শনিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২১

ফাইটার জেটের হেলমেট

বর্তমান সময়ে আধুনিক এবং নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফিচার হচ্ছে জেট ফাইটারের ককপিটে বসা এর পাইলটের হেলমেটটি। আসলে এফ-১৮ সুপার হর্নেট, এফ-২২, এফ-৩৫, এসইউ-৫৭, এসইউ-৩৫ জে-২০ এবং ইউরোফাইটার তাইফুনের মতো ডেডিকেটেড হেভী এণ্ড লং রেঞ্জের জেট ফাইটারের ককপিটে বসা পালটের ব্যবহৃত হেলমেটটিকে কিন্তু অতি উচ্চ প্রযুক্তির হেলমেট_মাউন্টেড_ডিসপ্লে (এইচএমডি) প্রযুক্তি সমৃদ্ধ করে ডিজাইন করা হয়ে থাকে। হেলমেট_মাউন্টেড_ডিসপ্লে (এইচএমডি) সিস্টেমটির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো জেট ফাইটারকে না ঘুরিয়েই বিমানের পাইলট যে কোনো দিকে তাকিয়ে সেই দিকের টার্গেটকে লক্ করে এয়ার টু এয়ার মিসাইল ফায়ার করতে পারে। হেলমেট-মাউন্টেড ডিসপ্লে (এইচএমডি) আসলে এমন একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির হেলমেট সিস্টেম, যা কিনা বিমানের পাইলটের চালকের চোখের কাছে কমব্যাট মিশন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করে এবং এ থেকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে কিংবা কমাণ্ড করতে সহায়তা করে। যা অতি আধুনিক মানের এই জাতীয় প্রযুক্তি সমৃদ্ধ হেলমেটে আবার ভয়েস কমাণ্ডের মাধম্যেও পাইলট খুব সহজেই তার কাজটি করতে পারেন। মার্কিন যুক্তরাষ্টের এফ-৩৫ স্টিলথ জেট ফাইটারে পাইলটের একটি উচ্চ প্রযুক্তির (এইচএমডি) হেলমেট তৈরিতে প্রায় ৪ লক্ষ ডলার বা বাংলাদেশী মুদ্রায় ৩ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা বা তারও বেশি অর্থ ব্যয় করা হয়ে থাকতে পারে। আর এটি উৎপাদন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Rockwell Collins and Elbit Systems of America। আবার ভারতের ডিফেন্স রিসার্চ এণ্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ডিআরডিও) ভারতের তেজাস লাইট কমব্যাট জেট ফাইটারের পাইলটদের জন্য এরুপ অত্যাধুনিক এবং উচ্চ প্রযুক্তির এইচএমডি হেলমেট ডিজাইন করেছে।

বৃহস্পতিবার, ২২ এপ্রিল, ২০২১

অ্যাডলফ হিটলারের জন্মদিন

Wikipedia
আজ নাৎসি নেতা ও জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাডলফ হিটলারের ১৩২ তম জন্মদিন। তাকে নিয়ে একটি লেখা লিখব যখন ঠিক করলাম তখন শুরুতেই লিখেছি “শুভ জন্মদিন হিটলার”। এটা কি ঠিক হল!! হিটলার ১৭ মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করেছে তার জন্মদিন কি শুভ হতে পারে? তার জন্ম না হলে কি পৃথিবীর জন্য মঙ্গল হত? 

অস্ট্রীয় বংশোদ্ভূত এই জার্মান রাজনীতিবিদ ১৮৮৯ সালের আজকের দিনে (২০ এপ্রিল) জার্মানির সীমান্তবর্তী ব্রাউনাউ-আম-ইন গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তিনি ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর এবং ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সে দেশের ফুয়েরার ছিলেন।

ছোটবেলা থেকেই হিটলার ছিলেন ভীষণ রগচটা, একগুঁয়ে ও জেদি। মায়ের মৃত্যুর পর সংসারের সব বন্ধন ছিন্ন করে তিনি ভিয়েনায় চলে যান। সেখানে থাকাকালীন সময়েই তার মনে জেগে ওঠে ইহুদিবিদ্বেষ। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে হিটলার সৈনিক হিসেবে যুদ্ধে যোগ দেন। এরপর তিনি যোগ দেন লেবার পার্টিতে। এক বছরের মধ্যেই তিনি এ পার্টির প্রধান হন। পার্টির নাম পরিবর্তন করে রাখেন ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি। পরবর্তীতে এই পার্টিকেই বলা হত নাৎসি পার্টি।

হিটলার চেয়েছিলেন জার্মানিতে তার দল ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দল থাকবে না। ধীরে ধীরে নাৎসি বাহিনীর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। হিটলার মোহনীয় বক্তৃতার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ, ইহুদি বিদ্বেষ ও সমাজতন্ত্র বিরোধিতা ছড়াতে থাকেন। মাত্র এক বছরের মধ্যে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে গোটা জার্মানি তিনি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হন।১৯৩৪ সালে হিটলার রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে নিজেকে জার্মানির ফুয়েরার হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯৩৫ সালে নতুন আইন চালু করে দেশের নাগরিকদের দুটি ভাগে বিভক্ত করেন। এ আইনে ইহুদিরা জার্মানিতে বসবাসের অধিকার পেলেও নাগরিকত্ব হারান।

বিশ্বজয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মান বাহিনী পোল্যান্ড আক্রমণ করে। এই দিন থেকেই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। গণহত্যার মধ্য দিয়ে একের পর এক দেশ দখল করতে থাকেন হিটলার। ফ্রান্সের পতনের পর ১৯৪১ সালে হিটলার বাহিনী রাশিয়া আক্রমণ করে। প্রথমদিকে জার্মান বাহিনী সর্বত্র জয়লাভ করলেও মিত্রশক্তি যখন সম্মিলিতভাবে অগ্রসর হতে শুরু করে তখন হিটলার বাহিনী ধীরে ধীরে পিছু হটতে থাকে।অবশেষে মিত্র শক্তি বিজয় লাভ করে। ১৯৪৫ সালের মধ্যে জার্মানি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। হিটলারের রাজ্যজয় ও বর্ণবাদী আগ্রাসনের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়। পরিকল্পনামাফিক হত্যা করা হয় ৬০ লক্ষ ইহুদিকে। ইহুদি নিধনের এই ঘটনা ইতিহাসে 'হলোকস্ট' নামে পরিচিত।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে হিটলার বার্লিনে ছিলেন। রেড আর্মি যখন বার্লিন প্রায় দখল করে নিচ্ছিল সে রকম একটা সময়ে হিটলার তার প্রেমিকা ইভা ব্রাউনকে বিয়ে করেন। হিটলারকে গভীরভাবে ভালবাসতেন ইভা। বিয়ের পর দুটি চিঠি লিখেন। একটিতে তিনি সবকিছুর জন্য ইহুদিদের দায়ী করেন এবং অপরটিতে নিজের সব সম্পত্তি পার্টিকে দান করে দেন।


দিনটা ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল। হিটলার বুঝতে পারলেন যেকোনো মুহূর্তে তিনি লালফৌজ বাহিনীর হাতে বন্দি হতে পারেন। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তিনি বাঙ্কার থেকে ৫০০ মিটার দূরে গিয়ে তার সহযোগীদের সঙ্গে দেখা করে বলেন, তার মৃত্যুর পর যেন লাশ এমনভাবে পোড়ান হয় যাতে তার দেহের অংশের কোন চিহ্নই না থাকে। এর কিছুক্ষণ পরেই হিটলার নিজের পিস্তল দিয়ে আত্মহত্যা করেন। আর তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী ইভা বিষপানে আত্মহত্যা করেন। হিটলারের দুই সৈন্য তার মৃতদেহ আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন।
#SAS

বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০

নাবিকদের জীবন্ত ডুবিয়ে মেরে জাহাজ রক্ষার এক প্রক্রিয়া!

#কাউন্টারফ্লাডিং
কাউন্টার ফ্লাডিং। শব্দটা শুনলেই এর কার্যক্রম সম্পর্কে কিছুটা ধারণা চলে আসার কথা৷ কাউন্টার ফ্লাডিং অর্থ এমন একটি প্রক্রিয়া যা, ফ্লাডিং এর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। প্রশ্ম হলো, ফ্লাডিং কি?

উত্তরটা খুব সহজ। Flooding বা ফ্লাডিং অর্থ কোন স্থান ডুবে যাওয়া৷ এজন্য বন্যাকে বলা হয় Flood. Flood থেকেই Flooding শব্দটি এসেছে। কিন্তু এর সাথে জাহাজ ও নাবিকের কি সম্পর্ক? 

অবশ্যই সম্পর্ক আছে৷ একটা  উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা সহজ হবে। ধরা যাক, একটি জাহাজের পোর্ট সাইডে ওয়াটারলাইনের নিচে একটা মিসাইল বিস্ফোরিত হয়েছে। হাল ফুটো হয়ে গেচ্ছে এবং বন্যার মতো পানি ঢুকছে। এক পাশে পানির ওজনে জাহাজ যাচ্ছে বেকে। ধীরে ধীরে ৭ ডিগ্রি, ১০ ডিগ্রি, ১২ ডিগ্রি। এভাবে যদি জাহাজ বেকে যেতে থাকে তাহলে পানি ঢুকবে অনেক দ্রুত এবং মেরামতের আশাও শেষ হয়ে যাবে৷ আর কিছুক্ষণ পরেই জাহাজটি যাবে উলটে৷ জাহাজের ফুটো যদি খুব বড় না হয় তাহলে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয় ফুটো মেরামত করার। কিন্তু যদি কপাল খারাপ হয় তাহলে একমাত্র ভরসা কাউন্টারফ্লাডিং। জাহাজের পোর্ট সাইড যেহেতু ধীরে ধীরে ঝুকে যাচ্ছে তাই প্রথমেই পোর্ট সাইডের পানিরোধী দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর ইচ্ছাকৃতভাবে জাহাজের স্টারবোর্ড সাইডের রুমগুলোর দরজা বন্ধ করে বাইরে থেকে পানি ঢুকতে দেওয়া হয়। জাহাজের দুই দিক থেকে একইসাথে পানি ঢুকতে থাকে বিধায় জাহাজের ঝোকা কমে যায়। যদিও এতে জাহাজের ওজন অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু হিসাব অনুযায়ী করতে পারলে জাহাজ মারাত্নক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পুরোপুরি ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা পায়। 

কিন্তু নাবিকেরা? বলা বাহুল্য কাউন্টারফ্লাডিং খুবই বিপদজনক এবং সুক্ষ্ণ একটি প্রক্রিয়া। হিসাব বা সময়ে একটু গন্ডগোল হলে জাহাজ তো বাচবেই না বরং আরো দ্রুত ডুববে। তাই এর সিধান্ত নিতে হয় কয়েক সেকেন্ডের মাথায়, সিধান্ত কার্যকর ও করতে হয় কয়েক সেকেন্ডের মাথায়। তাই জাহাজদের নাবিকদের বের হওয়ার কোন সুযোগ দেওয়া হয় না। কাউন্টারফ্লাডিং চলার সময় সেইসব রুমে থাকা নাবিকরা বেশিরভাগ সময়ে জীবন্ত ডুবে মারা যায়। যদি হাতে সময় থাকে তাহলে অবশ্যই বের করানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বন্যার মতো পানি ঢুকতে থাকলে আসলে সেই সময়টা থাকে না। তাই বেশিরভাগ সময়েই নাবিকদের দরজা আটকে জীবন্ত পানিতে ডুবিয়ে মারা হয়। উদাহরণ দিয়ে পরিষ্কার করি। ধরা যাক দুই ভাই একই জাহাজের নাবিক। এক ভাই ইঞ্জিনরুমে আরেক ভাই পাশের রুমে। কাউন্টার ফ্লাডিং এর সময় পাশের রুমের ভাই যদি ডুবেও মারা যায়, ইঞ্জিনরুমে থাকা ভাই সেই দরজা খুলবেন না৷ কারণ তাতে পুরো জাহাজ ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই ফ্লাডিং কাউন্টারফ্লাডিং করে অনেক জাহাজ রক্ষা পেয়েছে৷ কিন্তু চাপা পড়ে গেছে অসংখ্য নাবিকের আত্নত্যাগ। স্মরণ করি ও শ্রদ্ধা জানাই সেইসব নাবিকদের, যারা দায়িত্ব পালনে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে ডুবে মরতেও রাজি। ছিলেন ও থাকবেন। 

জুলিয়াস সিজার হত্যাকান্ড

  খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সালের ১৫ মার্চ রোমান প্রাচীন উৎসব আইডিস শোভাযাত্রায় পোম্পে নাট্যমঞ্চের কাছে একটি জায়গায় ২৩ বার ছুরিকাঘাত করে রোমান বীর জুলিয়াস সিজারকে হত্যা করা হয়। চক্রান্তকারীরা এ হত্যাকান্ডকে অভ্যুত্থান হিসেবে মানতে নারাজ। তাদের দৃষ্টিতে এ হত্যাকা- ছিল টায়রানিসাইড বা অত্যাচারী শাসক হত্যাকা-। মূল হত্যাকারী হলেন মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস। আরেকজন চক্রান্তকারীর নাম প্রায় অভিন্ন। তার নাম ডিসিমাস জুনিয়াস ব্রুটাস আলবিনাস। ব্রুটাস ছিলেন চক্রান্তকারীদের নেতা। তার স্ত্রী পোর্সিয়াও সিজার হত্যাকা-ে সম্পৃক্ত ছিলেন। চক্রান্তকারীরা মনে করতেন যে, সিজার সংবিধান লংঘন করেছেন এবং স্বৈরাচারী একনায়কে পরিণত হয়েছেন। মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস ও গিজ ক্যাসিয়াস লংগিনাস রোমান সংবিধান পুনরুজ্জীবিত করতে চাইছিলেন। মহান রাজনৈতিক চিন্তানায়ক, দার্শনিক ও বাগ্মী  মার্কাস টিলিয়াস সিসেরো ছিলেন তাদের বন্ধু। তিনি দৃঢ়ভাবে রোমান প্রজাতন্ত্রকে সাংবিধানিক শাসনের ওপর দাঁড় করানোর পক্ষপাতী ছিলেন। সিসেরো হত্যাকা-ে অংশগ্রহণ করেননি। তবে তিনি আততায়ীদের অভিনন্দন জানিয়েছিলেন এবং হত্যাকা-কে একটি মহান কাজ হিসেবে প্রশংসা করেছিলেন। প্রকৃতি ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াসকে ক্ষমা করেনি। ফিলিপ্পি যুদ্ধে তাদের উভয়ে আত্মহত্যা করেন। ব্রুটাস শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন ভেবে ক্যাসিয়াস তার মুক্ত গোলাম পিন্ডারাসকে তাকে হত্যার নির্দেশ দেন। সিজারকে তিনি যে ছোরা দিয়ে হত্যা করেছিলেন, তাকে সেই ছোরা দিয়ে হত্যা করা হয়। যেদিন তার জন্ম হয়েছিল ঠিক সেদিন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ব্রুটাস তার লাশের ওপর আছড়ে পড়ে বিলাপ করেন। একই যুদ্ধে মার্ক এন্টনির কাছে পরাজিত হওয়ার পর ব্রুটাস আত্মহত্যা করেন। তার দুজন সহযোগী তরবারি ধরে রাখে। তিনি তীক্ষè তরবারিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে জীবন বিসর্জন দেন।
 প্রায় ৪০ জন লোক সিজার হত্যাকা-ে যোগদান করেন। তাদের অর্ধেকের নাম বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। তবে যাদের নাম জানা গেছে তাদের সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায়নি। জ্ঞাত ব্যক্তিরা হলেন: গিজ ক্যাসিয়াস লংগিনাস, মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস, সার্ভিয়াস সালপিসিয়াস গালবা, কুইন্টাস লিগারিয়াস, লুসিয়াস মিনিউসিয়াস বাসিলাস, গিস সার্ভিলাস কাস্কা (পাবলিয়াস সার্ভিলিয়াস কাস্কা লংগাসের ভাই), পাবলিয়াস সার্ভিলিয়াস কাস্কা লংগাস (গিস সার্ভিলাস কাস্কার ভাই ও প্রথম আঘাতকারী), ডিসিমাস জুনিয়াস ব্রুটাস আলবিনাস, লুসিয়াস টিলিয়াস সিম্বার, গিস ট্রিবনিয়াস, লুসিয়াস ক্যাসিয়াস লংগিনাস (গিস ক্যাসিয়াস লংগিনাসের ভাই), গিস ক্যাসিয়াস পারমেনসিস, কাইসিলিয়াস (বুকোলিয়নাসের ভাই), বুকোলিয়নাস (কাইসিলিয়াসের ভাই), রুবরিয়াস রুগা, মার্কাস স্পুরিয়াস, পাবলিয়াস সেক্সটিয়াস নাসো, লুসিয়াস পন্টিয়াস আকিলা, পেট্রোনিয়াস, ডিসিমাস টুরুলিয়াস, প্যাকুভিয়াস এন্টিসটিয়াস লাবিও। 
     খ্রিস্টপূর্ব ৪৫ সালে সিজার মুন্ডা যুদ্ধে রিপাবলিকান উপদলকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করার পর ডিক্টেটর হিসেবে রোমে ফিরে এলে মার্কাস ব্রুটাস চক্রান্তকারীদের সঙ্গে যোগদান করেন। ব্রুটাসের মা সার্ভিলিয়া ছিলেন রোমান সিনেটর ক্যাটো দ্য ইয়াংগারের সৎবোন। খ্রিস্টপূর্ব ৬৪ সাল নাগাদ সার্ভিলিয়া সিজারের রক্ষিতায় পরিণত হন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সালে সিজারের হত্যাকা- নাগাদ উভয়ের সম্পর্ক অক্ষুণœ ছিল। তার প্রতি সিজারের গভীর অনুরাগ ছিল এবং গল যুদ্ধ শেষে রোমে ফিরে আসার পর তিনি তাকে একটি অমূল্য কৃষ্ণ মুক্তা উপহার দিয়েছিলেন। জুনিয়া টারশিয়া ছিলেন সিজার ও সার্ভিলিয়ার কন্যা। তবে আরেকটি সূত্রে বলা হয়, সার্ভিলিয়ার প্রতি সিজারের আকর্ষণে ভাটা পড়লে তিনি জুনিয়াকে উপহার দেন। তবে আরেকটি সূত্রে বলা হয়, জুনিয়া হলেন সিজারের কন্যা। একই সূত্র দাবি করছে যে, সিজারের হত্যাকা-ে সম্পৃক্ত মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস ছিলেন সিজারের পুত্র। তবে বয়সের হিসাবে এ ভাষ্য সঠিক হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। কেননা ব্রুটাসের জন্মের সময় সিজারের বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। রোমান প্রজাতন্ত্রের সিনেট সিজারকে ডিক্টেটর পারপিটিউ (আজীবন ডিক্টেটর) হিসেবে নিয়োগ দিলে সংকট তৈরি হয়। সিনেটের এ ঘোষণায় বহু সিনেটর আশঙ্কা করছিলেন যে, সিজার নিরঙ্কুশ একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠায় সিনেটকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চাচ্ছেন। আরো আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে, সিজারের প্লেবিয়ান বা নিন্মশ্রেণির অনুকূলে প্রণীত শাসনতন্ত্র সিনেটরদের অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধার প্রতি হুমকি হয়ে দেখা দেবে। চক্রান্তকারীরা রোমান প্রজাতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয় এবং সিজারের হত্যাকা-ের প্রতিক্রিয়ায় গৃহযুদ্ধ (লিবারেটর্স সিভিল ওয়ার) বেধে যায় এবং রোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সূচনা পর্ব শুরু হয়।  

হত্যাকা-ের পটভূমি
জীবনীকাররা বলছেন যে, সিজার ও সিনেটের মধ্যে বিরোধ এবং তার রাজা খেতাব গ্রহণের সম্ভাবনায় তাদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। এসব ঘটনা সিজার হত্যাকা-ের মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। সিনেট সিজারকে ডিক্টেটর পারপিটউ (আজীবন ডিক্টেটর) হিসেবে নিয়োগ দেয়। রোমান টাকশাল একপিঠে রাজা খেতাব ও সিজারের প্রতিকৃতি এবং অন্যপিঠে গ্রীক কৃষি দেবী সিরিজের প্রতিকৃতি এবং সিজারের অগার পন্টিফেক্স ম্যাক্সিমাস খেতাব খোদাই করে রৌপ্যমুদ্রা চালু করে। ২ শো বছর পর গ্রীক বংশোদ্ভূত রোমান ঐতিহাসিক ক্যাসিয়াস ডিওর লেখা ইতিহাসে বলা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সালে সিনেটের একটি প্রতিনিধি দল সিজারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং তাকে নয়া খেতাব প্রদানের সুসংবাদ দেয়। সিজার দেবী ভেনাসের মন্দিরে উপবিষ্ট অবস্থায় তাদের অভ্যর্থনা জানান। কিন্তু তিনি তাদের সম্মান দেখানোর জন্য ওঠে দাঁড়াননি। প্রায় দেড় শো বছর পর আরেক রোমান ঐতিহাসিক সিউটোনিয়াসের লেখা ইতিহাসে বলা হয়, ইহুদি ধনকুবের কর্নেলিয়াস বালবাস বাধা দেয়ায় সিজার ওঠে দাঁড়াননি। সিউটোনিয়াস বলেন, রোমে ফিরে এলে সিজারকে অভ্যর্থনা জানাতে একদল লোক সমবেত হয়। জনতা বেদীতে সিজারের মূর্তিতে ফুলের তোড়া অর্পণ করে। বৃহস্পতি দেবীর প্রতীক ও পূজার অর্ঘ হওয়ায় ট্রিবিউন (নির্বাচিত রোমান কর্মকর্তা) গিজ এপিডাস মারুলাস ও লুসিয়াস ক্যাসিটিয়াস ফ্লাভাস ফুলের তোড়া অপসারণে জনতাকে নির্দেশ দেন। একদল লোক রোমের রাজপথে সিজারের উদ্দেশে ‘রেক্স’ (রাজা) বলে জয়ধ্বনি দেয়। জবাবে সিজার বলেন, আমি সিজার, রেক্স নই (ইগো সিজার, নন রেক্স)। রেক্স ধ্বনি দেয়ায় এ দুজন ট্রিবিউইন সংশ্লিষ্ট লোকদের গ্রেফতার করেন। সমর্থকদের প্রতি হুমকি সৃষ্টি হওয়ায় সিজার কঠোর পদক্ষেপ নেন। তিনি  নিজস্ব ক্ষমতার জোরে এ দুজন ট্রিবিউনকে অপসারণ করেন। তারপর থেকে সিজার রাজকীয় খেতাব পরিত্যাগ করেননি। ঐতিহ্যবাহী লিউপারকালিয়া উৎসবে বেদিতে ভাষণ দানকালে মার্ক এন্টনি কয়েকবার তার মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। সিজার  দেবতা জুপিটার অপটিমাস ম্যাক্সিমাসের উদ্দেশে উৎসর্গ করার জন্য রাজমুুকুট প্রত্যাখ্যান করেন। ঐতিহাসিক প্লুটার্ক ও সিউটোনিয়াস ঘটনার অভিন্ন বর্ণনা দিয়েছেন। তবে ঐতিহাসিক ডিও এসব উপাখ্যান সমন্বয় করে লিখেছেন, সিজারের মূর্তিতে ফুলের তোড়া অর্পণ করায় এবং মাথায় মুকুট পরিয়ে দেয়ায় ট্রিবিউনরা নাগরিকদের গ্রেফতার করেন। অতঃপর সিজার জনতাকে আলবান পাহাড়ের শীর্ষে ওঠে ‘রেক্স’ ধ্বনি দেয়ার জন্য পাঠান। এ সময় ট্রিবিউনরা সংশ্লিষ্ট নাগরিকদের গ্রেফতার করেন। সিজারকে অবাধে কথা বলার সুযোগ না দেয়ায় নিন্মশ্রেণির লোকেরা প্রতিবাদ করে। সিজার ট্রিবিউনদের সিনেটের সামনে হাজির করেন এবং বিষয়টি ভোটাভুটিতে দেন। তিনি তাদের বরখাস্ত করেন এবং রেকর্ড থেকে তাদের নাম কেটে দেন। সিউটোনিয়াস আরো বলেন, লুসাস কোট্টা সিজারকে ‘রাজা’ খেতাব প্রদানে সিনেটের কাছে প্রস্তাব করেন। কেননা ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল যে, কেবলমাত্র একজন রাজা পার্থিয়া জয় করবেন। সিজার পার্থিয়ায় অভিযান চালাতে আগ্রহী ছিলেন। এ অভিযান দ্বিতীয় ট্রায়াম্ভিরেটের আমলে মার্ক এন্টনির জন্য উল্লেখযোগ্য বিড়ম্বনা বয়ে আনে। সিজারের খেতাব ও উপাধিগুলো ছিল সম্মানসূচক। তাই তিনি আরো ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করছিলেন। মূল ক্ষমতা সিনেটের হাতে ন্যস্ত থাকায় সিজারের সঙ্গে তাদের বিরোধ দেখা দেয়। ব্রুটাস তার বন্ধু এবং ভগ্নিপতি গিজ ক্যাসিয়াস লংগিনাসকে নিয়ে চক্রান্ত পাকাতে থাকেন। তারা নিজেদেরকে লিবারেটর (মুক্তিদাতা) হিসেবে দাবি করেন। 
    বহু পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করা হয়। চক্রান্তকারীরা কখনো প্রকাশ্যে মিলিত হয়নি। তবে তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ বাড়িতে কয়েকজন করে মিলিত হতেন। কিভাবে পরিকল্পনা কার্যকর করা হবে তা নিয়ে বহু আলোচনা হতো। বহু প্রস্তাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হতো। কেউ কেউ পূণ্য শোভাযাত্রায় তাদের পরিকল্পনা কার্যকর করার প্রস্তাব দেয়। সিজার পূণ্য শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতেন। নির্বাচনী অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা কার্যকর করার আরেকটি প্রস্তাব ছিল। ক্যাম্পাস মার্টিনাসে ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়োগদানে সিজারকে একটি সেতু অতিক্রম করতে হতো। প্রস্তাব করা হয় যে, সেতু অতিক্রমকালে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হবে এবং অন্যরা ছুটে গিয়ে তাকে হত্যা করবে। 
   তৃতীয় পরিকল্পনা ছিল আসন্ন দ্বন্দ্বযুদ্ধের প্রদর্শনীর জন্য অপেক্ষা করা। এ প্রদর্শনীতে পরিকল্পনা কার্যকরের সুবিধা ছিল যে, অস্ত্র বহন করা হলে কারো সন্দেহ হবে না। অধিকাংশ চক্রান্তকারী সিনেটের সভাগৃহে উপবিষ্ট অবস্থায় তাকে হত্যার পক্ষে মতামত দেয়। সিজার সেখানে উপস্থিত থাকবেন। কেননা সিনেটর ছাড়া সিনেট ভবনে অন্য কারো প্রবেশের অনুমতি ছিল না। চক্রান্তকারীরা তাদের আলখেল্লার নিচে তাদের ছোরা লুকিয়ে রাখার সুযোগ পাবেন। সেদিন এ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। নিকোলাস লিখেছেন, হত্যাকা-ের পূর্ববর্তী দিনগুলোতে সিজারকে ডাক্তার, বন্ধুবান্ধব এবং এমনকি তার স্ত্রী কালপুর্নিয়া আইডিস শোভাযাত্রায় যোগদানে নিষেধ করেন। কোনো কোনো প্রাচীন সূত্রে বলা হয়, কালপুর্নিয়া তার স্বামী হত্যাকা-ের পূর্বাভাস পেয়েছিলেন এবং তাকে সতর্ক করে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। প্রিটর (নির্বাচিত ম্যাজিস্ট্রেট) ডিসিমাস জুনিয়াস ব্রুটাস আলবিনাস চক্রান্তে জড়িত একথা না জেনে তিনি তাকে সিনেটকে একথা অবহিত করতে অনুরোধ করেন যে, সিজার অসুস্থ এবং তিনি সিনেট অধিবেশনে যোগদানে সক্ষম নন। কিন্তু সিজার এ পরিকল্পনা নাকচ করে দেন এবং ব্রুটাস তাকে প্রহরা দিয়ে শত্রুর হাতে তুলে দেন। কালপুর্নিয়া দুঃস্বপ্ন দেখেন। তিনি অস্থির হয়ে বলে উঠেন, ‘কী ভীষণ দুঃস্বপ্ন দেখলাম! প্রহরী দেখেছে আরো ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। সে দেখেছে, এক সিংহী পথে সন্তান প্রসব করেছে। কবর থেকে লাশগুলো বের হয়ে আসছে। মেঘরাশির মধ্যে দুর্দান্ত অগ্নিময় সৈন্যরা যুদ্ধ করছে। একজন ক্রীতদাস অগ্নিবান নিক্ষেপ করছে। সভাগৃহে রক্তবৃষ্টি হচ্ছে। আগুন নিভে গেলে দেখা যায় লোকটি অক্ষত। যুদ্ধের কোলাহল, অশ্বের হ্রেষাধ্বনি, মুমূর্ষু মানুষের আর্তনাদ ও ভূত প্রেতের তীব্র চিৎকারে সপ্ত নভোম-ল কেঁপে উঠছে। সিজার এসব দৃশ্য অদৃষ্টপূর্ব, অশ্রুতপূর্ব। তাই আমি ভয় পাচ্ছি।’
     সিজার মাথা নেড়ে বললেন, আমকে যেতেই হবে। কালপুর্নিয়া  ব্যাকুলকন্ঠে বলেন, আমি স্বপ্নে দেখেছি, উল্কাপি- জ্বালিয়ে দেবতারা রাজ মৃত্যুর কথা ঘোষণা করছেন। সিজার বললেন, মৃত্যুর আগে কাপুরুষ বহুবার মৃত্যুবরণ করে। বীরের মৃত্যু জীবনে একবার। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। তাই মৃত্যুকে ভয় পেয়ে লাভ নেই। এসব বাজে কথা আমার জন্য নয়। অন্যদিকে সিজারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচিত অন্যতম চক্রান্তকারী ডিসিমাস ব্রুটাস এসে সিজারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেন, ‘একি বলছো সিজার? সিনেট তোমাকে সম্মানিত করেছে এবং বিশেষভাবে তোমাকে তলব করেছে। অতএব সিনেটের তলবে সাড়া না দেয়া অসম্মান নয় কি? একজন মহিলার দুঃস্বপ্ন এবং নির্বোধ লোকদের গালগল্পে কান দেয়ার কোনো মানে আছে? তার চেয়ে বরং যা বলি শোন। বাজে কথা বাদ দাও। আমার সঙ্গে এসো। সিনেট অধিবেশন শুরু হয়েছে এবং সকাল থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।’  
   ডিসিমাস ব্রুটাসের কথা শুনে সিজারের মন গলে যায় এবং তিনি বাড়ি থেকে রওনা হন। তিনি পার্থিয়া আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মার্চের মাঝামাঝি তিনি মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশে যাত্রার পরিকল্পনা করছিলেন। চক্রান্তকারীরা তাদের চক্রান্ত বাস্তবায়নে সময় পেয়ে যায়। হত্যাকা-ের দুদিন আগে গিজ ক্যাসিয়াস লংগিনাস চক্রান্তকারীদের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাদের জানান যে, কেউ তাদের পরিকল্পনা ফাঁস করে দিলে তাকেও হত্যা করা হবে। সিজারের উত্তরসূরিরা পার্থিয়া ও জার্মানিয়া বিজয়ের চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের অভিযান সফল হয়নি।  

আইডিস শোভাযাত্রা 
খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সালের ১৫ মার্চ আইডিস শোভাযাত্রার দিন চক্রান্তকারীরা পোম্পে নাট্যমঞ্চে মল্লযুদ্ধের আয়োজন করে। আইডিস শোভাযাত্রার দিন ছিল রোমানদের ঋণ পরিশোধের শেষ দিন। সেদিন ক্যাপিটোলিন নেকড়ের সম্মানে লিউপারকালিয়া উৎসব পালন করা হতো। এ নেকড়ে রোম শহর ও রোমান প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা শিশু রোমুলাস ও রেমোসকে দুধ খাওয়াতো। ডিসিমাস ব্রুটাস মল্লযোদ্ধাদের পাঠান। তারা পোম্পে নাট্যমঞ্চের বিশাল হলে অপেক্ষা করতে থাকেন। পূর্ববর্তী দিনগুলোতে সিজার বিলম্বে হুঁশিয়ারি লাভ করেন। তাকে নিয়ে আসার জন্য ডিসিমাস ব্রুটাসকে পাঠানো হয়। ডিসিমাস ব্রুটাস তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করান। একরাত আগে মার্ক এন্টনি পাবলিয়াস সার্ভিলিয়াস কাস্কা লংগাসের (কাস্কা) কাছ থেকে অস্পষ্টভাবে এ চক্রান্তের কথা জানতে পারেন এবং অশুভ পরিণতির আশঙ্কা করে সিজারকে ফিরিয়ে রাখার জন্য তার কাছে যান। চক্রান্তকারীরা অনুমান করেছিল যে, মার্ক এন্টনি সিজারের সহায়তায় এগিয়ে আসবেন। তাই ঠিক করা হয় যে, এন্টনি অধিবেশনস্থল পোম্পে নাট্যমঞ্চের বারান্দায় এগিয়ে আসা মাত্র গিস ট্রিবনিয়াস তাকে বাধা দেবেন। সিসেরো ব্যক্তিগতভাবে এ চক্রান্তে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তবে পরবর্তীতে তিনি দাবি করেন যে, এন্টনির কার্যকলাপ সিজারের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। প্রাথমিকভাবে চক্রান্তকারীরা শুধু সিজার নয়, মার্ক এন্টনিসহ তার বহু সমর্থককে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু ব্রুটাস এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং সিজারের মধ্যে চক্রান্ত সীমাবদ্ধ রাখেন। সিজারের সঙ্গে এন্টনির যোগদানের কথা ছিল। কিন্তু অন্যতম চক্রান্তকারী ট্রিবনিয়াস পথে ওঁৎ পেতে থাকেন এবং তাকে সিনেটে প্রবেশে বাধা দেন।  

হত্যাকা-
খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সালের ১৫ মার্চ স্ত্রী কালপুর্নিয়ার বাধা উপেক্ষা করে সিজার বাইরে বের হন। রোমের রাস্তায় জনতার ভিড়। রোমের সভাগৃহে চাপা উত্তেজনা। সিজার সভাগৃহে প্রবেশ করেন। সঙ্গে ব্রুটাস, গিস ক্যাসিয়াস, গিস সার্ভিলাস কাস্কা ও ল্যাপিডাসসহ আরো অনেকে। সিজার আসন গ্রহণ করেন। তারপর সামান্য কথাবার্তা। কথা কাটাকাটি। ঠিক তখন লুসিয়াস টিলিয়াস সিম্বার সিম্বার তার নির্বাসিত ভাই পাবলিয়াসকে ফিরিয়ে আনার অনুমতি চেয়ে তার কাছে একটি আবেদন পেশ করেন। বাদবাকি চক্রান্তকারীরা একইভাবে সিজারের কাছে দরখাস্ত পেশ করার ভান করেন। সিজার সিম্বারকে দূরে ঠেলে দেন। কিন্তু সিম্বার সিজারের কাঁধ চেপে ধরেন এবং তার আলখাল্লা কেড়ে নেন। সিজার তাকে বলেন, ‘এমন আচরণ করছো কেন? এটা তো সহিংসতা (ইস্তা কুইডেম ভিস ইস্ত।) পাবলিয়াস সার্ভিলিয়াস ক্যাসকেল লংগাস (কাস্কা) প্রথম সিজারকে আঘাত করেন। কাস্কা ছোরা বের করেন এবং পেছন থেকে সিজারের গ্রীবাদেশে আঘাত করেন। সিজার দ্রুত ঘাড় ফিরিয়ে নেন এবং কাস্কার হাত ধরে ফেলেন। ঐতিহাসিক প্লুটার্কের মতে, সিজার ল্যাটিন ভাষায় বলেছিলেন, কাস্কা তুমি হলে খলনায়ক। তুমি একি করছো? ভীতসন্ত্রস্ত কাস্কা গ্রীক ভাষায় চিৎকার করে বলেন, ‘সাহায্য করছি ভাই।’ চক্রান্তকারীরা এমনভাবে আক্রমণ চালাতে থাকেন যে, তারা একে অন্যকে আঘাত করতে থাকেন। মুহূর্তের মধ্যে ব্রুটাসসহ গোটা গ্রুপ সিজারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ব্রুটাস হাতে ও পায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হন।  সিজার দূরে সরে যাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু চোখ রক্তাক্ত হয়ে যাওয়ায় হোঁচট খেয়ে পড়ে যান। সিজার বারান্দার সিঁড়িতে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকলে ঘাতকরা তাকে অব্যাহতভাবে আঘাত করতে থাকে। রোমান ঐতিহাসিক ইউট্রোপিয়াসের মতে, ৬০ অথবা তার চেয়ে বেশি লোক হত্যাকা-ে অংশগ্রহণ করে। সিজারকে ২৩ বার ছুরিকাঘাত করা হয়। সিউটোনিয়াস উল্লেখ করেন যে, সিজারের ময়না তদন্তে সংশ্লিষ্ট একজন চিকিৎসক নিশ্চিত করেন যে, একটি মাত্র  আঘাত ছিল গুরুতর। ময়না তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়, ছুরিকাঘাতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সিজারের মৃত্যু হয়। পোম্পে নাট্যমঞ্চের সভাকক্ষে সিজারকে হত্যা করা হয়। গবেষক ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে সিজারের শেষ কথা নিয়ে বিতর্ক আছে। সিউটোনিয়াস বলছেন, তিনি কোনো কিছু বলেননি। তবে অন্যরা উল্লেখ করেছেন যে, গ্রীক ভাষায় সিজারের শেষ শব্দ ছিল কাই, সিউ, টেকনোন? (তোমরা কি শিশু?) প্লুটার্ক উল্লেখ করছেন, সিজার কোনো কিছু বলেননি। চক্রান্তকারীদের মধ্যে ব্রুটাসকে দেখে তিনি আলখাল্লা দিয়ে মাথা ঢেকে ফেলেন। জীবনের প্রতি তিনি অনুরাগ হারিয়ে ফেলেন। বুঝতে পারেন যে, জীবন বড় কুৎসিত, জীবন বড় কুটিল। তিনি ল্যাটিন ভাষায় ব্রুটাসকে দেখে বলে উঠেন, ইট টু, ব্রুটি? (ব্রুটাস তুমিও?)। এ বাক্যটি উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটক থেকে নেয়া হয়েছে। মুখ থেকে এ কথা বের হওয়ার পর সিজার পড়ে যান। তবে কথাটির ঐতিহাসিক কোনো ভিত্তি নেই। শেক্সপিয়র সমকালীন সময়ে ব্যবহৃত এ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেন। ঐতিহাসিক প্লুটার্কের মতে, হত্যাকা-ের পর ব্রুটাস চক্রান্ত বহির্ভূত সিনেটরদের যেন কিছু বলতে সামনে এগিয়ে যান। ব্রুটাস বেঁচে থাকেন ইতিহাসে অবিশ্বাস আর প্রহেলিকার প্রতীক হিসেবে। 
   সিনেটররা সভাগ্রহ থেকে পালিয়ে যান। তারপর ব্রুটাস ও তার সঙ্গীরা তাদের প্রিয় শহরের জন্য কাঁদতে কাঁদতে জুপিটারের মন্দিরের দিকে যান। উচ্চৈঃস্বরে বললেন, ‘হে রোমবাসী, আমরা পুনরায় মুক্ত হলাম।’ সর্বত্র নীরবতা বিরাজ করছিল। কেননা গুজব ছড়িয়ে পড়া মাত্র রোমবাসীরা নিজ নিজ গৃহে আশ্রয় নেয়। সিউটোনিয়াসের মতে, সব চক্রান্তকারী পালিয়ে যান এবং সিজার কিছু সময়ের জন্য সেখানে প্রাণহীন অবস্থায় পড়ে থাকেন। অবশেষে তিনজন সাধারণ ক্রীতদাস তাকে ডুলিতে তুলে এবং তাকে বাড়িতে বহন করে নিয়ে যায়। এ সময় সিজারের একটি হাত ঝুলছিল। ২৩টি ছুরিকাঘাত চিহ্নিত করে ফোরামে সিজারের মোমের একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। সমবেত জনতা অগ্নিসংযোগ করে। আগুনে নিকটবর্তী কয়েকটি ভবন মারাত্মকভাবে ভস্মীভূত হয়। পরবর্তী বছরগুলোয় লিবারেটর্স সিভিল ওয়ারে রোমান প্রজাতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং রোমান সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে। 

ক্লিওপেট্রার প্রতিক্রিয়া
টাইবার নদীর তীরে সাইপ্রাস বৃক্ষে ঘেরা প্রাসাদ অলিন্দে ক্লিওপেট্রা অবস্থান করছিলেন। ভাবছিলেন, পাশে সিজার, কোলে তারই সন্তান। সিজারের সাম্রাজ্য বিশাল। সিজার হবেন সম্রাট। তিনি হবেন সম্রাজ্ঞী, রোমের অধীশ্বরী। উত্তেজনায় শিহরিত হয়ে উঠেন তিনি। ঠিক তখন খবর পান সিজার নেই। আর্তনাদ করে উঠেন ক্লিওপেট্রা। পুত্র সিজারিয়ানকে বুকে চেপে ধরেন। তার লালিত স্বপ্ন নিভে যায়। বাকি জীবন তাকে অন্ধকারে হাতড়ে মরতে হবে। শিউরে উঠেন ক্লিওপেট্রা। আতঙ্কে তার চোখের পানি শুকিয়ে যায়। মনে দুশ্চিন্তার কালোমেঘ ছায়া ফেলে। তাকে বাঁচতে হবে। বাঁচাতে হবে তার সন্তান সিজারিয়ানকে। পুত্র সিজারিয়ানকে সিজারের উত্তরাধিকারী হিসেবে নিয়োগদানের ব্যর্থ আশায় এপ্রিলের মাঝামাঝি নাগাদ তিনি রোমে অবস্থান করেন। কিন্তু সিজারের উইলে প্রপৌত্র অক্টাভিয়ানকে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করা হয়। এপ্রিলের মাঝামাঝি অক্টাভিয়ান ইতালিতে এসে পৌঁছান। একই সময় ক্লিওপেট্রা মিসরের উদ্দেশে রওনা দেন। 
    সিজারের রক্ষিতার জন্য রোমের প্রজাদের কোনো দরদ ছিল না। তাই ক্লিওপেট্রা পালানোর সিদ্ধান্ত নেন। নাটকের প্রথম অঙ্কের শুরু হয় মাত্র। তার বয়স তখন ২৬ বছর। তাকে বহুদূর যেতে হবে। কিছুদিনের মধ্যে ক্লিওপেট্রা রোম থেকে পালান। তিনি সিজারের ধর্মপত্মী ছিলেন না। তাই তার কোনো বৈধ অধিকার ছিল না। সিজারের প্রসারিত দুই বাহুতে তিনি তার শয্যা বিছিয়েছিলেন। সিজারের খাতিরে রোমের নামী দামী লোকেরা প্রাসাদে তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতেন। সম্মান করতেন। তবে তাদের কেউ সিজারের হৃদয়রানীকে রাজ্যের রানী হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। সিনেটর সিসেরো তাকে একদম দেখতে পারতেন না। ঘৃণা করতেন। আলেক্সান্ড্রিয়া থেকে কিছু মূল্যবান বই এনে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়ায় সিসেরো তাকে বেশি কিছু বলেননি। সিজার ভেনাস জেনিট্রিক্সের মন্দিরে ক্লিওপেট্রার স্বর্ণমূর্তি নির্মাণ করে তার প্রতি বিশেষ অনুরাগ প্রদর্শন করেন। সিজার তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেয়া ছাড়া তার জন্য সবই করেছিলেন। প্রজারা বিদ্রুপ করতো। বলতো, বুড়ো বয়সে সিজারকে ভিমরতিতে ধরেছে। তিনি নিজেকে একজন রক্ষিতার পায়ে বিলিয়ে দিচ্ছেন। এছাড়া সিজারই কি-ই বা করতে পারতেন। 
     ক্লিওপেট্রা কুমারী ছিলেন না। শাস্ত্রমতে তিনি ছিলেন সধবা। স্বামী চতুর্দশ টলেমি তার আশপাশে ঘুর ঘুর করতেন। ক্লিওপেট্রার সঙ্গে তার বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটেনি। যেমনি ঘটেনি কালপুর্নিয়ার সঙ্গে সিজারের বিয়ে বিচ্ছেদ। সিজার আরো কিছুদিন বেঁচে থাকলে ক্লিওপেট্রার বৃহস্পতি তুঙ্গে উঠতো। সিংহাসনে বসলে সিজার হতেন অর্ধেক পৃথিবীর সম্রাট। পাশে থাকতেন সম্রাজ্ঞী     ক্লিওপেট্রা। চতুর্দশ টলেমিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে সিজারের বেশি দিন লাগতো না। ক্লিওপেট্রা সৌভাগ্যের সিংহদ্বার থেকে ফিরে আসেন। তবু তাকে বেঁচে থাকতে হবে। একদিন তিনি সিজার ও রোমের স্মৃতিকে শেষ বিদায় জানান। একটি লম্বা নৌকা টাইবার নদীর ঢেউ ভেঙ্গে ছুটে যায়। নৌকাটি ওস্টিয়ায় পৌঁছে। সেখানে তিন সারি দাঁড়ের একটি নৌকা অপেক্ষা করছিল। ক্লিওপেট্রা এ নৌকায় আরোহণ করেন। তার গন্তব্য ছিল মিসর। মিসরে ফিরে আসেন ক্লিওপেট্রা। কিন্তু তার মন পড়ে থাকে রোমে। তিনি রোমের রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতি লক্ষ্য রাখছিলেন। 

               
অস্বাভাবিক ঘটনাবলী  
ল্যাটিন কবি ভার্জিল ‘জর্জিক্স’-এ (কবিতা) লিখেন, সিজারের হত্যাকা-ের পর কয়েকটি অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে। জার্মানি নভোম-লে লড়াইয়ের কোলাহল শুনতে পায়। ভূমিকম্পে আল্পস কেঁপে ওঠে। নিস্তদ্ধ গোরস্তানে উত্থিত একটি কানফাটা শব্দ সবাই শুনতে পায়। অদৃষ্টপূর্ব ছায়ামূর্তিগুলোকে অন্ধকারে পতিত হতে দেখা যায়। পৃথিবী মুখ ব্যাদান করে পড়ে থাকে। পশুগুলো মানুষের ভাষায় কথা বলে। মন্দিরে রক্ষিত মূর্তিগুলো বেদনায় কেঁদে ওঠে। বিন্দু বিন্দু ঘামে রৌপ্যনির্মিত মূর্তিগুলো ঢাকা পড়ে। সমুদ্রের রাজা ভয়ঙ্কর গতিতে বনভূমি ভাসিয়ে দেয় এবং গবাদি পশু ও চালা ঘরগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যায়। নির্মেঘ আকাশ থেকে বজ্রপাত হয়। উজ্জ্বল রংয়ের ধূমকেতু দৃশ্যমান হয়।

প্রতিক্রিয়া  
সিজারের হত্যাকা-ে গোটা রোম কেঁপে ওঠে। দ্রুত উল্লাস মিলিয়ে যায়। শেক্সপিয়র রচিত ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকে প্রতিক্রিয়ার একটি চিত্র অঙ্কন করা হয়। এতে দেখা যায়, হট্টগোলের মধ্যে ক্যাসিয়াস এন্টনিকে দেখতে না পেয়ে একবার চেঁচিয়ে উঠছিলেন, এন্টনিকে তো দেখতে পাচ্ছি না? তাদের বেশিক্ষণ চিন্তা করতে হয়নি। কিছুক্ষণ পর ক্যাসিয়াস ও ব্রুটাস উভয়ে এন্টনিকে দেখতে পান। এন্টনি ফিরে আসেন। খুব শান্তভাবে তিনি তাদের পাশে দাঁড়ান। ব্রুটাস ও তার বন্ধুরা এন্টনির প্রতি তীক্ষè দৃষ্টি রাখছিলেন। মনে হলো তাকে নিয়ে তাদের ভয় নেই। সিজার হত্যাকা-ে তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। প্রথমে একটু ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এন্টনি সম্পর্কে ব্রুটাস সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হন। সিজারের লাশ দেখে এন্টনি অভিভূত হয়েছিলেন। ভীতসন্ত্রস্ত জনতার উদ্দেশে ব্রুটাস বলেন, আমি সিজারকে কম ভালোবাসিনি। তবে রোমকে আমি বেশি ভালোবাসতাম। তোমরা কি চাও সিজার বেঁচে থাকুক আর আমরা সবাই তার দাসত্ব করি? নাকি সিজারের পতন ঘটুক আর আমরা সকলে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকি? সিজার আমাকে ভালোবাসতেন। তাই আমার চোখে পানি। তিনি ভাগ্যবান। আমি তাই আনন্দিত। তিনি বীর ছিলেন। আমি তাকে সম্মান করি। কিন্তু তিনি ছিলেন উচ্চাকাঙ্খী। তাই তাকে হত্যা করেছি। There is tears for his love;  joy for his fortune; honour for his valour and death for his ambition জনতা জয়ধ্বনি দেয়, ব্রুটাস দীর্ঘজীবী হোক।  
   পোম্পের নির্বাক পাথরের মূর্তির পাশে সিজার শেষ শয্যার আয়োজন করা হয়। জনসাধারণ ও সিনেটরদের উদ্দেশে ব্রুটাস বললেন, আর কোনো ভয় নেই। শান্ত হও। আকাশচুম্বী অপরাধের প্রতিশোধ নেয়া হয়েছে। সহকর্মীর ধ্বনি দেয়, অত্যাচারী নিপাত গেছে। এখন আমরা স্বাধীন, আমরা মুক্ত। ক্যাসিয়াস হঠাৎ বলে উঠেন, এন্টনি কোথায় গেল? সে তো আমাদের সঙ্গেই এখানে এসেছিল। ব্রুটাস সিজারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় এন্টনিকে বক্তব্য রাখার অনুমতি দেন। তবে শর্ত দেন যে, সিজার হত্যাকা-ের জন্য তিনি তাদের অভিযুক্ত করবেন না। এন্টনি তার পুরো বক্তৃতায় হত্যাকারীদের ‘সম্মানিত ব্যক্তি’ হিসেবে সম্বোধন করেন। কৌশলে তিনি বক্তব্য রাখতে শুরু করেন। তার বক্তব্য শেষ হলে জনতা সিজারের হত্যাকারীদের প্রতি ক্ষেপে যায়। জনতার মুখোমুখি দাঁড়ান এন্টনি। সামনে সিজারের রক্তমাখা লাশ। এন্টনি বিষণœ, গম্ভীর। জনতাকে সম্বোধন করে বললেন: Friends, Romans, Countrymen, lend me your ears রোমান বন্ধুরা, আমার প্রিয় দেশবাসী, ব্রুটাস অনুমতি দেয়ায় আমি তোমাদের উদ্দেশে কয়েকটি কথা বলতে চাই। আমি সিজারকে সমাহিত করতে এসেছি, তার প্রশংসা করতে নয়। সিজার ছিলেন আমার বিশ্বস্ত বন্ধু। ব্রুটাস দাবি করছেন, তিনি নাকি উচ্চাকাঙ্খী ছিলেন। কিন্তু মনে রেখো, পরাজিত বন্দিদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করে তিনি রোমের ভা-ার সমৃদ্ধ করেছিলেন। দরিদ্রদের দুঃখে কেঁদেছেন। সবাই দেখেছে লিউপারকালিয়া উৎসবের দিন আমি সিজারকে তিনবার রাজমুকুট পরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তিনবারই তিনি মুকুট প্রত্যাখ্যান করেছেন। এন্টনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তিনি জনতাকে ধৈর্য ধারণ করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, যেসব সম্মানিত লোক ছুরিকাঘাত করে সিজারকে হত্যা করেছেন, তিনি উইল পাঠ করলে তারা ভুল প্রমাণিত হবেন। জনতা উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং চক্রান্তকারীদের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং উইল পাঠ করার জন্য এন্টনিকে অনুরোধ করে। কিন্তু তিনি তৎক্ষণাৎ উইল পাঠের পরিবর্তে সিজারের রক্তাক্ত লাশের প্রতি মনোযোগ দেয়ার জন্য জনতার প্রতি আহ্বান জানান। এন্টনি সিজারের ক্ষতের প্রতি ইঙ্গিত করেন এবং সিজারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার ওপর জোর দেন। তিনি অস্বীকার করেন যে, তিনি তাদের উত্তেজিত করতে চাচ্ছেন না। তিনি বলেন, ব্রুটাস তার বাগ্মিতার জোরে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তিনি আরো বলেন, তিনি ব্রুটাসের মতো বাগ্মি হলে সিজারের প্রতিটি ক্ষতের জবাব দিতে পারতেন।এন্টনি সিজারের রক্তমাখা জামা দেখিয়ে বলেন: Look! In this place ran Cassius dagger through.  See what a rent the envious Casca made through this the well-beloved Brutas stabbed.ক্যাসিয়াস আঘাত করেছেন। কাস্কাও আঘাত করেছেন। কিন্তু সবচাইতে মারাত্মক আঘাত করেছেন ব্রুটাস। দেখ, আঘাতে ক্ষতবিক্ষত সিজারের নিথর দেহ পড়ে আছে। জনতা চিৎকার করে ওঠে: Most noble Caeser. We’ll revenge his death.মহান সিজারের মৃত্যুর প্রতিশোধ চাই। সবশেষে এন্টনি জনতার সামনে সিজারের উইল প্রকাশ করেন। তার ভাষণ শেষ হলে জনতা দাঙ্গায় লিপ্ত হয় এবং চক্রান্তকারীদের হত্যার জন্য তাদের বাড়িতে ছুটে যায়। জনমত চক্রান্তকারীদের বিপক্ষে ধাবিত হয় এবং মার্ক এন্টনি ক্ষমতা দখল করেন।  

দ্বিতীয় ট্রায়াম্ভিরেটের যাত্রা শুরু
সিজার হত্যাকা-ের পর মার্ক এন্টনি সিনেট অধিবেশন তলব করেন এবং একটি আপোস ফর্মূলা বের করতে সক্ষম হন। এতে অপরাধের জন্য আততায়ীদের শাস্তি না দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। হত্যাকা-ের পর সিনেট আততায়ীদের ক্ষমা মঞ্জুর করে একটি আইন পাস করে। সিজারের বন্ধু ও কো-কন্স্যাল মার্ক এন্টনি সাধারণ ক্ষমার এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। গণবিক্ষোভের মুখে ব্রুটাস ও  অন্য চক্রান্তকারীরা রোম থেকে পালিয়ে যান। খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সাল থেকে ৪২ সাল পর্যন্ত ব্রুটাস ক্রীটে বসবাস করেন। সাধারণ ক্ষমার প্রস্তাবে বলা হয়, চক্রান্তকারীদের তাদের কার্যকলাপের জন্য শাস্তি দেয়া যাবে না। সিজারের সব নিয়োগ বজায় রাখা হয়। মনে হয় এন্টনি সরকারে ঐক্য বজায় রাখার জন্য এ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে একই সঙ্গে তিনি চক্রান্তকারীদের উদ্দেশ্য খর্ব করেন। আততায়ীরা তাদের কৃতকর্মের ভবিষ্যৎ অনুমান করতে পারেননি। সিজারের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রোমান প্রজাতন্ত্রের অবসান ঘটে। সিজারের সমর্থক নিন্মশ্রেণি ক্ষুদ্ধ হয় এবং এন্টনি তাদের ক্ষোভকে পুঁজি করেন। সিজার তার প্রপৌত্র গিস অক্টাভিয়াসকে তার একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। পালিত পিতার মৃত্যু সংবাদ শুনে অক্টাভিয়াস এপোলোনিয়ায় তার পড়াশোনা বাদ দেন এবং ব্রুন্ডিসিয়ামের উদ্দেশে আড্রিয়াটিক সাগর পাড়ি দেন। তিনি গিজ সিজার অক্টাভিয়ানাস (মহান সিজারের পুত্র) বা অক্টাভিয়ান নাম গ্রহণ করেন এবং উত্তরাধিকার সূত্রে রোমের অধিকাংশ নাগরিকের আনুগত্য লাভ করেন। সিজারের মৃত্যুর সময় অক্টাভিয়ানের বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর। তিনি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দেন। অন্যদিকে নয়া গৃহযুদ্ধের প্রথম পর্বে এন্টনি ডিসিমাস ব্রুটাসকে মোকাবিলা করেন। অক্টাভিয়ান তার নড়বড়ে অবস্থান সংহত করেন।
  বয়সে তরুণ ও অনভিজ্ঞ হওয়ায় প্রাথমিকভাবে এন্টনি অক্টাভিয়ানকে একটি সত্যিকার রাজনৈতিক হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেননি। কিন্তু শিগগির অক্টাভিয়ান সিজারের বন্ধু ও সমর্থকদের সমর্থন ও প্রশংসা অর্জন করেন। ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াস গ্রীসে বিশাল সৈন্যবাহিনী সমাবেশ করছিলেন। তাদেরকে মোকাবিলা করার জন্য এন্টনির সৈন্য, অর্থ এবং সিজারের নাম ব্যবহারের বৈধতার প্রয়োজন ছিলো।...... 

নাইন ইলেভেন পরবর্তী আমেরিকা

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বে গণতন্ত্রের অভিভাবক এবং আইনের শাসনের প্রতিভূ বলে গণ্য করা হয়। একথা সর্বজনবিদিত যে, দেশটিতে ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতা স্বীকৃত এবং মানবিক মূল্যবোধ সমুন্নত। কিন্তু এসব কিছু আজ কেতাবী কথায় পরিণত হতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র আমূল বদলে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশটিতে মানবাধিকারের রেকর্ড তৃতীয় বিশ্বের কোনো কোনো দেশের চেয়ে নিকৃষ্ট। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, নিরাপত্তার জন্য মুসলমানদেরকে তাদের ধর্মীয় পরিচয় গোপন করতে হচ্ছে।
   গবেষক তারিক রামাদান তার ওয়েস্টার্ন মুসলিমস এন্ড দ্য ফিউচার অব ইসলাম শিরোনামে বইয়ের ২৩৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ÔAfter the events of 11 September 2001, the situation has deteriorated in the United States: the civil rights of numerous citizens or residents of Muslim faith has been clearly flouted. The same is true in some European countries where `security reasons’ legitimate all kinds of interventions irrespective of the law. These are the situations that tend to confirm in the mind of Muslims that they are not at home and that there is no willingness to consider them as such. (১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে: অসংখ্য নাগরিক অথবা মুসলমানের নাগরিক অধিকার স্পষ্টত লংঘন করা হয়েছে। ইউরোপের কয়েকটি দেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সেখানে  আইন কানুন নির্বিশেষে ‘নিরাপত্তার অজুহাতে’ সব ধরনের হস্তক্ষেপ বৈধ করা হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মুসলমানদের মনে একথা নিশ্চিত হয়েছে যে, তারা স্বচ্ছন্দে নেই এবং নিজেদেরকে তারা সুখি ভাবতে প্রস্তুত নয়।’  
নাইন ইলেভেন পরবর্তী আমেরিকায় মুসলমানদের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস বৃদ্ধি পায় এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকার সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলাার প্রচেষ্টা জোরদার করে এবং আগ্রাসী পররাষ্ট্র নীতি অনুুসরণ করে। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ বিরোধী লড়াই আমেরিকার একটি গুরুত্বপূূর্ণ নীতিতে রূপান্তরিত হয়। নাইন ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলায় আমেরিকার রাজনীতি ও বৈদেশিক নীতিতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। অভ্যন্তরীণভাবে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয়ে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ. বুশের পাশে দাঁড়ায় এবং প্যাট্রিয়ট অ্যাক্ট পাস করে এবং আফগানিস্তান যুদ্ধের প্রতি সমর্থন দেয়। সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইনের আওতায় মামলার সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। নতুন করে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয়।
    নাইন ইলিভেনের আগে যুক্তরাষ্ট্রে যেসব বিদেশি অথবা আমেরিকান নাগরিকদের নির্দোষ হিসেবে বিবেচনা করা হতো পরবর্তীতে তাদের বহু কার্যকলাপ সন্দেহের চোখে দেখা হয়। পোশাক ও গায়ের রং আরবদের মতো হলে সন্দেহের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। বিমানে নামাজ আদায়ের চেষ্টা করায় ৬ জন মুসলিম ইমামকে ফ্লাইট থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও পুলিশ আশপাশের লোকদের অস্বাভাবিক আচরণের প্রতি খেয়াল রাখতে এবং প্রকাশ্য স্থানে সেঁটে দেয়া নিদর্শন সম্পর্কে রিপোর্ট করতে আমেরিকানদের নির্দেশ দিয়েছে। মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ নাগরিকদের সতর্ক থাকতে, আশপাশের প্রতি নজরদারি করতে এবং সন্দেহজনক বস্তু ও আচরণ সম্পর্কে অবিলম্বে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নজরে আনার নির্দেশ দিয়েছে। নাইন ইলেভেনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আরব, মুসলিম, শিখ ও দক্ষিণ এশীয় আমেরিকান এবং এ ধরনের লোক হুমকি, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের শিকার হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার বিষয়ক এটর্নি জেনারেল টমাস ই. পেরেজ আরব, মুসলিম, শিখ ও দক্ষিণ এশীয় আমেরিকানদের মানবাধিকার লংঘন মোকাবিলায় সক্রিয়ভাবে কাজ করতে সিভিল রাইটস ডিভিশনের ন্যাশনাল অরিজিন ওয়ার্কিং গ্র“পকে নির্দেশ দিয়েছেন। কোনো কোনো আমেরিকান বিমানে ভ্রমণে ভীত হয়ে পড়ায় গাড়িতে চলাফেরা করে। ২০০৮ সালের এক রিপোর্টে বলা হয়, গাড়িতে চলাচল বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০০৮ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা এক হাজার ৫৯৫-এ পৌঁছে। ২০০১ সালের এগারোই সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা সম্প্রচার ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। কোনো কোনো চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু স্থগিত, বাতিল কিংবা সংশোধন করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে যেসব ছবি ও রূপকথার বিষয়বস্তু সন্ত্রাসবাদ, বিমান ছিনতাই, বোমা হামলা কিংবা বিপর্যয় ছিল সেসব ছবির পরিকল্পিত প্রদর্শন স্থগিত অথবা বাতিল করতে হয়। অসংখ্য ছবি নির্মাণ বাতিল ও সংশোধন করতে হয়। সংশোধনের সবচেয়ে সহজ উপায় ছিল ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ছবি মুছে দেয়া অথবা অস্পষ্ট করে দেয়া। সংশোধনের কারণ হিসেবে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং ভাবাবেগকে এড়িয়ে যাবার কথা উল্লেখ করা হয়। নাইন ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষিতে সব মিলিয়ে মোট ৪৫টি ছবি সংশোধন অথবা স্থগিত রাখা হয়।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১১ সাল নাগাদ সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইনে এক লাখ ১৯ হাজার ৪৪ জন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয় এবং ৬৬টি দেশে ৩৫ হাজার ১১৭ জনকে শাস্তি দেয়া হয়। নাইন ইলেভেনের আগে প্রতি বছর সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে মাত্র কয়েক শো লোককে শাস্তি দেয়া হতো। নাইন ইলিভেন সন্ত্রাসী হামলার জবাবে মার্কিন সরকার ২০০২ সালের ২৫ ডিসেম্বর হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ (ডিএইচএস) গঠন করে। এ বিভাগের কাছে সন্ত্রাসী হামলা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ড রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়। এক লাখ ৮৪ হাজার জনবলসম্পন্ন এ বিভাগ হলো যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মন্ত্রিসভার তৃতীয় বৃহত্তম বিভাগ। আমেরিকান পুরুষ, মহিলা, যুবক, বৃদ্ধ, শিক্ষিত ও অশিক্ষিতদের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ বিদ্যমান। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ সমান নয়। পুরুষদের মধ্যে মহিলাদের চেয়ে বিদ্বেষের মাত্রা বেশি। নাইন ইলিভেনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জননিরাপত্তার প্রতি ইসলামী সন্ত্রাসবাদের হুমকি তুলনামূলকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বিচ্ছিন্ন কিছু ব্যক্তি বোস্টন ম্যারাথনে বোমা হামলার মতো কয়েকটি বিচ্ছিন্ন সহিংসতা চালিয়েছে। তবে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা যতটা আশঙ্কা করেছিলেন, উগ্র হামলার আশঙ্কা তার চেয়ে অনেক কম। ১৯৯৫ সালের এপ্রিলে ওকলাহোমাসিটিতে বোমা হামলার পর মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মুসলমানরা প্রাথমিকভাবে বর্ণবাদী হামলার শিকার হন। কেফোর-টিভি চ্যানেলের খবরে বলা হয়েছিল, আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম সংগঠন ন্যাশন অব ইসলামের একজন সদস্য এ হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে। সারাদিন কেফোর-টিভি চ্যানেল এ খবর প্রচার করে। ঘটনার তিনদিন পর আরব আমেরিকান ইন্সটিটিউটের এক রিপোর্টে বলা হয়, তিনদিনের মধ্যে আরব আমেরিকান ও আমেরিকান মুসলমানদের বিরুদ্ধে দুই শতাধিক গুরুতর বর্ণবাদী হামলা চালানো হয়েছে। ২০০১ সালের এগারোই সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে বোমা হামলার পরও একই ধরনের বর্ণবাদী হামলা চালানো হয়। রেডিওতে সকল আরব আমেরিকানকে বন্দি শিবিরে আটক রাখারও প্রস্তাব করা হয়।
২০১২ সালের এপ্রিলে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের খবরে বলা হয় যে, জয়েন্ট ফোর্সেস স্টাফ কলেজ ইসলাম বিরোধী একটি কোর্স চালু করেছে। এ কোর্সে শিক্ষা দেয়া হয়েছিল যে, আমেরিকানরা যা কিছু সমর্থন করে মুসলমানরা সেগুলো ঘৃণা করে এবং মুসলমানরা কখনো আমেরিকানদের সঙ্গে সহাবস্থান করবে না। এতে বেসামরিক লোকের মৃত্যু বিবেচনা না করে নির্বিচারে পবিত্র মক্কা ও মদিনা ধ্বংস করে দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। একজন ছাত্র বিষয়বস্তু সম্পর্কে আপত্তি করলে এ কোর্স স্থগিত করা হয়। ২০১২ সালে আগস্টের গোড়ার দিকে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য জো ওয়ালেস এক টাউন হলে ভাষণে বলেন, কট্টরপন্থী মুসলমানরা প্রতি সপ্তাহে আমেরিকানদের হত্যা করার চেষ্টা করছে। তার উস্কানিমূলক ভাষণের পর ১২ আগস্ট তারাবীহ নামাজের সময় ইলিনয়ের লোম্বার্ডে একটি মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসিড হামলাসহ মুসলমানদের বিরুদ্ধে তার নিজ জেলাসহ বহু জায়গায় বেশ কয়েকটি হামলা চালানো হয়। ১৬ আগস্ট একটি মুসলিম গোরস্তানে ঘৃণামিশ্রিত শ্লোগান লিখে রাখা হয়। কয়েকটি মসজিদে গুলিবর্ষণ, এসিড, ডিম ও পশুর বর্র্জ্য নিক্ষেপ করা হয়। এসব হামলাকে বর্ণবাদী অপরাধ হিসেবে চি‎িহ্নত করা হয়।
নাইন ইলেভেনের প্রতিক্রিয়ায় শিল্পগুলো তাদের নীতিমালা পরিবর্তন করেছে, মার্কিন সরকার নতুন নতুন সংস্থা গঠন করেছে এবং আমেরিকার জনগণের হৃদয়-মন পাল্টে গেছে। ২০০১ সালের সন্ত্রাসী হামলায় যুক্তরাষ্ট্র ৬টি ক্ষেত্র স্থায়ীভাবে বদলে গেছে।

বিমান বন্দর
নাইন ইলেভেনের পরপর যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার ট্রান্সপোর্টেশন সিকিউরিটি এডমিনিস্ট্রেশন (টিসিএ) গঠন করে এবং ২০০১ সালের ১৯ নভেম্বর মার্কিন কংগ্রেস এভিয়েশন এন্ড ট্রান্সপোর্টেশন সিকিউরিটি অ্যাক্ট পাস করে। এ আইন কার্যকর হওয়ায় বিমানে আরোহণের আগে যাত্রীদের জুতা খুলতে হয় এবং তরল পদার্থ বহন নিষিদ্ধ করা হয়। নাইন ইলেভেনের আগে বিমান বন্দরে নামমাত্র যাত্রীদের লাগেজ তল্লাশি করা হতো। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল শিথিল। ফেডারেল এভিয়েশন এডমিনিস্ট্রেশন বিমান ছিনতাই প্রতিরোধে বেশকিছু নীতি গ্রহণ করায় নাইন ইলেভেনের পর বিমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পাল্টে যায়। বর্তমানে বিমানের ককপিট বন্ধ রাখা হয় এবং কেবলমাত্র পাইলট ককপিটের ভেতর থেকে বিমানের দরজা খুলতে পারেন।

সরকারের প্রতি আস্থা
নাইন ইলেভেনের পরবর্তী দিনগুলোতে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর মার্কিন নাগরিকদের বিরাট আস্থা ছিল। বস্তুত নিউইয়র্কে সন্ত্রাসী হামলার জবাবে সরকারের প্রতি আস্থা তুঙ্গে পৌঁছে। পিউ রিসার্চ গবেষণার উপাত্ত অনুযায়ী ১৯৭০-এর দশকের পর থেকে সরকারের প্রতি এমন আস্থা কখনো দেখা যায়নি। তবে ২০০৮ সালের মন্দা, ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধ, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে উদ্বেগ এবং ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক বিভাজনে এ আস্থায় চিড় ধরে। পিউ রিসার্চের মতে, ২০১৩ সাল নাগাদ সরকারের প্রতি আমেরিকানদের আস্থা ১৯ শতাংশ হ্রাস পায়। ২০১৪ সালে গ্যালপ জরিপে বলা হয়, সরকারের প্রতি মার্কিনীদের আস্থা ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে। ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাস এবং কংগ্রেসের অকার্যকারিতায় অবিশ্বাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আস্থাশীলদের সংখ্যা ক্রমেই কমছে। ২০১৫ সালের জুনে পরিচালিত গ্যালপ জরিপে বলা হয়, কংগ্রেসের প্রতি মার্কিনীদের আস্থা মাত্র ৮ শতাংশ।

পর্যটন
নাইন ইলেভেনের পরবর্তী তিন বছর যুক্তরাষ্ট্রে পর্যটন হ্রাস পায়। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক পর্যটন আবার রেকর্ড সংখ্যায় পৌঁছে। ২০০৭ সালে ৬ কোটি বিদেশি যুক্তরাষ্ট্র সফর করে। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ৭ কোটি ৪৮ লাখে পৌঁছে। বাইরের দেশগুলোতে আমেরিকানদের সফর দ্বিগুণ হয়। ২০১৪ সালে ৬ কোটি ৮২ লাখ আমেরিকান বিদেশ সফর করে। নিউইয়র্কে নাইন ইলেভেন পর্যটন হলো সন্ত্রাসী হামলার আরেকটি বিতর্কিত উপজাত। ম্যানহাটানে নাইন ইলেভেন স্মৃতিস্তম্ভ এবং জাদুঘরে লাখ লাখ পর্যটকের ভিড় হয়। লোয়ার ম্যানহাটানে গাইডেড ট্যুর হচ্ছে দৈনন্দিন ঘটনা। টুইন টাওয়ার্সের ধ্বংসাবশেষে নির্মিত ফ্রিডম টাওয়ার্স ও ওয়ান ওয়ার্ল্ড অবজারভেটরি হচ্ছে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র।

আমেরিকার মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন
নাইন ইলেভেনের পর আমেরিকা মনস্তাত্ত্বিকভাবে বদলে গেছে। বিদেশি হুমকি অথবা আমেরিকা পুরোপুরিভাবে নিরাপদ নয় এমন একটি ধারণা আমেরিকানদের মনস্তত্ত্বে প্রভাব ফেলেছে। প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব সত্ত্বেও কিছুটা ভীতি বিরাজ করছে। জীবন ও ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি গভীর অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। নাইন ইলেভেনের পর মার্কিন গোয়েন্দা তৎপরতার ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পায়। টেলিফোন ও ইমেইলে আড়িপাতা হচ্ছে। কিভাবে কোটি কোটি আমেরিকানের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে গেছে, সিআইয়ের স্বপক্ষত্যাগী বিশ্লেষক এডওয়ার্ড স্লোডেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। ২০১৩ সালে গোয়েন্দা সংস্থার পেছনে মার্কিন সরকারকে ৫২৬ কোটি ডলার ব্যয় করতে হয়। ১৬টি গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মচারির সংখ্যা এক লাখ ৭ হাজারের বেশি। অডিট রিপোর্টে দেখা গেছে, এককভাবে জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা বার্ষিক কমপক্ষে ৫৬ হাজার ইমেইল পরীক্ষা করেছে।

অভিবাসন
নাইন ইলেভেনের পর হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাক্ট, এনহ্যান্সড বর্ডার সিকিউরিটি অ্যাক্ট ও ভিসা এন্ট্রি রিফর্ম অ্যাক্ট চালু হওয়ায় আমেরিকার অভিবাসন নীতিতে মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। পর্যটক, ছাত্র ও বিদেশি নাগরিকদের জন্য ভিসা প্রাপ্তি কঠিন হয়ে উঠেছে। তাদের আঙ্গুলের ছাপ নেয়া হয় এবং বায়োমেট্রিক উপাত্ত গ্রহণ করা হয়। ২০০২ সালের ২৫ নভেম্বর গঠিত হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ এবং ২০০৩ সালে গঠিত ইমিগ্রেশন এন্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্টকে (আইসিই) যুক্তরাষ্ট্র এবং সে দেশের সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। নাইন ইলেভেনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকলেও মেক্সিকো ও ল্যাটিন আমেরিকার লোক এ নীতিমালায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা নজরদারি
নাইন ইলেভেনের দুমাসের মধ্যে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ. বুশ প্যাট্রিয়ট অ্যাক্টে স্বাক্ষর করেন। পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০১১ সালে এ আইন নবায়ন করেন। এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার মার্কিন নাগরিক, বিদেশি নাগরিক ও বিদেশি সরকারগুলোর ব্যাপারে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির (এনএসএ) ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। এনএসএ’র ক্ষমতা বৃদ্ধির আওতা প্রকাশ করা না হলেও এ সংস্থার এজেন্ট এডওয়ার্ড স্লোডেন ২০১৩ সালে অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা নজরদারির ব্যাপকতা ফাঁস করে দেন। এনএসএ বিনা পরোয়ানায় সেলফোন, ইমেইল ও ল্যান্ডফোনের তথ্যে নজরদারি করার ক্ষমতা লাভ করে।
২০১৩ সালে সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক ট্রায়াঙ্গল সেন্টার এবং হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের একটি রিপোর্টে দেখানো হয় যে, ২০১৩ সালে সন্দেহভাজন মুসলিম আমেরিকান সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসীদের সংখ্যা কমে এসেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুসলিম-আমেরিকানদের প্রতি মার্কিনীদের দৃষ্টিভঙ্গি আরো নেতিবাচক হয়ে উঠেছে। নাইন ইলেভেনের পর পিউ ফোরাম পরিচালিত ৮টি জরিপের অধিকাংশ জরিপে প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকানদের কাছে জানতে চাওয়া হয় মুসলিম আমেরিকানদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুকূল নাকি প্রতিকূল। উত্তরদাতাদের অধিকাংশ প্রতিকূল মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। ২০০৬ সালের আগে পাঁচটি জরিপে প্রতিকূল মনোভাব পোষণকারীদের সংখ্যা ছিল ২৬ অথবা তার চেয়ে কম এবং ২০০৬ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে পরিচালিত চারটি জরিপের মধ্যে একটিতে প্রতিকূল মনোভাব দেখা গেছে। এ সংখ্যা ইতিবাচক মনোভাব পোষণকারীদের চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণভাবে কম। আমেরিকার জনগোষ্ঠীর একটি ক্রমবর্ধমান অংশ মুসলিম-আমেরিকানদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশে আগ্রহী। জরিপে মুসলিম-আমেরিকানদের প্রতি নয়, সাধারণভাবে মুসলমানদের প্রতি এ নেতিবাচক প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র প্যাট্রিয়ট অ্যাক্টের আওতায় বেশকিছু সংগঠনকে সন্ত্রাসী হিসেবে চি‎িহ্নত করেছে। নিচে তার বিবরণ দেয়া হলো:

সংগঠনের নাম  দেশের নাম নিষিদ্ধ করার তারিখ
আবু নিদাল অর্গানাইজেশন ফিলিস্তিন ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
আবু সায়াফ গ্র“প ফিলিপাইন ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
ওম শিনরিকো  জাপান ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
বাস্ক ফাদারল্যান্ড এন্ড লিবার্টি স্পেন ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
জামা আল-ইসলামিয়া  মিসর ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
হরকাকুল মুজাহিদীন (হুম)  পাকিস্তান ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
হামাস প্রতিরোধ আন্দোলন  ফিলিস্তিন ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
হরকাতুল মুজাহিদীন  পাকিস্তান ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
হেযবুল্লাহ  লেবানন ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
কাচ এন্ড কাহানি চাই  ইসরাইল ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি  তুরস্ক  ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
এলটিটিই  শ্রীলঙ্কা  ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি  কলম্বিয়া  ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
প্যালেস্টাইন লিবারেশন ফ্রন্ট  ফিলিস্তিন  ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
ইসলামী জিহাদ গ্র“প  ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন  ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
পিএফএলপি জেনারেল কমান্ড  ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
রেভলিউশনারী আর্মড ফোর্সেস অব কলম্বিয়া  ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
রেভলিউশনারী পিপলস লিবারেশন পার্টি ফ্রন্ট  ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
শাইনিং পাথ  পেরু  ১৯৯৭ সালের ৮ অক্টোবর
আল-কায়েদা  ১৯৯৯ সালের ৮ অক্টোবর
উজবেক ইসলামী মুভমেন্ট উজবেকিস্তান  ২০০০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর
রিয়্যাল আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি  ২০০১ সালের ১৬ মে
জয়শ-ই-মোহাম্মদ  পাকিস্তান  ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর
লস্কর-ই-তাইয়্যেবা  পাকিস্তান  ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর
আল-আকসা মার্টায়ার্স ব্রিগেড  ২০০২ সালের ২৭ মার্চ
আসবাত আসবাত আন-আনসার  লেবানন  ২০০২ সালের ২৭ মার্চ
আল-কায়েদা ইন দ্য ইসলামিক মাগরেব  ২০০৪ সালের ১৩ জুলাই
ফিলিপাইন কমিউনিস্ট পার্টি  ২০০২ সালের ৯ আগস্ট
জামা আল-ইসলামিয়া  মিসর  ২০০২ সালের ২৩ অক্টোবর
লস্কর-ই-জাংভি  পাকিস্তান  ২০০৩ সালের ৩০ জানুয়ারি
আল-কায়েদা কার্দিস ব্যাটালিয়ন  ২০০৪ সালের ২২ মার্চ
কনটিনিউয়িটি আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি  ২০০৪ সালের ১৩ জুলাই লিবিয়ান ইসলামিক ফাইটিং গ্র“প  লিবিয়া  ২০০২ সালের ২৭ মার্চ
ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড লিভেন্ট  ২০০৪ সালের ১৭ডিসেম্বর
ইসলামিক জিহাদ ইউনিয়ন  ২০০৫ সালের ১৭ জুন
হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী (হুজি-বি)  ২০০৮ সালের ৫ মার্চ
আল-শাবাব  সোমালিয়া  ২০০৮ সালের ১৮ মার্চ
রেভলিউশনারী স্ট্রাগল   গ্রীস  ২০১০ সালের ১৮ মে
কাতায়েব হেযবুল্লাহ  ২০০৯ সালের ২ জুলাই
আল-কায়েদা ইন দ্য অ্যারাবিয়ান পেনিনস্যুলা  ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি
হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী (হুজি)  ২০১০ সালের ৬ আগস্ট
তেহরিক-ই-তালেবান  পাকিস্তান  ২০১০ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর
জুনদাল্লাহ  ইরান  ২০১০ সালের ৪ নভেম্বর
আর্মি অব ইসলাম  ফিলিস্তিন  ২০১১ সালের ২৩ মে
ইন্ডিয়ান মুজাহিদীন  ভারত  ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর
জামা আনসারুত তাওহীদ  ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর
আবদুল্লাহ আজাম ব্রিগেড  ২০১৩ সালের ৩০ মে
হাক্কানি নেটওয়ার্ক  আফগানিস্তান  ২০১২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর
আনসার আদ-দীন  মালি  ২০১৩ সালের ২২ মার্চ
বোকো হারাম  নাইজেরিয়া  ২০১৩ সালের ১৪ নভেম্বর
আনসারু   ২০১৩ সালের ১৪ নভেম্বর
আল-মুলাদামুন ব্রিগেড  আলজেরিয়া  ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর
আনসার আল-শরিয়াহ ইন  বেনগাজী  ২০১৪ সালের ১৩ জানুয়ারি আনসার আনসার আল-শরিয়াহ ইন দারনাহ লিবিয়া  ২০১৪ সালের ১৩ জানুয়ারি আনসার আল-শরিয়াহ ইন  তিউনিসিয়া  ২০১৪ সালের ১৩ জানুয়ারি
আনসার বায়েত আল-মাকদিস মিসর  ২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল
আল-নুসরা ফ্রন্ট  সিরিয়া  ২০১৪ সালের ১৫ মে
মুজাহিদীন শুরা কাউন্সিল  মিসর  ২০১৪ সালের ২০ আগস্ট

যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ ঘোষিত ৫৯টি জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে ১১টি হলো অমুসলিম এবং বাদবাকি ৪৮টি মুসলিম। অমুসলিম জঙ্গি সংগঠনগুলো হলো ওম শিনরিকো, বাস্ক ফাদারল্যান্ড এন্ড লিবার্টি (ইটিএ), কাচ এন্ড কাহানি চাই, লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম এলটিটিই, ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি, রেভলিউশনারী আর্মড ফোর্সেস অব কলম্বিয়া, শাইনিং পাথ, রিয়্যাল আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি, ফিলিপাইন কমিউনিস্ট পাটি, কনটিনিউয়িটি আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি ও রেভলিউশনারী স্ট্রাগল। এসব গ্র“পের বাইরে যেসব গ্র“পকে নিষিদ্ধ করা হয়নি সেগুলো হলো ক্লু ক্লাক্স ক্লান (কে কে কে), মেগডালিন ড্রাগ কার্টেল, আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি, এন্টি-ক্যাস্ট্রো গ্র“প, মর্মন চরমপন্থী গ্র“প, কমিউনিস্ট বিরোধী ভিয়েতনামী গ্র“প, জিউইশ ডিফেন্স লীগ, জিউইশ অ্যাকশন মুভমেন্ট, ইউনাইটেড জিউইশ আন্ডারগ্রাউন্ড, থান্ডার জায়ন, মে নাইনটিন কমিউনিস্ট অর্ডার, শিকানো লিবারেশন ফ্রন্ট, জিউইশ আর্মড রেজিট্যান্স, আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুভমেন্ট, গে লিবারেশন ফ্রন্ট, আরিয়ান নেশন, জিউইশ অ্যাকশন মুভমেন্ট, ন্যাশনাল ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব কিউবা, ফোর্থ রাইখ স্কিনহেড ইত্যাদি। এছাড়া সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক গবেষক আরেফ এম. আল-খাত্তার দ্য কভনেন্ট, দ্য সোর্ড এন্ড দ্য আর্ম অব দ্য লর্ড (সিএসএ), গর্ভপাত বিরোধী সংগঠন ডিফেন্সিভ অ্যাকশন এবং মন্টানা ফ্রিমেন, দ্য কভনেন্ট, দে সোর্ড এন্ড দ্য আর্মি অব গড (সিএসএ) এবং আরো কয়েকটি খ্রিস্টান মিলিশিয়া গ্র“পকে চরম ডানপন্থী সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করছেন। কিন্তু মার্কিন সরকার এসব শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী সন্ত্রাসী গ্র“পকে অজ্ঞাত কারণে নিষিদ্ধ করেনি।
 (লেখাটি ‘পাশ্চাত্যে ইসলামভীতি’ থেকে নেয়া। বইটি প্রকাশ করেছে ‘প্রচলন।’)

সিজার যেখানে বলেছিলেন এলাম, দেখলাম, জয় করলাম


খ্রিস্টপূর্ব ৪৭ সালের ২ আগস্ট সিজার আধুনিক তুরস্কের জেলা (তবষধ) নামে একটি জায়গায় মিথ্রিডেটসের পুত্র পোন্টাস রাজ্যের রাজা দ্বিতীয় ফারনাসেসকে পরাজিত করেন। নীল নদের যুদ্ধে ত্রয়োদশ টলেমির সৈন্যবাহিনী পরাজিত হলে তিনি মিসর ত্যাগ করেন এবং ফারনাসেসের সঙ্গে লড়াই করার জন্য সিরিয়া, সিলিসিয়া ও ক্যাপ্পাডোসিয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যান। ফারনাসেস নিকোপলিসের যুদ্ধে সিজারের লিগেট (সামরিক কমান্ডার) নিইউয়াস ডোমিটিয়াস কালভিনাসকে পরাজিত করেন। তারপর তিনি রোমান যুদ্ধবন্দি এবং এ অঞ্চলে রোমানদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা চালান। ফারনাসেস সিজারের এগিয়ে আসার সংবাদ পেয়ে সন্ধি প্রার্থনা করে দূত পাঠান। তৎক্ষণাৎ সিজার তার সন্ধির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। সিজারের সঙ্গে ছিল দুটি পদাতিক ইউনিট এবং একটি ক্ষুদ্র অশ্বারোহী ইউনিট। সব মিলিয়ে ১০ হাজার ৯ শো সৈন্য।  অন্যদিকে ফারনাসেসের সৈন্য ছিল আনুমানিক ২০ হাজার। তার বাহিনীতে ছিল উপজাতীয় যোদ্ধা, পদাতিক সৈন্য এবং পেশাদার গ্রীক পদাতিক ও অশ্বারোহী। এছাড়া তার কাছে ছিল কয়েকটি রথ। তুরস্কের তোকাত প্রদেশের জেলা নামে একটি পাহাড়ের শীর্ষে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পাহাড়ের শীর্ষে পোন্টিক সৈন্যবাহিনী অবস্থান গ্রহণ করে। সিজারের সৈন্যরা পার্শ¦বর্তী উচ্চভূমিতে নিজস্ব শিবিরে পরিখায় অবস্থান নিলে আকস্মিকভাবে পোন্টিক সৈন্যরা আক্রমণ চালায়। বিভ্রান্তির ভেতর ফারনাসেসের বাহিনী কিছুটা সাফল্য লাভ করে। কিন্তু শিগগির রোমান বাহিনী বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠে এবং দ্রুত আত্মরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করে। তারপর সিজার পাল্টা হামলা চালান এবং পোন্টিক সৈন্যবাহিনীকে পাহাড়ে পিছু হটিয়ে দেন। সেখানে তাদেরকে পুরোপরি বিধ্বস্ত করা হয়। এটা ছিল সিজারের সামরিক জীবনের একটি চূড়ান্ত মুহূর্ত। গ্রীক ঐতিহাসিক প্লুটাক ‘লাইফ অব সিজার’ শিরোনামে পুস্তকে লিখেন, ফারনাসেসের বিরুদ্ধে সিজারের পাঁচ দিনব্যাপী অভিযান এত ক্ষিপ্র ও পূর্ণাঙ্গ ছিল যে, তিনি রোমান ভাষায় রোমে তার বন্ধু সিনেটর আমানটিয়াসের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ভিনি, ভিডি ও ভিসি (আমি এলাম, আমি দেখলাম, আমি জয় করলাম।) চূড়ান্ত ও নিষ্পত্তিকারী বিজয় বুঝাতে সিজার চিঠিতে এ তিনটি শব্দ উল্লেখ করেন। রোমান ঐতিহাসিক সিউটনিয়াস ‘লাইভস অব দ্য টুয়েলভ সিজার্স’ শিরোনামে পুস্তকে লিখেন, পোন্টিক যুদ্ধকালে সিজার খোদিত আকারে গুরুত্বের সঙ্গে এ তিনটি শব্দ প্রদর্শন করেন। ফারনাসেস যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু সংঘর্ষে তার একজন সাবেক গভর্নর তাকে হত্যা করেন। 
   সিজারের ব্যবহৃত এ তিনটি শব্দ প্রায়ই সঙ্গীত, শিল্পকলা, সাহিত্য ও বিনোদনে ব্যবহার করা হয়। সিজারের সময় থেকে সামরিক বিজয়ে এ শব্দ গুচ্ছ ব্যবহার করা হচ্ছে। ১৬৮৩ সালে অটোমান সুলতান চতুর্থ মেহমেদের বিরুদ্ধে ভিয়েনা যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে পোল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জন সোবায়েস্কি এ ভাবাবেগপূর্ণ বাক্য ব্যবহার করেন। তবে তিনি লিখেছিলেন, ভেনিমাস, ভিডিমাস, ডিইউস ভিসিট (আমরা এলাম, আমরা দেখলাম এবং ঈশ্বর বিজয়ী হলেন।) ২০১১ সালে লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট কর্নেল মোয়াম্মার গাদ্দাফির মৃত্যুতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন অনুরূপ ভাষায় বলেছিলেন, আমরা এলাম, আমরা দেখলাম, তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। 
(লেখাটি ‘সর্বকালের সেরা সুন্দরী রানী ক্লিওপেট্রা’ শিরোনামে বই থেকে নেয়া। )

অখণ্ড ভারত কায়েমের অলীক স্বপ্ন



ঘুরে ফিরে প্রায়ই ভারতের মনের একান্ত কথা প্রকাশ পায়। দেশটি অখণ্ড ভারত কায়েম করতে চায়। তবে সরকারিভাবে কখনো এ ঘোষণা দেয়া হয়নি। মৌর্য সম্রাট অশোক-পূর্ব ভারত কায়েম তাদের লক্ষ্য। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি), রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস), বজরং, শিব সেনা এবং ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মতো মূলস্রোতের ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলো ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সমন্বয়ে একটি অখণ্ড হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের দাবি উত্থাপন করছে। অবিভক্ত ভারতের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে অখণ্ড ভারতের অংশ হিসাবে দেখানো হচ্ছে। অখণ্ড ভারতের ধারণা ভারতীয়দের কাছে অত্যন্ত আবেগময় এবং তাদের অস্তিত্বের অংশ। ভারত বিভক্তি তাদের কাছে একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। সুযোগ পেলেই কোনো কোনো ভারতীয় রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা কিংবা বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিগত পর্যায়ে মুখ খোলেন। খোলস ঝেড়ে ফেলে অখণ্ড ভারত কায়েমের খায়েশ প্রকাশ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ভারতের প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মারকান্দাইয়ে কাৎসু অখণ্ড ভারত কায়েমের আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন। 
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত এই বিচারপতি ২০১৩ সালের ৭ এপ্রিল হায়দরাবাদে ‘রিপোর্টিং টেরর: হাউ সেন্সেটিভ ইজ মিডিয়া?’ শিরোনামে এক সিম্পোজিয়ামে বলেছেন, পাকিস্তান একটি ভুয়া দেশ। একদিন বাংলাদেশসহ দেশটি ভারতের সঙ্গে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হবে। তিনি আরো বলেছেন, ভারতকে একটি শক্তিশালী শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হতে না দিতে ব্রিটিশরা ভারত বিভক্ত করেছিল। আগামী ১৫/২০ বছরের মধ্যে একটি শক্তিশালী আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারত পুনরায় একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে। 
    বিচারপতি মারকান্দাইয়ে কাৎসু আরো একবার অনুরূপ উক্তি করেছেন। ২০১৩ সালের ৪ মার্চ তামিলনাড়–র থিরুভানানথাপুরামে ইন্সটিটিউট অব পার্লামেন্ট এফেয়ার্স আয়োজিত দ্বিতীয় রাজিব গান্ধী স্মারক ভাষণে তিনি বলেছেন, ভবিষ্যতের কোনো একসময় ভারত ও পাকিস্তানের সমন্বয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র বাস্তবে রূপ নেবে। সে রাষ্ট্র ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং হিন্দু ও মুসলিম উগ্রপন্থাকে বরদাস্ত করবে না। ভারত কি? শিরোনামে এ ভাষণে তিনি আরো বলেন, ভারত বিভক্তি জাতি হিসাবে পাকিস্তানের ধ্বংসের বীজ বপন করেছে। তিনি পাকিস্তানকে স্টিভেন স্পিলবার্গ পরিচালিত বিশ্ববিখ্যাত শিহরণ সৃষ্টিকারী আমেরিকান ছবি জুরাসিক পার্কের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, দেশটির গঠনে ত্র“টি আছে। একটি ধর্মান্ধ রাষ্ট্র গঠন করা ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের লক্ষ্য। 
     বিচারপতি কাৎসু একা অখণ্ড ভারত কায়েমের কথা বলছেন তা নয়, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) সাধারণ সম্পাদক ড. মোহন ভগৎ-ও অনুরূপ উক্তি করেছেন। এ হিন্দুবাদী সংগঠনের মুখপত্র অর্গানাইজারে ‘জাতিকে রক্ষায় হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করো’ শিরোনামে তার এসব উস্কানিমূলক উক্তি প্রকাশিত হয়। উড়িষ্যার রাজধানী ভুবনেশ্বরে এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা গোলওয়ালকারের জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনের একটি অনুষ্ঠানে ভারতের বর্তমান দুর্দশায় দুঃখ প্রকাশ করে ড. মোহন ভগৎ বলেছেন, এখনো সত্যিকার স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি। আজ পরিস্থিতি এত বিপজ্জনক যে, আমরা বন্দে মাতরম গাইতে এবং গরুকে মা হিসাবে সম্মান জানাতে ইতস্তত করছি। কেবলমাত্র অখণ্ড ভারত এবং ‘সম্পূর্ণ সমাজ’ (ঐক্যবদ্ধ সমাজ) সত্যিকার স্বাধীনতা বয়ে আনতে পারে। তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় অখণ্ড ভারত গঠনের ধারণার ওপর জোর দিয়ে বলেছেন, ভারত বিভক্তি হিন্দু-মুসলিম সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। বরং তাতে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। একমাত্র অখণ্ড ভারত কায়েম করলে শান্তি আসতে পারে। 
মোহন ভগৎ আরো বলেছেন, সময় অতিক্রান্ত হওয়ায় প্রমাণিত হয়েছে যে, ভারত বিভক্তি কোনো সমস্যার সমাধান নয়। উপমহাদেশ বিভক্তি সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান করতে পারে বলে যারা বিশ্বাস করতেন ইতিহাস তাদের ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে। 
 কাশ্মীর সফরে গিয়ে মোহন ভগৎ একই কথা প্নুর্ব্যক্ত করে বলেছেন, চীন, রাশিয়া ও আমেরিকা জাতীয় স্বার্থে তাদের ভূখণ্ড সম্প্রসারণে কোনো রাখঢাক করছে না। তাই ভারতকেও একই নীতি গ্রহণ করতে হবে। অনুষ্ঠানে জম্মু ও কাশ্মীরের গভর্নর অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল এসকে সিনহা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুকরণে সার্ক দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব দিয়ে বলেছেন, এ কনফেডারেশনের নিউক্লিয়াস হবে ভারত। মোহন ভগৎ তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে এক টিভি সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান ভারতের অংশ এবং একদিন এ দু’টি দেশ ভারতে ফিরে আসবে।  
    শুধু বক্তৃতা বিবৃতি দেয়া হচ্ছে তা নয়, আনুষ্ঠানিকতাও পালন করা হচ্ছে। ২০১২ সালের ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় জিডি বিড়লা হল অব রেসিডেন্সে এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে প্রথমবার অখণ্ড ভারত দিবস পালন করা হয়। ভুপাল ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির ইলেক্ট্রোনিক্স এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. সদানন্দ সাপ্রি এ অনুষ্ঠানে ছাত্রদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। ভারতীয় ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ ও সুবক্তা ড. সাপ্রি তার ভাষণে অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার ধারণা ব্যাখ্যা করেন। তার ভাষণে মুগ্ধ হয়ে অসংখ্য ছাত্র অনুরূপ শত শত সেমিনারের আয়োজন করে দেশপ্রেমের এ সত্যিকার মন্ত্র সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার শপথ নেয়। 
  ২০১১ সালের ১৫ আগস্ট বাঙ্গালোরের বানাপ্পা পার্কে হিন্দুু জাগরণ বৈদিক নামে একটি সংগঠন অখণ্ড ভারত সংকল্প দিবস পালন করে। দিবসটি উপলক্ষে আয়োজিত এক সমাবেশে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ড. প্রবীণ ভাই তোগাড়িয়া তার মূল প্রবন্ধে অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন চিরজাগরুক রাখার উদাত্ত আহবান জানান। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বা আরএসএস-ও অখ- ভারত দিবস পালন করে।
আরএসএস তাদের প্রাত্যহিক সামরিক শাখাস বা সমাবেশে কর্মী ও সহানুভূতিশীলদের এ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার শিক্ষা দেয় যে, ভারতবর্ষের প্রাচীনতম জাতি ছিল সারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম জাতি এবং ভারতবর্ষের অধিবাসীরা ছিল সুখী, সমৃদ্ধ ও ধার্মিক। সংঘ পরিবারের নেতৃবৃন্দ কখনো একথা বলতে ভুলে যান না যে, হিন্দু জাতির অনৈক্য এবং এই পবিত্র ভূমিতে মুসলমান ও ব্রিটিশের আগ্রাসন থেকে ভারতের সকল দুঃখ দুর্দশার জন্ম হয়েছে। সংঘ পরিবারের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে কন্যাকুমারী এবং পশ্চিমে গান্ধার থেকে পূর্বদিকে ব্রহ্মদেশ পর্যন্ত অখণ্ড ভারত কায়েম করে অতীতের গৌরব ফিরিয়ে আনা। আরএসএস দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, হিন্দুত্ব কোনো ধর্ম নয়, হিন্দুত্ব হচ্ছে একটি জীবন ব্যবস্থা এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক ভারতীয় হিন্দু। 
অখণ্ড ভারত কায়েমের দূরভিসন্ধি থেকে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে। ভারতীয়দের মতে, অখণ্ড ভারত গঠনের আদর্শ ‘সাঙ্গাঠান’ (হিন্দু ঐক্য) এবং ‘শুদ্ধি’ (বিশুদ্ধিকরণ) ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত। আরএসএস নেতা এইচভি সেশারদি তার ‘দ্য ট্রাজিক স্টোরি অব পার্টিশন’ শিরোনামে গ্রন্থে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তিতে তার সীমাহীন আক্ষেপ প্রকাশ করে লিখেছেন:
 When the new viceroy Lord Mountbatten announced on 3rd June, 1947 the plan of transfer of power, it came as a stunning blow to the people. For that plan, approved by Nehru and Patel, had envisaged cutting up Bharat and creation of Pakistan. The great and trusted leaders of Congress had turned their back on the sacred oaths they had taken and the pledges they had administered to the people. What took place on August 15, 1947, was this gross betrayal of the nation’s faith, the betrayal of the dreams of countless fighters and martyrs who had plunged into the fire of freedom struggle with the vision of Akhanda Bharat in their hearts. 
অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ৩ জুন নয়া ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন যখন ক্হস্তান্তরের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন তখন তার এ ঘোষণা জাতির কাছে একটি মারাত্মক আঘাত হিসাবে বিবেচিত হয়। নেহরু ও প্যাটেল অনুমোদিত এ পরিকল্পনায় ভারতকে দ্বিখণ্ডিত এবং পাকিস্তান সৃষ্টির প্রস্তাব দেয়া হয়। কংগ্রেসের মহান ও বিশ্বস্ত নেতৃবৃন্দ তাদের পবিত্র ওয়াদা এবং জাতির কাছে প্রদত্ত প্রতিশ্র“তি থেকে পিঠটান দেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত ঘটনা ছিল জাতির বিশ্বাসের সঙ্গে একটি চরম বিশ্বাসঘাতকতা এবং হৃদয়ে অখণ্ড ভারত কায়েমের লক্ষ্য নিয়ে যেসব অগণিত যোদ্ধা ও শহীদ স্বাধীনতা সংগ্রামের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাদের স্বপ্নের সঙ্গে বেঈমানী। 
মূলস্রোতের ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দও সেশারদির অনুরূপ মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের অন্যতম স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বাঙালি ঋষি দার্শনিক স্যার অরবিন্দ ঘোষ তার জন্মদিনের বার্তায় বলেছিলেন:  
India today became free but she has not achieved Unity. The old communal devision into Hindu and Muslims seems now to have hardened into permanent political division of the country. It is hoped that this settled fact will not be accepted as  settled forever as anything more than a temporary expedient. For if it lasts, India may be seriously weakened, even crippled; civil strife may remain always possible, possible even a new invasion and foreign conquest. India’s internal development and prosperity may be impeded, her position among nations weakened, her destiny impaired or even fractured. This must not be. Partition  must go. By whatever means, in whatever way, the division must go. Unity must and will be achieved. For it is necessary for the greatness of the India’s future. (Sir Aurobinda, Complete works, Vol-26)  

অর্থাৎ আজ ভারত স্বাধীন হয়েছে তবে ঐক্য অর্জন করতে পারেনি। পুরনো হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক বিভক্তি এখন দেশের রাজনৈতিক বিভক্তিতে স্থায়ী রূপ নিয়েছে। আশা করা যাচ্ছে যে, এ মীমাংসিত সত্যকে একটি অস্থায়ী ব্যবস্থার চেয়ে চিরদিনের জন্য মীমাংসিত সত্য হিসাবে গৃহীত হবে না। কেননা এ বিভক্তি স্থায়ী হলে ভারত মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে। এমনকি পঙ্গু হয়ে যেতে পারে। গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা বরাবর বিরাজ করবে। এমনকি নয়া আগ্রাসন এবং বিদেশের পদানত হওয়ার সম্ভাবনা বিরাজ করবে। ভারতের অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে। বিশ্বের অন্যান্য জাতির মধ্যে ভারতের অবস্থান দুর্বল হবে। তার ভবিষ্যৎ বিপন্ন হবে। এমনকি ভেঙ্গে খানখান হয়ে যেতে পারে। অবশ্যই তা হতে দেয়া হবে না। বিভক্তি অবশ্যই থাকবে না। যে কোনো পন্থায় যে কোনো উপায়ে বিভক্তিকে অবশ্যই দূর করতে হবে। অবশ্যই ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও অর্জন করতে হবে। কেননা ঐক্য হলো ভবিষ্যৎ ভারতের বিশালত্বের জন্য অনিবার্য। (স্যার অরবিন্দ, পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থাবলী, ভলিউম-২৬)             
নব্বই দশকের শেষ প্রান্তে বিজেপি সরকারের আমলে সংঘ পরিবারের ২০ হাজার স্কুলে পাঠ্য ভূগোল বইয়ের মানচিত্রে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, তিব্বত, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটানকে অখণ্ড ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে দেখানো হয় এবং ভারত মহাসাগরকে হিন্দু মহাসাগর, আরব সাগরকে সিন্ধু সাগর এবং বঙ্গোপসাগরকে গঙ্গা সাগর হিসাবে আখ্যা দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, আফগানিস্তান, লাওস, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়াকেও অখণ্ড ভারতের অংশ হিসাবে কল্পনা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী হিন্দুদের সংগঠিত করে এ লক্ষ্যে পৌঁছার স্বপ্ন লালন করা হচ্ছে। খণ্ড বিখণ্ড ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করা হচ্ছে কট্টরপন্থী হিন্দু মহাসভার ঘোষিত নীতি। এ ব্যাপারে অর্পণা পাণ্ডে ‘এক্সপ্লে¬ইনিং পাকিস্তান ফরেন পলিসি’ শিরোনামে গ্রন্থের ৫৬ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লে¬খ করেছেন:

     The Hindu Maha Sabha had declared: India is one and indivisible and there can never be peace unless and until the separated parts are brought back into the Indian Union and made integral parts thereof. অর্থাৎ হিন্দু মহাসভা ঘোষণা করেছে: ভারত অভিন্ন ও অবিভাজ্য। বিচ্ছিন্ন অংশগুলো যতদিন ভারত ইউনিয়নে ফিরিয়ে এনে সেগুলোকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করা না হবে ততদিন শান্তি আসবে না।
      ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলে দুর্র্বল পশ্চিম পাকিস্তান দখল করে নেয়ার জন্য জঙ্গি হিন্দুরা দাবি তোলে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিষয়টিকে ভবিষ্যতে বিবেচনার জন্য রেখে দেন। এ সম্পর্কে লরেন্স জিরিং তার ‘পাকিস্তান অ্যাট দ্য ক্রসকারেন্ট অব হিস্ট্রি’ শিরোনামে গ্রন্থের ১১৩ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন:  Akhand Bharat, the hindu militant call for absorbing Pakistan within India, would have to wait on another day. অর্থাৎ হিন্দু জঙ্গিরা পাকিস্তানকে ভারতের অঙ্গীভূত করে নেয়ার দাবি জানায়। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী তাদের প্রস্তাব নাকচ করে দেয়ায় অখণ্ড ভারতকে আরেকটি সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।        
দ্বিজাতি তত্ত্ব হলো ভারতীয়দের চক্ষুশূল। ভারতের কংগ্রেস পার্টি কখনো দ্বিজাতি তত্ত্ব মেনে নেয়নি। ১৯৪৭ সালের ৫ জুন কংগ্রেস এক প্রস্তাবে বলেছিল:
   Geography and mountains and sea fashioned India as she is and no human agency can change that shape or come in the way of her final destiny. Once present passions had subsided the false doctrine of two nations will be discredited and discarded by all.
   র্থাৎ ভূখণ্ড, পর্বত ও সমুদ্র ভারতকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে এবং কোনো মানবীয় শক্তি ভারতের এ আকৃতি পরিবর্তন অথবা তার চূড়ান্ত ভাগ্যের পথে অন্তরায় হতে পারে না। বর্তমানে বিরাজিত মিথ্যা দ্বিজাতি তত্ত্বের আবেগ একদিন থিতিয়ে আসবে এবং সবাই তা পরিত্যাগ করবে।
‘ইন্ডিয়া’ কখনো ভারতের নাম ছিল না। ইংরেজ আমলে দেশটির এ নাম দেয়া হয়। ইন্ডাস বা সিন্ধু থেকে ইন্ডিয়া শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। আবার সিন্ধু থেকে হিন্দু শব্দটি এসেছে। ভারতীয়রা ইন্ডিয়া নামের কোনো দেশকে স্বীকার করে না। তাদেরকে এ নামটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অন্যদিকে মহাভারত, শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা ও বিষ্ণু পুরাণের মতো হিন্দু ধর্মগ্রন্থ থেকে উৎসারিত হওয়ায় ভারত বা ভারতবর্ষ নামটির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আত্মার।
কংগ্রেস ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করায় দ্বিজাতি তত্ত্বের ঘোর বিরোধিতা করেছে। মুসলিম লীগের মতো সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করলে তারাও দ্বিজাতি তত্ত্বের সমর্থক হতো। দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধিতা করার অর্থ ভারতে একটি মাত্র জাতি ছাড়া আর কোনো জাতির বসবাসের অধিকার নেই। এ ধরনের মানসিকতা সংখ্যালঘুদের অধিকার ও অস্তিত্ব অস্বীকার করার শামিল।             
ভারতীয় উপমহাদেশ পৃথিবীর এক-পঞ্চমাংশ জনগোষ্ঠীর বসতিস্থল হলেও এখানে একটি মাত্র জাতির শ্রেষ্ঠত্ব লক্ষ্যণীয়। বিশুদ্ধ আর্য জাতির দাবিদার এ জাতি ভারতের তিন-চতুর্থাংশের ওপর নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে এবং উপমহাদেশের বাদবাকি অংশে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েমের অশুভ চক্রান্তে নিয়োজিত রয়েছে। ভারতীয়দের কাছে ভারত হলো মায়ের মতো অবিভাজ্য। ব্রিটিশদের বিদায় করার স্বার্থে তারা সাময়িকভাবে ভারত বিভক্তি মেনে নিয়েছিল। পরবর্তী কার্যকলাপে ধরা পড়ে যে, অখণ্ড ভারত কায়েম করাই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এ লক্ষ্য পূরণে এক জাতিতে বিশ্বাসী এ শক্তি ধীরে ধীরে উপমহাদেশকে গ্রাস করছে। তাদের আগ্রাসী থাবায় দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাগুলোর ভবিষ্যৎ বিপন্ন। সুদূর অতীতকাল থেকে তারা অখণ্ড ভারত কায়েমের স্বপ্ন লালন করছে। বিগত ও চলতি শতাব্দীর ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, দক্ষিণ এশিয়ার অশান্তির মূলে রয়েছে ভারত। দেশটি প্রতিটি প্রতিবেশি বিশেষ করে ক্ষুদ্র প্রতিবেশিদের জন্য বরাবরই নিজেকে একটি হুমকি হিসাবে প্রমাণ করেছে। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বা সার্কের কার্যক্রমের প্রতি লক্ষ্য করলেও বুঝা যায় যে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতই সব। অন্য দেশগুলো তার ইচ্ছার কাছে জিম্মি। দক্ষিণ এশিয়াকে পদানত করতে ভারত প্রাচীন চানক্য নীতি অনুসরণ করছে। ভৌগোলিক সম্প্রসারণ হচ্ছে চানক্য নীতির মূল লক্ষ্য। উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ রাজশক্তির বিদায় লগ্ন থেকে অখণ্ড ভারত কায়েমে ভারতের ভৌগোলিক সম্প্রসারণ শুরু হয়। 
১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই প্রণীত ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তান ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেলেও মুক্তি পায়নি বহু দেশীয় রাজ্য। ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্টে বলা হয়েছিল, দেশীয় রাজ্যগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো হয়তো ভারত নয়তো পাকিস্তানে যোগদান করতে পারবে। অথবা স্বাধীন থাকতে পারবে। কিন্তু এ আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে গোয়ালিয়রে কংগ্রেসের এক সম্মেলনে নেহরু ঘোষণা করেন যে, যেসব দেশীয় রাজ্য ভারতের গণপরিষদে যোগদানে অস্বীকৃতি জানাবে তাদেরকে বৈরি হিসাবে ঘোষণা করা হবে। তিনি এ ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারত একটির পর একটি দেশীয় রাজ্য গ্রাস করে। এসব দেশীয় রাজ্য গ্রাসে ভারত যখন যেমন তখন তেমন নীতি অনুসরণ করে নিজের সীমানা সম্প্রসারিত করেছে।  
১৯৪৭ সালের ২৫ জুলাই ব্রিটিশ ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন দেশীয় রাজাদের এক সমাবেশে বলেন, তাদের রাজ্যগুলো টেকনিক্যালি ও আইনগতভাবে স্বাধীন হলেও কিছু ভৌগোলিক বাধ্যবাধকতাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তিনি রাজাদের নিজস্ব শাসন বজায় রাখতে ভারত ও পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সরকারের সঙ্গে স্থিতাবস্থা চুক্তি স্বাক্ষরের পরামর্শ দেন। মাউন্টব্যাটেন ‘ভৌগোলিক বাধ্যবাধকতা’ বলতে আসলে ভারত সংলগ্ন দেশীয় রাজ্যগুলোকে ভারতে যোগদানের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি দেশীয় রাজ্যগুলোকে ভারতে যোগদানে ব্যক্তিগতভাবে কাজ করছিলেন। অধিকাংশ রাজ্য আকার ও আয়তনে ছোট হলেও হায়দরাবাদ, জুনাগড়, জম্মু ও কাশ্মীর, যোধপুর, জয়পুর, গোয়ালিয়র, ইন্দোর, বরোদা, ত্রিবাঙ্কুর ও মহীশূর ছিল ভৌগোলিক, সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার উপযোগী।   
শক্তিপ্রয়োগ করা না হলে কাশ্মীর, হায়দরাবাদ ও জুনাগড় নিশ্চিতভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হতো। নয়তো নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পারতো। কিন্তু ভারতীয় নেতৃবৃন্দ ১৯৪৭ সালে চরম উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তে এসব রাজ্য সফর করে পরিস্থিতিতে ঘৃতাহুতি দেন। অন্যদিকে পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ গোলযোগপূর্ণ রাজ্যগুলো সফর করা থেকে বিরত থেকে নিজেদের জন্য চরম সর্বনাশ ডেকে আনেন। 
দুর্বল দেশীয় রাজ্যগুলো গ্রাসে ভারত কোনো ন্যায়নীতির তোয়াক্কা করেনি। শক্তি ও কূটকৌশল ছিল দেশটির বিজয়ের একমাত্র চাবিকাঠি। ভারত শুধু অন্যায়ভাবে দেশীয় রাজ্য গ্রাস করেছে তাই নয়, প্রতিবেশি দেশগুলোতেও দেশটি বারবার হস্তক্ষেপ করেছে এবং স্বাধীনতাকামী জনগণের মুক্তির আকাঙ্খাকে গলাটিপে হত্যা করেছে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু কখনো ছোট ও ক্ষুদ্র দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন না। তিনি মনে করতেন, ক্ষুদ্র দেশগুলোর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে এবং একদিন এসব ক্ষুদ্র দেশ ভারতে যোগদান করবে। ‘দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’র ৫৫০ নম্বর পৃষ্ঠায় নেহরু লিখেছেন:    Small nation state is doomed. It may survive as a cultural and autonomous area but not as an independent political unit. অর্র্থাৎ ক্ষুদ্র জাতি রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। এটি সাংস্কৃতিক ও স্বায়ত্তশাসিত এলাকা হিসাবে টিকে থাকতে পারে তবে স্বাধীন রাজনৈতিক ইউনিট হিসাবে নয়।   
ধর্মনিরপেক্ষতার জয়গান গাইতে গিয়ে প্রায়ই বলতে শোনা যায় যে, পাকিস্তান একটি সাম্প্রদায়িক ও ব্রিটিশদের সৃষ্ট কৃত্রিম রাষ্ট্র। কিন্তু বাস্তবতা সাক্ষ্য দিচ্ছে, পাকিস্তান নয় বরং ভারতই সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। পাকিস্তান সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হলে সে দেশে গুজরাট স্টাইলের দাঙ্গা হওয়ার কথা ছিল হাজারে হাজার। কিন্তু শিয়া-সুন্নিতে রক্তাক্ত সংঘর্ষ হলেও আজ পর্যন্ত দেশটিতে হিন্দু বিরোধী একটি দাঙ্গাও হয়নি। ব্রিটিশরা পক্ষপাতিত্ব করে থাকলে করেছে ভারতের প্রতি। পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হলে জম্মু ও কাশ্মীর, পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গে ভারতের ত্রিরঙ্গা পতাকা উড়তো না। 
সাম্প্রদায়িকতা কখনো সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু এ অঞ্চলে একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করা হয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, বিরোধিতাকারীদের অধিকাংশই হয়তো চরম সাম্প্রদায়িক নয়তো মুসলিম বিদ্বেষী। তাদের লক্ষ্য মুসলমানদের সম্প্রদায়গত স্বাতন্ত্র্য মুছে ফেলা। উপমহাদেশে মুসলমানদের আলাদা সম্প্রদায়গত পরিচিতি না থাকলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ভৌগোলিক সীমানা থাকে না। যতদিন এ দু’টি ভূখণ্ডের মানুষ নিজেদেরকে ভারতীয়দের থেকে পৃথক হিসাবে ভাববে ততদিন তাদের ভৌগোলিক সীমানা অক্ষুণœ থাকবে। নয়তো অখণ্ড ভারতে আত্মবিসর্জন হবে চূড়ান্ত পরিণতি।
 (লেখাটি 'ভারতের রাজনৈতিক ও সামরিক হস্তক্ষেপ’ থেকে নেয়া । বইটি প্রকাশ করেছে আফসার ব্রাদার্স।)

ফাইটার জেটের হেলমেট

বর্তমান সময়ে আধুনিক এবং নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফিচার হচ্ছে জেট ফাইটারের ককপিটে বসা এর পাইলটের হেল...