুষ্ঠানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন গ্র“প ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকার। কেন সেদিন মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানী?

ফাইটার জেটের হেলমেট

বর্তমান সময়ে আধুনিক এবং নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফিচার হচ্ছে জেট ফাইটারের ককপিটে বসা এর পাইলটের হেল...